1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Tuesday, January 26, 2021

মুক্তির স্বাদ

 

ছবি  : ইন্টারনেট 


মুক্তির স্বাদ
ইন্দ্রানী ভট্টাচার্য্য
    "ম্যাডাম একটা রিকুয়েস্ট ছিল। আমাকে আজ বলাকার জায়গায় ডিউটিটা দেবেন?"
কথাটা কানে যেতেই রিপোর্ট টাইপ করতে করতে চোখ তুলে তাকালো কেয়ার অ্যান্ড কিওর নার্সিংহোমের অভিজ্ঞ ম্যাট্রন দিশা হেমব্রম। তারপর খুব স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন করলো, " কেন বল তো? সবে তো কাল বিয়ে করে হানিমুন সেরে জয়েন করলি। আজই একেবারে নাইট করতে চাইছিস তাও আবার ফিমেল কোভিড ওয়ার্ডে! তোর বর জানতে পারলে আমাদের যে শাপ শাপান্ত করবে রে!" বলেই হাসতে লাগলেন মিটিমিটি। সেখানে দঁড়িয়ে থাকা বাকি স্টাফেরাও চোখ টেপাটিপি করতে লাগলো নিজেদের মধ্যে । 
প্রশ্নটা শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল হৈমন্তী। তারপর হাল্কা হেসে বলল, ," দিন না ম্যাডাম। অসুবিধা হবে না। এই উইকটা পুরোটাই নয় নাইট করলাম।"
হাতের কাজ বন্ধ করে এবার হৈমন্তীর দিকে সোজাসুজি তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন দিশা, "কি ব্যপার, খুলে বল দেখি? ঝগড়া করেছিস বুঝি বরের সাথে? "
হৈমন্তী ভেবে দেখলো সিঁথিতে সিঁদুর ওঠার পর এখনও এক মাসও গড়ায়নি। এখন নিজে থেকে নাইট করার জন্য বেশি জোরাজুরি করলে ম্যাডাম এবং অন্যদের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে।আর সেটাই স্বাভাবিক। পরিস্থিতি হালকা করার জন্য সে এবার জোর করেই হেসে উঠে বলল," না না ম্যাডাম। সে সব কিছু নয়। আদিত্যর তো আমেরিকান ক্লায়েন্ট। তাই রাতের দিকেই কাজ আসে বেশিরভাগ। আমাকেও জেগেই থাকতে হয়। তারপর মর্নিং ডিউটি থাকলে একটু চাপ হয়ে যায়। তাই বলছিলাম আর কি। ঠিক আছে আমি না হয় একদিন অন্তর নাইট করে দেবো, যদি আপনি রাজি থাকেন।"
-"বেশ, তাই হবে। তুই এখন মেটার্নিটি ওয়ার্ডে চলে যা। ডিউটি আওয়ার্স শুরু হয়ে গেছে। দুপুরে ডক্টর গোস্বামীকে অ্যাটেন্ড করিস। সিজার আছে একটা। আমাকেও রাউন্ডে যেতে হবে। সন্ধ্যেবেলা এটা নিয়ে বরং কথা বলছি তোর সাথে। "
হৈমন্তী তখনকার মত চলে গেলো। 
বিকেলবেলা ডিউটি শিফটের সময় ফের একবার অনুরোধ করলো," বলছি ম্যাডাম, ভেবে দেখলাম আরো, আমি তো অনেকদিন ছুটিতে ছিলাম। তাছাড়া বিয়ের আগেও কয়েকমাস হাল্কা ডিউটি নিয়েছি। চোখের ওপর মধুমিতা দি, গার্গী দি, তমালদের মাসের পর মাস কোভিড ওয়ার্ডে ডিউটি করতে দেখে আমার নিজেরই খুব খারাপ লাগছে আজকাল। কাজের প্রতি নিজের দায়বদ্ধতা নিয়ে নিজের মনেই প্রশ্ন উঠছে বারবার।"
চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে দিশা হাল্কা মেজাজে বলল, " বাবা, বিয়ে করে তো তোর বয়স বেড়ে গেছে দেখছি। আগে তো এত গোল গোল করে কথা বলতিস না। বুঝেছি মাঝে মাঝে রাত জেগে আজকাল ক্লান্ত হয়ে পড়ছিস। তাই ভোরে ডিউটিতে আসতে কষ্ট হচ্ছে।" বলেই ফিচেল হাসি হেসে আবার বলল," তুই বলছিস যখন, কর এক মাস। আমি ওখান থেকে মধুমিতাকে তুলে নিচ্ছি। ও কয়েকদিন ধরে বলছিলও বটে ওয়ার্ড শিফটিং এর কথা। বাড়িতে ওর দু বছরের মেয়ে আর বয়স্ক বাবা মা আছে। বর তো এখানে নেই। জানিস তো।"
-"হ্যাঁ ম্যাডাম,সেই ভালো। আমার কোনো অসুবিধা হবে না।"
-"ঠিক আছে। কাল তবে সকাল আটটা। বিনোদিনী ভবন মানে কোভিড ওয়ার্ডে সরাসরি চলে যাস। ওখানে মোহনা চার্জে আছে। ওকে আমি বলে রাখব। ওর কাছে অ্যাটেনডেন্স দিয়ে দিবি। ওই তোর পরের দিনের নাইট অ্যালোকেট করে দেবে।" 
-" থ্যাংক ইউ ম্যাডাম। আজ তবে আসি।"

