সনগ্রে :লিজা টাট্ল
অনুবাদ :ইন্দ্রাণী তুলি
শাওয়ারটা বন্ধ
করে আয়নার সামনে এসে দাঁড়াল গ্লেন্ডা। চুলগুলো চুড়ো করে মাথার ওপরে একটা শাওয়ার
ক্যাপ দিয়ে ঢেকে রাখা... যার ফলে তার নিরাভরণ মরাল গ্রীবা আরও আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে।
বড় বড় চোখদুটোতে লেগেছে গাঢ় রঙের ছোঁয়া।
'তোমাকে স্প্যানিশ মনে হচ্ছে...' স্টিভ বলে উঠল। গ্লেন্ডার কানে যেন কোনও কথাই
গেল না, একইভাবে তাকিয়ে
রইল সে নিজের প্রতিবিম্বের প্রতি। তার অতি সুন্দর মুখচ্ছবি সম্পূর্ণ ভাবলেশহীন।
স্টিভ তার হাত
দুটো গ্লেন্ডার ভেজা কাঁধে রেখে, তার গ্রীবা- চুম্বন করার জন্য নত হলো।
'আমাকে মুছে ফেল তো ভাল করে!' গ্লেন্ডা বলল।
তোয়ালেটা টেনে
নিয়ে স্টিভ আলতো ছোঁয়ায়, অতিযত্নে মুছিয়ে দিতে থাকল গ্লেন্ডার শরীর।
হাতদুটো মাথার
ওপরে তুলে, শাওয়ার ক্যাপটা খুলে নিল গ্লেন্ডা। মেহগনি রঙা একরাশ চুল ছড়িয়ে পড়ল তার কোমর
ছাপিয়ে। মোহগ্রস্ত স্টিভের শ্বাসরুদ্ধ হয়ে এল।
গ্লেন্ডা জিজ্ঞেস
করল 'হোটেল- চেক আউটের
সময় কী?'
'১২ টা।'
এতক্ষণে, স্টিভের মুখোমুখি
হলো গ্লেন্ডা।
'আর তারপরে... একঘন্টা পরে তো আমরা হোটেল ছাড়ব, তারপরে?'
'যেমন বলবে তেমন... আমরা আগে মধ্যাহ্ন ভোজনে যাব, যেখানে যেতে চাইবে তুমি। এয়ারপোর্টে পৌঁছবার
আগে সময় থাকবে... কিছু কেনাকাটাও করতে পার।'
'যেমন বলবে তেমন... ' স্টিভের স্বর নকল করে ভেঙিয়ে উঠল গ্লেন্ডা।
রাগে তমতমে মুখ তার, ঘাড় বেঁকিয়ে স্টিভের হাতের তোয়ালেটা এক ঝটকায়
কেড়ে নিয়ে নিজের শরীরে জড়িয়ে নিল সে।
'কীভাবে বলছ এ'কথা?'
'গ্লেন্ডা...'
'আজকের কথা বলছি না আমি। আমি বলছি, এরপরে কী হবে... আজকের পরে? যখন আমি ফিরে
আসব... তখনও কী আমরা এইরকমই ভাব দেখাব, যেন কিছুই হয়নি। আমরা কী একদম ভুলেই যাব আমাদের
কথা? আমাকে নিয়ে
চুটিয়ে আনন্দ করছ তুমি, আবার বাড়ি গিয়ে আমার মা'র জন্য জাল পাতছ।
আর... এই স্পেন- এ যাওয়ার ব্যাপারটা কী? তুমি আর সামাল দিতে পারছ না তো? মা'কে আর ধোঁকায়
রাখতে পারবে না তুমি, মা কিন্তু সন্দেহ করতে শুরু করেছেন।'
'ওহ সুইট হার্ট! আমি তোমাকে ভালবাসি। তোমাকে হারাতে চাই না... কিন্তু তোমার মা'কেও ভালবাসি আমি।
তুমি বিশ্বাস কর... আমার পক্ষেও যে এটা কত কষ্টের...'
'হ্যাঁ, তা তো বটেই... কষ্টের! কিন্তু আমাকে একটা কথা বল তো, পরিষ্কার করে... আমাকেই কেন হারাতে হবে সবকিছু? তুমি তো আমার মা'কে বিয়ে করে সুখে
থাকবে, তারপরে... আমার
কী হবে?'
'ওহ ডার্লিং, প্লিজ বোঝার চেষ্টা কর...'
'সে তো ঠিক, আমাকেই বুঝতে হবে সবকিছু! আর, তুমি কী ভাবছ, মা কিছু আন্দাজ করছেন না? কতদিন... আর
কতদিন ধরে চালিয়ে যেতে পারবে এই দুই নৌকোয় পা দিয়ে চলা...?'
'একটু সময় দাও আমাকে... প্লিজ।' অনেকখানি শক্তি সঞ্চয় করে বলে উঠল স্টিভ।
স্টিভের অভিজ্ঞ কণ্ঠস্বর বলে চলল 'কিছুটা সময় পেলে আমি... আশাকরি আমরা তিনজনে বসে, একটা কিছু উপায়
নিশ্চয়ই বার করে নিতে পারব। তবে পরিস্থিতি খুবই জটিল, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। তুমি... তুমি ছোট, অনভিজ্ঞ। তোমার
মা আর আমি, আমাদের মত মানুষেরা পুরনো নৈতিকতার শিকলে আবদ্ধ... তুমি সেই মুক্ত সম্পর্কটাকে
মেনে নিতে পার যা আমাদের পক্ষে কঠিন। আর... সময় গেলে, তোমার মা আর আমি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হলে, আমরা তিনজনে...' শব্দের অভাবে
হঠাৎ চুপ করে যায় স্টিভ। তার অভিব্যক্তি যেন তাকেই ব্যাঙ্গ করতে থাকে।
'আমি কিন্তু তোমাকে কখনও মিথ্যে বলিনি...' আত্মপক্ষ সমর্থনের চেষ্টা করে স্টিভ। হঠাৎ
উত্তেজিত হয়ে পড়ে সে। বুঝতে পারে, বোকার মতই একতরফা বকে চলেছে সে।
'তুমি তো সবই জানতে, আমার রক্ষিতা হওয়ার আগে... তুমি জানতে, কী আমার পরিচয়...'
