1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Tuesday, January 26, 2021

পাঞ্চজন্য

 

                                                                                                                                                          ছবি  : ইন্টারনেট 

পাঞ্চজন্য
সায়নদীপা পলমল

"কি কষ্ট হচ্ছে?"
 "আমার কষ্ট হয়না।"
"আচ্ছা, তাই বুঝি? তাহলে ওভাবে তাকিয়ে আছো কেন?"
 "দেখছি।"
"হুমম দেখো আর বিলাপ করো।"
"বিলাপ? কিসের জন্য?"
"কারণ নেই বলতে চাইছো? ক্ষমতা হারানোর জন্য খেদ নেই তোমার মনে? 
    ওহ ঠিক ঠিক, তুমি তো মহান… মানে তোমাকে মহান সাজতে হবে আরকি। তাই তো ভেতরে যতই জ্বলে পুড়ে যাও মুখে প্রকাশ করা চলবে না।"
    "তোমার তাই মনে হয়? আচ্ছা। তাই সই…"
"হাঃ হাঃ হাঃ। তুমি যতই মহান সেজে থাকো না কেন, সব ক্ষমতা এখন আমার হাতে, আর পরিবর্তনও আসবে না এইবার। আশা করি উপলব্ধি করতে পেরেছো এ সত্য?"
    "তাই নাকি? দেখা যাক।"

★★★



         বিচ্ছিরি রকমের চেঁচামেচির শব্দে ঘুমটা ভেঙে গেল অরার। মাথার কাছে রাখা ডিজিটাল ঘড়ি জানান দিল সময় এখন সাতটা আঠারো। বুকটা ছ‍্যাঁৎ করে উঠল অরার। সে এতক্ষণ ঘুমিয়েছে! আর অ্যালার্মটাও কি বাজেনি? মলিন রাত পোশাকের ওপর একটা চাদর জড়িয়ে রান্নাঘরে গেল সে। জলের পাত্র দুটো শুকিয়ে কাঠ। দেওয়াল আলমারি থেকে কার্ড বের করে ছুটল সে। সর্বনাশ! দূর থেকেই দেখতে পেল আজ জল নেওয়ার জন্য লম্বা লাইন। সাড়ে সাতটার মধ্যে তার নম্বর কি আসবে! একটু এগোতেই অরা বুঝতে পারল ভীড়ের মধ্যে সবাই জল নেওয়ার জন্য দাঁড়িয়ে নেই। কিছু একটা ঘটেছে, আর সেই ঘটনার মৌতাত নিচ্ছে সকলে। ভীড়টা ঠেলে আরও একটু এগিয়ে গেল অরা। মেশিনের কাছে জল নেওয়ার লাইনটাও নেহাৎ ছোটো নয়, অরা গিয়ে দাঁড়াল লাইনের শেষে। মেশিনের ঠিক পাশেই দুই মহিলা প্রায় হাতাহাতিতে লিপ্ত। 
"কি হয়েছে?"
        অরা ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করল তার সামনের জনকে। মহিলা একটা ব্যঙ্গের হাসি হেসে বললেন, "ওই যে নীল পোশাক পরা মহিলাকে দেখছো সে নিজের ভাগের জলটা নিয়ে একটু সরে গিয়েছিল, যেই বাদামী রঙের পোশাক পরা মহিলা জল নেবেন বলে নিজের কার্ডটা মেশিনে ঢুকিয়েছেন অমনি ওই নীল পোশাকের মহিলা তাকে ঠেলে দিয়ে নিজের আরেকটা ছোটো পাত্র মেশিনের সামনে বসিয়ে দিয়েছে।"
    "সেকি! কেন?" 
"জানিনা ভাই। বলছে ওর ছেলে নাকি অসুস্থ। সবসময় খুব জল পিপাসা পাচ্ছে তার। তাই… কিন্তু ভাই নিজের ভাগের জল কে দেবে বলো?"
    "সেই তো। ওনাকে কি এখন সেনার হাতে তুলে দেবে নাকি?"
"ওরা না তুলে দিলেও সেনারা তুলে নিয়ে যাবে। 
   ওই দেখো।" এই বলে মহিলা আকাশের দিকে ইঙ্গিত করলেন। 
   অরা সেদিকে তাকিয়ে দেখল একটা ড্রোন তাদের মাথার খুব কাছেই ঘুরছে।