দুদিন পর হৈমন্তীর নাইট ডিউটি পড়ল বিনোদিনী ভবনে। দায়িত্ব বুঝে নিল তমালের থেকে। 
রাত এখন আটটা। একটা দমবন্ধ করা নিস্তব্ধতা যেন থম মেরে আছে চারিদিকে। জীবন আর মৃত্যুর মাঝে এ যেন এক অদৃশ্য টানেল। নীলচে আলোয় করিডোর দিয়ে মাঝে মাঝে হেঁটে যাচ্ছে সাদা পোশাকে আপাদ মস্তক ঢাকা কিছু মানুষ যারা লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে জীবন রক্ষার অঙ্গীকার নিয়ে। আর মৃত্যুর অদৃশ্য দূতেরা ঘাপটি মেরে লুকিয়ে আছে আধো অন্ধকারে, মানুষের একটা ভুলের, একটু কিছু দুর্বলতার অপেক্ষায়। 
হৈমন্তী গুনে দেখলো ঘরটায় এখন কুড়িটা বেড আছে। অনেকের অবস্থাই বেশ ক্রিটিকাল। ওর সঙ্গে এই ঘরে ছন্দা বলে একটি মেয়েরও ডিউটি আছে। ফোন করে জানিয়েছে আজ ওর ছেলের জন্মদিন। তাই আসতে একটু দেরি হবে। হৈমন্তী আশ্বস্ত করে বলেছে, "চাপ নিস না। ঘন্টা দুয়েক পরে আয়। ডক্টর মজুমদারের ভিজিট হতে হতে দশটা বেজে যাবে। ততক্ষণ আমি সামলে নেবো।" 
হৈমন্তী ভাবতে পারেনি সুযোগটা এত অনায়াসে পেয়ে যাবে। জানলার পর্দাগুলো সে টানটান করে টেনে দিল। কিছুক্ষণ আগেই কয়েকজনের জন্য রাতের সেমিলিকুইড ডিনার দিয়ে গেছে ক্যান্টিন থেকে। 
হৈমন্তী আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল। তারপর ঘরের দরজাটা বন্ধ করে দিল ভালো করে। এই সময় পেশেন্টরা খায় এবং ঘুমোয়। তাই খুব একটা কেউ ভিজিটে আসে না। তাই কাজটা রাতের বেলায় করাই সহজ। এর মধ্যে সে পরীক্ষা করে দেখে নিয়েছে ঘরে লাগানো গোপন ক্যামেরায় কোনের দিকের ছশ পাঁচ নম্বর বেডটা ভালো দেখা যায় না। পর্দা টেনে দিলে বাইরে লাগানো বড় ডিসপ্লেতে পর্দার একটা অংশ শুধু চোখে পড়ে। সেই বেডে এখন শুয়ে আছেন একজন প্রৌঢ়া। হৈমন্তী পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল বেডের দিকে। পাশে রাখা ফাইলটা হাতে নিয়ে দেখলো স্প্রেডিং কন্টেন্ট যথেষ্ট হাই। স্যালাইন চলছে। তবে ডক্টর মজুমদার লিখেছেন সেমি লিকুইড খাবার এখনও অব্দি তাকে দেওয়া যেতে পারে। হৈমন্তী খাবারের ট্রেটা নিয়ে বেডের সাইড টেবিলে রাখলো। তারপর হেসে কুশল বিনিময় করে বললো," মাসিমা খুব গরম না?" মহিলা তেমন কিছু বললেন না মুখে। হৈমন্তী একাই আস্তে আস্তে বলতে লাগলো, "এসি তো আর বাড়ানো যাবে না। তাহলে বরং খুলেই ফেলি পিপিইটা। এই ধরাচুরো পড়ে একটানা কাজ করা যায় না " বলতে বলতে খুলে ফেলল পরনের সুরক্ষা কবচ। এমনকি মুখের মাস্ক অব্দি। তারপর নিজের হাতে পরম মমতায় ধীরে ধীরে খাইয়ে দিতে লাগলো মহিলাকে। মহিলা সুজির পায়েস খেলেন না সবটা। হৈমন্তী বাকি উচ্ছিষ্ট সেই পাত্র থেকেই চেটেপুটে খেয়ে নিয়ে ঢকঢক করে এক গলা জল খেয়ে বলল," ভারি খিদে পেয়েছিল মাসিমা। বাড়ি থেকে তাড়াহুড়ো করে বেরোনোয় কিছু মুখে দিয়ে আসতে পারিনি। আপনি শুয়ে পড়ুন এবার।" বলে বেডের পজিশন ঠিক করে চাদরটা টেনে দিল। ভদ্রমহিলা কিছু বললেন না।শুধু বিস্ফারিত চোখে চেয়ে রইলেন হৈমন্তীর দিকে। 
হৈমন্তী এরপর চটপট আবার পরে নিল সব। তারপর পর্দাটা সরিয়ে দিয়ে এগিয়ে গেল অন্য দিকে। 
সেই রাত কাটতেই ছুটির দরখাস্ত দিল হৈমন্তী। জ্বর এসেছে শুনে ম্যাডাম ছুটি আর হোম আইসলেশন এর উপদেশ দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন। সাথে প্রয়োজনীয় টেস্ট আর টেলি কনসাল্টিং করে প্রয়োজনীয় ওষুধ খাবার কথাও বলে দিলেন বারবার করে।
হৈমন্তী বাড়ি এসে একেবারে নিয়ম মেনে ঘরবন্দী করে নিল নিজেকে। আপাতত কয়েকদিনের জন্য মুক্তি। পজিটিভ হলে তো কথাই নেই। আর না হলে হসপিটাল জয়েন করলেও আপাতত নাইট ডিউটি পাকা। বেশ কিছু দিন রেহাই পাবে শরীরটা রাতের পশুটার আঁচড় কামড়ের হাত থেকে। ফুলশয্যার পর থেকে তো শুধু এমন রাতেরই অপেক্ষায় ছিল সে।
indranibhattacharyya47@gmail.com
কলকাতা

No comments:

Post a Comment