'রক্ষিতা!' অতীব ঘৃণার সঙ্গে শব্দটা উচ্চারণ করে গ্লেন্ডা। তার চোখে বিদ্যুৎ চমকের মত এক
কঠিন বিতৃষ্ণার দৃষ্টি ঝলকে ওঠে। গ্লেন্ডাকে শান্ত করার চেষ্টায়, কিছু বলার আগেই
অধৈর্য ভাবে মাথা ঝাঁকিয়ে তার বিরক্তি প্রকাশ করে গ্লেন্ডা। তার শরীর থেকে খসে পড়ে
তোয়ালেটাও।
'আচ্ছা...' গ্লেন্ডা বলে ওঠে। 'আমাদের হাতে এখনও এক ঘণ্টা আছে।'
একটা হাই চাপার
প্রাণপণ চেষ্টা করছিল ডেবী, ঠিক তখনই টেক অফের জন্য দৌড় শুরু করল প্লেনটা।
এয়ারপ্রেশারে একটু স্থিরতা আসতেই সে গ্লেন্ডার দিকে ফিরে প্রশংসনীয় চোখে বলল, 'তোর সৎ- বাবাকে
দারুণ দেখতে।'
'স্টিভ আমার স্টেপ ফাদার নয়।'
'তা সে যাই হোক, ওরা তো বিয়ে করছে শিগগিরই... তাই না?'
'হ্যাঁ, জুলাই মাসে। আমি স্পেন থেকে ফিরে আসার পরেই।'
প্লেনের জানলায়
মাথাটা ঠেকিয়ে, চোখ বন্ধ করল গ্লেন্ডা।
'ওনার চেহারা দেখে বয়েস বোঝা যায় না...'
কাঁধ ঝাঁকিয়ে
গ্লেন্ডা বলল, 'আমার মা'র থেকে বছর কয়েকের ছোট।'
ডেবী বুঝতে পারল, কথা চালিয়ে
যাওয়ার কোনও ইচ্ছেই নেই গ্লেন্ডার। তাই সে ঝুঁকে পড়ল তার কোলের ওপরে রাখা, "দ্য সান অলসো
রাইজেস' বইটার ওপরে।
ছোটবেলা থেকেই
একসঙ্গে পড়াশোনা- খেলাধুলো করে বেড়ে উঠেছে ডেবী আর গ্লেন্ডা। কলেজ যাওয়া পর্যন্ত
সে বন্ধুত্ব অক্ষুণ্ণ রয়েই গেছে, কিন্তু ভাসা ভাসা। এই বন্ধুত্বে দুজনের কারোরই
যদিও কোনও চাহিদা নেই অপরের কাছে।
দাঁত দিয়ে নিজের
ঠোঁট চেপে ধ'রে, গ্লেন্ডা হঠাৎ
বলে উঠল 'দেখ, ও আমাকে কী
দিয়েছে... স্টিভের কথা বলছি।'
ডেবীর দিকে নিজের
হাতটা বাড়িয়ে দিল সে। গ্লেন্ডার আঙুলে খুব সাধারণ একটা রূপোর আংটি... যার প্রান্ত
দুটো মোড়ানো, ইংরিজির 'এস' এর আকারে।
গ্লেন্ডার মনে
পড়ল সেই ছোট্ট, অন্ধকারাচ্ছন্ন হস্তশিল্পের দোকানটার কথা... তার জন্যই তৈরি করানো হয়েছিল এই
আংটিটা। যতক্ষণ কাজ চলছিল, সে স্টিভের হাতটা ধরে রেখেছিল গভীর আবেগে
কিন্তু তার মুখে সেই অভিব্যক্তি প্রকাশ পায়নি।
ডেবী ঘাড় নেড়ে
বলল 'বাহ সুন্দর!
স্টিভই তো তোর এই বেড়াতে যাওয়ার সব খরচ যোগাচ্ছে... তাই না?'
'হ্যাঁ, ও জোর করেছিল... আর আমার মা! স্টিভের কথা তো তার কাছে বেদবাক্য... যা বলবে, তাতেই রাজি।'
'আমার তো ভাবতেই ভালো লাগছে গ্লেন্ডা, তোর মা আবার বিয়ে
করছেন... আর স্টিভকে তো তুইও খুব পছন্দ করিস...'
'হ্যাঁ, আমরা খুব ভালো বন্ধু।'
সেভিলার হোটেলের
ঘরটা ছোট। লাল ইটের মেঝের কামরাটাতে দুটো খাট পাতা। ঘরের লাগোয়া একটা ঝুল বারান্দা, যেখানে দাঁড়ালে
"লা গিরালডা"র ম্যুরিশ টাওয়ার দেখতে পাওয়া যায়।
সন্ধে হয়ে এসেছে, ব্যালকনিতে
দাঁড়িয়ে গেল্ডা। সারাদিনের গরম ভাব কেটে গিয়ে ঠাণ্ডা হয়ে আসছে হাওয়া। সূর্যাস্তের
লালিমায় ঘেরা টাওয়ারের আশেপাশে উড়ে বেড়ানো সোয়ালোদের সৌন্দর্য উপভোগ করছে সে।
অগুন্তি গাড়ীর ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন, গ্রে মাদ্রিদ শহরের প্রবল কোলাহল ছেড়ে সেভিলায়
এসে তার কেন যেন মনে হচ্ছে বাড়ী ফিরেছে সে, অনেকদিন পরে... গ্লেন্ডা তো কিছুতেই বুঝে উঠতে
পারছে না আঁকাবাঁকা রাস্তায় ঘুরে ঘুরে কীভাবে সে এসে পৌঁছল এই ছোট্ট হোটেলটায়...
