1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Saturday, August 1, 2020

মরুৎ - সুখের বাতাস

...দিব‍্যেন্দু গড়াই


       জানালার পাশে দাঁড়িয়ে অতসী। বাইরে এখন তুমুল বৃষ্টি আর সাথে এলোমেলো হাওয়া। কবাট দুটো বন্ধ না করলে বৃষ্টির ছাঁটে ঘরদোর ভেসে যাবে। রান্নাঘর থেকে তাই তরিঘরি শোওয়ার ঘরে ঢুকেছিল সে। বাইরেটা ঘোর অন্ধকার। শাঁখে ফুঁ দিয়ে, ধূপ জ্বালিয়ে ঠাকুরঘরে সন্ধ্যে দেওয়া হয়ে গেছে অনেকক্ষণ। এতক্ষণে তো বাপনের বাবার চলে আসার কথা। চিন্তায় কপালে ভাঁজ পড়ে অতসীর।

গতবছর শ্বশুরমশাই মারা যাওয়ার পর সংসারে একটা ধাক্কা লেগেছিল। স্বামী-সন্তান আর এক দেওর নিয়ে অতসীর এই ছোট সংসারটা কেমন যেন মনমড়া হয়ে পড়েছে এখন। দেওর শঙ্করের বিয়ে-থা হয়নি। চাকরি করে শহরে। এমনিতেই বাড়িতে কম থাকত, বাবার মৃত্যুর পর শুধু রাতের খাওয়া আর ঘুমোনোর জন্য বাড়ি ফেরে। স্বামী আর ছেলে, এই নিয়েই এখন অতসীর দিন কাটে। সারাদিন বাড়ির পাশের চালাঘরে পোড়ামাটির পুতুল তৈরী করে তার স্বামী বিমল সর্দার। সে নিজেও ঘরসংসারের হাজার কাজের ফাঁকে হাত লাগায় পুতুল তৈরীতে। কারণ নিজের বাপ-ঠাকুর্দার পেশা’কে বড্ড ভালোবাসে অতসী। ছোট থেকেই নয়াগ্রামের পটুয়া পাড়ায় নিজেদের ঘরে বাপ-কাকাদের হাতের কাজে সাহায্য করত ও। মাটি দিয়ে কি সুন্দর সব পুতুল, হাতি, ঘোড়া তৈরি হত একের পর এক। বাবা খুব সুন্দর করে বলতেন,

-‘আমাদের পুতুল খেলা হল পঞ্চভূতের খেলা। ক্ষিতি অর্থাৎ পৃথিবীর বুক থেকে মাটি নিয়ে তাতে অপ অর্থাৎ জল মিশিয়ে ভালো করে মাখার পর আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে পুতুলের আকার দেওয়া হয়। তারপর সেই কাঁচা মাটির পুতুলকে তেজ অর্থাৎ আগুনে পুড়িয়ে শক্ত করা হয়। এরপর সেই তপ্ত পুতুলকে ঠান্ডা করা হয় মরুৎ অর্থাৎ বাতাস দিয়ে। বাকি রইল ব্যোম অর্থাৎ শূণ্যতা। সে তো রয়েছে পুতুলের ভিতরেই। কারণ পুতুলগুলোর ভেতরটা ফাঁপা। ওখানেই তো লুকিয়ে রয়েছে ব্যোম।’

*****
নারাণপুরের বসন্ত রায়ের থান ঈশ্বরীগঞ্জ থেকে প্রায় বারো মাইল দূর। বাদাভূমি ঘেঁষা এই থান খুব জাগ্রত। ভালোই জনসমাগম হয়। কেউ আসে সুন্দরবনের রাজার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য, কেউবা সন্তানকামনায় মানতের ঢিল বাঁধতে। পোড়ামাটির ঘোড়া-হাতি-পুতুলেরও ভালোই চাহিদা। তাই সপ্তাহে একবার করে নিজের তৈরী পুতুলগুলো নিয়ে এখানে আসে বিমল। দুপুরের দিকে এসে কাজটাজ মিটিয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যে। আজও তাই করেছিল। কিন্তু ভুল হয়ে গেছিল একটা জায়গায়। গত কয়েকদিন ধরেই টিভি, রেডিও-তে লাগাতার পূর্বাভাস দিচ্ছিল আজকের ঝড়-ঝঞ্ঝার। খুব একটা আমল দেয়নি। এখন মনে হচ্ছে দিলেই ভালো করত। বাড়িতে বৌ আর ছেলে একা। চিন্তায় পড়ে গেল বিমল। এই ঝড়বৃষ্টিতে সড়কপথ যদিও বা চালু থাকে দুখনী নদীর খেয়া পারাপার নির্ঘাত বন্ধ। কি করবে এখন সে? বুকপকেট থেকে ফোন বার করে। বৌ’কে ফোন করতে গিয়ে দেখে নো- নেটওয়ার্ক। খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। আর দেরী করা ঠিক হবে না। ভালো করে গামছাটা মাথায় বেঁধে নেয়। তারপর ছাতা মাথায় হাঁটতে শুরু করে ভ্যানস্ট্যান্ডের দিকে। কোনরকমে একটা ভ্যানে যখন জায়গা করে নেয় বিমল তখন আকাশে মুহুর্মুহু বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। পরবর্তী একঘন্টা ওলটপালট ঝড়বৃষ্টির মধ্যে জবুথবু হয়ে বসে থাকে ভ্যানের ওপর। খেয়াঘাটে পৌঁছানোর পর দেখে শেষ লঞ্চ ঘাট ছেড়ে যাচ্ছে। প্রাণপণে দৌড়ায় বিমল আর রতন। চেঁচামেচি করে কোনরকমে লঞ্চকে দাঁড় করিয়ে উঠে পড়ে দু’জন। বিমলের পাশের পাড়ায় থাকে রতন। নারাণপুরে একটা ভাতের হোটেল চালায় ও। ঝড়বৃষ্টিতে কোন খদ্দের আসবে না, তাই হোটেলের ঝাঁপ ফেলে বাড়ির দিকে চলেছে।

