1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Wednesday, October 21, 2020

ব‍্যোম - পুনরাবির্ভাব

 

ছবি : লেখকের 
                                                        দিব‍্যেন্দু গড়াই

স্থান- বিশদিঘি, ঈশ্বরীগঞ্জ

কাল- ব্লু-আওয়ার, ১৩ই অক্টোবর, ২০৩০

পাত্র- দুইজন। একজন কিশোর। বয়স সতেরো। গায়ে ট্রাকস্যুট। আরেকজনের বয়স খানিকটা বেশী। কুড়ি থেকে বাইশের মধ্যে। তার নিম্নাঙ্গে অন্তর্বাস ছাড়া কিছুই নেই। সেটাও ভিজে সপসপ করছে। ঠান্ডায় কাঁপছে ছেলেটি। 

-‘তোমাকে বেশ চেনা চেনা লাগছে। কিন্তু ঠিক চিনতে পারছি না। কে বলতো তুমি?’ কাঁপতে কাঁপতে জিজ্ঞেস করে ছেলেটি। 

-‘তুমি কে?’ 

-‘আমি ফিরোজ। আর তুমি?’

-‘মাণিক সর্দার।’

-‘মাণিক সর্দার। মানে...  তুমি... তুই কি শঙ্করের ভাইপো?’

-‘হ্যাঁ। তুমি.. মানে... আপনি কাকা’কে চেনেন?’ দারুণ অবাক হয় মাণিক। 

-‘চিনি মানে, আমরা হলাম এক বৃন্তে দুইটি কুসুম। প্রাণের বন্ধু রে আমরা। কিন্তু একটা কথা বল, তুই হঠাৎ এত বড় হয়ে গেলি কি করে?’

*****

কিছুক্ষণ আগের ঘটনা...

রাতের ঘন অন্ধকার কিছুটা ফিকে হয়েছে। ভোরের আলো ফুটতে দেরী আছে খানিকটা। রাত আর ভোরের এই মধ্যবর্তী সময়ে চারিদিকটা অপার্থিব সুন্দর নীল রঙে ভরে যায়। বেশ লাগে মাণিকের এই ব্লু-আওয়ার। তার মনে হয় আকাশের ঐ অদ্ভুত নীল রঙ চুঁইয়ে পড়ে গা-মাথা ভিজিয়ে দিচ্ছে। ভিজতে ভিজতে এইসময় রোজ বাড়ি থেকে বেড়িয়ে পড়ে সে। সাইকেল চালিয়ে এক একদিন এক এক দিকে চলে যায়। আজ যেমন নৈর্ঋত দিকের পালা। পূর্ব-পশ্চিম-উত্তর-দক্ষিণ-ঈশান-অগ্নির পর আজ নৈর্ঋত দিক। মস্ত দিঘি রয়েছে এ দিকটায়। এদিকের রাস্তায় এখন লোকজন বেশ কম থাকে। মৃদু আলোকিত পাকা রাস্তায় সাইকেল চালাতে চালাতে বেশ শীত করছিল মাণিকের। দিঘির যত কাছে যাচ্ছিল ক্রমশঃ বাড়ছিল ঠান্ডার পরিমাণ। বাঁধানো দিঘির পাড়ে যখন সাইকেল থামাল তখন পুবের আকাশের নীল রঙে মিশে গেছে লাল। আর সেই লালচে আভায় দিঘির শান্ত, কালো জলে মৃদু আলোড়ন দেখে একটু থমকে দাঁড়াল মাণিক। নিস্তব্ধ, নিদ্রিত, ধীর-স্থির প্রকৃতির মাঝে কিছুটা বেমানান সেই আলোড়নের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল মাণিক। নিজের কানে নিজের দ্রুত হৃদস্পন্দন শুনতে পারছিল। ক্ষণিকের বিরতি… আর তারপরেই জল থেকে উঠে এল একটি মুখ। ধীরে ধীরে ছেলেটির জলে ভেজা দেহ প্রকট হল… বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল মাণিক। 

****

“আইনস্টাইন-রসেন ব্রীজ আসলে একটা ওয়ার্মহোল। একটি চতুর্মাত্রিক টানেল যা মহাবিশ্বের দুটি ত্রিমাত্রিক বিন্দুকে পরস্পরের সাথে যুক্ত করে। হতে পারে সে বিন্দু দুটি পৃথক দুই জগৎ, হতে পারে সে দুটি ভিন্ন দুই সময়। মানে বর্তমান সময়ের সাপেক্ষে অতীত বা ভবিষ্যৎকাল। আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতাবাদের সাথে তাত্ত্বিক ভাবে এই ওয়ার্মহোলের জোরালো সম্পর্ক রয়েছে, কিন্তু সত্যিই এর অস্তিত্ব আছে কিনা, তার প্রমাণ এখনও পাওয়া যায়নি।”