কিন্তু একটুও বিস্মিত হয়নি সে যদিও তার মনে হয়েছে, ক্রমাগত কে যেন তাকে পথনির্দেশ দিয়ে, নিয়ে এসেছে
এখানে। হোটেলটা খুব ভালো লেগেছে গ্লেন্ডার।
পিঠে ভারী
ব্যাগের বোঝা নিয়ে, এত হাঁটাহাঁটি করে হাঁফিয়ে পড়েছে, স্থূলকায়া ডেবী।
কেমন এক অস্বস্তি
ঘিরে ধরেছে গ্লেন্ডাকেও। মাথাটা ঝিম ঝিম করছে, পেট গুড় গুড় করছে, উত্তেজনার বশে। এই উত্তেজনার তুলনা হয় একমাত্র
স্টিভের সঙ্গে একা সময় কাটানোর সুযোগের... যেমন যেমন ঘন হয়ে আসছে রাতের অন্ধকার, আসন্ন কোনও এক
অজানা আশংকায় ভরে উঠছে তার মন। বাস্তব থেকে যেন সরে সরে যাচ্ছে সে, স্বপ্নের জগতে।
নিজের গালে হাত
বুলিয়ে গ্লেন্ডা বুঝতে পারল, তার শরীরের উত্তাপ বেড়েছে। মুখ ফিরিয়ে, ঘরের দিকে তাকাল
সে... ডেবী পোশাক বদলে একটা স্কার্ট পরছে।
'প্রায় আটটা বাজে রে,' ডেবী বলে উঠল। আমার মনে হয়, এবারে রাতের
খাওয়া সেরে ফেলা উচিৎ।'
ডিনার টেবিলে বসে
গ্লেন্ডার মনে হলো, সে যেন ভাসছে, ভেসে ভেসে যাচ্ছে কোথাও... ডেবী যখন অভিযোগ
জানাল যে গ্লেন্ডা মনোযোগই দিচ্ছে না তার কথায়... গ্লেন্ডা তখন সব দোষ চাপিয়ে দিল
তার ওয়াইনের ঘাড়ে। শরীর- মন কোনও কিছুই আর নিজের বশে নেই গ্লেন্ডার...
পারিপার্শ্বিক যেন ক্রমশই এক উজ্জ্বল, কল্পনার জগতে বদলে যাচ্ছে... কোনও এক শব্দহীন-
অন্ধকারাচ্ছন্ন ঘরে বসে দেখতে থাকা পর্দায় ফুটে ওঠা ছবির মতো।
হোটেলরুমে ফিরেই
গ্লেন্ডা শুয়ে পড়ল, ডেবী ব্যস্ত হয়ে পড়ল তার বাবা- মা'কে চিঠি লিখতে।
'তোর ঘুমোতে অসুবিধে হবে নাতো গ্লেন্ডা, লাইট জ্বললে?'
'না রে...' কথা দুটো অনেক কষ্টে বেরলো তার মুখ দিয়ে। ঘরটা যেন বন বন করে ঘুরতে ঘুরতে চলে
যাচ্ছে অনেক দূরে, সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছে তাকেও... অন্য কোনও এক
দুনিয়ায়। ঘুমিয়ে পড়ল গ্লেন্ডা।
প্রবল এক পিপাসা
বোধে ঘুম ভেঙে গেল গ্লেন্ডার, গলাটা শুকিয়ে গেছে। পাশের বিছানায় ঘুমে অচেতন
ডেবি, পড়ে আছে এক
স্তূপের মত। জানলার খোলা খড়খড়ি দিয়ে চাঁদের আলো ঢুকে, টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে আছে সারা ঘরে। গ্লেন্ডা
অনুভব করল, তার শরীর ভীষণ গরম, জ্বর এসেছে... ঘরের অন্য সব বস্তুর মতো তার
নিজের শরীরটাও যেন তার ধরা ছোঁয়ার বাইরে।
গ্লেন্ডার হঠাৎ
নজর গেল বারান্দার দিকে। সেখানে কারুর
উপস্থিতি আকর্ষিত করল তাকে। চাঁদের আলো'কে ঢেকে রেখেছে এক ছায়াময় অবয়ব... সে একটু
নড়াচড়া করতেই আবার আলোকিত হয়ে উঠল ঘরটা। গ্লেন্ডার শরীরটা কেঁপে উঠল কোনও এক অজানা
আশংকায় কিন্তু তার মন যেন সবকিছু পর্যবেক্ষণ করতে করতে টাইপ করে চলল তার প্রত্যক্ষ
চেতনাতে।
বারান্দায়
দাঁড়ানো শরীরটা একটা আলখাল্লায় ঢাকা। তার মাথায় এক অদ্ভুত দর্শন টুপি। তার পায়ের
চকচকে বুটজুতো চাঁদের আলোতে চকচক করছে। আর... কোমরের একপাশে কী ওটা, তলোয়ার? কে রে বাবা!
"ডন জুয়ান"? তার কানে ফিসফিস করে কে যেন বলে উঠল, তাহলে সে বোধহয়
এসেছে এই অ্যান্ডালুসিয়ান সুন্দরীকে প্রলুব্ধ করতে।
সেই অবয়বটির ঘরে
ঢোকার কোনও প্রবণতা দেখা না যেতে, কিছুটা সাহস সঞ্চয় করে গ্লেন্ডা তার কনুইদুটোর
ওপরে ভর দিয়ে, আধশোয়া অবস্থায় লক্ষ্য করতে থাকল তার কার্যকলাপ। সে'ও হয়তো'বা খেয়াল করে থাকবে, গ্লেন্ডার এই নড়াচড়া কিন্তু তার ব্যবহারে কোনও
প্রকাশ দেখা গেল না।
উঠে বসল গ্লেন্ডা, বিছানার পাশে পা
দুটোকে ঝুলিয়ে দিয়ে। ঘরটা যেন কাঁপতে কাঁপতে তার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে হঠাৎ এক
নির্লিপ্ত- কাল্পনিক জগতে স্থিতিশীল হয়ে গেল।
ব্যালকনির ছায়াময়
শরীরটা যেন গ্লেন্ডার জন্যেই অপেক্ষা করছিল। কিছু বলার জন্য, ঠোঁটোদুটো ফাঁক
করল গ্লেন্ডা... মজার শেষ হোক এবারে। বাইরের লোকটারও জানা দরকার যে গ্লেন্ডা জেগেই
আছে, আর সে এসে
দাঁড়িয়েছে এক ভুল জানলায়... কিন্তু তার গলা দিয়ে কোনও আওয়াজ বেরলই না, কথা বলার কাজটা
যেন দুর্লঙ্ঘ্য পাহাড়ের মতো তার পথ রোধ করে দাঁড়াল।
ক্লোকধারী, অজ্ঞাত সেই
মূর্তি তার হাতদুটো বাড়িয়ে এগিয়ে এল গ্লেন্ডার দিকে। ছায়ার মুখোশে ঢাকা তার মুখ...
