1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Wednesday, March 31, 2021

অভিনেত্রী

 

ছবি  : ইন্টারনেট 
অভিনেত্রী
উত্তম চক্রবর্তী



ll এক ll

সেই ছোট বেলায় মা মারা যাবার পর থেকে শুধু বাবা আর ভাই সুজনকে নিয়েই সুমীর বড় হয়ে ওঠা। বাবা ছিলেন রেলের ইলেক্ট্রিশিয়ান, সুমী তখন ক্লাস ফাইভে, সুজন মাত্র ক্লাস টুতে পড়ছে। মায়ের একটা অনেক পুরানো মাথার যন্ত্রনা ছিল। কিন্তু অনেক ডাক্তার দেখিয়েও কোন লাভ হয়নি। সমর বোস একটাই ভুল করেছেন যে স্ত্রীকে কলকাতায় এনে চিকিৎসার কোন চেষ্টাই করেন নি। ফলে এক সময় চুড়ান্ত বাড়াবাড়ি হলে পর হাসপাতাল জানিয়ে দিল মাথায় ব্রেন টিউমার এবং তখন একমাত্র অপারেশন ছাড়া আর কোন কিছু করা যাবে না। শেষে সেই অপারেশন থিয়েটারেই প্রাণ হারালেন সুমীর মা।

জামালপুরের রেলের চাকরিতে এরপর আরও কুড়ি বছর কাজ করে রিটায়ার করেছেন সমর বাবু। ততদিনে মেয়ে সুমী বাংলা নিয়ে বি এ পাশ করে একটা জুনিয়র হাই স্কুলে চাকরি পেয়ে গেছে। সুজন কলকাতায় বি টেক করে জামালপুরে রেলেই ইলেকট্রিকাল জুনিয়র ইঞ্জিনিয়ারের চাকরিতে ঢুকে পড়েছে। সমর বাবু কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও সুমীকে বিয়ের পিড়িতে বসাতে পারলেন না। সুমীর বয়স ততোদিনে তিরিশ পার হয়ে একত্রিশ, নিজের প্রচেষ্টায় ওর এম এ পাশ করাও হয়ে গেছে। তখন সমর বাবু বাধ্য হয়েই একমাত্র ছেলে সুজনের বিয়ে দিয়ে দিলেন আসানসোলের ওঁর এক বন্ধুর মেয়ে লীনার সাথে। রিটায়ার্ড শ্বশুর, অবিবাহিতা দিদি সুমী আর সুজনকে অল্প সময়ের মধ্যেই লীনা আপন করে নিলো। কিন্তু সমস্যা হল সুমীর আর জামালপুরে থাকবার কোন ইচ্ছাই রইল না। 

অবশেষে সুমী বি এড পড়বার জন্য একাই একদিন কলকাতা চলে আসে। সুমী এতোদিন সংসারের চাপে পড়ে , ভাইয়ের পড়াশুনা, বাবাকে দেখাশুনা করা আর ঘর ও স্কুলের কাজের চাপে কোনদিনই নিজের উপর নজর দিতে পারেনি বা নিজের সখ আলহাদের দিকে খেয়াল করেনি। এখন বাড়িতে ভাইয়ের বউ এসে পড়ায় ওর আর কোন বাঁধন রইল না। হ্যাঁ, বাবা জীবিত আছেন ঠিকই, তবে ভাইতো রইল বাবার দেখাশুনা করবার জন্য। আগেই নেট ঘেঁটে লেডিস  মেসের সন্ধান করে একটা ঘর বুক করে রেখেছিল। সেদিন সকাল বেলা হাওড়া স্টেশনে নেমে সোজা চলে এলো ওর শিয়ালদার  সেই মেস বাড়িতে। এখান থেকেই শুরু হয়ে যায় সুমীর এক নতুন জীবন।

সুমী মেয়েটি দেখতে মন্দ নয়। গায়ের রঙ বেশ ফর্সা, সাস্থ্য খুব ভালো, লম্বা প্রায় সাড়ে পাঁচ ফুট, মাথায় ছোট স্টেপ কাট করে কাটা চুল। এখন ওর বয়স বত্রিশ। সাধারণত সালোয়ার কামিজ পরে থাকতে ভালবাসে। শাড়ী পরবার অভ্যাস নেই বলা যায়। একমাত্র পূজো এবং কোন পারিবারিক বা সামাজিক অনুষ্ঠানে সুমী শাড়ী ছাড়া অন্য কিছু পড়তে চায়না। আর শাড়ী পরলে সুমীকে একদম অন্য রকম লাগে। ওর পারসোনালিটি অনেক বেড়ে যায় এবং দেখে মনে হয় ওর বয়স পঁয়ত্রিশ ছাড়িয়ে গেছে। তবে বাইরে থেকে গম্ভির দেখালেও আসলে সুমী কিন্তু বেশ রসিক মেয়ে। আড্ডা মারতে, হিন্দি গান শুনতে বা সীনেমা দেখতে খুব ভালবাসে। যদিও কলকাতায় চলে আসবার পর সুমীর জীবনে এলো এক অদ্ভুত পরিবর্তন। সুমী এখন ওর বি এড পড়া নিয়ে, লাইব্রেরী গিয়ে নোট নিতেই বেশি ব্যস্ত থাকতে ভালোবাসে।      

