1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Sunday, February 21, 2021

বাঁচা-মরার মাঝখানে

 

ছবি  : ইন্টারনেট 

বাঁচা-মরার মাঝখানে
অনিরুদ্ধ চক্রবর্তী

এক

মাছ ধরতে বসে লোকটা ঢুলছে। একেবারে থেবড়ে বসে আছে ঢালাই রাস্তার উপর। মোটা মোটা হাত পা, লম্বা-চওড়া দেহ। মোটা মোটা আঙুলে রূপোর তৈরি আংটি। সেগুলি ঝকঝক করছে। হয় নতুন লাগিয়েছে বা রোজ মার্জনা করে তাদের। এতদিন এদিকে আসছি, একে কখনও মাছ ধরতে দেখিনি। আগেরজনের মতো রাস্তার পাশে সাইকেল দাঁড় করানো নেই। তার মানে এ লোকটি একেবারেই স্থানীয়। অনেকে অপরের সঙ্গে রেষারেষি করে মাছ করে বা অন্য কাজ করে। হতে পারে এই লোকটি তাদেরই একজন। বা ওর দাপট আছে বেশ। কেননা নিত্যকার মেছুড়েরা সরে গেছে এই লাইন থেকে। তারা ছিপ নিয়ে বসেছে উল্টোদিকে।

লোকটার গায়ে সাদার উপর ডোরাকাটা ফুলহাতা জামা, হাতায় বোতাম নেই। পরনে কালো রঙের ফুল প্যান্ট। লম্বা ছিপটি নুয়ে গেছে জলের উপর। ফাতনার আশেপাশে বেশ কিছু মাছ লাফাচ্ছে—আগের মতন—হতে পারে তারা চ্যাং ছানা। তারা এমনি জোরে লাফাচ্ছে যে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়েও জলের মধ্যে কলকল শব্দ আমার কানে আসছে। মাছেরা বেশ মজায় আছে—বোঝাই যাচ্ছে। এদিকে লোকটাও এই অঘ্রানের মিঠে রোদে বসে-বসে ঢুলে নিচ্ছে। মাথার উপর মেঘমুক্ত নীল আকাশ, দূরের ওই মাঠটায় কিছু ছেলে ঘুড়ি উড়িয়ে যাচ্ছে, উড়িয়েই চলেছে তারা। হালকা বাতাস দিচ্ছে। আজকের তাজা খবর, কদিনের মধ্যেই জোর শীত পড়বে। ঠিক করেছি, এবারে একটা ভালো দেখে কোট কিনতে হবে। ভালো কোট আবার সাড়ে পাঁচ হাজারের নীচে নেই।

পুরানো দুই মেছুড়েদের মধ্যে আজ রয়েছে একজন। সেই বয়স্কটি। মাল খেয়ে খেয়ে ঠোঁট ও চোখ সবসময় লাল ও ফোলা। ওদিকের এক নারকেল গাছের ছায়ায় সে বসে আছে উবু হয়ে, ছিপ ফেলে ঝুঁকে পড়ে তীক্ষ্ণ চোখে  ফাতনার নড়াচড়া দেখছে। ঠোঁটের কোণে নিভে যাওয়া বিড়ি। পিছনের রাস্তা দিয়ে কে এল-গেল সেদিকে কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। এই হচ্ছে আসল মেছুড়ে।

ওদিক-ওদিক তাকিয়েও ওর সঙ্গী সেই অল্পবয়স্ক, চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা পড়া বছর ত্রিশের ছেলেটিকে দেখতে পেলাম না। অর্থাৎ লোকটি আজ একাই। পাশে ওর সেই সাইকেল স্ট্যান্ড দিয়ে রাখা আছে। তাতে ঝুলছে নাইলনের পুরানো ব্যাগ ও কয়েকটি ঘুড়ি। ঘুড়ি দেখে একটু অবাক হলাম। ওদিকের ধান উঠতে থাকা মাঠে ছেলেরদল ঘুড়ি ওড়াচ্ছে। সেটা ভোকাট্টা চিৎকারও ভেসে আসছে মাঝে মধ্যে। 

বাইক লক করে পায়ে পায়ে ওই মেছুড়ের কাছে গিয়ে দেখি, পাশের বাড়িটার টিনের চালের নীচে, বাঁশের উপর নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে একটি প্যাঁচা! টিনের একটালা বাড়ি। ছায়াচ্ছন্ন পরিবেশ বাড়িটির। আশপাশে নানা ফলপাকুড়ের গাছ, কলাবাগান আর পিছনে হু হু করছে হোগলার বন। কেউ কেউ সেখানে নানারঙের দু-তিনটি গরু বেঁধে দিয়ে যায়। তার টিনের চালের উপর ঝুঁকে আছে একটি পত্রহীন আমড়াগাছ। তাতে পাকা আমড়া ফলে আছে। অঘ্রানের এই মিঠে রোদ-ঠান্ডা আর কমলালেবুর গন্ধের ভেতর বাড়িটিকে বেশ লাগে।

