1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Tuesday, January 26, 2021

হরির লুট

 

ছবি  : ইন্টারনেট 

হরির লুট 
উত্তম চক্রবর্তী
        আজ ওদের কি বলে বিদায় করবে, সকাল থেকেই রণ সেই চিন্তায় শান্তিতে কোথাও বসতে পারছিল না। চা খেয়ে পেপারটাও পড়তে পারছিল না মন দিয়ে। এখন লক ডাউন চলছে। রাস্তায় বের হলেই পুলিশের লাঠির তাড়া খেতে হচ্ছে। সেই মার্চের তেইশ তারিখ শুরু হয়ে প্রায় দুমাস হয়ে গেল, দোকান, বাজার সিনেমা হল, ট্রেন বাস সব বন্ধ। এমনকি রাজনৈতিক বা ধর্মীয় সমাবেশ পর্যন্ত নিষেধ। মন্দির মসজিদ সব বন্ধ করে দিয়েছে সরকার। চারিদিকে কল কারখানা, শপিং মল সব বন্ধ। প্রচুর লোকের চাকরি চলে গেছে, হয় কোম্পানি বন্ধ হয়ে গেছে নয়তো মালিক ছাড়িয়ে দিয়েছে। বাজারে শাক সবজির দাম বেঁড়ে আকাশ ছোঁয়া হয়ে যাওয়ায় মানুষ হাহাকার করছে। ইনকাম বন্ধ, কিন্তু খরচ বেঁড়ে যাওয়ায় অবস্থা খুবই খারাপ।  

রণ পরেছে আরও মুশকিলে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মিছিলে লোক জড় করে নিয়ে যাওয়া, রাজনৈতিক নেতাদের মিটিঙে ভিড় বাড়ানো, ধর্মীয় সভায় মানুষের ঢল নামিয়ে দেওয়ার মত লোক জড় করা, ফিল্ম বা ক্রীড়া জগতের স্টারদের দিয়ে দোকান উদ্বোধনে ভিড় জমায়েত করা, কোন দল ধর্মঘট ডাকলে রাস্তায় রাস্তায় টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ দেখানোর মানুষ জড় করা কিংবা সিনেমার শুটিঙে দলে দলে মানুষের ভিড় দেখানোর সিনে লোক জড় করা, এই সব রকমের কাজের মানুষ সাপ্লাইয়ের কাজ করে রণ। এতো লোক ও পায় কোথায় ? আসলে রণ থাকে টিটাগড় ও খড়দার মাঝি মাঝি পি কে বিশ্বাস রোড এলাকায়। এখানে আসে পাশে প্রচুর মানুষ বেকার হয়ে বসে আছে বেশ কয়েক বছর যাবত।

এই অঞ্চলের সব কটা জুটমিল বন্ধ, কারখানা বন্ধ, সিনেমা হল বন্ধ আজ বেশ কয়েক বছর যাবত। স্বাভাবিক ভাবেই আসে পাশের বস্তির গরীব মানুষ গুলি রণর মত বুদ্ধিমান শিক্ষিত যুবকের রোজগারের হাতছানিতে সহজেই এগিয়ে এসেছে। আর তাদের দেখাদেখি ব্যারাকপুর পলতা বা এদিকে সোদপুর আগর পাড়ার গরীব মানুষ গুলিও এসে যোগ দিয়েছে রণর এই মানুষ সাপ্লাইয়ের অসংগঠিত সংগঠনে। কলকাতার এমন কোন রাজনৈতিক নেতা বা ফিল্ম প্রডিউসার নেই যে রণকে চেনে না।

রণ বিভিন্ন সমাবেশের জন্য বিভিন্ন ধরনের টাকা পায়। যেমন রাজনৈতিক জমায়েতে লোক পাঠালে মাথা পিছু দুশো টাকা ও খাওয়া দাওয়া, ধর্মীয় সমাবেশে মাথা পিছু তিনশ টাকা ও খাওয়া দাওয়া, ফিল্মের শুটিং হলে শুধু মাথা পিছু পাঁচশো টাকা, রাজনৈতিক দলের সমাবেশে বিপরীত পক্ষেরও একই দিনে লোক দরকার হলে সেই দুশো টাকা হয়ে যায় তিনশ টাকা এবং সবচেয়ে বেশি টাকা পাওয়া যায় ধর্মঘটের দিন বিক্ষোভ কর্মসূচীতে লোক এনে জোর করে রাস্তা অবরোধ করাতে পাড়লে। তখন মাথা পিছু আট’শ থেকে হাজার টাকা পর্যন্ত পাওয়া যায় কখনো কখনো। দোকানের উদ্বোধনে বা নেতাদের মিটিঙে লোক জড় করলে মাথা পিছু দুশো থেকে চারশো টাকা পর্যন্ত পাওয়া যায়। টাকা হাওয়ায় ওড়ে, রণ সেটা ধরতে জানে।