ফাইনাল সেমিস্টার শেষ হবার পরেই সুমী আমহার্স্ট স্ট্রিটে রাম মোহন কলেজে বাংলার অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রোফেসরের চাকরি পেয়ে গেল। একমাস বাদেই ওকে নতুন বছরের শুরুতে সেই চাকরিতে জয়েন করতে হবে। সুমী কয়েকদিনের জন্য জামালপুরে থেকে আসতে চলে গেল। কিন্তু যাবার আগে ওর এক রুম মেট শিখাকে বলে রেখে গেল ওর কলেজের কাছাকাছি একটা  এক কামরার ঘর দেখে রাখতে যাতে ওর কলেজ করতে সুবিধা হয়। নতুবা শিয়ালদা থেকে ওর কলেজে যেতে অনেকটা হাটতে হবে রোজ। সুমী কলেজের কাছা কাছি থাকাটাই বুদ্ধিমানের কাজ মনে করছিল। 

ll দুই ll

রাম মোহন কলেজ থেকে হাঁটা পথে মাত্র পাঁচ মিনিট দুরে সুখিয়া স্ট্রিটের কাছে সাইবাবা মন্দিরের পিছন দিকে একটা বড় ফ্লাট বাড়ির দোতলায় একটা এক কামরার ফ্ল্যাট দেখে রেখেছিল ওর বান্ধবী ও রুম মেট শিখা। জামাল্পুর থেকে চারদিন বাদে সকালে ফিরেই বিকেলবেলা দুই বন্ধু গিয়ে হাজির হল সেই ফ্ল্যাট বাড়িটার দরজায়। পাঁচতলা বাড়িটার নিচে কার পারকিং আর উপরে চারটে ফ্লোর। প্রতি তলায় একটা সিঙ্গেল বেড রুম আর তিনটা টু বেড রুম ফ্ল্যাট আছে। সিঙ্গেল বেড রুম ফ্ল্যাটে ঢুকেই একটা ছোট বসবার ঘর, পিছনে ব্যাল্কনির সাথে লাগোয়া একটা ভাল বড় বেড রুম, একটা বাথরুম ও কিচেন। ভাড়া মাত্র পাঁচ হাজার টাকা, ডিপোসিট কুড়ি হাজার টাকা।

ফ্ল্যাট বাড়িটা প্রায় দশ বছরের পুরানো, মোট ষোল খানা ফ্ল্যাট। যদিও অনেক মালিকই  নিজেরাই থাকেন, তবে বেশ কিছু ফ্ল্যাট ভাড়া দেওয়া আছে। সিকিউরিটি, জেনারেটর, লিফট সবই আছে। সুমীর ফ্ল্যাট খানা দেখেই পছন্দ হয়ে গেল। আর সবচেয়ে সুবিধা হল ওর কলেজ এখান থেকে বেরিয়ে মাত্র পাঁচ মিনিটের রাস্তা, হেটেই চলে যাওয়া যাবে। সুমীকে শুধু একটা খাট ও একটা আলমারীর ব্যাবস্থা করতে হবে। জানা গেল বৌবাজারে নাকি পুরানো বেশ ভাল খাট আলামারী ইত্যাদি সব পাওয়া যায়। সুমী ঠিক করল একদিন গিয়ে রান্নার জিনিস পত্র আর খাট আলমারী সোফা কিনে ওর এই সুন্দর ছোট্ট ফ্ল্যাটখানা গুছিয়ে নেবে। 