সে অপেক্ষায় রইল তার প্রসারিত বাহুযুগলে, গ্লেন্ডার ধরা দেবার আশায়।
গ্লেন্ডা নিজেই
দেখল নিজেকে...
সাদা গাউনে ঢাকা
শরীর, এলোমেলো লম্বা
চুলের রাশি ছড়ানো বুকে পিঠে... ঘুমভাঙা- নিষ্পাপ মুখের এক স্বপ্নচারী, ধীর পায়ে এগিয়ে
গিয়ে ধরা দিল সেই অপেক্ষারত বাহুযুগলে। মুখটা উঁচু করে তাকাল গ্লেন্ডা সেই
অজ্ঞাতপরিচয় চরিত্রের দিকে... লোকটা তার মুখ সরিয়ে নিতেই,
চাঁদের আলোর ধারায় তার
মুখমণ্ডলের প্রতিটা রেখা স্পষ্ট হলো... না, এ তো "ডন জুয়ান" নয়, কল্পকাহিনীর আরও
এক অতি পরিচিত চেহারা... সেই প্রাণহীন মুখ, তীরের ফলার মত কোণা করা ভ্রূযুগল, অল্প ফাঁক হয়ে
থাকা টকটকে লাল অধরোষ্ঠের মাঝে তীক্ষ্ণ- চকচকে দাঁতের সারি। গ্লেন্ডার মাথাটা ঝুলে
পড়ল সেই অবয়বের প্রসারিত হাতের ওপরে, চোখদুটো বন্ধ হয়ে গেল... শুধু উদ্ভাসিত হলো তার
দীর্ঘ, শুভ্র পবিত্র
গ্রীবা, যেন বলিদানের
জন্য সমর্পিত।
'গ্লেন্ডা...'
চোখ খুলল
গ্লেন্ডা। সারা শরীর গুলিয়ে উঠল... হোঁচট খেয়ে পড়ে যেতে যেতে বারান্দার রেলিং ধরে
সামলে নিল সে, নিজেকে।
'গ্লেন... তুই ঠিক আছিস তো?"
মাথা ঘুরিয়ে
গ্লেন্ডা দেখল ডেবী দাঁড়িয়ে... নাহ আর কেউ নেই, শুধুই ডেবী... গোলাপী নাইলনের রাত্রিবাসে ঢাকা, সেই আনন্দময়
চেহারা।
'আমার খুব গরম লাগছিল রে...' কথাগুলো জড়িয়ে যাওয়ায়,
গলাটা পরিষ্কার করে আবার
বলল গ্লেন্ডা। তার শরীর পুড়ে যাচ্ছে জ্বরে, ভয়ংকর তেষ্টায় ছাতি ফেটে যাচ্ছে।
'কোনও ড্রিংক আছে... গলা ভেজাবার জন্য?'
'ট্রেন- এ কেনা, এক লিটার কোকের বোতলে রয়েছে কিছুটা... তুই
সত্যি বলছিস গ্লেন, তুই একদম ঠিক আছিস?'
'আরে হ্যাঁ রে... শুধু ভীষণ পিপাসা।' অনেকখানি কোক ঢক ঢক করে পান করে ফেলল সে কিন্তু
গলা জ্বলতে থাকল তার... হঠাৎ জোর বিষম খেয়ে খেয়ে আবার অসুস্থ বোধ করল গ্লেন্ডা।
'শুভরাত্রি...' আর কোনও কথা না বলে বিছানায় চলে গেল সে।
এক দীর্ঘশ্বাস
ছেড়ে, ডেবী আবার
ঘুমোবার জন্য আশ্রয় নিল বিছানায়।
'তোকে একা ছাড়তে খুব খারাপ লাগছে আমার।' অদ্ভুত ভাবে বার বার দরজার দিকে তাকাতে তাকাতে
বলল ডেবী। 'এখন কেমন লাগছে রে?'
নিথর ভাবে
বিছানায় পড়ে থাকা গ্লেন্ডা বলল, 'আরে কিছু হয়নি আমার... তবে কিছু করতেই ভালো
লাগছে না। আর, আমি এতটাও অসুস্থ নই যে দরকার পড়লে, তিন- চারটে সিঁড়ি নেমে ম্যানেজার বা তার বউকে
ডাকতে পারব না। তুই যা তো... সাইটসিয়িং-এ, তোর প্রিয় ক্যানাডিয়ানের সঙ্গে। আমার জন্য
ভাবিস না। একটু ঘুমোলেই ঠিক হয়ে যাব আমি।'
তুই ঠিক বলছিস...
অন্য কোনও বড় হোটেলে যেতে চাস না? সেখানে আমরা নিজেদের জন্য একটা বাথরুম পাব...'
'একদমই না, আমার এখানে খুব ভালো লাগছে।'
'আচ্ছা, তোকে কিছু এনে দেব কি?''
'কোনও পানীয় নিয়ে আসিস প্লিজ... এক বোতল ওয়াইন! আমার এত তেষ্টা...'