এই বাড়িটার দুটি ধাপ। পিছনদিকে যে ঘর আছে, সেটির দেওয়ালও টিনের। আর রাস্তার সামনে যে বাড়িটি, সেটি একচালা, তবে দেওয়াল ইঁটের। বাড়িটির ভেতর ও বাইরে প্রচুর গাছপালা রয়েছে। নানা ফল ও ফুলের গাছ। ফলে একটা ছায়াছন্ন অন্ধকার বিরাজ করে সেখানে। প্যাঁচাটা হয়তো রোজ সকালে এখানেই এসে বসে আর রাত হবার অপেক্ষা করে।

আমাদের পাড়াতেই কিছু প্যাঁচা আছে। আগে তারা আমাদের বাড়ির পিছনে যে বাড়ি, তার জানালার নীচে বসে থাকত। মাঝে কিছুদিন পাঁচার ডাক শুনিনি। এখন সন্ধে হলেই ডাকে। পাশের আর একটি বাড়ির ভিতর  বারান্দার সানসেটে কয়টি পায়রা বাসা করেছে। এখন যেদিন-যেদিন দুপুরে বাড়ি থাকি, ঘরে শুয়ে-শুয়ে বকমবকম শুনি। আবার মাঝরাতেও তাদের বকমবকম কানে আসে। আমার তো এটা ভয় হয়, প্যাঁচারা না-ঝাঁপিয়ে পড়ে পায়রাদের উপর!

তখন সবে লকডাউন শুরু হয়েছে। মার্চ মাসের শেষ। একদিন মাঝরাতে কোনো এক পাখির গলায় তীব্র চিৎকার শুনে অন্তরাত্মা অবদি কেঁপে উঠেছিল—এখনো বেশ মনে পড়ে। সেই লকডাউনপর্ব, তখন রাস্তাঘাট শুনশান, মানুষের বাইরে পা রাখা বারণ, আকাশ-বাতাস-নদী—সব নির্মল ও শুদ্ধ হয়ে উঠছে; এক পাখির আর্ত-চিৎকারে হাঁটু কেঁপে উঠেছিল। মনে হয়েছিল, বাকি দিনগুলিতে বাঁচব তো?

সেই মার্চ থেকে আজ ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ—অনেকগুলি দিন; মানুষ জানে করোনাকে সঙ্গে নিয়েই চলতে হবে, সে আজ আর তেমন তাকে ভয় পায় না। অনেকেই মাস্ক খুলে চলাচল করে। এখন সবই নিউ-নরম্যাল। ট্রেনও চালু হয়ে গেল কদিন আগে। কিন্তু আজও সেই না-দেখা পাখির তীব্র আর্তস্বর আমি ভুলতে পারিনি। আজ আবার, আনলক পর্বে মানুষের উদ্দামতায় সেকথা মনে পড়ে গেল এই প্যাঁচাটাকে দেখে। মনে পড়ে গেল আবার, আমরা বাঁচব তো? 

বয়স্ক লোকটি এখনও দেখেনি আমায়। একইভাবে ঝুঁকে আছে  উঁচু রাস্তার নীচুতলা দিয়ে একেবেঁকে বয়ে যাচ্ছে অঘ্রানের জল। জলের ওদিকেও জল। তবে এদিকে যেমন কেবল ধূ ধূ হোগলার বন, রাস্তার ওদিকে তেমন নয়। সেখানে আছে ধানমাঠ। রোজ-রোজ ধান ওঠে, প্রতিদিন ধান কাটা হয়ে যাচ্ছে। যে মলিন চাষিলোকেরা ধান মাথায় নিয়ে  ঘরের পানে হাঁটা দেয় আলপথ দিয়ে, কেন যে তাদের পিছন-পিছন ল্যাজ নাড়তে-নাড়তে একটি কুকুর গ্রামের ভেতর চলে যায় ও ফিরে আসে—বুঝি না।

হ্যাঁ, এসময় লোকটি আমার দিকে তাকাল আর আমার তখন মনে হল, আমি এখানে অনেক দুপুরযাপন করলেও কিন্তু কখনও রাত্রিযাপন করিনি। রাতে কীভাবে নামে এখানে?