এর আগে নাকি এক বিধবা মহিলা তার মেয়েকে নিয়ে অনেক বছর ছিলেন এই ফ্ল্যাটে। মেয়েটি একটা বাঙ্কে চাকরি করত। মাস চারেক আগে মেয়েটির বিয়ে হয়ে যায়। সেই বিধবা মহিলা মেয়ের বিয়ে দিয়ে এই ফ্ল্যাট ছেড়ে দিয়ে শিলিগুড়িতে তার ভাইয়ের কাছে চলে গেছেন গত মাসে। ফ্ল্যাটের মালিক সপরিবারে থাকেন বোম্বেতে, সেখানে তার বিশাল ব্যবসা। সিকিউরিটির কাছে চাবি থাকে। বাঙ্কে প্রতিমাসে ভাড়া জমা করে দিতে হবে, এগ্রিমেন্টে সে ভাবেই লেখা আছে। দুদিন বাদেই সুমী সুটকেস ও জামা কাপড় নিয়ে চলে এলো ওর নতুন ঠিকানায়। এরপর আরও এক সপ্তাহের মধ্যে গুছিয়ে ফেলল  নিজের সংসার।

প্রায় তিন মাস বাদে একদিন কলেজ থেকে বাড়ি ফিরে ফ্রেস হয়ে চায়ের কাপ হাতে টি ভি খুলে বসে খবর দেখছিল সুমী। নতুন কলেজটা বেশ ভালো লাগছে ওর। ছাত্রীরা সুমীর মত স্মার্ট, শান্ত ও ভদ্র টিচার পেয়ে খুব খুশি। বিকেল সাড়ে পাঁচটার মধ্যেই সুমীর ক্লাস শেষ হয়ে যায়। এম এ বি এড করে এত ভালো একটা চাকরী পাবে সুমী ভাবতেই পারেনি। তবে ওর আশা ছিল কলকাতায় এসে ওর বি এড করাটা কখনই বৃথা যাবে না। আর সত্যিই ভগবান ওকে দেখেছেন, ওর স্বপ্ন পুরণ করেছেন আজ। যদিও মাঝে মাঝে নিজেকে বড্ড একা লাগে সুমীর। পুরানো মেস বাড়ির দু একজন বান্ধবী ও কলেজের নতুন কয়েকজন বান্ধবী ছাড়া ওর আর কোন সঙ্গি সাথী নেই। শুধু প্রায়ই ভাইয়ের বৌ লীনা দিদিকে ফোন করে বাড়ির খবরা খবর দেয়।   

সুমীর বাবা সমর বাবু তার এক বন্ধুর শালার ছেলের সাথে একবার মেয়ের বিয়ের চেষ্টা করে প্রায় তাদের কথা দিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু তখনও ভাই ওর ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করে নি। সুমী ভাইকে প্রতিষ্ঠিত না করা পর্যন্ত নিজে বিয়ে করবে না গোঁ ধরে বসেছিল। পাত্র একটি নেভি কোম্পানিতে চাকরি করে, মুম্বাইয়ে পোস্টিং। সুমী তার ফটো দেখেছিল, দেখতে শুনতে ভালই ছিল। কিন্তু ঐ, ওর জেদের কাছে এবারও সমর বাবু হার মানলেন। সুমী এখন বিয়ে করবে না বলে এড়িয়ে গেছিল। এরপর সমর বাবু হাল ছেড়ে দেন। সুমীর জীবনে এখন পর্যন্ত কোন পুরুষের প্রবেশ ঘটেনি, বা বলা যায় সুমীই সব সময় ছেলেদের সান্নিধ্য বা তাদের ইশারা গুলিকে পাত্তা দেয়নি, কাউকেই কাছে ঘেসতে দেয়নি।   

ফ্ল্যাট বাড়িতে কয়কদিন হল নতুন সিকিউরিটি কোম্পানি এসে কাজে যোগ দিয়েছে। সেদিন সন্ধ্যায় দরজায় কলিং বেলের আওয়াজ শুনে সুমী গিয়ে দরজা খুলে দেখে সামনে ঐ কোম্পানির একজন নতুন সিকিউরিটি গার্ড দাঁড়িয়ে। মাঝ বয়সী লোকটাকে সুমী আগেও দেখেছে মেন গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে। লোকটা একটা এনভেলপ এগিয়ে দিয়ে বলল,”মেম সাব, আপনার চিঠি, পোস্টে এসেছে।“ এই বাড়িতে কোন পিয়নকে উপরে উঠতে দেওয়া হয়না। সিকিউরিটির কাছেই চিঠি পত্র রেখে যায় ওরা।