          জল নিয়ে প্রায় টলতে টলতে বাড়ি ফিরল অরা। সেনারা ধরে নিয়ে গেল মহিলাকে। অন্যের ভাগের জল চুরি করতে চাওয়া অপরাধ তো বটেই। প্রত্যেক পরিবার সদস্য পিছু পায় তো সাকুল্যে পাঁচ লিটার করে জল, তাতে পানিয় থেকে শুরু করে রান্না সবটুকু মেটাতে হয়। আগের দিনের ভাষণে প্রধান বলছিলেন জলের পরিমাণ কমিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা চলছে কারণ পানীয় জলের স্তর আরও নেমে গিয়েছে। এমতাবস্থায় রাশ না টানলে চলবে না। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল অরা। মহিলাকে সে চেনে না, এখানে কেউ কাউকে চেনার প্রয়োজন বোধ করেনা। কিন্তু মহিলাকে নিয়ে যাওয়ার সময় মাটিতে লুটিয়ে পড়ে মহিলার সেই কাতর আর্তি কিছুতেই ভুলতে পারছেনা অরা, "আমাকে ছেড়ে দাও… আমাকে ছেড়ে দাও… ছেলেটা যে আমার খুব অসুস্থ…"


বাড়িতে ঢুকে অরা দেখল বাবা খাটে শুয়ে একটা কাপড়ের টুকরো চিবোচ্ছে। লালা গড়িয়ে পড়ছে তাঁর মুখের চারপাশ বেয়ে।
  "তোমার তেষ্টা পেয়েছে বাবা?" এই বলে বাবার মুখ থেকে কাপড়টা সরিয়ে চামচে করে অল্প অল্প জল বাবার মুখে দিতে লাগল সে। শিশুর মত চুকচুক করে জলটা খেতে লাগলেন মানুষটা। গতকাল রাতে কিনে আনা রুটির টুকরো ছিঁড়ে ছিঁড়ে বাবাকে খাইয়ে ঘড়ি দেখল অরা--- সাতটা সাতচল্লিশ। বুকটা আবার ধক করে উঠল তার। তাড়াতাড়ি বাথরুমে গিয়ে চোখ মুখ পরিষ্কার করে পোশাক পরিবর্তন করল সে। তারপর একটা ছোট্ট ব্যাগ কাঁধে নিয়ে আবার ছুটল সে। 

     কারখানার মাথায় লাগানো ঘড়িতে জ্বলজ্বল করছে তিনটে সংখ্যা আর দুটো বিন্দু --- ৭:৫৮। ক্ষিপ্র গতিতে ভেতরে ঢুকে বায়োমেট্রিক রেজিস্টারে আঙ্গুল ছোঁয়াল সে। আঙ্গুলটা তোলা মাত্রই রেজিস্টারে সংখ্যাগুলো পাল্টে গেল- ৮:০০। পেছন ফিরতেই অরা দেখল একটা মেয়ে বিধ্বস্ত অবস্থায় দাঁড়িয়ে,

"আজকেও পারলাম না… এই নিয়ে তিনদিন সময়ে ঢুকতে পারলাম না। আজ ডাক পড়বে নিশ্চয়।" ভেজা ভেজা গলায় বিড়বিড় করল মেয়েটা। অরা কোনো মন্তব্য না করে সিঁড়ি ভেঙে তিনতলায় উঠে এলো। লিফট তাদের জন্য নয়। নির্দিষ্ট বাথরুমে ঢুকে দেওয়ালের একটা দাগে হাত বোলাল অরা। দুটো নাম খোদাই করা সেখানে--- 'শৌর্য+আরিয়া'। 

"বাবা… মা…" রোজকার মত বিড়বিড় করল অরা। বাবার কাছে শুনেছে সে যে এই কারখানায় চাকরিটা হয়ে যেতেই দাদু যেদিন মা আর বাবার বিয়েতে সম্মতি দিলেন সেদিন বাবা আনন্দে আত্মহারা হয়ে কাজে এসে এই কান্ডটা করেছিলেন। তারপর থেকে কারখানার বেশিরভাগ অংশের রিকন্সট্রাকশন হলেও এই অংশটা কেন না জানি ছাড় পেয়ে গিয়েছে, হতে পারে এই অংশে কাজ করা মানুষগুলো মালিকদের কাছে অতটা গুরুত্বপূর্ণ নয় বলে। 