'আমার মনে হয় না ওয়াইন... যাক গে, তোর জন্য আমি নিয়ে আসব কিছু।'
ডেবী বেরিয়েই গেল, অনেক ইতস্তত করে।
তার অদ্ভুত
মানসিক অবস্থার থেকে বাস্তবে ফিরে আসার চেষ্টায় কঠোর হলো গ্লেন্ডা। নিরুদ্বেগ
হওয়ার প্রয়াসে ব্যর্থ হয়ে সে ফিরে গেল আবার, তার আগের অবস্থায়... জ্ঞান হারাল সে।
মেয়েটা পৌঁছেছে
এক মৃত্যু- গলিতে। সরু পাথুরে এক রাস্তার দু'ধারে চোখ ধাঁধানো সাদা বাড়ীর সারি। রাস্তার নাম
লেখা, নীল রঙে... একটা
বাড়ীর গায়ে লাগানো ফলকে "মুয়ের্ত"- মৃত্যু। কেঁদে চলেছে মেয়েটা। সারা
শরীর ধুলো মাটিতে মাখামাখি। অশ্রুজল আর মাটির মিশ্রণে তার কচি মুখ এক অদ্ভুত রূপ
ধরেছে। ভরদুপুরে, একা একাই ঘুরে মরছে সে, সেই মরণ- পথে। সে জানে,
বেশিক্ষণ একা থাকতে হবে
না তাকে, কিন্তু... কেউ কি
খুঁজে পাবে তাকে? বুঝতে পারছে মেয়েটা, এই বিপদসংকুল স্থান ছেড়ে এক্ষুনি চলে যাওয়া
উচিৎ তার, কোনও নিরাপদ
যায়গায়... কিন্তু একা একা সেই গ্রাম্য পথে ঘুরে বেড়াবার সাহসও জুগিয়ে উঠতে পারছে
না সে। আবার, এই নির্জন স্থানও নির্বিঘ্ন নয় তার জন্য। কী যে এক দ্বন্দ্বে পড়েছে সে, এই ধাঁধাঁ থেকে
বেরোবার পথ নেই।
একবার যদি তারা
পায় তাকে... প্রতিশোধ তো নেবেই, নিশ্চিত। তার কিন্তু কোনও দোষই নেই, কীভাবে যেন জড়িয়ে
পড়েছে সে এই জালে। মেয়েটার মনে পড়ে, গত একমাস ধরে এই মৃত্যুপুরীতে ঘটতে থাকা
ঘটনাগুলো... এক দুর্বোধ্য রোগে আক্রান্ত ও মৃত নগরবাসীর দেহ পড়ে থাকত
রাস্তাঘাটে... রক্তশূন্য, প্রত্যেকেরই গলায় অদ্ভুত ক্ষতচিহ্ন। মানুষ ভয়ে
কাঁটা হয়ে অপেক্ষায় থাকত, কখন আসে তার পালা...
মেয়েটার মা
সারারাত বাইরে কাটিয়ে, ভোরবেলা ঘরে ফিরত হাক্লান্ত- পাণ্ডুর
অবস্থায়... তারপরেই ঢলে পড়ত সে, গভীর ঘুমে। মা'র বালিশের পাশে দাঁড়িয়ে, অতিযত্নে যখন সে
মা'র চুলের জটগুলোকে
ছাড়াবার চেষ্টা করত... মা'র ঘুমন্ত মুখটা বারে বারে ভরে উঠত হাসিতে আর
তার তার কানে বাজতে থাকত শহরের মানুষের কানাঘুষা... অযাচিত ভাবেই যা তার কানে
পৌঁছত।
মা নাকি শয়তানের সঙ্গে মিলিত হয় প্রতি রাতে...
মা আর তার প্রেমিক বাদুড়ের রূপ ধরে চড়াও হয় অসাবধানী পথিকের ওপরে... রক্তপান করে, তাদের ভুলিয়ে
ভালিয়ে বিপথে নিয়ে গিয়ে। মা'কে খুব ভালবাসে মেয়েটা,
কিন্তু এবারে ভয় পেতেও
শুরু করেছে সে তার মা'কে। রাতে বিছানায় শুয়ে,
আধখোলা চোখে রোজ সে
সাক্ষী থাকত তার মা'র বেরিয়ে যাওয়ার। তারপরে... একদিন আর ফিরে এল
না মা, এই বিশাল
পৃথিবীতে একেবারেই একা হয়ে পড়ল মেয়েটা।
ক্ষুধার্ত-
পিপাসার্ত, একা মেয়েটা ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত... জানে
না সে, বুঝতেও পারে না
কোথায় যাবে। কোনও বাড়ির দরজায় কড়া নেড়ে খাবার বা জল চাইতেও ভয় পায় সে। আজকাল সন্ধে
হলেই সব বাড়ির জানলা- দরজা বন্ধ হয়ে যায়। মানুষ একা বেরোয় না পথে। সূর্য ডোবার পরে
পরেই, দু'তিন জন মিলিত
ভাবে চটপট ঢুকে পড়ে, যে যার বাড়িতে। একসময়,
এই পথ লণ্ঠনের আলোয়
আলোকিত থাকত যেমন গরমকালে মাঠ ঘাট ভরে থাকে জোনাকির আলোতে। আজ এক অজানা শত্রুর ভয়ে
ভীত, সন্ত্রস্ত সকলে।
চাঁদ উঠেছে আকাশে, আলোকিত চরাচর।
ধীরে ধীরে, হাঁটতে হাঁটতে মেয়েটা পৌঁছল পার্শ্ববর্তী চৌরাস্তায়, যেখানে একটা পরিত্যক্ত ফোয়ারা রয়েছে, কবেই শুকিয়ে গেছে
যদিও... জল টল কিছুই নেই। ফোয়ারাটার গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়াল মেয়েটা, কাঁদতে কাঁদতে
ক্লান্ত আর হতাশ হয়ে পড়েছে সে।
হঠাৎ তার
ষষ্ঠেন্দ্রিয় তাকে এক বিপদ- সংকেত পাঠাল। আকাশের দিকে মুখ তুলে চাইল মেয়েটা। চাঁদ
প্রায় মধ্য গগনে... চকের পাশে বাজারের চারটে প্রবেশদ্বারের একটায়, এক ছায়া ছায়া
অবয়ব দেখতে পেল সে, তার সারা শরীর ঢাকা এক আলখাল্লাতে। চোখদুটো
চকচক করে উঠল লোকটার, তার জুতোজোড়ার মতই... অদ্ভুত এক টুপির নীচে যেন
একজোড়া আলো জ্বলছে। নিশ্চল হয়ে বসে রইল মেয়েটা, এই ভরসায়... আধো আলো, আধো অন্ধকারে লোকটা হয়তো লক্ষ্য করেনি তাকে।
'এইযে মেয়ে...' হঠাৎ ডাকল লোকটা। তার গলার আওয়াজ কেমন যেন
বাতাসে ওড়া শুকনো পাতার মত। থর থর করে কেঁপে উঠল মেয়েটার ছোট্ট শরীর।
'ওগো সোনা মেয়ে...' এক পা এগিয়ে এল লোকটা তার দিকে। দৌড়োতে শুরু
করল মেয়েটা প্রাণপণে, একবারও পেছনে না তাকিয়ে। গলার মধ্যে কান্নাটাকে