ll তিন ll

সুমী ঠিক তখনই খবর শেষ করে একটা বাংলা সিরিয়াল দেখতে শুরু করেছিল। হাত বাড়িয়ে চিঠিটা নিয়ে আবার দরজা বন্ধ করে টি ভির সামনে রাখা দুটো সেকেন্ড হ্যান্ড সোফার একটায়  বসে সিরিয়ালে মগ্ন হয়ে পড়ল। ভাবল বোধ হয় বাবার চিঠি এসেছে, পরে পড়া যাবে খন। কিছুক্ষন বাদে সিরিয়াল শেষ করে খামটা হাতে নিয়ে দেখল সেখানে কোন এক মিস এস বসাক, ফ্ল্যাট নম্বর ২০৪, মালতী ম্যান্সন, ২১/৮, সুখিয়া স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০০০৬ লেখা। সুন্দর হাতের লেখায় লেখা এই বাড়ির ঠিকানা একদম ঠিক আছে, শুধু নামের যায়গায় সেটা বসাক না হয়ে বসু হবে। চিঠিটা পাঠিয়েছে কোন এক ইন্দ্রজিৎ মল্লিক।

এবার সুমী বুঝতে পারল এটা ওর চিঠি নয়। হয়ত এই ফ্ল্যাটের আগের ভাড়াটের মেয়ের নাম ছিল ঐ মিস এস বসাক। সুমী চিঠিটা টেবিলের উপর রেখে দিল কাল সকালে কলেজ যাবার পথে সিকিউরিটিকে ফেরত দিয়ে দেবে ভেবে। এরপর আরও কিছুক্ষন টি ভি দেখে রাত সাড়ে নটায় ডিনার সেরে লাইট নিভিয়ে শুয়ে পড়ল সুমী। অনেকক্ষণ চেষ্টা করেও ওর চোখে ঘুম আসছিল না। বারবার ভাবছিল সেই চিঠি খানার কথা। কে এই ইন্দ্রজিত মল্লিক ? তার সাথে এই মিস এস বসাকের কী সম্পর্ক ছিল ? লোকটা কী জানেনা যে ঐ মেয়েটির বিয়ে হয়ে গেছে আর এই বাড়ি ছেড়ে ওর মা’ও চলে গেছে ? বিভিন্ন ছোট ছোট প্রশ্নে সুমীর মনটা বিক্ষিপ্ত হয়ে উঠছিল। ফলে ওর চোখের ঘুম কেড়ে নিল সেই চিঠি খানা।

সুমী প্রায় ঘণ্টা খানেক মনের সাথে অযথা যুদ্ধ করে উঠে জল খেয়ে চিঠিখানা হাতে নিয়ে বিছানায় বসে একটু ইতস্তত করে শেষপর্যন্ত খুলেই ফেলল খামটা। প্রায় দুই পাতার একটা বাংলায় লেখা চিঠি সেটা। চিঠির ভাষা পড়তে পড়তে সুমীর সারা শরীর ঘেমে উঠল। প্রতিটি অক্ষরে অক্ষরে ঝরে পড়ছে সেই ইন্দ্রজিত মল্লিকের বুকভরা ভালবাসার বর্ণনা। এ যেন দুর পাহারের গা বেয়ে এক কুলু কুলু ঝরনা বয়ে চলেছে চিঠির প্রতিটি লাইনের মাঝখান দিয়ে সুদুর সাগরের বুকে ঝাপিয়ে পড়বার জন্য। আজ অনেকদিন বাদে তার প্রিয়তমাকে লিখতে গিয়ে সেই ইন্দ্রজিৎ নামের লেখক ভাবের সাগরে গা ভাসিয়ে দিয়েছে। বেশ বোঝা যাচ্ছে ইন্দ্রজিৎ মল্লিকের প্রেয়সী ছিল সেই মিস এস বসাক যাকে ইন্দ্রজিৎ শেষ দেখেছিল দুই বছর আগে এম বি এ পড়তে দিল্লি যাবার আগে। 

চিঠিতে ইন্দ্রজিৎ লিখেছে এক বছর আগে মিস বসাক, অর্থাৎ ইন্দ্রজিতের প্রিয়তমা স্নিগ্ধা যখন ওকে জানাল যে ওর মা ওর বিয়ের সম্বন্ধ প্রায় ঠিক করে ফেলেছেন তখন ইন্দ্রজিৎ ওর পরীক্ষার জন্য কোন উত্তর দিয়ে উঠতে পারে নি। আর তারপরেই ওর করোনা হয় এবং হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। প্রায় পনের দিন বাদে হাসপাতাল থেকে ফিরে স্নিগ্ধাকে ওর চিঠির উত্তর দেবে ভেবেও দিতে পারে নি, কারন এক যদি করোনা হয়েছে শুনে স্নিগ্ধা ঘাবড়ে যায়, আর দুই ইতিমধ্যে যদি স্নিগ্ধার বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়ে থাকে ? কিন্তু স্নিগ্ধাকে ও সেদিন চেপে গেলেও আজ তার ওকে বলতে কোন দ্বিধা নেই, কারন ইন্দ্রজিৎ এখন সম্পূর্ণ সুস্থ এবং গত মাসেই কলকাতার একটা নামী খবরের কাগজে চাকরী পেয়ে চলে এসেছে। 

