1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Tuesday, January 26, 2021

অনাদিবাবুর বিপদ

 

ছবি  : ইন্টারনেট 

অনাদিবাবুর বিপদ
 অভিষেক ঘোষ 
         যেন একটা রূপোলি রেখা বুকে নিয়ে সন্ধ্যার আকাশে চাঁদটা ঝিমোচ্ছিল । নৌকার দাঁড় টানতে টানতে তারাপদ দেখছিল, কেমনভাবে মেঘগুলো চাঁদটার সাথে ছেনালি জুড়েছে । মতি গতি ভালো নয় প্রকৃতির, যে কোনো সময় ফের আকাশ কালো করে বৃষ্টি নামতে পারে । ওই শালা চাঁদটাকে ভরসা নেই তার । সে চাইছিল অনাদি বাবুকে দ্রুত বাসায় পৌঁছে দিতে ! অন্তত ওর দিকে চেয়ে বসে থেকে অনাদিবাবু এগুলিই পর্যবেক্ষণ করেন । অবশ্য চারপাশে এই মৃদু আলোয় আর দেখারও নেই কিছু । মেলাই ছোঁকছোঁক বাতিক এই অনাদিবাবু লোকটার । তাই এই গ্রামে-গঞ্জে এসেও ওই ছিটেফোঁটা ঘর-বারান্দা ঝাড়-পোঁছ আর বাসন মাজা, জল আনার জন্য, একটা ভালো ঠিকে ঝি ও টিকছে না ! তা টিকবেই বা কি করে ! ঘর মোছার সময় ওর'ম ড্যাবড্যাব করে মেয়ে-মানুষের বুকের দিকে তাকিয়ে থাকলে, কেই বা কাজ করতে চাইবে ? কিন্তু তা বলে নিজের ভাইঝির আপন ননদ, একথা জেনেও যে তিনি ভদ্রলোক হয়ে অন্ধকারে মেয়েটার হাত ধরে টানাটানি করবেন, এতটা বাড়াবাড়ি তাঁর বাড়ির লোকও বোধহয় আশা করে নি । সেই ঘটনার পর থেকেই তিনি এই জলে-জঙ্গলের প্রবাসে বন্দী । বাড়ির সাথে আর কোনো যোগাযোগ নেই তাঁর । তিনি এই এলাকায় এসেছেন পোস্টমাস্টারের চাকুরি নিয়ে, এলাকার একমাত্র পোস্ট অফিসটিতে, তাও প্রায় ছয় মাস হতে চললো । এখানে তাঁর বাসস্থানে সকাল-বিকেল দুবেলা কাজের জন্য প্রায় ছটা-সাতটা মেয়েকে জুটিয়েও রাখা গেল না তাঁর ওই হারামিপনার জন্য । এদিকে উপায়ও নেই তারাপদর । চাইলেই একশো-দুশো টাকা এক অনাদি বাবু ছাড়া কেই-বা এ তল্লাটে তাকে ধার দেবে ! তাই এখন পেটের দায়ে ও নেশার টানে, অনাদি বাবু-কে সে একেবারে তার নিজের ঘরে নিয়ে গিয়ে ঢুকিয়েছে ।
"বাবুর কি ভগবানের ভয় ও নেই ?" - লুঙ্গির গেঁজে খুলে বিড়ি বের করে বলে ওঠে তারাপদ ।
"বাল ! ভয় নয়, বিশ্বাস নেই ।" - অনাদি বাবু মুখে চালাক-চালাক একটা হাসি টেনে এনে বলেন ।
"বাবু ভগবান কিন্তু আছে... সব পাপের একদিন বিচার হয় ।"
"থাকা ভালো । নয় তো সব গোলমাল হয়ে যাবে, এটা মানি ।"
"মাথায় কিছু ঢোকে না বাবু আপনার এসব কথা !"
"ওরে বোকাচোঁদা ! ভগবান বলে যদি কোনো কিছু না থাকে, তাহলে তোর মতো মর্কট ও আমার মতো চালবাজ, সব শালাই হারামি হয়ে যাবে । কিছু একটা ওই ওপরে আছে বলে এখনও ভাবিস বলেই হয়তো মানুষ এখনও মানুষ আছে ।"
"বাবু আমাদের তো উনিই ভরসা !"
"তোর খিদে পেলে পেটের ভাত কি তিনি দেন ?"
"কি যে বলেন !"
"তাহলে ?"
"কিন্তু বাবু মনে একটা জোর পাই, এ আপনাকে মানতেই হবে !"
"মনে জোর পাস্ ? তা পাস হয়তো... কিন্তু ওখানে জোর পাস কি ?" - বলে লুঙ্গির মধ্যে গোপন একটি অস্বস্তিকর জায়গার প্রতি ইঙ্গিত করে হাসতে থাকেন অনাদি বাবু ।