রণ কিন্তু সাধারণত ওর দলের লোকদের দেড়শ দুশো টাকার বেশি দেয়না। শুধু ধর্মঘটের দিন রাস্তায় লোক জমাতে গিয়ে ওর মাথা পিছু চার থেকে পাঁচশ টাকা পর্যন্ত খরচ হয়ে যায়। কারণ এই কাজটায় রিস্ক বেশি। পুলিশের লাঠির বাড়ি শুধু না, টিয়ার গ্যাস, জল কামান আবার গুলি পর্যন্ত চলতে পারে সেখানে। তাই এসব কাজে সবাই যেতে চায়না। কিন্তু যারা যায় তাদের রণ ভাল টাকাই দেয় সবাই সেটা জানে।

কিন্তু এই লক ডাউনে সমস্ত কিছু বন্ধ হয়ে যাওয়ায় রণ পড়েছে মুশকিলে। না হচ্ছে কোন রাজনৈতিক মিছিল বা মিটিং, না ধর্মীয় সমাবেশ, না দোকানের উদ্বোধন বা ফিল্মের শুটিং। আসে পাশে থাকে যারা তারা প্রায় রোজই এসে কাজের খবর চায়। রণ কোন জবাব দিতে পারে না। রণর দলের এই মানুষগুলি কারখানা বা ফ্যাক্টরি বন্ধ হয়ে যাবার পর থেকে কেউ রিক্সা চালায়, কেউ বাজারে সবজি বেঁচে, কেউ রাস্তার ধারে চায়ের দোকান বা সাইকেল সারাবার ও স্টেশনের কাছে সাইকেল জমা রাখবার কাজ করে কোনমতে দিন চালায়। এছাড়া রণ ডাকলেই এসে হাজির হয় অতিরিক্ত রোজগারের আসায়।

লক ডাউন হবার মাস খানেক বাদেই অন্য প্রদেশে যারা চাকরি বা ব্যবসা করে সংসার চালাচ্ছিল, তারাও দেশে নিজের ঘরে ফিরে আসবার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। এমনকি এখন তো কাতারে কাতারে মানুষ রাস্তা দিয়ে বা রেল লাইন ধরে দেশে নিজের বাড়িতে ফিরবার জন্য বৌ ছেলে মেয়ে নিয়ে বেড়িয়ে পড়েছে। ব্যারাকপুর বেল্টের কয়েকশ পরিযায়ী মানুষ ফিরে এসেছে যে যেখানে ছিল সেখান থেকে। রণর দলে এসে ভিড়েছে এদের মধ্যে অনেকেই। কিন্তু রণর হাতেই বা কাজ কই ? এই মানুষগুলির অবস্থা এখন না ঘরকা না ঘাটকা। না আছে রিক্সা চালাবার উপায়, না আছে সবজি বেচবার উপায়, না আছে সাইকেল জমা রাখার উপায় বা চায়ের দোকান চালাবার উপায়। ঘরে না আছে চাল, ডাল, তেল বা ওষুধ পত্র। এখন এরা সরকারি অনুদানের চাল পেয়ে কোনমতে একবেলা ভাত ডাল আলুসিদ্ধ খেয়ে দিন কাটায়।