আটকে রেখে, রাস্তার পর রাস্তা পেরিয়ে যেতে থাকল সে। ভীষণ এক ভয় তাকে চেপে ধরল, দৌড়োতে দৌড়োতে
আবার হয়তো পৌঁছে যাবে সে, সেই চকে আর আবারও
দেখা হয়ে যাবে সেই মানুষটার সঙ্গে। ভুল করে ঢুকে পড়ল সে এক অন্ধগলিতে... যাওয়ার
রাস্তা না পেয়ে, ঘুরে দাঁড়াতেই সামনে দেখতে পেল লোকটাকে... রাস্তা জুড়ে দাঁড়িয়ে।
ভয়ে কাঠ হয়ে
দাঁড়িয়ে রইল সে। মানুষটা এগিয়ে আসতে থাকল তার দিকে। তার গলার শুকনো পাতার নূপুর
বেজেই চলল। হাতদুটো উঁচু করে তুলল লোকটা, তার আলখাল্লাটাও ওপরে উঠে গেল, যেন তা হাতের
সঙ্গেই জোড়া... বিশাল একজোড়া ডানার রূপ ধরল সেই আলখাল্লা সমেত হাত। ঠোঁটজোড়া ফাঁক
করল লোকটা, তার শ্বাস প্রশ্বাসের শব্দও কানে আসছে। আস্তে আস্তে প্রকাশিত হল তার চকচকে
দাঁতের সারি... জ্ঞান হারিয়ে ফেলল মেয়েটা।
ঘুম ভাঙল
গ্লেন্ডার, ঠকঠক করে কাঁপছে তার সারা শরীর।
'ওহ সোনা, আমি কি তোর ঘুম ভাঙিয়ে দিলাম?' অনুতপ্ত স্বরে বলল ডেবী।
'তুই কেমন আছিস রে? তোকে প্রেতাত্মার মত নিষ্প্রাণ আর বিবর্ণ
দেখাচ্ছে। চল, আমরা লাঞ্চ করি। তুই...'
মাথা নাড়ল
গ্লেন্ডা, 'না রে, আমার একদম ভালো লাগছে না।' একটা ঘড়ঘড়ে আওয়াজের সঙ্গে কথাগুলো বেরলো তার
গলা থেকে।
'আমার খুব তেষ্টা পাচ্ছে ডেবী, তুই কি কোনও ড্রিংক এনেছিস আমার জন্য?'
'ওহ, ভীষণ সরি রে, আমি একদম ভুলেই
গেছিলাম। কী আনব বল, আমি এক্ষুনি এনে দিচ্ছি... কী খাবি বলত!'
মাথা নেড়ে না বলল
গ্লেন্ডা। 'না, খাব না... শুধুই
কোনও পানীয়।'
মাথাটা ঘুরছে
গ্লেন্ডার, কিছুতে মনঃসংযোগই করতে পারছে না সে।
বিছানার কাছে এসে
ডেবী হাত বাড়াল বন্ধুর দিকে। ধড়ফড় করে সরে গেল গ্লেন্ডা।
'গ্লেন... আমি শুধু দেখতে চাই তোর জ্বর আছে কি না... হুমমম, তোর গা তো বেশ
গরম। হে ভগবান, তোর গলায় কী হয়েছে রে?'
গ্লেন তার তার
গলায় একজোড়া ছোট ক্ষততে আঙুল বোলাতে বোলাতে মাথা নাড়ল।
'তোকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে মনে হচ্ছে...'
'আরে, না রে... আমি...
আমি অ্যাসপিরিন খেয়ে নেব। আমি কোথাও যাব না, ঠিক হয়ে যাব রে...'
ডেবীর মুখটা তার
চোখের সামনে থেকে ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে যেতে থাকল... কাঁপতে কাঁপতে, যেন জলের নীচ
থেকে দেখছে সে ডেবীকে। গ্লেন্ডার জ্ঞানহীন শরীরটা পড়ে রইল বিছানাতে।
চোখ মেলল মেয়েটা।
চাঁদ প্রায় অস্তমিত, ভোরের আলো ফুটি ফুটি করছে। হাত- পা ছড়িয়ে
পড়েছিল সে, সরু এক পাথুরে রাস্তার ধারে... অতিকষ্টে, অনেক যন্ত্রনায় উঠে দাঁড়াল মেয়েটা। আকণ্ঠ
তৃষ্ণায় আঠালো হয়ে আছে মুখের ভেতরটা... জিভটা যেন অনেকটা বড় হয়ে গেছে। চুলগুলোকে
মুখের ওপর থেকে সরিয়ে, মাথার পেছনে ঠেলে দিতে গিয়ে চটচটে কী যেন একটা
লাগল তার হাতে... হাত সরিয়ে গলায় কিছু খোঁজার চেষ্টা করল সে। তার মনে পড়ে গেল
শহরের কিছু লোকের মৃত্যুর কথা, গলায় ক্ষত নিয়ে।
আঁকাবাঁকা রাস্তা
দিয়ে চলতে চলতে সে এসে দাঁড়াল "লা গিরাল্ডা" র সামনে। উদিত সূর্যের
লালিমাতে মাখামাখি সেই টাওয়ারে ঝুলে রয়েছে... একটা শুকনো,
গোটানো পাতার মতো... একটা
মাত্র বাদুড়।
সেভিলার দুই
মদ্যপ নগরবাসী একবার জুটে পড়েছিল, ম্যুরিশ টাওয়ারের বাসিন্দা, শয়তানরূপী
বাদুড়টাকে তার বিশ্রামস্থানেই বন্ধ ক'রে রাখতে যাতে সে আর সেভিলার রাস্তায় ওড়াউড়ি
করতে না পারে... এই কারণে, ম্যুরিশ টাওয়ারের দরজাটা পাকাপাকি ভাবে বন্ধ ক'রে দেওয়ার কথা
ভেবেছিল তারা। কিন্তু যখন তাদের বলা হলো যে দরজা বন্ধ ক'রে টাওয়ারের ভেতরে শয়তানকে বন্ধ রাখার পরিকল্পনাটা ভালো হলেও কার্যকরী হবে না
কারণ শয়তান বাদুড়ের ঢোকা আর বেরনোর জন্য দরজার দরকারই পড়বে না, ম্যুরিশ টাওয়ারে
যখন এতগুলো জানলা আছে... অতএব সেই কাজ থেকে বিরত হয়েছিল তারা।
ম্যুরিশ টাওয়ারের
অসম্পূর্ণ পাঁচিলের দেওয়ালটা ধরে হাঁচড় পাঁচড় করে ওপরে উঠল মেয়েটা, আঁচড় লেগে রক্তের
দানা ফুটে উঠল তার পায়ে। একবার ফিরে দেখল সে তার পায়ের দিকে তারপরে মুখ তুলে তাকাল
বেল টাওয়ারের দিকে, যেখানে অনেক ঘণ্টা বাঁধা থাকলেও, তারা আর বাজে না।
কীভাবে ওখানে পৌছবে সে... হঠাৎ তার নজর গেল, বড় একটা কাঠের দরজার দিকে... পৌঁছে দেখল, দরজাটা পরিষ্কার, মাকড়শার জাল
নেই... ব্যবহৃত হয় বলে মনে হচ্ছে। দরজার কাছে গিয়ে ধাক্কা দিতেই খুলে গেল তার
পাল্লা দুটো। সিঁড়ি নেমে গেছে নীচের অন্ধকারের দিকে। দরজাটা বন্ধ করল না সে...