অনাদি বাবুর মনে হয়, তারাপদ তীব্র বিরক্তিতে গুটিয়ে যায় ভিতরে ভিতরে । তারপর অনেকক্ষণ থেমে বলে, "বাবু আপনি কি ভূতেও বিশ্বাস করেন না ?"
অনাদি বাবু রহস্যময় ভঙ্গিতে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকেন তারাপদর দিকে । তাঁর বাড়ি পৌঁছাতে এখনও ঢের দেরি আছে । এভাবেই নদীর ধার ঘেঁষে মাঝেমাঝে তিনি অভিসারে যান । জীবনে অনেক অপ্রত্যাশিত মুহূর্তের সাক্ষী হয়েছেন তিনি । কিন্তু এই মদখোর লোকটা যে এই জল-জঙ্গলের দেশে তাঁকে একেবারে নিজের বউয়ের বিছানায় নিয়ে যাবে, এ একেবারে অপ্রত্যাশিত ও বিস্ময়কর অভিজ্ঞতা তাঁর কাছে । শালা লোকে পয়সার জন্য কি না করে ! খিদে শালা সত্যিই অনন্ত ! এই নাকি মানুষের সমাজ ? শালা মদের টাকার জন্য বউকে বেচে দিয়ে বলে কিনা ভগবানে বিশ্বাস করে ! শালা ভূত একটা ।

"ভূতে বিশ্বাস করতাম না ! কিন্তু গত এক সপ্তাহ ধরে তাও করছি ।" - অনাদি বাবু গলায় গাম্ভীর্য এনে বলেন ।

"বলেন কি বাবু ! কী এমন ঘটলো ?"
"এই রাতবিরেতেই শুনবি ! শুনলে তোর হার্ট ফেল হয়ে যাবে ।"

অন্ধকার জলে মৃদু ছপছপ-কলকল শব্দ আর ঝিঁঝিপোকা-ব্যাঙের ডাক যে একঘেঁয়ে আচ্ছন্নতা তৈরি করে, তা সশব্দে ভেঙে দিয়ে সহসা হেসে ওঠে তারাপদ । "কি যে বলেন বাবু ! আমাদের আবার রাতবিরেতের ভয় ? এই জলে-জঙ্গলেই জন্ম থেকে মানুষ আমরা ।"

একটু চমকে গেলেও সামলে নিয়ে অনাদি বাবু হালকা চালে বলেন, "অতসী মরে গিয়েছে জানিস তো ? সেই যে যে মেয়েটা আমায় প্রপোজ করেছিল ?"
"ও ওই বাগদি পাড়ায় ঝি-টা বাবু ?"
"হ্যাঁ ।"
"বাবু ও তো খুন হয়েছিল !"
"আরে জানি । তোর মতোই ওর বরটাও হাতে টাকা পেলেই বেদম মাল টানতো কি-না ! আর তারপর সেই বউকে পেটানো... রোজকার নাটক বাঁড়া । তারপর সে মরে পড়ে থাকলেও ডোন্ট কেয়ার ।"
"আপনারা শহর থেকে এসেছেন বাবু । এসব আপনারা বুঝবেন না ! আমরা কেন মাল টানি !"

"বুঝে আমার কাজ নেই... তা ওই অতসী তো আমায় হেব্বি ইয়ে করতো । মানে একদিন তো আমায় এ কথাও বলেছিল যে, ছেলেপুলে না থাকলে, আমি বললেই নাকি আমার সাথে যে কোনো দিন চলে যেত ।"

"বাবু অপঘাতে মরেছে মেয়েটা ! তাকে নিয়েও আপনি মশকরা করছেন !" - তারাপদ থেমে থেমে বলে ।

"ধুর ! সত্যি কথাই বলছি । শোন্ রে ব্যাটা... একদিন্ ডিরেক্ট আমায় বুকে টেনে নিয়েছিল ।" - এটুুকু বলেই সংযত হয়ে অনাদি বাবু গম্ভীর হয়ে বলেন, "মেয়েটা খুব পাংচুয়াল ছিল রে ! একেবারে টাইমে আসতো । একদিনও কামাই নেই । ঘর মুছতো পরিষ্কার করে । আমার শালা এর'ম একটা বউয়ের দরকার ছিল !"