রণ এই মানুষ জোগাড়ের কারবার করে এই পাঁচ বছরে বেশ টাকা জমিয়ে নিয়েছে। বাড়িতে রিটায়ার্ড স্কুল শিক্ষক বাবা, অসুস্থ মা , দুই বোন ছাড়া আর কেউ নেই। বোন দুটোর মধ্যে বড় বোন দিয়া বি কম পাশ করে ঘরে বসা, বিয়ের বয়স হয়ে গেছে। আর ছোট বোন রিয়া হাই স্কুলে এগার ক্লাসে পড়ে। রণর এখন প্রায় তিরিশ বছর বয়স। বি এস সি পাশ করে চাকরীর চেষ্টা করে বিফল হয়ে ওর চেনা জানা লাল দলের একজন রাজনৈতিক নেতার পরামর্শে এই ধান্দায় নেমে পড়ছিল পাঁচ বছর আগে। বিকাশ হালদার নামের এই নেতাটি রণকে চেনেন ওর বাবার সূত্রে। রণর বাবার স্কুলে ছাত্র ছিলেন বিকাশ বাবু।

বিকাশ বাবুর রাজনৈতিক জীবনে অনেক উত্থান পতন হয়েছে। আগে ছিলেন সবুজ দলের নেতা। এমনকি দলের এম এল এ ছিলেন পাঁচ বছর। কিন্তু হাওয়ার সাথে সাথে নিজেও ঘুরে গিয়ে লাল দলে চলে এসেছিলেন এই নেতা মহাশয়। শোনা যাচ্ছে এখন নাকি এই গিরগিটিকে শুধু গেরুয়া রঙের পাঞ্জাবী পড়ে বের হতে দেখা যায়। যদিও রণ বিকাশ বাবুর রাজনৈতিক জীবনের উত্থান পতনের বা রং বদলের ব্যাপারে একদম মাথা গলায় না। তবে বিকাশ বাবু কিন্তু রণর কাজকর্ম ও চলা ফেরার উপর নজর রেখে চলেন। আর তার একটি মাত্র কারণ হল ওর মেয়ে ঝিলিক। বিকাশ বাবু জানেন ঝিলিক রণকে ভালোবাসে।

রণ গরীব মানুষগুলির দুঃখে কষ্টে কখনো কখনো নিজের পকেট থেকেও টাকা বের করে ওদের সাহায্য করছে। কিন্তু এই ভাবে আর কতদিন ? এই লক ডাউন যদি আরও বেশিদিন চলে তাহলে রণর পুঁজিতে টান পরবে। ওর তো আর কোটি কোটি টাকা নেই যে দান ছত্র খুলে বসবে। আজ আবার বেলা দশটায় ব্যারাকপুর থেকে একদল মানুষ ওর কাছে সাইকেল নিয়ে ভিতরের রাস্তা দিয়ে দেখা করতে আসছে শুনে  সকাল থেকেই চিন্তায় পড়ে গেছে। এরাও যদি এসে আজ টাকা চায় তো কি করবে রণ ?

রণ সাইকেল নিয়ে বেলা নটার সময় বেড়িয়ে পড়ল। ওর কাছে খবর ছিল যে নীল পার্টির স্থানীয় এক নেতা মিহির বসু নাকি সরকারের দেওয়া বিনা পয়সার চাল গম গোপনে তার গঙ্গার পাড়ের গোডাউনে মজুত করে রেখেছে। রণ ওর সেই সংবাদদাতা বন্ধুকে নিয়ে চলে গেল গঙ্গার পাড়ের সেই গোডাউনের পাশের রাস্তায়। এলাকার অনেকেই রণকে বেশ ভালই চেনে। রণ ওর বন্ধুকে আগেই বলে দিয়েছিল দুটো বোরখা জোগাড় করে রাখতে। গোডাউনের কাছাকাছি এসে একটা পুরানো ভাঙ্গাচোরা বাড়ির ভিতর ঢুকে দুজনেই বোরখা পড়ে নিলো। একটু বাদেই গোডাউনের বিহারী দারোয়ান গেটের সামনে টুলে বসে খৈনি টিপতে টিপতে দেখতে পেল দুজন বোরখা পরা মুসলমান মহিলা এগিয়ে আসছে।