      কারখানার সাধারণ কাজগুলো যখন থেকে রোবট দ্বারা নিয়ন্ত্রণ হতে শুরু করল তখন কারখানাগুলো থেকে বিপুল পরিমাণ কর্মী ছাঁটাই হতে লাগল--- বলা যেতে পারে কিছু উচ্চপদস্থ কর্মী ছাড়া বাকি সকল কর্মীকে ছাঁটাই করা হয়েছিল এক কালীন কিছু টাকার বিনিময়ে। বাদ পড়েননি অরার বাবাও। কারখানা থেকে খানিক দূরত্বে এইসব কর্মহীনদের বস্তি গড়ে উঠল ক্রমশ। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শিখিয়ে যারা মানুষ করার স্বপ্ন দেখত একসময় তাদের স্বপ্নগুলো বস্তির স্যাঁতস্যাঁতে ঘুপচি ঘরের অন্ধকারে মিলিয়ে গেল ক্রমশ। ব্যতিক্রম নন অরাও বাবাও। বাকি সবাই অন্যত্র টুকটাক কাজ জুটিয়ে নিলেও একই সঙ্গে স্ত্রীর আর স্বপ্ন দুটোর মৃত্যু সহ্য করতে পারলেন না মানুষটা।  নার্ভাস ব্রেক ডাউন হয়ে গেল। বসে খেলে রাজার ধনও একসময় শেষ হয়ে যায়, সেখানে বাবার অবসরের ওই সামান্য কটা টাকা শেষ হতে বেশি সময় লাগল না। তখন বাধ্য হয়ে সংসার চালানোর জন্য অরাকে বাবার পুরোনো কারখানতেই এই কাজে নামতে হল। 

     একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ব্যাগ থেকে প্রায় অর্ধ ভেদ্য আঁটোসাঁটো পোশাকটা বের করে পরে নিল অরা। বাবা জানেন না অরা কি কাজ করে, জানার অবস্থাতেও অবশ্য নেই।  টিং টিং করে বেল বাজার শব্দ হল। নির্দিষ্ট পায়রার খোপে ব্যাগখানা রেখে কিচেনের দিকে ছুটল অরা। রোবট কুকের হাত থেকে ধূমায়িত কফির কাপের ট্রে'টা নিয়ে B2 বিভাগের দিকে পা বাড়াল সে। রোবট শ্রমিক পেয়ে সাধারণ কর্মীদের বহু আগেই ছাঁটাই করা হয়েছে কারখানা থেকে কিন্তু উচ্চপদস্থ কর্মীরা রয়ে গিয়েছেন আজও, হয়েছেন আগের থেকে আরও বেশি বিত্তবান। এই মানুষগুলোকে খাবার পরিবেশন করা এবং টুকিটাকি কাজ করে দেওয়ার জন্য নিযুক্ত রয়েছে অরার মত কিছু কম বয়সী মেয়ে বা বলা ভালো এদের বিনোদন করার জন্য নিযুক্ত রয়েছে তারা। মায়ের মুখে অরা শুনেছিল একসময় নাকি নারীবাদী আন্দোলন খুব তীব্রভাবে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছিল, এখনও মূল শহরের দিকে সেই আন্দোলন চলছে। তারা নাকি মেয়েদের এমন "objectification"-এর প্রতিবাদ করছে। একথা ভাবলে ভালো লাগে অরার, আবার ভয়ও হয়। আন্দোলনের জোয়ারে যদি এই কাজটা চলে যায় তাহলে সে সংসার চালাবে কি করে! 

     খানিক অন্যমনস্ক ভাবে হাঁটতে গিয়ে একজন অফিসারের সঙ্গে ধাক্কা লেগে গেল অরার। কেঁপে উঠল সে। মুহূর্তের মধ্যে অফিসারের ঠোঁটের কোণে খেলে গেল ধূর্ত একটা হাসি --- "আরিয়ার মেয়ে, তাই না? সেই ফর্সা শরীর, সুডৌল গড়ন…"


"বাবা!" ঘরে ঢুকেই চিৎকার করে উঠল অরা। রোজকার মতোই যে মানুষটাকে খাইয়ে দাইয়ে ঘরের মধ্যে রেখে গিয়েছিল এই মুহূর্তে সেই মানুষটার ঘাড়টা ঝুলে পড়েছে বিছানা থেকে, চোখ আধ বোজা, মুখ থেকে কষ গড়িয়ে মেঝেটাকে চ্যাটচ্যাটে করে তুলেছে। মুহূর্তের তৎপরতায় মানুষটাকে নিয়ে কারখানার কর্মীদের ফ্রি হেলথ সেন্টারে নিয়ে ছুটে এলো অরা। দীর্ঘদিন রোগে ভুগে মানুষটার শরীরে আর কিছু নেই নাকি দীর্ঘদিন একলা লড়াই করতে করতে অরার নিজের শরীরের ক্ষমতা অনেক বেড়ে গিয়েছে বুঝতে পারেনা অরা, শুধু দেখে এখন প্রয়োজন মতো দিব্যি বাবাকে কাঁধে তুলে সে ছুটে পৌঁছে যেতে পারে হেলথ সেন্টারে।

    "Not Available"

চিকিৎসক রোবটের চোখে লাগানো কালো চশমায় লাল হয়ে শব্দ দুটো ফুটে উঠতেই চমকে উঠল অরা। 

"এর অর্থ কি?"