একটু হলেও আলো পাওয়া যাবে।
সরু সিঁড়ি বেয়ে
নীচে নামতে লাগল মেয়েটা… সিঁড়ির যেন কোনও শেষ নেই... অন্তহীন পাতাল গমনে ব্যথা হয়ে
গেল তার পা দুটো।
সিঁড়ির শেষে এক
বিশাল চত্বরে পৌঁছল সে ... চত্বরটা যে কত বড় তার হদিশ পেল না মেয়েটা। দেওয়ালের
গায়ে লাগানো ধোঁয়াযুক্ত মশালের আলোতে স্বল্পালোকিত জায়গাটা। একটা কফিন দেখতে পেয়ে, সেদিকেই এগিয়ে
গেল মেয়েটা। কফিনের ঢাকাটা খোলা। ভেতরে শুয়ে সেই আলখাল্লা আর বুটে সজ্জিত
মানুষটা... অদ্ভুত টুপিটা স্থানচ্যুত। এই লোকটার থেকেই পালাতে চেষ্টা করেছিল সে...
এইই সেই শয়তান, যাকে ভালবাসত, না কী যার গোলামী করত তার মা!
মেয়াটার মাথার
দিকে নিঃশব্দে উড়ে এল এক ভয়ংকর বাদুড়। ভয়ে মাথা ঝুঁকিয়ে নিল মেয়েটা কিন্তু বাদুড়ের
পাখার এক ঝাপটা এসে লাগল তার গালে। ফেরৎ যাওয়ার চেষ্টা করল সে সিঁড়িটার দিকে। বাদুড়টা কিন্তু পিছু নিল না
তার। অনেক কষ্টে, আবার অতগুলো সিঁড়ি চড়ে বাইরে বেরিয়ে এল মেয়েটা, এখনো দিনের আলো আছে। একটু বিশ্রাম নিতেই তার মস্তিষ্ক কাজ করতে
শুরু করল। ভাবতে লাগল সে, আজ ঠিক কী কী ঘটনা ঘটল। মনে এল সেই শয়তানের
নিষ্ঠুর চেহারা, টকটকে লাল ঠোঁট... জিভ বুলিয়ে ভেজাবার চেষ্টা করল সে তার নিজের শুকনো
ঠোঁট জোড়া।
একটা বেশ বড়
ছুঁচলো কাঠের টুকরোকে অস্ত্রের রূপ দিতে গিয়ে, হাতদুটো বেশ জখম হলো মেয়েটার, ছোট ছোট ক্ষত আর
কাঠের কুচিতে ভরে গেল তার হাত। বাইরে স্তুপাকারে পড়েছিল, ভাঙা পাথর আর ইটের টুকরো। একটা বেশ বড়সড় ইটের
টুকরো বেছে নেওয়ার সময়ে প্রাতঃভ্রমণে বেরনো, কালো পোষাক পরিহিত এক মহিলা তার দিকে বেশ
সন্দেহের চোখে চেয়ে রইলেন কিন্তু কিছু বললেন না।
সিঁড়ি ভেঙে আবার
সেই চত্বরে পৌঁছতেই, বাদুড়টা আবারও ধেয়ে এল আর তার মাথার চারপাশে
ঘুরতেই রইল। মাথা ঝুঁকিয়ে মেয়েটা বাঁচাতে চেষ্টা করল তার চোখদুটোকে কিন্তু ভয়ে
পিছপা হলো না বা তার কাজ বন্ধও করল না সে। ইটের টুকরোটা নীচে নামিয়ে রেখে, তার ক্ষত- বিক্ষত, নোংরা দু'হাতে শক্ত করে
ধরল কাঠের টুকরোটাকে আর সর্বশক্তি প্রয়োগ ক'রে তা ঢুকিয়ে দিল কফিনে আবদ্ধ শয়তানটার
হৃদয়স্থলে। মুখের ওপরে ছড়িয়ে পড়া চুলের রাশি আর বাদুড়ে ঠোকরানো রক্তের ধারায়
সাময়িক অন্ধত্ব এনে দিলেও নিজের কাজে সফল হলো সে। আহত শয়তানের চাপা গোঙানি তাকে
বেশ সন্তুষ্ট করল। বাদুড়টা আবারও উড়ে এল তার দিকে কিন্তু পরাজয়ের এক কর্কশ ধ্বনির
সাথে বিদায় নিল, ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে। ইটের টুকরোটা তুলে নিয়ে সে প্রাণপণে আঘাত করে চলল
শয়তানের বুকে পুঁতে থাকা কাঠের অস্ত্রটার ওপরে...
