1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Tuesday, January 26, 2021

মহাপুরুষ

 

                                                                                                                            ছবি  : ইন্টারনেট 

মহাপুরুষ
জয়দীপ মুখোপাধ্যায়
        গতবছর বিএ পাস করে বাবার হোটেলে থাকি।সকাল হলেই জলখাবার সাঁটিয়ে সাইকেল চড়ে এদিক ওদিক উদ্দেশ্যবিহীন ঘুরে বেড়ানো ছাড়া আমার আর কোনো কাজই নেই।আমার বন্ধু রথিন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে, ফাইনাল ইয়ার, তার আড্ডা দেবার সময় নেই।সংকল্প হোস্টেলে থেকে ডাক্তারি পড়ে, সুতরাং ওর সাথে দেখা হবার সুযোগটাও নেই।ওরা দুজন আমাদের পাড়াগাঁয়ের মুখউজ্জ্বল করা ছেলে।এখন নিজের কেরিয়ার এগিয়ে নিয়ে যেতে ব্যস্ত।আমি সাইকেল নিয়ে সারদাসুন্দরী মহিলা কলেজের আশেপাশে চক্কর কাটি,দূরথেকে সুন্দরী মেয়েদের দেখি।কখনো কখনো চলে যাই সাতসা মাইল দূরে গোলাপ বাঁধে।লোকেদের অলসভাবে  মাছ ধরা দেখতে ভালো লাগে।কি অসীম ধৈর্য নিয়ে সবাই ফাতনার পানে চেয়ে আছে।কখন ফাতনাটা টুপ করে জলে ডুবলে একটানে মাছটাকে ডাঙ্গায় ফেলবে সেই আশায় ওরা দুপুর রৌদ্রে বসে আছে।রোদ চড়া হতে শুরু করলেই যখন নিজের ছায়াটা ছোট হতে শুরু করে তখন শর্টকাট দিয়ে সাইকেল চালিয়ে বাড়ি ফিরে আসি।

      দুএকটা চাকরির দরখাস্ত যে করিনি তা নয়, তবে ডাক পাবার সম্ভাবনা ভীষণ ক্ষীণ।ইতিহাসে এমএ করার কথা মা বললেও আমার সেসবে ইচ্ছে নেই। পাড়াগাঁয়ের নিস্তরঙ্গ জীবন আমাকে আর যেন টানে না।মনে হয় দুর্ভাগা বলেই পাড়াগাঁয়ে জন্মেছি।শহরে জন্মালে এতদিনে কোথাও একটা না একটা কিছু ঠিক জুটিয়ে নিতাম।
     সেদিন সাইকেল নিয়ে এক নাম না জানা গলি দিয়ে ভর দুপুরে ফিরছি হঠাৎই একটা বাড়ির গেটের ওপর ছোট্ট নতুন ফ্লেক্সে লেখাটা আমার চোখে পড়লো।
"  মহাপুরুষ - শিক্ষা নিন "
নিচেই এক সাধুর ছবি যিনি ধ্যানে বসেছেন।
বেশ নতুনত্ত্ব আছে।এখানে কি কোনো মহাপুরুষ এলেন?সাইকেল থেকে নেমে বন্ধ দরজায় কড়া ধরে দুবার নাড়াতেই ভিতর থেকে তীব্র নারিকণ্ঠের চিৎকার ভেসে এলো।
