...রবীন বসু
আজ দু'দিন হল মফসসল থেকে শহরের এই নামকরা ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে জয়েন করেছে অভিজিৎ। দক্ষিণ কলকাতার বাইপাস সংলগ্ন এই অঞ্চলটা আগে ফাঁকা ছিল। দেখতে দেখতে এই ক'বছরের মধ্যে জমজমাট। শপিংমল স্টেডিয়াম হোটেল রেস্তোরাঁ কফি-কাফে কী নেই। পাল্লা দিয়ে বেড়েছে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল ও অবেসরকারি কলেজ। টাকা এখানে হাওয়ায় উড়ছে। আর সেই টাকা ছুঁতে বউ বৈশাখীর স্বপ্ন সার্থক করতে মেধাবী অভিজিতের শহরে আগমন।
প্রথম দিনটা কেটেছে কাজ বুঝে নিতে। প্রিন্সিপালের সঙ্গে মিটং। স্টাফ কোয়ার্টার দেখা। দু’ শিফটে স্কুল হয়। আজ দ্বিতীয় দিনে চারটে ক্লাস নিল। পাঁচটায় ছুটি হতে কোয়ার্টারে ফিরছিল। একটু এগুতে কী মনে হল চার পাশটা ঘুরে দেখে। দু'পাশে হাল ফ্যাশনের সব বাড়ি। কিছুটা যাওয়ার পর একটা গান ভেসে এল কানে। খুব ভরাট গলায় কে যেন রবীন্দ্রসংগীত গাইছে। গলাটা তার অত্যন্ত চেনা। সে সম্মোহিতের মত পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল। একটা অপেক্ষাকৃত পুরনো রঙচটা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল। গান এ বাড়ির ভিতর থেকেই আসছে। অভিজিৎ সন্তর্পণে লোহার গেট ঠেলে ভিতরে ঢোকে। বারান্দায় উঠে বড় কাঠের দরজার সামনে দাঁড়ায়। বেল বাজাতে যাবে, এমন সময়।
--ওয়েলকাম মিঃ অভিজিৎ, ওয়েলকাম…!
সে অবাক হয়। ঘরের মধ্যেকার মানুষটা তার নাম জানল কীভাবে!
--ভেতরে আসুন।
অভিজিৎ দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকে দেখল, একটা আধুনিক ডিজাইনের ছিমছাম বসার ঘর। বড় সোফাটায় যে বসে আছে হুবহু তার মত দেখতে। বয়সও তার মতই হবে। যেন মনে হল অভিজিতের এক ক্লোন বসে আছে । ইশারায় তাকে সামনের চেয়ারটায় বসতে বলে আবার গানে ডুবে গেল।
একসময় গান থামে। চোখ খোলেন ভদ্রলোক।
--কি, মনে পড়ে গানটা!
--আমিই তো গাইতাম। আমার খুব প্রিয় গান। জানেন, আমার মাও খুব ভালো গান গাইত। কিন্তু সংসারের চাপে আর অভাবের জন্য মা গান ছেড়ে দিয়েছিল। যখন দেখল, ছেলের মধ্যে গানের প্রতিভা আছে, মা আমাকে রবিতীর্থে ভর্তি করে দিয়েছিল। ভালো গাইতাম। একটা সিডিও বেরিয়েছিল।
--সে গান কোথায় গেল মিঃ?
--সে কথা আর বলবেন না মশাই। ছেড়ে চলে গেছে।
--কেন?
--বাবা একদিন হঠাৎ ঘুমের মধ্যে হার্ট অ্যাটাকে চলে গেলেন। আর তারপরেই মা পড়ল কঠিন অসুখে। অ্যালজাইমার্স। মায়ের চিকিৎসা আর ছোট বোনের পড়াশোনা। তাড়াতাড়ি এসএসসি দিয়ে একটা গ্রামের স্কুলে ঢুকলাম। উপরি রোজগার চাই, তাই টিউশন। সময় নেই। গান চলে গেল।
--তা, মফসসল থেকে শহরের এই ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে কেন?
--টাকা চাই মশাই, টাকা। ইতিমধ্যে বিয়ে করেছি। আধুনিকা বউয়ের দাবি ফোর হুইলার চাই। ১২০০ স্কোয়ার ফিটের ফারনিশড ফ্ল্যাট। মেয়েকে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়াতে হবে। বোনকে তাড়াতাড়ি বিয়ে। অগত্যা গাঁয়ের স্কুল ছেড়ে এই হাই-ফাই শহরের স্কুলে।
যদিও দু’ শিফটে স্কুল, তবু পে-স্লিপ ভালো। ফ্রি-তে থাকার কোয়ার্টার। আর প্রচুর টিউশন। রেট হাই। আমি খুব তাড়াতাড়ি আমার স্বপ্নকে ছুঁতে পারব।
--মিঃ অভিজিৎ, আপনার কি মনে আছে, একদিন তালি দেওয়া ছেঁড়া প্যান্ট পরে স্কুলে যেতেন! মিড ডে মিলের জন্য থালা হাতে বসে থাকতেন! রোজ এক শার্ট পরে কলেজে যেতেন বলে বন্ধুরা হাসত।
--ওসব আমি ভুলে যেতে চাই। অতীত।
--মনে পড়ে, এক সময় কত ভোরে উঠে যত্ন নিয়ে রেওয়াজ করতেন। বাগানে ফুল ফুটলে আনন্দ পেতেন। দু'কান ভরে পাখিদের কাকলি শুনতেন…
এবার বিরক্ত হয় অভিজিৎ। --থামুন তো মশাই, বড্ড বেশি বকবক করছেন। মনে হয় বিষয়-সম্পত্তি ভালোই আছে। তাই নিশ্চিন্তে গান গাইছেন!
--না, একদম তা নয়। তবে অভাবের মধ্যেও মনের গানকে বাঁচিয়ে রেখেছি।
--সে আপনি রাখুন। আমার অত সময় নেই। পাস্ট ইজ পাস্ট, চলি।
দ্রুত বেরিয়ে আসে অভিজিৎ। তারপর কোয়ার্টারে না ফিরে সে ঘোরলাগা মানুষের মত স্কুল কম্পাউন্ডের চারপাশে ঘুরতে থাকে। ঘুরতে থাকে তার ফেলে আসা গ্রাম, শৈশব কৈশোর...। কারখানায় কাজ করা তার সাদামাটা বাবার শুকনো মুখ মনে পড়ে…অ্যাসাইলামে থাকা স্মৃতি-হারানো মায়ের অসহায় দৃষ্টি...আর সরল নির্লোভ আদর্শবান এক তরুণ শিক্ষকের স্টিল মুখ!
পরদিন সকালে স্কুলের লেটার বক্সে কর্তৃপক্ষ অভিজিতের রেজিগনেশন লেটার পেল।
rabindranathbasu616@gmail.com
আন্তরিক ধন্যবাদ আর অভিনন্দন জানাই "বইসই"
ReplyDelete