"জানোনা বুঝি? Not Available মানে বলতে চাইছে তোমার বাবার এখন যে পরিস্থিতি তার চিকিৎসা এই সেন্টারে উপলব্ধ নয়।" বলে উঠলেন অরার পরে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা ভদ্রলোক। 

"মানে?"

"মানে তোমার বাবার অবস্থা আশঙ্কাজনক। এই ফ্রি হেলথ সেন্টারে মেশিনের চিকিৎসায় আর চলবেনা।"

"এ… এখন আমি কি করব!" হতাশা ঝরে পড়ল অরার গলায়। ভদ্রলোক বললেন, "কিছু করার নেই মা। যে যাই বলুক, মেশিন ডাক্তার কখনও মানুষের জায়গা নিতে পারেনা। তুমি এখন ভালো নার্ভের ডাক্তারের কাছে যাও। এখানের মেশিন ডাক্তারের মুরোদ ফুরিয়ে গেছে।" 


    বাবাকে নিয়ে ফেরার পথটা বড্ড ক্লান্ত লাগছিল অরার। এখন চিকিৎসা এতই ব্যয়বহুল হয়ে গিয়েছে যে অরার মত যাদের আর্থিক সঙ্গতি কম তাদের জন্য এরকম রোবট চিকিৎসকের ব্যবস্থা করা হয়েছে যাতে বিনামূল্যে বা স্বল্প মূল্যে মানুষ চিকিৎসা পরিষেবা পেতে পারে। কিন্তু এই রোবট চিকিৎসদের ক্ষমতাও সীমিত, জটিল কিছু হলে মানুষকে সেই ব্যয়বহুল হাসপাতালেই যেতে হয়। 

       বাড়ি পৌঁছে স্মার্টফোনটা নিয়ে নিজের ব্যাংকের ব্যালেন্স দেখল অরা। জমানো পুঁজি বলতে কিছুই নেই প্রায়। এই মুহূর্তে তার অনেক টাকার দরকার। কিন্তু কিভাবে আসবে টাকা! হঠাৎ অরার মনে পড়ে গেল আজ সকালে কারখানার লোকটার বলা কথাগুলো, "তুমিও তোমার মায়ের মতোই বোকা। শুধু একবার রাজি হলেই যখন পদোন্নতি নিশ্চিত তখন ঠুনকো আত্মসম্মানের জন্য হাতের লক্ষ্মী পায়ে ঠেলছো!"

      একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল অরা। প্রথম দফায় বাবাদের বেতন অর্ধেক করে দেওয়া হয়েছিল, তখন সংসার চালানোর জন্য মা অনেকের হাতে পায়ে ধরে কারখানাতে রান্নার কাজ পায়। মা ছিল অপূর্ব সুন্দরী। অচিরেই কিছু নরপিশাচ অফিসারের নজর পড়ে মায়ের ওপর। একদিন বাধ্য হয়ে নিজের সম্মান বাঁচাতে কারখানার ছাদ থেকে ঝাঁপ দেয় মা। তারপর বাবার চাকরিটাও পুরোপুরি চলে যায়। তবে মায়ের ঘটনার পর নতুন নিয়ম করা হয়। কারখানায় টুকিটাকি কাজের জন্য যেসব মেয়ে রয়েছে তাদের সম্মতি না থাকলে কোনো অফিসার জোর করতে পারবেন না, কিন্তু আবার একই সঙ্গে অলিখিত ভাবে যেসব মেয়েরা স্বেচ্ছায় শয্যা সঙ্গিনী হতে সম্মত হবে তাদের বেতন প্রায় তিনগুণ বাড়িয়ে দেওয়া হয়। মায়ের আর নিজের আদর্শের জন্য শত অনটন সত্ত্বেও অরা কোনোদিনও এই কাজ করেনি। কিন্তু আজ… তার জগৎ যে মানুষটাকে নিয়ে সেই মানুষটারই চিকিৎসা করাতে পারছে না সে! 