" কে রে মুখপোড়া দুপুরে খাবার সময় বিরক্ত করিস?" 
একটু ঘাবড়ে গেলাম।পাড়ার কেউ বদমাইসি করে মজা করার জন্য ফ্লেক্সটা দরজার ওপরে টাঙিয়ে যায়নি তো? নিজের মনেই প্রশ্ন করলাম।
" একটু দরজাটা খুলবেন মাসিমা?" আমি বাইরে থেকে বলি।
একটু পরে দরজাটা খুলে গেল।ভীষণ রোগা, শ্যামবর্ণ, সাদা থান পরে মাথায় ঘোমটা দেওয়া প্রায় পঞ্চাশ বছর বয়সী এক মহিলা দরজাটি খুলে দু হাত দিয়ে দোর আগলে দাঁড়ালেন।
" কি ব্যাপার ছোকরা, ভরদুপুরে কি চাই? আমি কোনো সাবান, সেন্ট কিনতে পারবো না।"
" না না মাসিমা,আমি সেলসম্যান নই। মানে এই ফ্লেক্সটি কি আপনাদের বাড়িতে দেওয়া হয়েছে?" আমি দরজার ঠিক ওপরে আঙ্গুল দিয়ে দেখালাম।
" ও, ছাত্র।এসো।আরো দুজন ছাত্র সকালে ঘুরে গেছে।সাইকেল স্ট্যান্ড করে বারান্দার ডানদিকের ঘরে ঢুকে যাও।" উনি হাসি হাসি মুখে আদেশ দিলেন।
নির্দিষ্ট ঘরে ঢুকতে গিয়ে চৌকাঠে মাথা ঠুকল। প্রয়োন্ধকার ঘরটিতে এক সাদা দাড়িওয়ালা বয়স্ক লোক চেয়ারে বসে টেবিললাম্প  জ্বালিয়ে বই পড়ছেন।বইটিতে মলাট দেওয়া বলে কি বই বুঝতে পারলাম না।লোকটির সামনে রাখা টেবিলের ওপর অনেক মলাট দেওয়া বই ডাঁই করে রাখা।
" কি ব্যাপার? হুটহাট করে কাউকে জিজ্ঞাসা না করে ঘরে ঢুকে পড়ছো যে?" উনি বেশ রেগে বললেন।
" স্যার, আমি মহাপুরুষ হতে চাই।আমার সব বন্ধু বান্ধবরা ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বড়ো ব্যবসাদার হয়ে যাচ্ছে।আমাকে আপনি মহাপুরুষ হবার ট্রেনিং দিন।"
" ধীরে বৎস,ধীরে।সারা ভারতে আমরা এজেন্সি খুলেছি।ছাত্রদের বিভিন্ন জায়গা থেকে যোগ্যতা অনুসারে তুলে তারপর এক অজ্ঞাত জায়গায় ট্রেনিং হয়।একটা ফর্ম দিচ্ছি।আমাদের এখানে পাশ্চ্যাত্বের নিয়ম মেনে সিলেকশন করা হয়।তিনটি পয়েন্ট আছে।প্রথম, কেন তুমি মহাপুরুষ হতে চাও, দ্বিতীয় এযাবৎ তুমি এই জগতে তুমি কি কি মহান কাজ করেছ,আর পরিশেষে একজন যাকে তুমি গুরু বলে মান তার থেকে প্রশংসা পত্র।" এই বলে উনি আমার হাতে একটি দুপাতার ছাপানো কাগজ ধরিয়ে দিলেন।
" এটা দশ দিনের ভিতর জমা করে দিও।"  ভদ্রলোক বললেন।