রক্তজল করা এক
বীভৎস চিৎকারে কেঁপে উঠল সারা চত্বর। চারপাশের দেওয়ালগুলোও যেন সামিল হলো সেই
কান্নায়। রক্তের এক ফোয়ারা এসে ভিজিয়ে দিল মেয়েটার শরীর। সে কিন্তু আঘাতের পরে
আঘাত করেই চলল সেই কাঠের টুকরোটাতে, সেটা পুরোপুরি
ভাবে তার শিকারের হৃদয়ে ঢুকে যাওয়া পর্যন্ত। জয়ের আনন্দে,
ইট- খণ্ডটাকে দূরে ছুঁড়ে
ফেলে দিয়ে হাঁফাতে লাগল সে। একভাবে তাকিয়ে থাকল বুদ্বুদের মত উপচে উঠতে থাকা
রক্তস্রোতের দিকে। নিঃশব্দ সেই চত্বরে, হঠাৎ করেই প্রবল এক তৃষ্ণা গ্রাস করল তাকে… তার
সমস্ত জ্বালা- যন্ত্রণা ও জয়ের আনন্দ হেরে গেল সেই পিপাসার কাছে। হাঁটুমুড়ে বসে, সেই শয়তানের বুকে
মুখ ডুবিয়ে সে পান করে চলল রক্ত... আকণ্ঠ, যতক্ষণ না তৃপ্ত হলো তার অন্তরাত্মা।
চোখ খুলল
গ্লেন্ডা... ঘরে কেউ নেই। সূর্যের আলো ভাসিয়ে দিচ্ছে ঘরের লাল ইটের মেঝে আর সাদা
দেওয়ালগুলোকে। সবকিছু এখন একদম পরিষ্কার তার কাছে, হীরকখণ্ডের দ্যুতির মত জ্বল জ্বল করছে ঘটনার
ঘনঘটা... আগে কখনও যা হয়তো সে খেয়ালই করেনি। জ্বরটা ছেড়ে গেছে মনে হয়।
ব্যালকনি থেকে
ঘরে এল ডেবী। গ্লেন্ডা উঠে বসেছে দেখে, অবাক হয়ে খানিক্ষণ চেয়ে রইল সে, তার দিকে।
'বাহ... এখন কেমন লাগছে? তুই তো ভয় পাইয়ে দিয়েছিলি, আমাদের।'
'আমাদের...?'
'রজার! ওই ক্যানাডিয়ান... সে গেছে ডাক্তার ডাকতে।'
'আমার ডাক্তার দরকার নেই, তোকে আমি বলেছি তো...'
'হ্যাঁ, বলেছিলি... জ্ঞান হারাবার আগে। চুপচাপ শুয়ে থাক, বুঝেছিস? সব ঠিক হয়ে যাবে। কেমন বোধ করছিস এখন?'
'আরে, খুব ভালো রে...
এর থেকে ভালো বোধহয় আগে কখনও ছিলামই না।'
'খুব ভালো... কিছু পানীয় চাই কি তোর?'
'না রে, থ্যাংকস।' চুপচাপ শুয়ে রইল গ্লেন্ডা।
কিছুই বুঝে উঠতে
পারলেন না ডাক্তার, গ্লেন্ডাকে পরীক্ষা করে। কোনও রোগ নেই শরীরে...
শুধু গলার ক্ষতদুটো বিহ্বল করে তুলল
তাঁকে।
ডাক্তারের
জিজ্ঞাসাবাদ এক্কেবারেই পছন্দ হলো না গ্লেন্ডার। সে ভাব দেখাল যেন ডাক্তারের
ইংরিজি বুঝতেই পারছে না সে, যদিও ডাক্তারবাবু ঠিকঠাক ইংরিজিই বলছিলেন। চাদর
টেনে, মাথা অবধি ঢেকে
নিল গ্লেন্ডা। অনুযোগ করল, চোখে আলো লাগছে তার, আর খুবই ক্লান্ত সে... ঘুমোতে চায়।
দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ও
আত্নবিশ্বাসী গ্লেন্ডা অবশেষে চড়ে বসল নিউ ইয়র্ক গামী ৭৪৭ বিমানে।
বেচারি ডেবী...
হতভম্ব ডেবী স্পেনেই থেকে গেল তার ক্যানাডিয়ান বন্ধু রজার আর রজারের বন্ধুদের
সঙ্গে, দেশভ্রমণ করবে
তারা।
'তোর মা'কে একটা তার তো অন্তত করে দেওয়া উচিৎ ছিল তোর...' ডেবী দুঃখের সঙ্গে বলল।
মাথা নেড়ে, হেসে উত্তর দিল
গ্লেন্ডা... 'মা'কে চমকে দিতে চাই
আমি।'
স্টিভ তো থাকবে
মা'র সঙ্গেই...
গ্লেন্ডা তা জানে। তার ফ্লাইট পৌঁছবে খুব ভোরে... তখন তো তারা ঘুমিয়েই থাকবে, আলিঙ্গনাবদ্ধ।
গ্লেন্ডার প্রত্যাবর্তনের কোনও খবরই নেই তাদের কাছে।
জানলার বাইরে, ঘন অন্ধকারের
দিকে তাকিয়ে নিজের মনেই একটু হাসল গ্লেন্ডা। রূপোর আংটিটা স্পর্শ করে, আঙুল থেকে খুলে
নিল সেটা। আংটিটা নিয়ে খেলা করে চলল গ্লেন্ডা। বার বার হাত বোলাতে থাকল 'এস' টার ওপরে। 'স্টিভ' এর 'এস'… 'স্পেন' এর ও... ভাবল সে।
হঠাৎই আংটিটাকে
দু'আঙুলের মাঝে ধরে
চাপ দিতে থাকল গ্লেন্ডা। 'এস' এর আকারটাকে বিকৃত করে,
ধীরে ধীরে তাকে বদলে দিল
একজোড়া শিং-এ। আংটিটাকে এতই জোরে চেপে ধরল সে, যে তার আঙুল কেটে রক্ত বেরিয়ে এল।
No comments:
Post a Comment