            কাল সারারাত ঘুম হয়নি। আজ ভোর ভোর জলের লাইনে চলে এসেছে সে। আজকে জায়গাটা অন্য দিনের মতোই শান্ত, কালকে যে অমন একটা ঘটনা ঘটেছে তার কোনো ছাপ নেই কারুর মুখে। অবশ্য থাকবেই বা কেন আগে তো নিজেদের বাঁচতে হবে, তারপর অন্যের জন্য চিন্তা। যেখানে নিজের বেঁচে থাকাটাই সংকটের সম্মুখীন সেখানে অন্যের জন্য প্রতিবাদ করা নেহাৎ-ই নির্বুদ্ধিতা।  বুকটা ধড়ফড় করছে অরার। কাল সন্ধ্যেবেলায় সে আবার ফিরে গিয়েছিল কারখানায়। অনলাইনে আবেদন করে এসেছে তার "পদোন্নতি"-র এবং সেই সঙ্গে আর্জি জানিয়েছে তিনমাসের বেতন অগ্রিম দেওয়ার। অগ্রিম বেতন নিতে হলে প্রত্যেকদিন তিনঘন্টা করে ওভার টাইম করতে হয় ওই সময়টা। সবেতেই সম্মতি জানিয়ে সবুজ টিক দিয়ে এসেছে অরা। রাতে মায়ের ছবি জড়িয়ে কাল সে কেঁদেছে, খুব কেঁদেছে। কতকাল আগে যে শেষ এভাবে কেঁদেছিল মনে পড়েনা তার। তবুও তাকে এই সিদ্ধান্তটা নিতেই হয়েছে। অর্থের খুব প্রয়োজন তার। যে করে হোক বাবার চিকিৎসা করাতেই হবে। 

     সৈন্য বাহিনীর একটা ড্রোন আজও ঘুরছে মাথার ওপর। কি ব্যাপার কে জানে! দেশের ক্ষমতা যখন  মিনিস্ট্রি ক্যাবিনেট আর মিলিটারি ফোর্সের মধ্যে ভাগ হয়ে যায় তখন সাধারণ মানুষ খুব আনন্দে ছিল। ভেবেছিল মিনিস্ট্রি ক্যাবিনেট দেশের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বাণিজ্য এবং অর্থনীতির দায়িত্ব পুরোপুরি নিলে দেশ অর্থনীতিতে অনেক উন্নতি করবে। আর অন্যদিকে মিলিটারি ফোর্সের হাতে শাসন এবং সুরক্ষার দায়িত্ব থাকলে তারা সাধারণ মানুষের কথা অন্তঃত ভাববে। কিন্তু সেই ইউটোপিয়ান দেশ আর গড়ে ওঠেনি। একদিকে পুঁজিবাদ আর অন্যদিকে স্বৈরাচারের বেড়াজালে সাধারণ জনজীবন এখন ধুঁকছে। সেনাদের ভয়ে সদা সন্ত্রস্ত সবাই। সেনাদের প্রেরিত ড্রোন সবার ওপরে নজর রাখছে সর্বদা।

     "এবার নিয়ে যাবে বোধহয়।" পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা মহিলার কথা শুনে চমকে উঠে পেছন ফিরল অরা। দেখল কাল লাইনে যার সাথে কথা হয়েছিল সেই মহিলা। অরা কৌতূহল বশে জিজ্ঞেস করল, "কাকে নিয়ে যাবে?"

"ওই যে যে মহিলাকে কাল ধরে নিয়ে গেল তার ছেলেকে।"

"কেন?"

"ওরা বলছে ছেলেটার জন্যই তো এমন অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটেছে। তাই এই ঘটনার জন্য আসল দায়ী সেই।"

"মানে! ছেলেটা তো অসুস্থ। এর জন্য সে দায়ী হল কিভাবে?"

শশ… মুখে আঙ্গুল চিপে অরাকে চুপ করতে ইশারা করলেন সেই মহিলা, "তোমার কি মাথা খারাপ! কি সব বলছো এখানে দাঁড়িয়ে?"

মাথা নাড়ল অরা। সত্যিই এরকম কথা বলাটা তার ঠিক হয়নি। কেউ শুনতে পেলে বিপদ হতে পারে। 

মহিলা এবার অরার কানের কাছে মুখটা এনে ফিসফিসিয়ে বললেন, "আসলে শুনলাম কাল মহিলাকে যারা ধরে নিয়ে গিয়েছিল তারা নাকি…." কথাটা অসম্পূর্ণ রেখে চোখ টিপলেন মহিলা, তারপর আবার বললেন, "ছেলেটা থাকলে মায়ের কথা জানতে চাইবে। তখন ওপর মহলে তদন্ত হলেই মুশকিল। তাই তো…"

মহিলার কথা শুনে চমকে উঠল অরা। কি বলছেন কি উনি!

   "আরে ম্যাডাম তাড়াতাড়ি করুন, গল্প করতে দাঁড়িয়েছেন নাকি!" 