       প্রথম প্রশ্নের উত্তর সোজা।কেন তুমি মহাপুরুষ হতে চাও? মহাপুরুষ হলেন সেই  ব্যক্তি যিনি নিজের সুখের কথা চিন্তা না করে অন্যের সুখের জন্য চিন্তা করেন এবং অন্যের মঙ্গল সাধন করেন ।আমিও নিজের সুখের ও মঙ্গলের কথা চিন্তা না করে সর্বদা অপরের সুখ ও মঙ্গলের কথা চিন্তা করতে চাই।কলিযুগে মহাপুরুষের বড় অভাব।আমি নিজে মহাপুরুষ হয়ে সেই অভাব পূরণ করে জগতের ভালো করতে চাই।লিখছি আর ভাবছি বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে গেল নাতো? বেশি ভালো ভালো কথা লিখে ফেললে না আবার ফর্মটা ছিঁড়ে ফেলে দেয়।
      দ্বিতীয় প্রশ্নে আমি ঠোক্কর খেলাম।আমার ভালো কাজের খতিয়ান দিতে হবে।আজপর্যন্ত সত্যি কি কিছু ভালো কাজ করেছি সেই নিয়েই সন্দেহ দেখা দিল।টিকিট কেটে ট্রেনে চড়েছি,চুরি ছিনতাই করিনি, পরীক্ষায় টুকলি করার সুবর্ণ সুযোগ পেয়েও করিনি এগুলো ছাড়া আমার আর ভালো কাজের খতিয়ান নেই।এগুলো যে সাধারণ কাজ যা সবাই এর করা উচিত এটা জেনেও আমাকে তাই লিখতে হলো।আমি আবার বানিয়ে লিখতেও ছাই পারি না।
       আসল সমস্যা এলো রেকমেন্ডেশন লেটার বা প্রশংসা পত্রে। কলেজের স্যারেরা আমাকে চেনেই না।কারণ এখন কলেজে যেতে হয় না।আজকাল খালি টিউশন গেলেই চলে।পুরোনো টিউশনের স্যারের সাথে দেখা করে প্রশংসাপত্র দিতে বলাতে উনি আকাশ থেকে পড়লেন।
" কিসে লাগবে রে? আমেরিকা পড়তে যাচ্ছিস নাকি?" 
" না স্যার।আমি মহাপুরুষ হতে চাই।তাই আমার মধ্যে মহাপুরুষ হবার কি কি গুন আপনি দেখেছেন সেটাই লিখে প্রশংসাপত্র দিতে হবে।" আমি আঙ্গুল কচলাতে কচলাতে বললাম।
স্যার মাথা ঘুরে পড়ে যাচ্ছিলেন।কোনো রকমে ধরে মাটিতে বসালাম।উনি মাটিতেই সটাং শুয়ে পড়ে চোখ উলটে ফেললেন।চোখে মুখে জলের ছিটা দেবার বেশ কিছুক্ষণ পর ঘোলাটে চোখে চেয়ে বললেন" আমি কোথায়,আমি কোথায়?" আমাকে সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চমকে উঠে  বললেন " তুই এখন চলে যা।পরশু আসিস।"
     স্যারের জন্য একঠোঙা জিলিপি নিয়ে নির্দিষ্ট দিনে ওনার বাসায় হাজির হলাম ।দেখি স্যার বিরাট ব্যাচে পড়াচ্ছেন।মেয়েরা খচখচ করে মাটিতে বসে নোট নিচ্ছে আর ছেলেরা ভাবুক দৃষ্টিতে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে, খুনসুটি করছে।।স্যারের দিকে ঠোঙাহাতে তাকাতেই  স্যার চমকে উঠলেন।
" আরে ,আমি ভীষণ ব্যস্ত।লিখে উঠতে পারিনি।অন্যদিন আয়।" উনি বললেন।আমিও জিলিপির ঠোঙা হাতে নিয়ে ফিরে এলাম।
রাস্তায় নিতাইদার সাথে দেখা হয়ে গেল।জিজ্ঞাসা করলো " কিরে মুখ শুকনো করে কোথায় যাচ্ছিস?" 
নিতাইদা আমাদের এই পাড়াগাঁয়ের কেউকেটা লোক।পঞ্চায়েতের প্রধান।একশো দিনের কাজে আশিজনের নাম দিয়ে চল্লিশজনকে দিয়ে কাজ করিয়ে দাদা বেশ টুপাইস করেছে।তিনতলা বাড়ি।গোটা চারেক বাইক।দাদার চেলাচামুন্ডা অনেক।বালির কারবারও আজকাল শুরু করেছে।মনে অনেক দ্বিধা নিয়েও জিলিপির ঠোঙাটা নিতাইদার হাতে ধরিয়ে দিয়ে  বললাম
 " দাদা আমাকে একটা প্রশংসাপত্র দেবে?"
"আরে আমি তো সিক্স ফেল রে। বিএ পাস কে কি প্রশংসাপত্র দেব? আমার প্যাডের একটা কাগজ তোকে দিয়ে দেব, তুই ওতে লিখে নিয়ে আসিস আমি সাইন করে স্ট্যাম্প মেরে দেব।আর শোন।তোর তো এখন সাইকেলে করে মেয়েদের কলেজের সামনে ঘোরা ছাড়া আর কোনো কাজ নেই।সব খবর রাখি।আমার বালি ব্যবসায় কিছু লেবার লাগবে।তুই কাজটা করতে পারিস।ভেবে দেখিস।"
" দাদা,আমি মহাপুরুষ হতে যাচ্ছি।ওই লেবারের কাজ আমার জন্য নয়।"আমি একটু মিনমিন করে বলি।
" কি পুরুষ?এই সব পুরুষ,নারী নিয়ে কি কাজকারবার করছিস বলতো? তোর ভাবগতিক তো ভালো ঠেকছে না।নাঃ তোর একটা বন্দোবস্ত করতে হবে দেখছি।" নিতাইদা বাইকে স্টার্ট দিয়ে চলে গেল।আমি হতভম্ব হয়ে রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে রইলাম।