"হবে বাবু হবে... বেঁচে থাকলে সব হবে ।"
"ধুর্ শালা ! তারপর শোন্ । গত সপ্তায় বেলা দশটা নাগাদ সবে পোস্ট অফিসে যাবো বলে বেরিয়েছি, দেখি মাগী এসে হাজির ! আমার তো তখন দেখেই বুক ধরফর্ করছে । কোনো মতে বললাম, ত্ ত্ তুমি ? উত্তর দিলে, আপনার কাজ কি ফেলে রাখা যায় বাবু ? জীবন থাক্, আর নাই থাক্ ! আমি ছাড়া আপনার কেই বা আছে ?"

তারাপদ জুলজুল করে তাঁর দিকেই চেয়ে আছে দেখে আবার বলে ওঠেন অনাদি বাবু, "মেয়েটার যা বুক ছিল না শালা কী বলবো ! যাই হোক্ তারপর থেকে রোজ্ সকালে বিকেলে সে আসে ! বাসন মাজে, ঘর মোছে, এমন কি আমার সাথে গল্পও করে বুঝলি ? কিন্তু অনেক সময়েই কেবল ওই চুড়ির শব্দ বা, পায়ের শব্দটুকুই পাই... তাকে দেখতে তো পাই না ! কেমন ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ ! কিন্তু গতকাল রাতেই যে... "

"গতকাল রাতে কি হয়েছিল বাবু ?"
"ভাবলে এখনও আমার গায়ে কাঁটা দিচ্ছে । আমি সামান্য একজন পোস্ট মাস্টার । ক্ষমতা থাকলে ওই মেয়েকে আমি মরতে দিতাম না ! কিন্তু আমার কি দোষ ! অতসী গতরাতে এসেছিলো একেবারে ঠিক্ সময়ে । আমি খাটে মশারির মধ্যে একেবারে কুঁকড়ে বসে আছি আর ভাবছি, কতক্ষণে এই আপদ যাবে ! মাঝেমাঝেই টুংটাং চুড়ির শব্দ আর বাসন বা, ন্যাতা বোলানো, বালতি টানার শব্দ শুনতে পাচ্ছি না ! কিন্ত তাকে দেখতে তো পাচ্ছি না ! তারপর সাড়ে সাতটা বাজতেই বললো, বাবু আজ আসি তাহলে !"

তারাপদ মুচকি মচকি হাসছিল । অন্ধকারে তার মুখ ভালো করে দেখতে না পেলেও চাঁদের অল্প আলোয় সেটুকু বুঝেছিলেন অনাদি বাবু । কিন্তু একরোখা ভঙ্গিতে বলে চলেন, "তো আমি বললাম, আচ্ছা এসো ! বলে সবে বিছানা থেকে নীচে নামতে যাবো, মনে হল ঠান্ডা একটা হাত আমার হাঁটু ছুঁলো ! তারপর আরেকটা হাত আমার বুকে ঘুরে বেড়াতে লাগলো ! আমার তখন গলা দিয়ে কথা বেরুচ্ছে না । তাও বললাম, ত্ তুমি ক্ কি চাও ? অতসী বললো, তোমাকে ! আমি বললাম, কেন আমি ত্ তোমার কী ক্ষতি করেছি ? সে বললে, উপকারও তো কিছু করো নি... ব্যাস্ বলেই সোজা আমার গলাটা টিপে ধরলো ! উরিশ্লা ! কী গায়ের জোর মাইরি !"

তারাপদ বিদ্রুপের চাবুক হেনে বলে উঠলো, "বাবু তাহলে আপনি এখন বেঁচে আছেন না মরে গেছেন ?"

অনাদি বাবু বেপরোয়া ভঙ্গিতে বলে উঠলেন, "তোর ঘাড় মটকাবো রে শালা... দ্যাখ এবার ।" এ কথা শুনেই তারাপদ রাতের নিস্তব্ধতা খানখান করে অট্টহাস্য করে উঠলো... তারপর বললো, "বাবু চেয়ে দেখেন একবার, আপনার ফেরার আর কোনো পথ নেই ।"