রজতের বন্ধু নির্মল একজন অভিনেতা, ওর নাটকের দল আছে। নির্মল সেই দারোয়ানকে একেবারে হুবহু মহিলার কণ্ঠ নকল করে হিন্দিতে জিজ্ঞাসা করল,’ হাজি, আপকা ইধর কই টয়লেট মিলেগা জি ? হাম দোনো কো একবার যানা হায়।‘  নির্মলের কথার ধরনে এমন একটা মিষ্টি ভাব ছিল যে সেই বিহারী দারোয়ান যেন চায়ের কাপে দেওয়া সুগার ফ্রি ট্যাবলেটের মত মুহূর্তে গলে জল হয়ে গেল। উঠে দাঁড়িয়ে,’ হাঁ হাঁ, কিউ নেহি। আইয়ে আইয়ে। জরুর মিলেগা।‘ বলেই দারোয়ানটা বড় লোহার গেটের ছোট দরজাটা খুলে ভিতরে গিয়ে ওদের দুজনকে ডাক দিয়ে বলল,’ আইয়ে জি, অন্দর আইয়ে।‘ বলে লজ্জাবনত ভাবে দাঁড়ানো রণর দিকে তাকাল সে। মনে মনে ভাবল এই মেয়েটা নিশ্চয়ই ঐ বৌটারই মেয়ে। দেখে তো মনে হচ্ছে বেশ তাগড়া মাল আছে। যৌন রসে টগবগ করে ফুটতে থাকে সে।

রণর উদ্দেশ্য ছিল গোডাউনের ভিতরে ঢুকে নির্মলের দেওয়া খবরের সত্যটা যাচাই করা। এইভাবে মুসলমান মহিলার ছদ্মবেশ ধরা ছাড়া আর কোন উপায় ছিলনা ওদের। এদিকে সেই বিহারী দারোয়ান নিজে গিয়ে আবার ছোট দরজাটা আটকে ভিতরের উঠোনের অন্য দিকে এগিয়ে গেল। রণ দেখল উঠোনের অপর দিকে বড় উঁচু একটা গোডাউনের মত দেখতে বাড়ি। সেই ব্রিটিশ জমানায় তৈরি এই বাড়িতে নাকি এই এলাকার ব্যবসায়ীরা গঙ্গা দিয়ে নৌকায় পাট নিয়ে এসে জমা রাখত চটকল গুলিতে সাপ্লাই দেবার জন্য। এখন এই নীল দলের রেশন ব্যবসায়ী নেতা এই গোডাউনের মালিক।

সামনের বড় দরজাটা বন্ধ ছিল। এক সাইডের ছোট ঘরের ভিতর দিয়ে গোডাউনে ঢুকে গিয়ে সেই দরজাটা খুলে দিল বিহারী দারোয়ান। মনে হল বাথরুমটা পিছন দিকে। আর সেখানে যেতে গেলে বন্ধ গোডাউনের ভিতর দিয়েই যেতে হবে। অন্ধকার গোডাউনে ঢুকে আলো আঁধারি পরিবেশে রণ আর নির্মলের চোখে পড়ল শয়ে শয়ে চাল আর গমের বস্তা ঢাই করে দেওয়ালের দু’পাশ দিয়ে রাখা। মাঝখান দিয়ে পিছনে যাবার সরু একটা পথ। বিহারী দারোয়ান গিয়ে উল্টোদিকের দরজা খুলে বলল,’ ইধার আইয়ে, টয়লেট ইধর হায়,’ বলে লোকটা গিয়ে দাঁড়ালো সেখানে।

রণ ইশারায় নির্মলকে এগিয়ে যেতে বলে। নির্মল দরজার দিকে যেতেই লোকটা ওকে নিয়ে পিছন দিকের বাথরুম দেখাতে নিয়ে যায়। আর সঙ্গে সঙ্গে রণ বোরখার ভিতর থেকে মোবাইলটা বের করে ফটাফট বেশ কয়েকটা ফটো তুলে নেয় মোবাইল ক্যামেরায়। তারপর গিয়ে দাঁড়ায় পিছনের দরজায়। টয়লেটের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল সেই বিহারী দারোয়ান। রণ গিয়ে দরজায় দাঁড়াতেই সে মুখ ঘুড়িয়ে একটা হাসি ছুড়ে দিল ওর দিকে। রণ যেন নারী সুলভ লজ্জায় লাল হয়ে গেছে এমন একটা ভাব দেখিয়ে মুখটা নিচু করে দাঁড়ায়। বোরখার ফাঁক দিয়ে দেখে বেচারা বিহারীর দিলখুশ হয়ে গেছে , লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে হাসছে।