এই মূল কথাটাই ইনিয়ে বিনিয়ে বিভিন্ন ভাষার ছলচাতুরীতে স্নিগ্ধাকে জানাতেই যে এতদিন বাদে এই চিঠি লিখবার উদ্দেশ্য সেটা সুমী বেশ ভালই বুঝতে পারল। চিঠিটার নিচে ‘ অনেক অনেক ভালবাসা নিও - ইতি তোমার ইন্দ্র’ লেখা। সুমী দেখল চিঠিটা চারদিন আগে বৃহস্পতিবার লেখা এবং স্থানীয় পোস্ট অফিসের স্ট্যাম্পে আজকের তারিখ আছে। চিঠিটার মধ্যে কোথাও বা বাইরে খামটার উপর প্রেরকের অর্থাৎ ইন্দ্রজিতের কোন ঠিকানা লেখা নেই। শুধু কলকাতার একটা বিখ্যাত ইংরাজি পত্রিকার নাম ছাপা খামে ও একটা পোস্ট বক্স নম্বর দেওয়া আছে। অর্থাৎ চিঠিটা ডেলিভারি না হলে সেই পোস্ট বক্সে ফেরত পাঠাতে হবে। সুমী বুঝতে পারল ইন্দ্রজিৎ ভিষন বুদ্ধিমান এবং এখনই ওর ঠিকানা জানাতে চায়না। সুমী চিঠিটা যথাস্থানে রেখে লাইট নিভিয়ে আবার বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল। বুঝল যে স্নিগ্ধার যে বিয়ে হয়ে গেছে সেটা তার মানে ইন্দ্রজিৎ এখন জানেনা। ওরা আজও এই বাড়িতে থাকে ভেবেই সে এই চিঠিটা পাঠিয়েছে। সুমী এখন কী করবে ভাবতে ভাবতেই এক সময় ঘুমে ঢলে পড়ল।

ll চার ll

ইন্দ্রজিৎ তার বাপ মায়ের দ্বিতীয় সন্তান। ওর বাবা মনোজিত মল্লিক বড় বাজারে একটা হোটেল চালান। জনা দশেক কর্মচারী, নিজে ও বড় ছেলে মিলে খাবারের হোটেলটা বেশ রমরমিয়ে চালাচ্ছেন ওঁরা। ছোট ইন্দ্রজিৎ কিন্তু বরাবরই একটু অন্য ধরনের। বি কম পাশ করে সে এম বি এ করতে চলে যায় দিল্লিতে। বাবার অঢেল পয়সা। দিল্লিতেই  করোলবাগে একটা মেস বাড়িতে একটা আলাদা ঘর নিয়ে পড়াশুনা করতে থাকে ইন্দ্রজিৎ। কিন্তু ভুলতে পারেনা ওর কলেজের সহ পাঠিনী স্নিগ্ধার কথা। কলেজ জীবনের দুই বছর স্নিগ্ধার সাথে প্রেমের জোয়ারে গা ভাসিয়ে দিয়েছিল ইন্দ্রজিৎ , অর্থাৎ ওর প্রেয়সীর প্রিয়তম ইন্দ্র। দিল্লিতে এসেও চিঠি ও ফোনে ওদের যোগাযোগ বজায় থাকে। যদিও স্নিগ্ধার শেষ চিঠি আসবার পর ইন্দ্র করোনাতে আক্রান্ত হওয়ার পর থেকে ওদের মধ্যে সমস্ত যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। 

ইন্দ্রজিৎ এম বি এ পাশ করে কলকাতায় একটা বিখ্যাত ইংরাজি পত্রিকায় চাকরী পেয়ে যায়। বিজ্ঞাপন বিভাগে সহকারী হিসাবে কাজে জয়েন করে ইন্দ্রজিৎ। ওদের শোভা বাজারের বাড়ি থেকে অফিসে মেট্রো রেলেই যাতায়াত করে আপাতত। তবে ওর ইচ্ছা আছে একটা মোটর সাইকেল কিনে নেবার। বাবার গাড়ি আছে, আর দাদা ইন্দ্রজিতের আগের মোটর সাইকেলটা এখন ব্যবহার করছে। ইন্দ্রর বয়স এখন সবে আটাশ। ওর চেহারাটা ভিষন সুন্দর। লম্বায় প্রায় ছ ফুট, গায়ের রঙ চাপা হলেও স্বাস্থ্য  ও মুখশ্রী বেশ সুন্দর। মাথা ভর্তি ঝাঁকরা চুলে চোখে গগলস পরে বের হলে মেয়েরা ঘুরে ঘুরে তাকায় ইন্দ্রজিতের দিকে। 