লোকটি উঠে দাঁড়াল। না, আজ আর ওদের জন্য কোনো বোতল আমি আনিনি। বদলে সেদিনের মতো এনেছি কমলালেবু। এখন দাম আরও কম। কুড়ি টাকায় চারটি।

আজ হল নাকী কিছু?

না-হে! লোকটার গলায় হতাশা। বলে, হয়ে যাবে। কোনো দিনই তো খালি হাতে ফিরি না। যদি একটা কচ্ছপ পাই, বেশ হয়।

দুটি লেবু ওকে দিই, বাকি দুটি আমার। লেবু খেতে খেতে ওকে বলি, এখানে রাতেরবেলা কী হয়?

কী হয় মানে? লোকটা অবাক। বলে, কী হবার কথা বলছেন? বলে সে পাশের বাড়িটির দিকে আড়চোখে তাকায়। হ্যাঁ, মাঠের মধ্যে এই একটিই বাড়ি আছে। বাড়িটি আগে রাস্তার সমান ছিল। টিনের ঘর, টিনেরই  দেওয়াল। রাস্তা উঁচু হওয়ায় বাড়ি নেমে গেছে নীচে আর চাপা পড়েছে তাদের বাড়ির ভিতর পায়েচলা পথ। এই বাড়িতে যদি রাত থাকা যায়, বেশ হয়। তাহলে এখানের রাতকে আমি চিনে নিতে পারি।

বলি, আসলে আমি এখানের রাত কোনোদিন দেখিনি। একটা রাত এখানে কাটাতে চাই।

লোকটি হাঁ। বলে, এখানে রাত কাটাবেন?

হ্যাঁ। দেখব কেমন করে রাত নামে এখানে। দেখব এখানে কেমন করে রাতপাখিরা চলাচল করে। ওই যে দূরে, ধূধূ মাঠ—সেখানেই বা কী হয়। আসলে এইরকম জায়গায়, এই ফাঁকা মাঠ, জলাভূমি, ধানমাঠ, ওই দূরে জ্যোতিদের বাড়ি—এখানে কীভাবে অঘ্রানের রাত নামে, দেখার খুব সাধ হয়।

আপনি কি কবি নাকী?

দ্যুত!

লোকটা মাথা নেড়ে বলল, আপনার জ্যোতিকে একদিন দেখলুম জানেন—একজনের বাইকের পিছনে চেপে যাচ্ছে।

গর্বের সঙ্গে বলি, ওটা আমিই।

আপনি! সে হাঁ। বলে, দেখে চিনতে পারলাম নাতো!

হ্যাঁ, আমিই। আমরা মাঝে-মাঝে অমনি করে ঘুরি। আমি ছাড়া আর কারও সঙ্গে ও ঘোরে না।

লোকটা হাসল। বলল, তা ঘুরে-ঘুরে কোথায় যান?

লোকটার এত কুতুহলে বিরক্ত লাগল। কিন্তু লোকটিকে চটাবার উপায় নেই। বললাম, যাই ওই দূরে ভেড়িতে। জল দেখতে আমাদের ভালো লাগে। শুনেছি ওদিকের জলায় এইসময় পাখিরা নামে।  সেদিন আমরা পাখি দেখতে গেছিলাম। আচ্ছা, ওই যে একজন মাছ ধরছে—ও কে?

হুম!

বলে লোকটা রাস্তার উল্টোদিকে বসা তার প্রতিদ্বন্দ্বীকে দেখে নিল। বলল, ওদিকে বাড়ি। আজই প্রথম এসেছে। 

গলায় তাচ্ছিল্য ঝরে পড়ল। বুঝলাম, লোকটা এই নিয়ে আর কোনো কথা বাড়াতে চায় না।

বললাম, আপনার সঙ্গী কোথায় আজ?

ওর জ্বর হয়েছে।

জ্বর! সেরেছে! করোনা নয় তো?

বলল তো নয়।

কী করে জানল? টেস্ট করেছে?

না। 

তবে

ও বলল, সব গন্ধই পাচ্ছে। তাই আর হাসপাতালে যায়নি। এখন করোনা ঘরে বসেই সেরে যায়। আর হাসপাতালও এখন ঘরে চুপুচাপ বসে থাকতে বলে। তাই ও নিজেই আর বেরুচ্ছে না।

চুপ করে গেলাম। লোকটা খারাপ কিছু বলেনি। তাছাড়া পুজোর পর করোনা রুগীর সংখ্যা বাড়বে বলে যেটা ধরা হয়েছিল, সেইভাবে পজিটিভ হয়নি। ফলে লোকে এখন খুব ডেস্পারেট হয়ে গেছে। আগামীদিনে সত্যিই কী হবে কেউ জানে না!