একথায় সচকিত হয়ে উঠে অনাদি বাবু দেখলেন, সত্যিই তো... তাঁর নৌকোটা তো কোনভাবেই স্থলভাগের কাছাকাছি নেই ! কিন্তু এ কী করে সম্ভব ! এই পথ যে তাঁর চেনা । নিয়মিত এই পথেই যে তিনি যাতায়াত করেন । তারাপদর সঙ্গে অতটা নিয়মিত সখ্য না হলেও তাঁর লোকটাকে বোকাসোকাই মনে হত বরাবর ! তার ওপর আজ এমন করছেই বা কেন সে ? সহজ সাদাসিধে মানুষটা হঠাৎ এমন বদলে গেল কী করে ?
তারাপদ এবার দাঁড়দুটো জলে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে উঠে দাঁড়ায়... অনাদি বাবুর অস্বাভাবিক লম্বা মনে হয় তাকে ! শরীরটা যেন বেঁকে ভীতিপ্রদভাবে তাঁর মুখের উপরে ঝুঁকে পড়তে চাইছে... হাতদুটো যেন তাঁর গলা টিপে দেবে বলে এগিয়ে আসতে ছটফটাচ্ছে ! মনে পড়ে যায় তাঁর, আজ ওর বউটার সাথে শোয়ার পর তিনি বহুক্ষণ ওর ঘরেই ঘুমিয়ে ছিলেন ! তারপর নিজেই উঠে পড়েন... ততক্ষণে সন্ধ্যে নেমেছে । ওর বউটা কাঁদছিল ! কেন কাঁদছিল, জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন মনে করেন নি তিনি ! ওর কাঁদাই স্বাভাবিক নয় কি ? কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, আজকের সন্ধ্যার কান্নাটা একটু বাড়াবাড়ি রকমের চাপা ও বুক ফাটা ছিল । তিনি ঘুম চোখের আলস্যে তা খেয়াল করেন নি ।

এই সময় তারাপদ যেন সুতীব্র বেদনায় বলে ওঠে, "একটু যদি পাশের ঘরে তাকাতেন তখন বাবু, দেখতেন আমার লাশটা উপরের কড়ি কাঠ থেকে ঝুলছে ! পাড়া প্রতিবেশী ও আসছিলো একে একে । কিন্তু আপনার তখন তৃপ্তির ঘুম ভাঙা চোখে আর মাথায় এসব ঢোকে নি । কিন্তু চিন্তা করবেন না বাবু... আজ দিনটা ভালো... আপনার সমস্ত ছটফটানি আজ থামিয়ে দেবো । খিদের জ্বালায় বউটাকে বেচছিলাম... কিন্তু আর পারলাম না ! রাতের পর রাত ঘুমোতে পারি নি বাবু । কিন্তু আর কোনো চিন্তা নেই... আমারও না ! আর আপনার ও কোনো ভাবনা থাকবে না আজকের পর ! বাবু আপনিই যে থাকবেন না ! আপনার অনন্ত খিদে ও থাকবে না !"

অনাদি বাবু ক্ষিপ্ত হয়ে গোটা কয়েক বিশ্রী গালাগালি দিয়ে বলে ওঠেন, "চুপ শালা ! আমার সাথে এই রাতের অন্ধকারে মাজাকি হচ্ছে ? ভূত সাজা হচ্ছে শালা ? মেরে তোর চামড়া গুটিয়ে দেবো ।"

"মাজাকি তো আপনারা করেন বাবু ! আমাদের নিয়ে... আমাদের খিদের সুযোগ নিয়ে... মেয়ে বউ নিয়ে... মরা অতসী ও আপনার মাজাকি থেকে রেহাই পায় না ! কিন্তু আজ আমি একটু করবো... মাজাকি !"

"আ.. আমি কিন্তু জলে ঝাঁপ দেবো এই বলে দিচ্ছি... !"

"দিন্ বাবু… দিন্ ঝাঁপ দিন্... আমি ও দেখি আপনার কেরামতি!"

অনাদি বাবু যেন বাক্শক্তিরহিত হয়ে গেলেন এই দেখে যে, তাঁর কাছে সর্বক্ষণ হাত পেতে থাকা তারাপদ আজ খুনীর বিভীষিকা নিয়ে ধীরে তাঁর দিকে এগিয়ে আসছে... নিশ্চিত মৃত্যুর পরোয়ানা তার দু চোখে । হ্যাঁ এখন তিনি ওর চোখদুটো দেখতে পাচ্ছেন বই কি ! এমন ঘোলাটে অন্ধকার চোখ কোনো মানুষের হতে পারে না... যেন কাদা জলের আবর্ত ওই দুটো চোখে... যেন বাদা বনের কুয়াশা-মাখা মধ্যরাতের অন্ধকার । সুনিশ্চিত মৃত্যু !

তারাপদর অশরীরী শরীরটা ধীরে ধীরে উঠে আসে অনাদি বাবুর দেহের উপর । তিনি কাত হয়ে নৌকার ছইয়ের উপর পড়ে যান্... তাঁর বাম হাতে অসম্ভব বেদনা অনুভব করেন । পাটাতনের কোণ ঘেঁষে তাঁর মাথাটা হেলে পড়ে একপাশের জলে । চাঁদের আলোর নীচে অনাদি বাবু প্রত্যক্ষ করেন এক আদিম অনন্ত অন্ধকার... দ্রুত এক কঠোর শাস্তি হয়ে তাঁর বুকের উপরে নেমে আসতে যা উদ্যত ।
abhisek1988ghosh@gmail.com
কলকাতা


No comments:

Post a Comment