" ভবিষ্যতের মহাপুরুষ হবার সব গুণই ওর মধ্যে বিদ্যমান।শুধু মহাপুরুষ কেন আধ্যাত্মিক পুরুষ হিসেবেও ওকে আমি যোগ্য মনে করি।ও নিজেকে আশা আকাঙ্খা থেকে মুক্ত করেছে।ওর বড় হবার , চাকরিবাকরি করে সংসারী হবার বাসনাই নেই।জাগতিক বন্ধন ওর মুক্তির পথ আটকাতে পারবে না।জগৎসংসারের সুখ ও কল্যানসাধনের জন্য ওর মহাপুরুষ হবার যাত্রা যেন সাফল্যমন্ডিত হয় এই কামনা করি।"
প্রশংসাপত্রের লেখাটা দেখে নিতাইদা প্রথমে পড়ার চেষ্টা করে বিফলমনোরথ হলো।কিন্তু সেটা মুখে প্রকাশ করা শোভনীয় নয় বুঝে বললো " বেড়ে লিখেছিস তো।যাক নিচে সাইন করে দিচ্ছি।একটা গরিব ছেলের যদি উপকার হয় তো ভালো।আমি ডিসেম্বর মাসে গরিবভোজন করাবো।তোর বাবাকে বলিস গরিবভোজনের চালটা দিতে।"
ফর্ম আর প্রশংসাপত্র আমি জমা দিয়ে দিলাম।শুনলাম রেজাল্ট আসতে মাসখানেক অপেক্ষা করতে হবে। বিভিন্ন জেলা থেকে ছাত্র নিয়ে তারপর ট্রেনিং শুরু হবে।আমি মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে প্রাথমিক কাজগুলো শুরু করলাম।
রোজ ভোরবেলায় ধ্যান করে, সূর্যপ্রনাম সেরে জোর কদমে পাড়ার ফুটবল মাঠটাকে গুনে গুনে দশ চক্কর দৌড়োন শুরু হলো।তার সাথে সাত্ত্বিক আহার আর ভগবৎ গীতা পাঠ মন দিলাম।বাড়িতে কান্নার রোল পড়ে গেলো।ছেলে সংসার ধর্ম ত্যাগ করে মানবকল্যাণে জীবন উৎসর্গিত করতে চলেছে শুনে মা -মাসীরা কেঁদে কেঁদে শরীর খারাপ করে ফেললো।কেবল বাবা বললো "ন্যাকামি হচ্ছে।চাপকে সব সিধে করে দিতে হয়।"
প্রায় মাস দেড়েক পর বাড়িতে একটি চিঠি এলো।প্রেরকের ঠিকানা ঋষিকেশ।মহাপুরুষ বানানোর আদর্শ জায়গাই বটে।ডিসেম্বরের  এক তারিখে নির্দিষ্ট ঠিকানায় যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে।
মায়ের দেওয়া হাতেবোনা গোটা দুয়েক সোয়েটার, বাঁদর টুপি, মাফলার, আর গোটা তিনেক জামাপান্ট নিয়ে আমি যখন দুন এক্সপ্রেসে চড়ে বসলাম তখন দুচোখে মানবকল্যানের স্বপ্ন।শীতে কাঁপতে কাঁপতে  ঋষিকেশে হাজির হয়ে দেখি আমার বয়সী বেশ কয়েকটি ছেলে সেখানে মহাপুরুষ হবার স্বপ্ন নিয়ে হাজির হয়েছে।একটি ছেলেকে খুব চেনা চেনা লাগলো।সেও যেন আমাকে চিনতে পেরেছে।
" ভাই তোকে কেমন চেনা চেনা লাগছে।" আমি বললাম।
" আরে আমি ভোঁদড়, তুই ভুলে গেলি।সেই যে ক্লাস টুতে আমি ক্লাসে ইয়ে করে ফেলেছিলাম।এবার মনে পড়েছে?"ভোঁদড় হেসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো।
" ওহ তোকে পেয়ে যেন বাঁচলাম।এখানে কোনো চেনা মুখ দেখতে পাচ্ছি না।অবশ্য মহাপুরুষ হবার পথে চেনাশোনা লোক না পাওয়াই ভালো।এ পথে একলাই যেতে হয়।নাহলে মন আবেগপ্রবণ হয়ে পড়বে।" আমি বেশ গম্ভীর হয়ে বললাম। জিজ্ঞাসা করলাম
" হাঁরে, তুইও কি আমার মতো মহাপুরুষ হতে এসেছিস?"
ভোঁদড় ওর পানপরাগ খাওয়া কালো মাড়ি আর হলদেটে দাঁত বার করে বললো " সেভেন ফেলের পর কলকাতায় মামার বাড়ি চলে এলাম।কিন্তু কিসসু হোলো না।ভাবলাম এই ট্রেনিং টা নিয়ে রাখি।আজকাল তো বাবা টাবাদের জমানা।কখন কোন বিদ্যেটা কাজে লেগে যায় কে জানে।"
" আমি কিন্তু সিরিয়াসলি শিখে মহাপুরুষ হতে চাই।আজকাল সব জিনিসে প্রফেশনাল হতে হয়।ঠিকঠাক ট্রেনিং নিয়ে আমি কাজে নেমে পড়লে আশা করি খাবার অভাব থাকবে না।শিষ্যটিস্য তো দেদার হবে।।ভাগ্য ভালো থাকলে শহরের বাইরে শিষ্যের দেওয়া জমিতে আশ্রমও তৈরি হয়ে যাবে খন।" স্বপ্ন দেখি আর ভোঁদড়কে দেখাই।