যেদিন রাত থাকবেন বলছেন সেদিন জ্যোতিকেও আনবেন? বলে মুখ ফিরিয়ে লোকটা আমার দিকে তাকাল। খেয়াল করে দেখলাম, আজ সে দুটি ছিপ এনেছে। সেগুলিতে টোপ গেঁথে ফেলে রেখে সে উঠল। অন্যদিন একটাতেই সে রাস্তার পাশ দিয়ে এঁকেবেঁকে বয়ে চলা নয়ানজুলির মধ্যে থেকে টপাটপ মাছ ধরে। আজ কী হল?

ক্ষেপেছেন? ও কিছু জানবে না। এটা আমার নিজের ব্যাপার। 

কিন্তু থাকবেন কোথা? বলে লোকটা আমার কাছে এগিয়ে এল। ওর মুখে মাস্ক নেই। আমার আছে। মাস্ক ছাড়া আমি কোথাও বেরোই না। একটুও যে ভয় লাগল না, তা নয়। কিন্তু মাস্ক থাকলে আক্রান্ত হবার চান্স ৫% বলে একটু আশ্বস্ত হওয়া গেল।

লোকটা একটা শ্বাস ছেড়ে বলল, তার মানে জ্যোতির সঙ্গে এই জায়গাটারও আপনি প্রেমে পড়েছেন। কিন্তু থাকবেন কোথায়? এই রাস্তার উপর? রাতে এই এলাকাটা চলে যায় শেয়ালদের দখলে।  তারা আপনাকে বিপদে ফেলতে পারে।

রাস্তার ওদিকে আমার বাইক দাঁড় করানো। এখন বিকেল সাড়ে তিনটে। এখনি পড়ে আসছে রোদ। এখন রোদ নরম—চাঁদের আলোর মতন। ওই দেখো, চাঁদও খানিক দেখা যায় ধূ ধূ আকাশে। যেমন জ্যোতি। যেন কতদূরে আছে সে। কতদিন দেখা নেই তার। তার সঙ্গে কথা হয় না। অথচ ইচ্ছে করলেই তাকে ছোঁয়া যায় দেখা যায় তার সঙ্গে কথা বলা যায়। সেই যে একদিন হেসে সে পালিয়ে গেল তার পর আর কই?

মেছুড়ে লোকটিকে বলি, ওই বাড়িটিতে থাকা যায় না?

শুনে লোকটি ঘাড় ফিরিয়ে দেখল বাড়িটিকে। আমি জানি বাড়িতে দু, তিনজনের বেশি মানুষ থাকে না। একজন বয়স্ক ও একজন বউ মানুষ। বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি, একদিন দুপুরে দেখি বয়স্ক লোকটি, মাথায় একটি স্পোর্টস টুপি, পরনে ইঞ্চিপাড়ের সাদা ধুতি ও ছিটচিট পাঞ্জাবি। পাঞ্জাবির ভেতর লোকটি একটি উলিকটের ফুলহাতা গেঞ্জি পরে আছে। আর মাথা নেড়া ও গলায় তুলসীর মালা।

তার সঙ্গে একটি অল্প বয়স্ক বউ। বউটির মুখে মাস্ক থাকায় তার মুখটি ভালো দেখা গেল না।  সে পড়েছে হলুদের উপর লাল ছাপা সাধারণ মানের শাড়ি, গায়ে লাল চাদর। তখন দুপুর। হালকা রোদ আছে। বাতাস দিচ্ছে। টিনের বাড়ির ভেতরে একটুখানি জায়গা। কিন্তু গাছপালার খুব শখ বাড়ির লোকের। সেখানে কোন গাছটা নেই? পেঁপেগাছ দুটি। তাতে পেঁপে ফলে আছে। আর আছে গাঁদাফুলের গাছ। সে গাছ বৃহৎ। প্রাচীর ছাড়িয়ে উপরের দিকে উঁকি মারে।

ওদের টিনেরবাড়ির পিছনে দিগন্ত-বিস্তৃত হোগলার বন, জলা। সেখানে গরু চরে, বক নামে। একদিন এমনি এক নির্জন নিস্তব্ধ দুপুরে হঠাৎ দেখি, সেই হোগলার বন থেকে শূন্যে বের হয়ে এল এক বৃহৎ সাদা বক। সেটা শূন্যেই স্থাপিত হল, ঠিক আমার মাথার উপর।

ওই বাড়িতেই মেলা আছে বউটির সেদিনের সেই শাড়ি। হয়তো সে তা মেলেছে অনেকক্ষণ। শুকিয়ে গেছে, রোদে, বাতাসে। শাড়ির পাশে জামাও শুকিয়ে উঠেছে।  সবই সাধারণ মানে ও রঙের। বউটি কী ঘুমুচ্ছে অঘ্রানের এই দুপুরে? অঘ্রানের রাতকে সে কী চোখে দেখে?