পেছন থেকে তাড়া আসতেই চমকে উঠল অরা। তার পালা এসে গিয়েছে। মেশিনের দিকে এগোতে গিয়ে অরা টের পেল তার পা দুটো কাঁপছে। প্রতিবর্ত ক্রিয়ার বশে কার্ড পাঞ্চ করা থেকে জল নেওয়া সবটুকু হয়ে গেল আর সঙ্গে সঙ্গে অরার চোখ দুটোও ভরে এলো জলে। ধীরে ধীরে সরে এলো অরা। চোখের সামনে বারবার ভেসে উঠছে কালকের সেই মহিলার আর্তনাদ। ধীরে ধীরে সেই মহিলার ছবিটা কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে যেতে থাকল, মহিলার পরিবর্তে ক্ষণিকের জন্য চোখের সামনে ঝলসে উঠল আজ থেকে প্রায় সাত বছর আগে মৃত একটা মানুষের মুখ। অরা নিজেও জানে না এমনটা কেন হচ্ছে, শুধু সে উপলব্ধি করতে পারছে তার বুকের ভেতরে একটা হুলুস্থুলুস হচ্ছে। জলের পাত্রগুলো পিঠের ব্যাগে নিয়ে বাড়ি ফেরার সময় ওই বাড়িটার দিকে নজর গেল অরার। বস্তির অন্যান্য বাড়িগুলোর মতোই এক চিলতে ঘর। কালকেই বাড়িটাকে চিনেছিল সে। ছেলেটাকে কি ধরে নিয়ে চলে গেছে ওরা! ওকে কি মেরে ফেলবে! নিজের অজান্তেই গুটিগুটি পায়ে ঘরটার সামনে এলো অরা। দরজাটা ভেজানো ছিল। একটু অবাক হল অরা। ছেলেটা দরজা লাগায়নি কেন, নাকি দরজা খুলে তাকে নিয়ে চলে যাওয়া হয়েছে! হঠাৎ-ই তৎপর হয়ে উঠল অরা। দরজাটা ঠেলে ঘরের ভেতর ঢুকতেই দেখতে পেল খাটের উপর শুয়ে বছর ছয়েকের একটা শিশু। ছুটে গিয়ে ওর নাকের কাছে আঙ্গুল নিয়ে গেল অরা, শ্বাস চলছে এখনও। ছেলেটাকে ডাকার চেষ্টা করল সে, কিন্তু সাড়া দিলনা। অরা পিঠ থেকে জলের একটা পাত্র নামিয়ে ছেলেটার ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে কয়েক ফোঁটা জল ঢালতেই চুকচুক করে জলটা খেয়ে ফেলল ছেলেটা। তারপরেই চোখ মেলে তাকাল সে। অরা আঙুলের ইশারায় তাকে চুপ করে থাকতে বলল। তারপর জলের পাত্রটা পিঠে নিয়ে ছেলেটাকে কোলে তুলে ফেলল। চাদরটা এমনভাবে নিজের শরীরের ওপর জড়িয়ে নিল যাতে কেউ চট করে বুঝতে না পারে। সন্তর্পণে ঘরটা থেকে বেরিয়ে এলো অরা, আশেপাশে কেউ নেই। ছেলেটাকে নিয়ে গিয়ে ওদের বাড়িতে লুকিয়ে রাখতে পারলে কেউ চট করে টের পাবেনা। তারপর কি হবে এই মুহূর্তে ভাবতে পারল না অরা। সে শুধু অনুভব করতে পারল ছেলেটাকে যে করে হোক বাঁচাতেই হবে। 

      দ্রুত পায়ে এগোচ্ছিল অরা। রাস্তায় লোক থাকলেও সকালের ব্যস্ততায় কেউ খেয়াল করছিলনা তাকে। বুকের ভেতরে কেউ যেন হাতুড়ি পিটছিল তার। বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছে খানিকটা নিশ্চিন্ত মনে দরজাটা ঠেলল অরা, খুলে গেল সেটা। কিন্তু ঘরের ভেতর পা রাখতে যেতেই বুকটা ছ‍্যাঁৎ করে উঠল তার। বন্দুকধারী দুই সৈন্য দাঁড়িয়ে ঠিক তার ঘরের মধ্যে।


"ওয়েলকাম, তোমার অপেক্ষাতেই ছিলাম আমরা।" ব্যঙ্গ করে বলে উঠল একজন। 

"কি ভেবেছিলে ছেলেটাকে তোমার বাড়িতে এনে লুকিয়ে রাখবে? তুমি ভুলে গিয়েছিলে আমাদের ড্রোনের নজর এড়ায়না কিছুই।"

