1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Wednesday, October 21, 2020

দেবী যেথায় কৃষ্ণঘন

 

ছবি : ইন্টারনেট

                                                                                                                    ডা: করণ দেবদ্যুতি

          নাইকিম গ্যাটওয়েচকে যখন প্রথম দেখি তখন কষ্ঠি পাথরের মূর্তি বলে ভুলে করেছিলাম। তিনি সুদানের বিখ্যাত মডেল। তিনি একজন কালো চামড়ার যোদ্ধা; বর্ণ যোদ্ধা। তাকে দেখে কবিগুরুর "কৃষ্ণকলি" কবিতাটি মনে পড়েছিল, "কালো? তা সে যতই কালো হোক/ দেখেছি তার কালো হরিণ চোখ।"

          সমসাময়িক একটি ঘটনায় যাবার আগে এই ভূমিকাটি উল্যেখযোগ্য বলে মন হল। এবার সেই ঘটনায় আসি। এই বছরের মে মাসে আমেরিকার পুলিশ জনৈক কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তিকে গ্রেফতার করেন। দশ মিনিটের সেই ভিডিও ফুটেজ সারা পৃথিবীকে তোলপাড় করে তোলে। কারণ সেখানে দেখা যাচ্ছে যে জর্জ ফ্লয়েড নামের ওই ব্যক্তিকে একজন শেতাঙ্গ পুলিশ হাঁটু দিয়ে গলা চেপে ধরে আছে। কিছুসময় পর তার মৃত্যু ঘটে।  এরপর আমেরিকা তোলপাড় হয়ে ওঠে "ব্ল্যাক লাইফ ম্যাটার" আন্দোলনে। একটি বেসরকারি সংস্থা পরিসংখ্যান দেয় যে আমেরিকার পুলিশের গুলিতে কৃষ্ণাঙ্গদের মৃত্যুর সংখ্যা শেতাঙ্গদের তিন গুণ। এর আগেও এরকম দুটি ঘটনার নজির মেলে। একই নৃশংসতায় ঘটেছিল কিশোর ট্রেইভেন আর এরিক গার্নার নামে দুই কালো চামড়ার মানুষের মৃত্যু। এরপর লেব্রন জেমসের মত খেলোয়াড়, ব্রিয়ানসের মত গায়ক এই আন্দোলকে প্রকাশ্যে সমর্থন করেন। আমেরিকায় এই বর্ণ বৈষম্য অনেক কালের হলেও এই ঘটনাটি প্রমাণ করে যে এখনও সেই বিদ্বেষ আমেরিকার কোণে কোণে জমে আছে।

           এই সূত্রে মনে পড়ে যায় আমার কিছুদিন আগে দেখা একটি সিনেমা; "গ্রীনবুক"। ২০১৮ সালের, একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত এই সিনেমাটির বিষয়বস্তু কৃষ্ণাঙ্গ-শেতাঙ্গ বৈষম্য ঘিরে। আফ্রো-মার্কিন ধ্রুপদী ও জ্যাজ  পিয়ানো বাদক ডন শার্লি দক্ষিণ আমেরিকার একজন কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিক। সময়টা ১৯৬২। তিনি কয়েক সপ্তাহ ব্যাপী কনসার্ট ট্যুরে পিয়ানো বাজানোর চুক্তিবদ্ধ হয়ে বের হচ্ছেন। অথচ তাঁর সর্বত্র বিচরণের সমানাধিকার নেই। এরপর সমকালীন আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গ বিদ্বেষের ভয়াবহ পরিস্থিতি উঠে আসে। শার্লির বিশ্বস্ত দেহরক্ষী ও মোটর চালক টনি তাঁকে অনেকগুলো বিপদ থেকে উদ্ধার করে। দুবছর আগে দেখা মাহারশালা আলী এবং ভিগো মার্টনসনের এই চমৎকার সিনেমাটির ভয়াবহ রূপ এবছর মে মাসে বাস্তবায়িত হতে দেখলাম। যদিও এর আগেও যে এরকম ঘটনা ঘটেছে তা আগেই উল্যেখ করেছি।