দুই

 

সেদিন বলছিল জ্যোতি, আমার ফোন নম্বর নেবেন না? আমি বলি, না। কী হবে নিয়ে? সে বলে, বারে! কত ছেলে আমার ফোন নম্বর নিতে চায়—আর আপনিই নেবেন না? শুনে আমার রাগ হয়ে যায়। চুপ করে থাকি। বুঝি জ্যোতির উপর আমি একটু বেশি অভিমান করে ফেলছি। সে আমার মুখ দেখে খিলখিল করে হাসে। বলে, বাবুর কি রাগ হল? আহারে!  বলে সে মুখে চুকচুক করে শব্দ করে। বুঝি, সে মজা করছে। কিন্তু তবু, মনের ভেতরটা খুঁতখুঁত করে। বলি, সত্যি কেউ আছে নাকি তোমার জীবনে?

আছে তো।

কে সে?

বলব কেন?

আমি আরও হতবাক হয়ে যাই। মনের ভেতর গুমরে ওঠে রাগ।  বলি, তার নাম জানতে পারি কি? জ্যোতি ঘুরে দাঁড়িয়ে বলে, জেনে কি করবেন? আপনি তো কিছু করতেই পারবেন না।

তার মানে?

মানে তো জানি না।

তাহলে বললে কেন?

বললাম। তো? বলে সে হাত উলটে দেয়। বলে, পারবেন আমাকে বিয়ে করতে? 

এখন মনে হয়, তবে কী তার ফোন নম্বর নিলেই ভালো করতাম? নিলে এই যে বিরহবোধ, এই যে দেখার তীব্র আকাঙ্খা, সেটা কী থাকত? এই যে জ্যোতির টানে আমি দেশজ মানুষের সঙ্গ লাভ করছি, তাদের আবিস্কার করছি, তাদের চোখ দিয়ে নিজেকে চিনছি, সেটা কী থাকত? হয়তো থাকত, বা থাকত না। কিন্তু ফোন করে এটা অন্তত জানা যেত, অঘ্রানের রাত সে কীভাবে কাটায়। 

 জ্যোতি বাঁশপাতি পাখি চেনে না। এদিকে তারা যে দিনরাত তার বাড়ির সামনেই ডানা মেলে উড়ে যাচ্ছে, তাদের ধানমাঠের উপর দিয়ে, আশপাশে ওড়ে তারা—সেকথা মিথ্যে নয়। তাকে বললে সে বলে, দূর! ওগুলি এমনি ওড়ে। ওরা কোনো পাখি নয়।

তাহলে ওগুলো কী?

ছাতামাতা কিছু একটা হবে। এই বলে সে মাথা নাড়ে। দেখি গালের পাশে একটা তিল। সে বলে, আমাদের ধানজমির ওখানে অনেক টুনটুনি পাখি আছে। তারা ধানগাছে বসে দোলে। গান গায়। ওড়ে। তাদের গান শুনেছেন? 

ধানও তো পাকেনি এখনও।

তাতে কী? কাঁচা ধানে বসে দুলতে দোষ কি? অঘ্রান তো শেষ হয়নি এখনও। শেষ অঘ্রানে লোকে ধান কাটে। আমাদের জমির ধানও ওই সময়ে কাটা হবে।   

তা বটে! ওরা কী তবে কাঁচা ধান খায়?

পাখি তো-খেতেই পারে। তবে ধানগাছে দুলে-দুলে ওদের আমি খেলতে দেখি। 

এইভাবে আমি ক্রমশ আশ্চর্য হয়ে উঠি। বিভিন্ন দেশের সব পাখিরা উড়ে যায় সামনে দিয়ে, এদিক ওদিক বসে তারা, চক্রাকারে ঘোরে-ওড়ে, হোগলার বনে বসে—কিন্তু কাঁচাপাকা ধানগাছে বসে তাদের যে দুলতে দেখি না। এদিকে ধান কাটার সময় এসে গেল।