টয়লেট যাবার নাটক শেষ হতেই ওরা দুজন বেড়িয়ে পড়ে গোডাউন থেকে। রণর বোন দিয়া ওকে সেল ফোনে জানায় যে ব্যারাকপুর থেকে প্রায় কুড়ি পঁচিশজন এসে ওর জন্য অপেক্ষা করছে বাড়িতে। রণ কাছেই নির্মলের বাড়িতে ফিরে এসে বন্ধুকে ধন্যবাদ জানিয়ে ড্রেস পাল্টে সাইকেল নিয়ে বাড়ি ফিরে যায়।

রণ এবার ব্যারাকপুর থেকে আসা দলটার সাথে ওদের বাড়ির ছাঁতে গিয়ে মাদুর পেতে বসে একটা পরিকল্পনা তৈরি করে ফেলল। ঠিক হল আজই সন্ধ্যায় টিটাগড়, খড়দা, ব্যারাকপুর ও সোদপুর থেকে মোট পাঁচ ছয়শ মানুষ দুটো দলে ভাগ হয়ে একদল জড় হবে ফকির ঘাট রোডে জয়শ্রী কেমিক্যালের গেটের কাছে। আরেক দল জড় হবে একটু দুরে বড়ি মসজিদের কাছে। ঠিক রাত আটটায় ওরা একত্রিত হয়ে গিয়ে দাঁড়াবে মিহির বসুর সেই গোডাউনে এবং গোডাউনে গচ্ছিত সমস্ত চাল ও গমের বস্তা লুট করে নিজেদের মধ্যে ভাগ করে যে যার বাড়ি নিয়ে চলে যাবে। কিন্তু সমস্ত কাজটা গোপনে এবং খুব তাড়াতাড়ি করতে হবে মেন গেট আটকে দারোয়ানকে বেঁধে রেখে। তার আগে বেশ কয়েকটা ভ্যান রিক্সা এনে গঙ্গার ধারে জড় করে রাখতে হবে বস্তা গুলি রাতারাতি পাচার করবার জন্য।

রণর বাড়ির ছাতে বসেই ফোন করে ব্যারাকপুর থেকে আসা দলটির নেতা টিটাগড় ,খড়দা ও সোদপুরের দলপতিদের জানিয়ে দিল প্ল্যানটা। রণদার বাড়িতে বসে এই প্ল্যান করা হয়েছে শুনেই সবাই এক কথায় সন্ধ্যায় জমায়েত হতে রাজি হয়ে গেল। বেলা এগারোটায় যেভাবে সবাই সাইকেলে এসেছিল সেইভাবেই আবার যে যার বাড়ি ফিরে গেল পেটে খিদে ও চোখে আসন্ন বিপ্লবের দৃঢ় প্রতিজ্ঞা নিয়ে।

সেই রাতে সত্যি সত্যি নীল দলের নেতা মিহির বসুর গোডাউন লুট হয়ে গেল। কিন্তু রণ মেঘের আড়ালে থাকা ইন্দ্রজিতের মত এই অপারেশনের সময় নিজেকে আড়ালে রাখল। সন্ধ্যার পরেই সাইকেল নিয়ে গিয়ে হাজির হয়েছিল বিকাশ বাবুর তালপুকুরের বাসায়। বিকাশ বাবুর বাড়িতে মাঝে মাঝে যেত রণ। যদিও ঝিলিকের সাথে বেশির ভাগ সময়েই দেখা সাক্ষাৎ হত গঙ্গার পাড়ে গান্ধী ঘাটে অথবা অতিন্দ্র সিনেমার ব্যালকনিতে কোণার সিটে বসে সময় কাটানোর প্রোগ্রামে। বিকাশ বাবুর স্ত্রী রণকে ভীষণ ভালোবাসেন। আর বিকাশ বাবু সব জেনেও না জানার ভান করে থাকেন। 

বিকাশ বাবুর বাড়িতেই রাতের খাওয়া সেরে বেশি রাতে বাড়ি ফিরল রণ। বিকাশ বাবু দেশের বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থা, সরকারের ব্যর্থতা, করোনার লড়াইয়ে আমাদের কি করনিয় এই সব আলোচনা করতে করতে ডিনার করলেন একসাথে। ঝিলিক খুব খুশী। রণ আজ নিজে থেকে ওদের বাড়িতে ডিনার করবে জানিয়েছিল সকালেই, আর ও মার সাথে মিলে দুজন বেশ ভাল ভাল রান্না করেছে আজ। শুধু হবু জামাই হিসাবে না, অনেক দিন পর ছেলে ঘরে ফিরলে মায়েরা যেমন আদর যত্ন করে ঝিলিকের মা যেন ঠিক সেইভাবেই নিজে সামনে দাঁড়িয়ে থেকে খাওয়াল রণকে।