অনলাইন ক্লাসে ফিজিক্সের এক প্রফেসরের লেকচার শুনতে খুব ভালো লাগে মাণিকের। বাংলা- ইংলিশ দুটো ভাষায় সমান দক্ষ সেই বাঙালি প্রফেসর থাকেন উত্তরাখন্ডে। নাম উত্তীয় বাসু। সামনাসামনি আলাপ না থাকলেও ওনার সঙ্গে ভিডিও কলে কথা হয় মাণিকের। তাঁকে নিজের হাতে তৈরী দূর্গাপ্রতিমা দেখিয়েছে। দেখে উনি খুব খুশি। উনি আরও খুশি হয়েছেন এটা জেনে যে ফিজিক্সের সাথে সাথে ও লোকশিল্প’র মত বিষয় কে গ্র্যাজুয়েশানের সিলেবাসে রেখেছে। আসলে মৃৎশিল্পীর সংসারে ছোট থেকে বড় হয়েছে ও। বাবা-মা’র সাথে ছোট থেকেই মাটির পুতুল তৈরীতে হাত লাগাত ছোট্ট বাপান। মাটির প্রতি সেই টান, সেই ভালোবাসায় ওকে প্রতিমা-নির্মাণ শিল্পে নিয়ে এসেছে। ঠাকুরদা মাটি ভালোবাসত খুব। না, মৃৎশিল্পী ছিল না, তবে মাটির বুকে সোনার ফসল ফলাতে জুড়ি ছিল না অবনী সর্দারের।  শেষে সেই মাটির বুকেই পেতেছিল অন্তিম শয্যা। মাথার ওপরে ছিল ভোরের নীলাকাশ। লালন সাঁইয়ের গান শুনতে শুনতে চোখ বুজেছিল ঠাকুর্দা। তখন মাণিকের কতই বা বয়স! ছয়-সাত হবে। ঐ ঘটনার বছর দেড়েকের মাথায় আরেক দুর্ঘটনা নেমে এসেছিল ওদের পরিবারে। মাণিকের বাবা বিমল সর্দার এক ঝড়জলের সন্ধ্যায় দুখনী নদীর বুকে প্রায় ডুবতে বসেছিল। বরাত জোরে বেঁচে গিয়েছিল সেবার। তারপর থেকেই দেবদ্বিজে ভক্তির আধিক্য ঘটেছিল বাবা-মা দুজনারই। এমনিতেই ঠাকুর্দা হরিনাম সংকীর্তনে খোল বাজাত। সেটাই ছিল তাঁর পেশা। সে নিজেকে শ্রীহরির চরণে সমর্পণ করেছিল। আর মা-বাবা দুজনায় ভক্ত হয়ে উঠেছিল কালিঠাকুরের। বাড়িতে কালিপুজো শুরু হয়েছিল সেই দুর্ঘটনার পর থেকে। প্রতিমা তৈরি হত বাড়িতেই। মৃৎশিল্পী নিমাই’য়ের পাশে পাশে ঘুরঘুর করত মাণিক। কাঠামো তৈরী, মাটির প্রলেপ দেওয়া, ছাঁচে ফেলে মুখ তৈরি, হাতের আঙুল বানানো, রঙ করা, চোখ আঁকা... একটু একটু করে শিখে নিয়েছিল মাণিক। বছর ছয়েক আগে বিজয়া-দশমীর দিন যখন পড়ে গিয়ে নিমাইয়ের কোমর ভাঙল, সে বছর মাণিক নিজেই কালিঠাকুর  তৈরি করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল। নিমাইও প্রশংসা করেছিল সেই প্রতিমার।

মুর্তি গড়ার সাথে সাথে পড়াশোনাতেও মন ছিল মাণিকের। ক্লাস এইট থেকে বিজ্ঞানের বিষয়গুলো, বিশেষ করে ফিজিক্স আর ম্যাথেমেটিক্স নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটাতে কোন অসুবিধে হত না। কোভিড-পরবর্তী পরিবর্তিত দুনিয়ায় তখন ডিসট্যান্ট এডুকেশন স্বাভাবিক ঘটনা। বছর দুয়েক ধরে চলা করোনা ভাইরাসের তান্ডব ভ্যাক্সিন এসেও দমাতে পারেনি। শেষ অব্দি প্রকৃতির আপন নিয়মেই কোভিড মিলিয়ে গেছে বিশ্ব থেকে। কোভিড প্যানডেমিকে ওয়াক ফর্ম হোম, ডিসট্যান্ট এডুকেশন, অনলাইন বিজনেসের চক্করে মানুষের হাতে সময়ও বেড়েছে অনেকটা। পৃথিবীর বুকে করোনার আগমনের দশ বছর কেটে গেছে। এখনও প্রয়োজন ছাড়া অধিকাংশ লোক বাড়ির বাইরে বেরোয় না, বেরোলেও সিংহভাগ মানুষের মুখে থাকে মাস্ক আর হাতে স্যানিটাইজারের বোতল।