স্নিগ্ধাকে নিয়ে একসময় ইন্দ্র ভিক্টোরিয়া, আউট্রাম ঘাট এসব যায়গায় মোটর সাইকেল নিয়ে অনেকবার ঘুরে বেরিয়েছে। কিন্তু স্নিগ্ধাকে ওর বাড়ির ব্যাপারে বেশি কিছু জানায়নি ইন্দ্র। শুধু জানিয়েছিল যে ওদের বড় বাজারে একটা ব্যবসা আছে যেটা ওর বাবা আর দাদা দেখাশুনা করে। ওদের বাড়িও কাছাকাছি। কিন্তু ঠিক কোথায় ইন্দ্রজিতের বাড়ি সেটা স্নিগ্ধা কোন দিনই জানতে পারেনি। আর যেহেতু কলেজে ওদের প্রায় রোজই দেখা শুনা হত স্নিগ্ধাও ইন্দ্রজিতের বাড়ির ব্যাপারে তেমন আগ্রহ দেখায়নি কোনদিন। তবে মোবাইল ফোনে ওদের রোজই অনেকক্ষন যাবত কথাবার্তা বা চ্যাটিং হত। কিন্তু ইন্দ্র স্নিগ্ধার সাথে  যোগাযোগ বন্ধ করে দেবার পরে অনেককে জিজ্ঞাসাবাদ করেও স্নিগ্ধা ওর বাড়ির কোন খোঁজ পায়নি।

এদিকে স্নিগ্ধার মা ওদের শিলিগুড়ির দাদার এক বন্ধুর ছেলের সাথে মেয়ের বিয়ের কথা বার্তা চালাতে থাকেন। স্নিগ্ধা যে কারো সাথে প্রেম করছে সেটা উনি আঁচ করতে পারছিলেন, আর তাই তাড়াতাড়ি মেয়ের বিয়ে পাকা করে ফেললেন। পাত্র বিনয় কলকাতা ইলেকট্রিক সাপ্লাইয়ে খুব ভাল চাকরী করে। শিলিগুড়ির বাড়িতে মা , একটা বোন আর বাবা ছাড়া আর কেউ নেই। সুন্দর চেহারা আর বেশ ছিম ছাম পরিবার। স্নিগ্ধা ওর ফিয়াসের কাছ থেকে এরকম ব্যবহার আশা করেনি। বাধ্য হয়ে মায়ের চাপের কাছে ওকে মাথা নত করতে হয়। চার মাস আগে শীতের সন্ধায় ওর বিয়ে হয়ে যায়। এরপর দুই আড়াই মাস বাদেই স্নিগ্ধার মা ওর দাদার বাড়িতে শিলিগুড়ি চলে যান।    

কলকাতায় এসে চাকরিতে জয়েন করে ইন্দ্রজিৎ কয়েকদিন চুপচাপ থাকে। এখন ওর কাজ হল প্রত্যেকদিন খবরের কাগজের বিভিন্ন বিজ্ঞাপনের জবাবে যত চিঠিপত্র আসে সেগুলি দেখা ও তার স্টক চেক করে সহকারীকে দিয়ে যেখানকার চিঠি সেখানে সেই দপ্তরে পৌঁছে দেওয়া ও বিজ্ঞাপনের জবাবের  এম আই এস করে  সহকারী সম্পাদকের কাছে জমা করা।

এই সময় একদিন ইন্দ্রর মাথায় বুদ্ধি আসে শুধু ওর একজন বিশেষ পরিচিত খদ্দেরের পোস্ট বক্স নম্বর দিয়ে স্নিগ্ধাকে একটা সুন্দর করে গুছিয়ে রসিয়ে চিঠি লিখে বাই পোস্টে পাঠিয়ে ওদের পুরানো সম্পর্কটাকে চাঙ্গা করে তোলা। শেষ যখন কথা হয়েছিল তখন স্নিগ্ধা একটা বাঙ্কে চাকরী পেয়েছে এবং পরের মাসে এক তারিখ ওকে জয়েন করতে হবে। কিন্তু সেই ব্যাঙ্কটার নাম বা কোন ব্রাঞ্চ তখনও স্নিগ্ধা ওকে কিছুই বলতে পারে নি। শুধু ওর ফ্ল্যাটের ঠিকানাটা ছিল ওর কাছে। সেই ঠিকানার ভরসায় ঠাকুরের নাম করে অনেক আশা নিয়ে চিঠিটা পোস্ট করে দিয়েছিল ইন্দ্রজিৎ।     