প্রথম থেকেই দুলছিল লঞ্চ। মাঝনদীতে পড়ার পর দুলুনির মাত্রা ছাড়াল। প্রতিটি যাত্রী শক্ত করে আঁকড়ে ধরে রেলিং, দড়িদড়া, খুঁটি... যা পায় হাতের কাছে। প্রবল ঝড়ের দাপটে লঞ্চ ঘুরতে থাকে একজায়গায়, এগোতে পারে না। হঠাৎ এক দমকা হাওয়ায় একদিকে হেলে পড়ে লঞ্চ। টুপটাপ করে জলে খসে পড়ে কয়েকজন। ভয়ে কেঁপে ওঠে সারা শরীর, যখন বিমলের দেহটা নদীর ঠান্ডা জল স্পর্শ করে। চোখের সামনে ভেসে ওঠে ছেলে বাপানের মুখ। ঝড়বৃষ্টির তীব্র আওয়াজে ঢাকা পড়ে যায় জনাকয়েক মানুষের হাহাকার।

*****
বাপানের মা রান্নাঘরে আসে। রাতের তরকারিটুকু করে নিতে হবে। বিমল রুটির সাথে গরম তরকারি খেতে ভালোবাসে। দুশ্চিন্তা কিছুতেই পিছু ছাড়ছে না অতসীর। বাপানের বাবার ফোন নট-রিচেবল। এই দুর্যোগে দেরী হওয়ার একটাই মানে। আর ভাবতে চাইছে না। চোখ ভিজে ওঠে ওর। মন’কে প্রবোধ দেয়, ছেলেকেও। একটু আগে ছেলে জিজ্ঞেস করছিল,

-‘বাবা এত দেরী করছে কেন মা?’

-‘ঝড়জলে আটকে গেছে রাস্তায়। এসে পড়বে এক্ষুনি।’

শঙ্কর এসে এরমধ্যে উঁকি দিয়ে গেছে। দাদা দেরী করছে কেন, ফোনে কিছু বলেছে কিনা... এসব জিজ্ঞেস করছিল। অতসী বলেছিল,

-‘ঠিক চলে আসবে অন্যদিনের মত।’

বিশ্বাস, বিশ্বাসের জোরেই দালানে এসে চৌকির ওপর বসে রইল অতসী। রাত বাড়ল। ঝড়ের দাপট কমল একটু। ওদিকে দুখনী নদীর গর্ভে তলিয়ে গেল একজন মানুষ। তার আর ঘরে ফেরা হল না।

*****
মাঝরাত পেরিয়ে গেছে অনেকক্ষণ। ঝিপঝিপ বৃষ্টি পড়ছে থেকেথেকে। ঠান্ডা দখিনা বাতাসে কেঁপেকেঁপে উঠছে শরীর। অতসী আঁচলটা ভালো করে জড়িয়ে নেয় গায়ে। চোখের জল শুকিয়ে গেছে হাওয়ায়। চরম বিপদের আতংকে স্তব্ধ অতসী দেখে সামনের নিমগাছের নীচে একজন মানুষকে। হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে তার। তীর বেগে দৌড়ায় অতসী, মানুষটার পানে। ডুবন্ত মানুষ চোখের সামনে খড়কুটো দেখতে পেয়েছে যে!

যে হাওয়ার ঝাপটায় নদীতে ডুবতে বসেছিল, সেই হাওয়াকেই ধরে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছে বিমল। হাওয়া ভরা রাবারের টায়ার ধরেই উঠে এসেছে পাড়ে। সবাই বেঁচে গেছে, একজন ছাড়া। রতন মাঝি। তাকে চোখের সামনে ডুবে যেতে দেখেছে বিমল। কাঁদতে কাঁদতে সেটাই শোনাচ্ছিল বৌ কে।

অতসীর সেদিকে মন নেই। শুধু বারদুয়েক ‘আহা রে’ বলে উঠেছে অজান্তেই। তার মন এখন খুশীতে টইটম্বুর। নিজেকে তার মনে হচ্ছিল বাবার হাতের তৈরী পোড়ামাটির পুতুল। যার ভেতরটা বাতাস ভরা। সুখের বাতাস।


dibyendugarai.dg@gmail.com


কলকাতা 

এই ধারাবাহিকের 

প্রথম গল্প 

দ্বিতীয় গল্প
তৃতীয় গল্প 

                                                       তেজ-সর্বগ্রাসী

পড়তে ক্লিক করুন 




6 comments:

  1. যথারীতি অসাধারন।ব্যোমের অপেক্ষায় আছি।😊

    ReplyDelete
  2. আমিও দুরুদুরু বক্ষে অপেক্ষায়, কি হয় শেষটায়। ঐ যে কথায় বলে না, সব ভালো যার শেষ ভালো...

    ReplyDelete
  3. নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না, প্রতিটাতেই কিছু না কিছু চমক থাকেই !

    ReplyDelete
    Replies
    1. চমক টুকু শেষ অব্দি কতটা রাখতে পারি, দেখা যাক। 😊

      Delete
  4. অসাধারণ,পরের সংখ্যায় পঞ্চভূতের ব্যোমের অপেক্ষায় রইলাম।

    ReplyDelete
  5. অসংখ্য ধন্যবাদ। দেখা যাক শেষ পর্বে কি আসে...

    ReplyDelete