*****

সেদিন ঊষালগ্নে ফিরোজ ওরফে মাসার সাথে আলাপ হওয়ার পর থেকে মাণিকের জীবন পাল্টে গেছে। সায়েন্স-ফিকশনের গল্প, সিনেমা, ওয়েবসিরিজের পোকা মাণিক স্বচক্ষে যে ঘটনার সাক্ষী হয়েছে তা প্রথম প্রথম বিশ্বাস করতেও কষ্ট হচ্ছিল। কিন্তু যখন ওর কাকা শঙ্কর দূর থেকেই প্রাণের বন্ধু মাসা’কে চিনতে পেরে ছিল, বলেছিল স্বয়ং ভগবান সামনে এসে বললেও বিশ্বাস করবে না এ মাসা নয়, অন্য কেউ...  তখন মাণিকের মন থেকে অবসান ঘটেছিল সব সন্দেহের। ৩২বছর বয়সী শঙ্কর সর্দারের সাথে ২২ বছর বয়সী রক্তমাংসের মাসার আবার সাক্ষাৎ ঘটেছিল সেদিন। দীর্ঘ দশ বছর আগে খুব ভোরবেলায় যে জায়গা থেকে নিরুদ্দেশ হয়েছিল, ঠিক সেই  বিশদিঘি থেকেই পুনরাবির্ভাব ঘটল মাসার। তবে পৃথিবীর বয়স দশ বছর বাড়লেও মাসার বয়স একই রয়ে গেছে। এক বছরও বাড়েনি।

কোথায় ছিল সে দশ’টা বছর? বিশদিঘিতে কি সত্যিই রয়েছে ওয়ার্মহোল? যার মধ্যে দিয়ে প্রায় আলোর গতিবেগে টাইম ট্রাভেল করে ভবিষ্যতের করোনামুক্ত পৃথিবীতে পৌঁছে গেছে মাসা? নিছক দূর্ঘটনা না ঘটলে, মাসা সেদিন শঙ্করের বারণ সত্ত্বেও বিশদিঘির জলে না নামলে আদৌ কি এমন কিছু ঘটত? নাকি রহস্য অন্যকিছুতে লুকিয়ে আছে? প্রশ্ন অফুরন্ত। ভবিষ্যৎ পৃথিবীর মানবজাতি নিশ্চয় উত্তরগুলো পাবে একদিন। আর সেই উত্তর জানার জন্য অপেক্ষা করতে হবে বিজ্ঞানের ওপর। মাণিকের মাথায় তখন ঘুরছিল প্রফেসর উত্তীয় বাসুর কথাগুলো… 

“চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারকা

কোথা হতে সব সৃষ্ট,

শূণ্য হইতে আসিয়াছে এ

নিরন্তর মহাবিশ্ব।”

শূণ্য তথা ব্যোমে’র ক্ষমতা অসীম। মহাবিশ্বের অধিকাংশ স্থানেই কিচ্ছুটি নেই। বেবাক ফাঁকা। আর সেই শূণ্যস্থানের সূক্ষ্মস্তরে প্রতিনিয়ত ঘটে চলে ভর ও শক্তির অস্থিরতা। বিজ্ঞানের ভাষায় ‘কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশন’। হুবহু এক কিন্তু বিপরীত চার্জবিশিষ্ট কণা ও প্রতিকণা তৈরী হওয়ার সাথে সাথে তারা পরস্পরের সংস্পর্শে এসে ধ্বংস হয়ে যায়। ভর থেকে শক্তির রূপান্তর ঘটে, যা আবার মিশে যায় ঐ শূণ্যে। হয়ত এই মহাশূণ্যে এই সৌরজগতের যমজ অথচ বিপরীতধর্মী কোন জগত আছে।  সূর্য, বুধ, মঙ্গল, বৃহস্পতি, শনি, ইউরেনাস, নেপচুনের মত সেখানে আরেকটা পৃথিবীও রয়েছে। আর সেই পৃথিবীর বুকে প্রতিটি জীবের মত হুবহু জীব বিরাজ করছে। যদিও তারা আমাদের পৃথিবীর জীবজগতের সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী। মহাশূণ্যের নিয়মানুযায়ী যদি কখনো এই বিপরীতধর্মী কণা ও প্রতিকণা (ম্যাটার ও অ্যান্টিম্যাটার) পরস্পরের সন্মুখে আসে তাহলে সবকিছু ধ্বংস হয়ে যাবে। পরে থাকবে শূণ্য বা ব্যোম।”

dibyendugarai.dg@gmail.com
কলকাতা 


এই ধারাবাহিকের 

দ্বিতীয় গল্প - অপ:বিশ(বিষ) দিঘি
তৃতীয় গল্প - তেজ-সর্বগ্রাসী
চতুর্থ গল্প  - মরুৎ - সুখের বাতাস

2 comments:

  1. তরুণ চক্রবর্তীOctober 21, 2020 at 1:07 PM

    অবশেষে বৃত্ত সম্পূর্ণ।দারুণ।

    ReplyDelete
  2. শেষ করে আমিও খুব খুশি হয়েছি।

    ReplyDelete