"ভালোই হল, কাল আমরা ওর মাকে নিয়ে খুব আনন্দ করেছিলাম, আজ আবার হবে। কে হয় তোমার? কেউ না? আজকাল শুধু শুধু অন্যের জন্য কেউ নিজের বিপদ ডেকে আনতে পারে? হাঃ হাঃ হাঃ…" কথাটা বলেই অট্টহাস্যে ফেটে পড়ল তারা। তারপর বন্দুক বাগিয়ে এগিয়ে আসতে গেল অরার দিকে… মুহূর্তের মধ্যে নিজের গায়ের চাদরটা খুলে ওদের দিকে ছুঁড়ে দিল অরা। ক্ষণিকের জন্য হতভম্ব হয়ে গেল লোকদুটো। এই সময়টুকুই অরার দরকার ছিল, রুদ্ধশ্বাসে ছুটতে লাগল সে। পেছনের লোকদুটো যে ইতিমধ্যে সাহায্য চেয়ে পাঠিয়েছে একথা অনুমান করতে কষ্ট হয়না। তাছাড়া প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত দুজন সেনার সঙ্গে ছুটে পাল্লা দেওয়া যে মুখের কথা নয় তা অরা বিলক্ষণ জানে। সোজা রাস্তায় না হোক, বাঁকা পথেই নাহয় চেষ্টা করা যাক। কারখানার উত্তর দিক বরাবর রয়েছে পাহাড় আর জঙ্গল। এখনও অবধি ওদের গায়ে আঁচড় পড়েনি কেন সেটাই আশ্চর্যের। তবে মানুষের থেকে প্রকৃতিকে বোধহয় বেশি বিশ্বাস করা যায়। চোখের সামনে একটা পাথরের টুকরো পড়ে থাকতে দেখে সেটা তুলে নিয়ে লোকদুটোর ছুঁড়ে দিল অরা। সে অন্যমনষ্ক করতে চেয়েছিল ওদের কিন্তু পরিবর্তে পাথরটা গিয়ে লাগল একজনের চোখে, সে যন্ত্রনায় কঁকিয়ে উঠে বসে পড়ল মাটিতে। তার সঙ্গী ব্যস্ত হয়ে পড়তেই উত্তর দিকে ছুটল অরা, জঙ্গল খুব কাছেই। কিন্তু আচমকা ওপর থেকে গুলির মত কি যেন ছুটে এলো অরার দিকে, এক চুলের জন্য রক্ষা পেল অরা। ওপর দিকে তাকিয়ে দেখল দুটো ফ্লায়িং গান কখন যেন কালো মেঘের মত এসে হাজির হয়েছে তার মাথার ওপর। এবার রক্ষা পাওয়া মুশকিল, ওই উড়ন্ত বন্দুকে লাগানো ক্যামেরায় ওদের কন্ট্রোল রুমে ক্রমাগত উঠে যাচ্ছে অরার ছবি আর তার পরিপ্রেক্ষিতেই অরাকে লক্ষ্য করে গুলি ছুটে আসছে। কিন্তু যে করে হোক শেষ চেষ্টা করতেই হবে। নিজের শরীরের সমস্ত শক্তি একত্রিত করে ছোটার গতি আরও বাড়িয়ে দিল অরা। পাল্লা দিয়ে ছুটতে লাগল গুলি। ছুটতে ছুটতে সে পৌঁছে গেল কারখানার পেছন দিকে বয়ে চলা সরু খালটার কাছে, কারখানার নোংরা জল এসে মেশে সেখানে। মুহূর্তের মধ্যে বাচ্চাটার মুখে হাত চাপা দিয়ে খালে ঝাঁপ দিল অরা। সঙ্গে সঙ্গে একাধিক গুলি ছুটে এলো জলে, ফোয়ারার মত উত্তাল হয়ে উঠল খালের জল। ভগ্নাংশের ব্যবধানে হয়তো একটাও গুলি স্পর্শ করতে পারল না অরার শরীর। খালটার ওপারে শুরু হচ্ছে জঙ্গল, দূরত্ব বেশি নয়। তবুও নোংরায় আটকে যাচ্ছে পা। আর সেই সুযোগেই একটা ফ্লায়িং গান নেমে এলো খুব কাছে। মুহূর্তের মধ্যে অরার মনে পড়ে গেল তার পিঠের ব্যাগটার কথা। একহাতে ব্যাগটাকে টেনে আনতে আনতে গুলি ছুটে এল তার দিকে, তবে অরার শরীরে না লেগে লাগল ব্যাগটায়। ধাতব জলের পাত্রে গুলি লেগে ছিটকে গেল। ব্যাগটা এবার উড়ন্ত বন্দুকটার দিকে ছুঁড়ে দিল অরা। ভারী ব্যাগটা যন্ত্রটার কোণ ছুঁইয়ে পড়ে গেল জলে। যন্ত্রটা একটু হলেও বেসামাল হয়ে পড়ল আর সেই সুযোগেই খাল পেরিয়ে ওপারে উঠল অরা। কিন্তু তখনই দ্বিতীয় ফ্লায়িং গানটার থেকে এক ঝাঁক গুলি ছুটে এলো। শেষ রক্ষা হল না আর, একটা গুলি এসে বিঁধে গেল অরার কাঁধে। ঝর্ণার মত লালচে রক্ত বেরিয়ে এলো তার শরীর থেকে। যন্ত্রনায় হাতটা আলগা হয়ে এলো অরার, তবুও শিশুটাকে মাটিতে পড়তে দিল না সে। পা'টা টেনে টেনে জঙ্গলের দিকে এগোবার চেষ্টা করল সে। আবার একটা গুলি ছুটে এলো তার দিকে। এবারে আর পারল না অরা, হাঁটু ভেঙে মাটিতে পড়ে গেল সজোরে। ফ্লায়িং গানটা এবার সোজা একঝাঁক গুলি ছুঁড়ল তার বুক লক্ষ্য করে--- একসঙ্গে দুটো শরীরকে ঝাঁঝরা করে দিতে চাইল, কিন্তু আচমকা কালো বর্মের মত কি যেন একটা এসে আড়াল করে দিল অরার শরীর, সেই বর্মের গায়ে গুলিগুলো লেগে বুমেরাংয়ের মত ছুটে গেল যন্ত্রটার দিকেই। সশব্দে ফেটে গেল যন্ত্রটা, বিস্ফোরণের ধোঁয়ায় ঢেকে গেল চারিদিক; আর এদিক অরার চোখেও নেমে এলো অন্ধকার…