        এতক্ষণ আমেরিকার কথা আলোচনা করলাম বলে হয়তো মনে হতে পারে বর্ণ বিদ্বেষ ওদের আছে। আমরা তো ভালো আছি, এসব নেই। কিন্তু তাই কি? আমাদের দেশে দেহত্বকের সেডের পার্থক্য এতখানি নেই ঠিকই। কিন্তু উজ্জ্বল বর্ণের প্রতি আকর্ষন এবং কলোর প্রতি অনীহা অবশ্যই আছে। তা যদি নাই হবে তো বিয়ের আগে পাত্র পাত্রীর গাত্রবর্ণ নিয়ে কেন এত লুকোচুরি হয়? কেউ হয়তো বলবেন এসব তো আদ্যিকালের কথা। চুল দেখত, হেঁটে দেখাতে বলত, ঘরকন্যা কাজ পারে কিনা জানতে চাইত; এমনকি স্নো পাউডার মেখে ফরসা হয়েছে কিনা তাও ঘষে দেখত। এখন আর সেসব দিন আছে নাকি? এখন ডেটিং সাইট বা ফেবুতেই রিলেশন হয়। এরপরেও যারা জোটাতে পারল না তাদের জন্য মাট্রিমনিয়াল সাইট আছে। ক'বছর ঘুরে দেখে তারপর বিয়ে। আগের মত পাত্রপক্ষ দেখতে এসে ইন্টারভিউ নিলে তাদের পত্রপাঠ বিদায় করা হয়।

           তাহলে প্রথমেই বলি, আমি সিস্টেমের কথা বলিনি; চাওয়ার কথা বলেছি। ফরসা বউ তো ছেলেরা চায়', মেয়েরাও চায় বর ফরসা অন্তত উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ যেন হয়। তাই ম্যাট্রিমনিয়াল সাইটে স্কিন কমপ্লেকশন উল্লেখ করতে হয়। ডেটিং অ্যাপের বিজ্ঞাপনগুলোও ফরসা ছেলে মেয়েকে দিয়ে করানো হয়। ব্যতিক্রমী বিজ্ঞাপন ছাড়া। তাই একথা স্বীকার করতে বাধা নেই যে, আমাদের চোখ ফরসাকে টানে। সেটা আই সেনসিটিভিটির জন্যই হোক বা মস্তিকে জমে থাকা উজ্জ্বলতা প্রিয়তার বংশানুক্রমিক পুনরাবৃত্তির জন্যই হোক। হয়তো সেজন্যই আদিকাল থেকে সৃষ্ট সহিত্যাগুলোতে নায়ক-নায়িকার সৌম্য চেহারার রূপ বর্ণনা প্রকাশ পেয়েছে। তাই হয়তো বাংলাসাহিত্যে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের আগে তেমন কেউ তথাকথিত রূপহীন পুরুষ, লাবণ্যহীন মহিলাকে বারবার নায়ক নায়িকার স্থান দেন নি।

          তবু তারা স্থান পেল একসময়। পেতেই হত।কল্পনার চাহিদা মেটাতে যতই রূপ লাবণ্য প্রিয় হই না কেন, চোখের সামনে বাস্তব সে কথা বলে না। আমাদের চারপাশে আমাদের সেই স্বপ্নসুন্দর দৈবরূপ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। সে সত্যই পুনর্বার প্রমাণ করল সাম্প্রতিক জৈবিক নৃবিদ্যার গবেষণা। হোল জিনোম স্টাডি করে দেখা গেল আমাদের দেশের মানুষের ষাট শতাংশ জিন আফ্রিকার বংশোদ্ভূত মানুষের কাছ থেকে পাওয়া। অর্থাৎ সার্বিকভাবে আমাদের ৬০% বৈশিষ্ট্য আফ্রিকার কালো মানুষের কাছ থেকে এসেছে। কালচে ভাব প্রকট হবে এটাই স্বাভাবিক। তাই স্বপ্ন থেকে বাস্তবে ফিরে চলুন কৃষ্ণকলির কাজল কালো চোখে ডুব দিই। নাইকিম পৃথিবীকে শেখাচ্ছেন কৃষ্ণতা নিয়ে আশঙ্কায় না পড়তে। তিনি কৃষ্ণাঙ্গ মডেল হয়ে  প্রচলিত সৌন্দর্য প্রিয়তার ধরণাগুলো ভেঙে দিয়ে অন্যদের উদ্বুদ্ধ করছে তার দেখানো পথে বর্ণ বিদ্বেষের প্রাচীর ভেঙে ফেলতে। এই বৈষম্য প্রাচীর আমাদের মনের উদারতা দিয়েই ডিঙিয়ে যেতে হবে।

drdebadyuti.karan@gmail.com
মঠ চন্ডীপুর ,পূর্ব মেদিনীপুর





No comments:

Post a Comment