মনে হয়, পাখিরা তবে যায় কোথায়? কেন? তারা জ্যোতিদের বাড়িতে ছাদে গিয়ে বসে। ওরা তবে জ্যোতির ছাদে বসে গান গায়। অঘ্রানের রাতে সেইসব গানের ভাষায় জ্যোতি গালে হাত রেখে ঘুমিয়ে পড়ে।

এইভাবে কথা বলতে-বলতে একদিন বেলা পড়ে এল। বাতাসে হিম বাড়িতে লাগল। শীতের কামড় শুরু হল। শীতবস্ত্র গায়ে ভালো করে জড়িয়ে নিলাম। মাথার উপর দিয়ে একঝাঁক বক উড়ে গেল। এছাড়া অন্যান্য পাখিরা। মাথার উপর দিয়ে এই সন্ধেবেলা উড়ে গেলে সব পাখিদের প্রায় একইরকম লাগে। তখন মনে পড়ল জ্যোতির কথা।

এই অঘ্রান সময়ে সে কাজ থেকে ফেরে রাত দশটায়। এখন ট্রেন চালু হয়েছে। সে ট্রেনেই ফেরে। তার পর টোটো ধরে। স্টেশন থেকে সোজা বাড়ি। ফিরতে-ফিরতে তার রাত দশটা বেজে যায়।তার বাবাও কাজ থেকে ফেরে ওই সময়। বাড়িতে থাকে তার বোন ও মা। খেয়েদের শুতে যেতে রাত বারোটা-একটা। ওর সাপ্তাহিক ছুটি বৃহষ্পতিবার। সেদিন ও সারাদিন বাড়ি থাকে আর ঘুমায়।

ও বলে, আমাদের বাড়ি হচ্ছে।

হ্যাঁ, সেদিন ওর মুখে এই কথা শুনে আমি অবাক হয়ে গেলাম। কই, এতদিন ওর বাড়ির আশেপাশে ঘোরাফেরা করলাম, চোখে পরেনি তো! তবু সে বলে, হচ্ছে, হচ্ছে তো। একতলা বাড়ি ছিল আমাদের। সেখানে হচ্ছে।

একতলা ভেঙে দোতলা?

তা কেন? একতলার উপর দোতলা হচ্ছে।

ভারি চিন্তার কথা। এই যে এত বাইক নিয়ে চক্কর কাটি, তবু সে বাড়ি আমার চোখে পড়ে না-কেন? এই তো সেদিন গেলাম ওর বাড়ির সামনে দিয়ে। এখন লকডাউন পুরোপুরি উঠে গেলেও স্কুল-কলেজ বন্ধ। ফলে জ্যোতির কলেজপড়া বোন এখন বাড়িতেই থাকে। সেদিন সে দরজায় সামনে দাঁড়িয়েছিল। আমাকে পাড়ার মধ্যে দেখে বলল, এসো না।

আমি বলি, না। সে বলে, কেন? দিদি নেই বলে? আমি বলি, এমনিই। সে বলে, এমনিই এসো। আমি চুপ করে দাঁড়াই। ওদের বাড়ির সামনেই বাইক রেখেছি। জানি জ্যোতি নেই। সে এখন তার পার্লারের কাজে কাজে গেছে। তবু এসেছি। ওর পাড়ার গন্ধ নেব বলে।

ওর বাড়ির দরজার গায়েই বাইক দাঁড় করিয়ে স্টার্ট বন্ধ করে দিয়েছি। বাইকেই বসে থাকি। ওর বোন, প্রীতি  চৌকাঠ থেকে নেমে আসে না। সেখানে দাঁড়িয়েই একটু ঝুঁকে আমার বাইকের হ্যান্ডেলে হাত রাখে। আরও ঝুঁকে পড়ে বলে, আমি তোমার বাড়ি যাব।

এবার মুখ খুলতেই হয়। বলি, কেন? সে দুষ্টু হেসে বলে, যেতে পারি না? তুমি না-ডাকলেও আমি যেতেই পারি তোমার ঘর—আমি তোমার শালী না? তোমার দেহের আদ্দেক আমার—এটা মনে রেখো।

অমনি জ্যোতি তার পাশ থেকে ফস করে বেরিয়ে এসে বলে, ওই দু-পাঁচ মিনিটের জন্য এসে দাঁড়ালে হবে না। দিনের পর দিন, রাতের পর রাত এখানে এসে থাকতে হবে। তবেই না দেখা মিলবে।

তোমার?

না, পাখিদের।

তুমি আজ কাজে যাওনি?