ll পাঁচ ll

পরের দিন সকালে চিঠির কথা ভুলেই গিয়েছিল সুমী। বেশি রাতে ঘুমনোর ফলে সুমী উঠল একটু বেলা করে। তাড়াতাড়ি স্নান করে টিফিন খেয়ে কলেজে চলে গেল সুমী। আজ ওর প্রথম ক্লাস ঠিক বেলা দশটায় শুরু হবে। রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাবার সময় সুমীর মনে পরে গেল আগের রাতের ঘটনা। ইন্দ্রজিতের চিঠির ভাষা মনে করে আবার সুমীর সারা শরীরে একটা বিদ্যুত খেলে গেল যেন। এ যেন উপন্যাসে পড়া গল্পের মত এক বিরহে কাতর নায়ক তার নায়িকাকে সম্বোধন করে তার কাছে ক্ষমা ভিক্ষা করে তার অতি সুন্দর দেহবল্লরীর উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে প্রিয়তমার মান ভঞ্জনের এক আকুল কাকুতি করছে। প্রতিটি লাইন প্রেম রসে টাই টম্বুর, যেন নায়িকাকে নায়ক মদিরার নেশায় মাতিয়ে রাখবার চেষ্টা করে চলেছে। বাংলা সাহিত্যে এরকম কোন প্রেম পত্রের কথা পড়েছে বলে ওর মনে পরল না।      

সুমী মনে মনে এক চোট হেসে নিলো। আবার স্নিগ্ধার বিয়ে হয়ে গেছে আর সেই খবরটা ছেলেটা জানে না ভেবে ইন্দ্রজিতের জন্য ওর মনটাও নরম হয়ে পড়ল। ভাবল বাড়ি ফিরে আবার একবার চিঠিটা পড়ে তারপর ভাবা যাবে কি করা যায়। এখন আর এসব ভাবতে গেলে ক্লাসের পড়ায় ব্যঘাত ঘটবে। সারাদিন পাঁচখানা ক্লাস ও ছাত্রীদের সাথে ক্লাসের বাইরে বিভিন্ন আলোচনায় কেটে গেল সুমীর দিনটা। সন্ধ্যাবেলা বাড়ি ফিরে ফ্রেস হয়ে চায়ের কাপ হাতে সোফায় বসে টি ভি চালিয়েই আবার সুমীর মনে পড়ে গেল কালকের ডাকে আসা ইন্দ্রজিতের সেই চিঠিটার কথা। সুমী টি ভি বন্ধ করে আবার খামটা হাতে নিয়ে বিছানায় শুয়ে শুয়ে পড়তে লাগল  সেই প্রেম পত্রখানা। 

সুমী চিন্তা করতে থাকে আচ্ছা সেই মিস স্নিগ্ধার হাতে যদি এই চিঠিখানা সত্যিই এসে পড়ত তাহলে সেই মেয়েটি এই চিঠিটা পড়ে কিভাবে রিএক্ট করত ? স্নিগ্ধা নিজেও কি ইন্দ্রর এরকম রসালো প্রেম পত্র আগে কখনো পড়েছে ? আচ্ছা স্নিগ্ধা মেয়েটি কি সত্যিই ইন্দ্রকে ভালোবাসতো ? ও কি বিয়ের আগে হন্যে হয়ে ইন্দ্রর সাথে যোগাযোগ করবার কোন চেষ্টা সেইভাবে করেছিল ? কেমন দেখতে ছিল মেয়েটি, তার স্বভাব চরিত্র কেমন ছিল, কী কী ভালোবাসতো মেয়েটি ? বোঝাই যাচ্ছে ছেলেটি বেশ রোমানটিক, কিন্তু স্নিগ্ধাও কি সেইরকম রোমানটিক ছিল ? সুমী হটাত নিজেকে স্নিগ্ধার যায়গায় বসিয়ে ভাবতে থাকে ব্যাপারটা।