        লছমনঝুলা পেরিয়ে ডান দিকে একটু ঢালু রাস্তা দিয়ে  গঙ্গার পাড়ের দিকে নেমে একটা দোতলা বাড়িতে আমাদের প্রথম মিটিং।উত্তেজনায় আমার বুক ধড়পড় করছে।আমার আর ভোঁদড়ের মতো গোটা কুড়ি ছেলে জড়ো হয়েছে।বিহার, ঝাড়খন্ড, উত্তরপ্রদেশ আর পশ্চিমবাংলা থেকেই অধিকাংশ ছেলেরা এসেছে।মহাপুরুষ হবার জন্য লোকের এত উৎসাহ দেখে মনটা আনন্দে ভরে উঠল।এই পোড়া দেশের আধ্যাত্মিক ও নৈতিক উন্নতি এখন খালি সময়ের অপেক্ষা।দলে দলে মহাপুরুষ বেরিয়ে যখন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়বে তখন দেশে একটা পরিবর্তনের জোয়ার আসবে।কে না জানে পরিবর্তনই জগতের একমাত্র সত্য।এই পরিবর্তিত দেশ যে আবার জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসন নেবে সে ব্যাপারে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ রইলো না।
      পবিত্র গঙ্গা আমাদের ছোট্ট ঘরটির প্রায় গা দিয়ে বয়ে চলেছে। ঘরটিতে একটি টেবিল চেয়ার আর গোটা সাতেক বেঞ্চ রাখা আছে।স্যাঁতস্যাঁতে ঘরটিতে জ্বলা একমাত্র টিউবলাইট যেন ঘরটির অন্ধকার দূর করতে অক্ষম।অবশ্য ঘরের অন্ধকার দূর না হলেও যদি ওদের শিক্ষায় মনের অন্ধকার দূর হয় তাহলেই শিক্ষা সম্পূর্ণ হবে।মহাপুরুষ তৈরির এক আদর্শ পরিবেশ।বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর কোট, প্যান্ট আর লাল টাই পরা একটি লোক হাতে একটি বড় চটের ভর্তি থলি নিয়ে আমাদের ঘরে প্রবেশ করলেন।ওনার হাতে একটি কাগজে আমাদের সবাইয়ের নাম, ঠিকানা লেখা আছে।রীতিমতো রোলকল করে আমাদের ক্লাস শুরু হলো।
      কোট প্যান্ট টাই পরা আমাদের প্রথম শিক্ষক হিন্দিতে নিজের নাম বলে থলিটি থেকে কিছু প্যাকেট বার করে টেবিলে সাজিয়ে রাখতে লাগলেন।মহাপুরুষ পাঠের প্রথম প্রাক্টিক্যাল ক্লাস।নিশ্চয়ই সাত্ত্বিক মন নির্মলকারী আহার সামগ্রীর ওপর বক্তৃতা হবে।আমরা অধীর আগ্রহে ওনার পানে চেয়ে আছি।প্যাকেট সাজানো হয়ে গেলে এবার  ভদ্রলোক বলা শুরু করলেন।
" হিমালয়ের অনেক উঁচুতে অবস্থিত গাছগাছড়ার থেকে আমাদের কোম্পানি এক মহা শক্তিশালী ওষুধ আবিষ্কার করেছে।পুরুসত্ত্বহীনতায় যারা ভুগছে এবং সেই জন্য যাদের সংসারে অশান্তি সৃষ্টি হচ্ছে তাদের আবার পুরুসত্ত্ব ফিরিয়ে দেবার ওষুধ এই প্যাকেটে আছে।এই ওষুধই 'মহাপুরুষ'।সাধারণ পুরুষকে পুরুষশ্রেষ্ট তৈরি করাই আমাদের ওষুধের কাজ।তোমাদের এই 'মহাপুরুষ' বিক্রি করতে সারা দেশের ট্রেনে, বাসে ছড়িয়ে পড়তে হবে।আর গুণগান গেয়ে যা বিক্রি হবে তার চল্লিশ পার্সেন্ট তোমাদের।"
এখন আমি বনগাঁ লোকালে " মহাপুরুষ " বিক্রি করি।

mukhopadhyayjaydip@ymail.com
কলকাতা





No comments:

Post a Comment