সে মাথা নাড়ে। হাসে। আমি গালে হাত দিয়ে ভাবি। জ্যোতি যা বলে, ঠিকই বলে। সত্যি, তাকে চিনতে-জানতে গেলে এখানে যে পড়ে থাকতে হবে—এটা একশোভাগ সত্যি। কিন্তু আমি তা পারি না। কতটুকুই বা সময় দিতে পারি তাকে। এই নিয়ে আমার মধ্যেও খেদ রয়েছে। তাই ঠিক করি, একদিন সারাটা বিকেল কাটাবো এখানে। ওই যে দূরে ধানমাঠ, সেখানে ধানচারারা মাথা দোলায় অঘ্রানের বাতাসে, বেশ ঠান্ডা বাতাস দেয়, রোজই কাগজে শুনছি এবার জোরে শীত পড়বে, সাঁতরাগাছি ঝিলে পাখিরা নেমেছে আগের চেয়ে বেশি সংখ্যায়, এদিকেও পাখিরা আসছে। আকাশ থেকে মেঘেরা চলে যাচ্ছে, এমনি নীল আকাশ যে এইসময় আকাশকে দেখতে ভালো লাগে। আর এখানে ধানমাঠের পিছনে আকাশ পড়ে থাকে অনেকটা। মাঠের মাঝে একটি, দুটি বাড়িঘর উঠেছে বটে, কিন্তু আকাশ তাতে ব্যাহত হয় না।

তিন

 আজ অঘ্রানের শেষ রাত। এখন রাত দশটা। চারিদিক নিঃঝুম। আজ এসেছি, এখানে রাত কাটাবো বলে।

রোজ যেখানে বাইক দাঁড় করাই আজও রাখলাম সেখানেই। টিনের সেই বাড়িরটি অন্ধকারে মিশে আছে। বউটি কি ঘুমুচ্ছে? নাকি সে পিছনের জানালা খুলে রাত্রি নামা দেখছে?  চারিদিকে অনন্ত কুয়াশা। আর প্রবল শীতের বাতাস। এলোপাথাড়ি ভেসে যাচ্ছে কুয়াশার দল। এত কুয়াশা যে ধানমাঠের মধ্যে যে কিছু জমিতে এখনও কিছু ধান অবশিষ্ট আছে, বোঝা যাচ্ছে না তাদেরও। কেবল চলেছে কুয়াশার বিস্তার। আর থেকে-থেকে শুনতে পাচ্ছি প্যাঁচার আর শিয়ালের ডাক। সেই প্যাঁচাটা? এখানে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলে বা কোথাও বসে পড়লেও এই মাঠের ভেতর, অনন্ত-অঘ্রানের একটি রাতকে সম্পূর্ণ নিজের করে বুঝতে-জানতে পারব। 

জ্যোতিদের জানালা দিয়ে রাত দেখা যায়। ও কাজ সেরে ফেরে—একটি অনন্ত টোটো ওর জন্য স্টেশনের বাইরে এই রাতের মধ্যেও দাঁড়িয়ে থাকে। ফিরতে-ফিরতে ও রাতের অঘ্রান দেখে। ও বলে, খাওয়া-দাওয়া সেরে বোনের সঙ্গে গল্প করে ঘুমুতে-ঘুমুতে রাত একটা বাজে। এখন ওদের পাড়ায়, ওর জানালার ধারে গিয়ে দাঁড়ানো কী ঠিক হবে?

ওকে বলি, রাত দিয়ে রাত দেখো না। ও বলে, দূর! অত রাতে শুয়ে আর কাব্যি করতে ভালো লাগে না। পৃথিবী কত কঠিন জানেন? ইস্কুল বন্ধ; আপনি তো ঘরে বসেই মাইনে পেয়ে যাচ্ছেন, আমাদের খেটে ইনকাম করতে হয়। তখন আর রাত দেখা হয় না। রাতের ভেতর যে প্রাণীরা চলাচল করে, তাদের সঙ্গে চেনাজানা হয় না। এই যে কুয়াশা পড়ছে রোজ-রোজ, যেদিন প্রথম পড়ে সেদিন জানালা বন্ধ করতে গিয়ে দেখি আলের ওধারে সারসার প্যাঁচা বসে আছে।

অত প্যাঁচা? কেন? ওরা কী করে?