     "কেমন বোধ করছেন এখন?" 

শরীরে প্রচন্ড যন্ত্রনা নিয়ে ভারী হয়ে থাকা চোখের পাতা দুটো কোনোক্রমে খুলল অরা। দেখল তার দিকে মাথা ঝুঁকিয়ে তাকিয়ে রয়েছে এক সুদর্শন যুবক। 

    "আ… আমি কোথায়?" অস্ফুটে জানতে চাইল অরা।

     "আমাদের সুরক্ষিত আশ্রয়ে।" এক বজ্রগম্ভীর কন্ঠস্বর জবাব দিল। অরা দেখতে পেলনা মানুষটাকে। সে আবার প্রশ্ন করল, "মানে?"

    "আপনার সাহসিকতা আমাদের মুগ্ধ করেছে, শুধু তাই নয় এই পচে যাওয়া সমাজের বুকে দাঁড়িয়েও এক অচেনা শিশুর জন্য আপনি যা করলেন তা ভাবতেও অবাক লাগে।" বললেন সেই সুদর্শন যুবকটি। অরা আরও অবাক হয়ে প্রশ্ন করল, "কিন্তু আপনারা কে?"

    "আমরা! আমাদের যোদ্ধা বলতে পারো।" বজ্রগম্ভীর কন্ঠ ভেসে এলো আবার, "সমাজের এই ধ্বংস স্তূপের ওপরে দাঁড়িয়ে আমরা যুদ্ধ করছি সাধারণ মানুষের অধিকারের জন্য, পুরাতন সমাজকে আবার ফিরিয়ে আনার জন্য। আর এই যুদ্ধের জন্য তোমার মত যোদ্ধাদের খুব প্রয়োজন যাদের মধ্যে এখনও মনুষ্যত্ববোধ মিলিয়ে যায়নি। যারা এখনও নিজের সঙ্গে সঙ্গে অন্যের কথা ভাবে।"

     "কি ভাবছেন? হবেন আমাদের সঙ্গী?"

জিজ্ঞাসু চোখে যুবকটি তার হাত বাড়িয়ে দিল অরার দিকে। হতবাক অরার ব্যান্ডেজ বাঁধা হাতটা নড়ে উঠল আলতো করে…


★★★


দৃশ্যটা দেখে একটা তৃপ্তির হাসি হাসল সে। ব্রহ্মাণ্ডের নিয়মে অধর্মের হাতে সময়ে সময়ে ক্ষমতা আসে ঠিকই, কিন্তু সেটা চিরস্থায়ী হতে পারে? যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু হয়ে গিয়েছে। দেখা যাক শেষ হাসি কে হাসে…

sayandipapalmal@gmail.com
পশ্চিম মেদিনীপুর   




1 comment:

  1. গল্পটা ভালো হয়েছে। কল্পবিজ্ঞানের আদলে লেখা ঘটনার বিন্যাস ও বুনট বেশ সুললিত।
    লেখককে আমার শুভকামনা।
    একেবারে শেষের সংযোজনটা বাহুল্য বলে মনে হল। লেখককে ভেবে দেখার অনুরোধ রইল।

    ReplyDelete