পরদিন সকালে মিহির বাবু গোডাউনে গিয়ে দেখেন গেটের ছোট দরজা খোলা, রাতের একজন অতিরিক্ত  দারোয়ান সহ দুজনেরই মুখ বাঁধা। ওদের দুজনকে বারান্দার এককোণে হাত পা বেঁধে ফেলে রেখে কে বা কারা গোডাউনের সব লুকানো সরকারি চাল ও ডালের বস্তা চুরি করে নিয়ে পালিয়েছে। বস্তার ফুটো ফাটা জায়গা দিয়ে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়া অল্প স্বল্প চাল গম ছাড়া আর কিছুই নেই গোডাউনে।   

মিহির বাবু পড়লেন মুশকিলে। থানাতে কমপ্লেন করতে পারবেন না। ফোন করে দলের ছেলেদের খবর দিলেন। মুহূর্তে জনা পঞ্চাশেক যুবক হাজির হয়ে গেল বসের ডাকে। মিহির বাবু বুঝতে পারছিলেন এসব বিরোধী দলের লোকদের কাজ। কে একজন বলে উঠল,’ বস, এক রাতে এতো বড় গোডাউন সাফ করতে পারে যে তার হাতে নিশ্চয়ই অনেক লোকবল আছে। না হলে কয়েকটা মাত্র লোক এলে পারতো না।‘

মিহির বাবুর কথাটা মনে ধরল। লোকবল কথাটা কানে যেতেই সঙ্গে সঙ্গে ওর মনে পড়ল রণর কথা। ফোন করল রণকে। বেলা তখন দশটা। রণ ওপার থেকে ফোন তুলেই বলল,’ গুড মর্নিং মিহির দা। সকাল সকাল এই অধমকে ফোন করেছেন আজ ! কি, কোন মিছিল টিছিল আছে নাকি স্যর ? বলুন কত লোক লাগবে ? তবে এখন করোনাতে কিন্তু ভাড়াটা একটু বেশি দিতে হবে বস কারণ ...।‘

‘আরে ছাড়তো তোমার মিছিল। আচ্ছা কাল তুমি কোথায় ছিলে রণ ? মানে কাল রাতের কথা বলছি।‘

‘কেন বলুন তো মিহির দা। কাল কি আপনি আমাকে খুঁজছিলেন ? কই কেউ তো বলেনি আমায় ?’

‘ আরে না না। অন্য একটা ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করছি। তুমি কোথায় ছিলে কাল ?’

রণ মনেমনে হাসে। আর ভাবে ‘অব উট আয়া পাহাড় কে নিচে’। কিন্তু মুখে বলে,’ কাল আমি সারাদিন বাড়িতেই ছিলাম। তবে রাতে বিকাশদার বাড়িতে ডিনারের নিমন্ত্রণ ছিল। বোঝেনই তো। সব দিক সামলে চলতে হয় আমাদের। সন্ধ্যা সাড়ে ছ’টা থেকে রাত সাড়ে এগারোটা অবধি তো ওখানেই ছিলাম দাদা।‘


মিহির বসু কথা না বাড়িয়ে চুপ করে গেলেন। বুঝতে পাড়লেন রণ কালই কেন বিকাশের বাড়িতে ডিনার করতে গেছে। এই হাড় বজ্জাত ছেলেটাকে কোন ভাবেই আর ফাঁসানো যাবে না। বেশি কিছু করতে গেলে আবার কলকাতা থেকে ফোন চলে আসবে। মনে মনে শুধু একটা খিস্তি করে মাথায় হাত দিয়ে বসে রইলেন মিহির বসু, এলাকার জন দরদি নেতা। জনতার প্রাপ্য চাল ডাল যে চোরের উপর বাটপারি করে একদল লোক হরির লুটের মত ওর সবকিছু  লুটে পুটে নিয়ে পালিয়েছে বুঝতে পেরেও এখন আর কিছুই করার নেই অপদার্থ লোকটার। একেই হয়ত বলে ভগবানের মার। 
uttamchakraborty306@gmail.com
ব্যাঙ্গালোর


No comments:

Post a Comment