জ্যোতি বলে, ঠিকঠাক জানি না। তবে কোথায় নাকি ফসল বিক্রির নিয়ম বদলেছে, মান্ডি আর থাকবে না; কর্পোরেট হাতে চলে যাবে সব, তাই ওরা প্রতিবাদ করে ধানআলে দাঁড়িয়ে। ওখানেই থাকে খায় ঘুমায়। ওরা চায়, এই নতুন আইন বদলাক।

বলি, এত প্যাঁচা একত্রে থাকে, করোনা হবার ভয় নেই ওদের? জ্যোতি বলে, কই! এই ঠান্ডাতেও পাইপজলের স্রোত ওদের দিকে ধেয়ে যায়—ওরা তাও অকুতোভয়। নতুন নিয়মের বদলে পুরানো নিয়মই বহাল রাখতে চায় ওরা।

তুমি সেখানে কি করো?

দেখি।

আর কী করো?

খাই। শুই। ঘুমাই।   

ওর মুখে কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বলি, জানালা দিয়ে অঘ্রান দেখো না, জ্যোতি? হোগলাবনের জানালা দিয়ে তুমি কত-কত অঘ্রানের রাত নামা দেখতে পারো। 

ও ঠোঁট বেঁকিয়ে বলে, অঘ্রানের রাত? বাঁচি-মরি কী তারই কোনো ঠিক নেই! লকডাউনে কতদিন কাজ ছিল না, জানেন? ধান উঠলে তবে আমরা একটু ছড়িয়ে-ছিটিয়ে খেতে পাবো। বিয়ের ছয়মাস যেতে না যেতেই ফিরে এসেছি, বিয়ের ফাঁস থেকে ছাড় পেতে মামলা করেছি—তার খরচ কীভাবে আসছে জানেন? আমরা কীভাবে বেঁচে আছি—সেটাই আপনারা জানেন না।

নীচু গলায় বলি, অঘ্রানের এইসকল মায়াবী রাতে, তোমাদের এখানে কী হয় জ্যোতি?

কিচ্ছু হয় না। আমার পিছনে না-ঘুরে বাড়ি যান, বৌ-ছেলের যত্ন নিন, ভালো থাকুন।   

এদিকেও দেখি, সেই প্যাঁচাদেরই স্রোত। দিনেরবেলা যেভাবে দূর-দূরান্ত থেকে পাখিরা এসে বসে ধানমাঠে, দোল খায়, চরে—এরাও এদিক-ওদিকের কুয়াশামাখা আকাশ থেকে চলে আসছে অজস্র-অজস্র প্যাঁচারা! অসে পরপর বসে যাচ্ছে আলের উপর। ক্রমে-ক্রমে গোটা এলাকাই হয়ে যাচ্ছে প্যাঁচাদের।

মনে পড়ল, বেশ কিছুদিন আগেই আইন করে নিত্যপ্র্যোজনীয় জিনিস থেকে আলু-পেঁয়াজের নাম বাদ যাওয়ার পরই আলুর কেজি পৌঁছে গেছে পঞ্চাশে। পিঁয়াজ একশো। সর্ষের তেলের প্রতি লিটার দাম প্রায় দেড়শো ছুঁইছুঁই করছে। মুগডাল দুশো, পোস্ত চৌদ্দশো টাকা কিলো। নতুন আলু বাজারে এসে আলুর দাম এখন চল্লিশে নেমেছে বটে, পেঁয়াজ ষাট; এদিকে গ্যাসের দাম বাড়ল সিলিন্ডার পিছু পঞ্চাশ টাকা। পেট্রোলের দাম  রোজই বাড়ছে।

তখন দেখি, সেই লোকটা। দুপুরে যেখানে বসে সে ঢোলে সেখানেই সে একই জামাপ্যান্টে দাঁড়িয়ে এই প্রতিরোধ-বিপ্লবে নেতৃত্ব দেয়। আমি হাঁ-করে দেখি তার ইশারায় কেমন করে নেমে আসছে প্যাঁচারা। পর পর বসে যাচ্ছে। ক্রমে সেও একটি প্যাঁচা হয়ে গেল। মনে হল, জ্যোতিও কী এইভাবে প্রতিরাতে প্যাঁচা হয়ে ওঠে?

চরাচর, জগত, আশপাশ কেমন করে বদলে যাচ্ছে। দেশে-দেশে, রাজ্যে-রাজ্যে ক্ষমতায়নের ভাষা পালটে যাচ্ছে। করোনাকালীন এই দিনগুলিতে প্যাঁচারা সেসব পাল্টাতে চায়, বদলাতে চায়।

এখানে দাঁড়িয়ে মনে আসে সেই পুরানো কথা—আমরা বাঁচবো তো?

ani.chotogolpo@gmail.com
হুগলী

1 comment:

  1. সমীর কুমার মজুমদার

    অসাধারণ প্রাসঙ্গিক গল্পের উপস্থাপনা। হৃদয় স্পর্শ করে গেল

    ReplyDelete