কী মনে হতেই সুমী উঠে একটা প্যাড ও কলম নিয়ে টেবিলে বসে লিখতে শুরু করল। যেন স্নিগ্ধা এতোদিন বাদে ইন্দ্রর এই চিঠিটা পেয়ে ভীষণ ভাবে আনন্দও পেয়েছে আবার রেগেও গেছে। নিজেকে স্নিগ্ধার যায়গায় বসিয়ে সুমী লিখল, “ প্রিয় ইন্দ্র। আজ এতোদিন পরে হটাত তোমার চিঠিখানা আমাকে যেন উড়িয়ে নিয়ে গেল সেই দুইবছর আগের আউট্রাম ঘাটের ছায়া ঘেরা গঙ্গার ফুরফুরে হাওয়ার বিকেলে। চিঠিটা পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিল তুমি দিল্লি চলে যাবে শুনে আমি যেন তোমার কাঁধে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছি আর তুমি আমার গালের ঝরে পড়া ফোটা ফোটা জল রুমাল দিয়ে মুছে দিচ্ছ। আমার রাগ আর দুঃখ দুটোই হচ্ছিল, কিন্তু আবার ভীষণ ভালো লাগছিল তোমার কাঁধে মাথা রেখে চোখ বুজে পরে থাকতে। আজও আমি এই চিঠিখানা পড়ে অনেকক্ষণ চোখ বুজে পড়ে ছিলাম।“ 

 সুমী এবার থেমে গেল আর ওর লেখা চিঠিখানা বার বার পড়ে মনে মনে খুব এক চোট হেসে নিলো। সুমী ভাবতেই পারছিল না যে ও কোনদিন এত ভালো একটা প্রেম পত্র লিখতে পারে। কিন্তু এবার সুমীর মনে হল এই স্নিগ্ধা মেয়েটার ব্যাপারে একটু খবর নেওয়া যাক। পরশু সকালেই পাশের ফ্ল্যাটের বিশ্বাস বৌদি ওর কাছ থেকে এক বাটি চিনি নিয়ে গেছিল, সুমী গিয়ে হাজির হল ওদের দরজায়, বাটি নেবার অছিলায়।

বিশ্বাস বৌদি ঘরে বসিয়ে চা খাইয়ে অনেক গল্প করলেন। তার কাছ থেকেই সুমী জানতে পারল স্নিগ্ধা নাকি খুব ভাল আর মিষ্টি মেয়ে ছিল। খুব ভালো গান গাইত মেয়েটি। ওঁর ছেলের জন্মদিনে এসে ওদের গানও শুনিয়েছে। বৌদি এলবাম খুলে সেই অনুষ্ঠানের ছবিও দেখালেন। সুমী লক্ষ্য করল মেয়েটির গায়ের রঙ চাপা হলেও মুখটা ছিল খুব মিষ্টি, চোখ দুটো বেশ বড় বড়। দেখেই বোঝা গেল মেয়েটি বেশ ভাল ছিল। ওর মা ছিলেন বেশ রাগী মানুষ। কলেজ ছাড়া মেয়েকে বেশি বেড় হতে দিতেন না।

ll ছয় ll

একটা জিনিষ সুমী বুঝতে পেরে গেছিল যে এই ফ্ল্যাটবাড়ির কেউই কখনো ইন্দ্রজিতের নাম শোনে নি বা ওকে দেখেও নি। সুমীর ভীষণ ইচ্ছা হতে থাকে এই ইন্দ্রজিৎ নামের যুবকটির সাথে আলাপ পরিচয় করে তার সান্নিধ্যে যেতে। সুমী ওর হাতের লেখা এই অসাধারন প্রেম পত্রটা পড়বার পর থেকেই কেন যেন নিজেকে স্নিগ্ধার যায়গায় বসিয়ে ফেলেছে আর স্নিগ্ধা কী কী করতে পারত সেই সবই ভাবতে থাকে সারাক্ষন। কল্পনায় ইন্দ্রজিৎ নামের যুবকটির আকুল দৃষ্টি ওকে আকর্ষণ করতে থাকে। কল্পনায় সুমী ইন্দ্রর ভালবাসার মৌতাতে মজে যায়। কেবল বিভিন্ন দৃশ্য কল্পনা করে আর মুচকি মুচকি হাসে। সেই রাতে ঐ চিঠি আর লেখা হয়ে ওঠে না। কিন্তু রাতেই সুমী স্বপ্ন দেখে ও কোন একটা ছেলের সাথে এক বাগানের লোহার বেঞ্চে বসে তার সাথে গল্প করছে। কিন্তু ছেলেটার মুখটা ও দেখতে পাচ্ছে না। 

এরপর ক্লাস টেস্টের কাজের চাপে আরও কয়েকটা দিন বেরিয়ে গেল। শনিবার ছুটির দিন বিকেলে চা খেতে খেতে সুমী আবার গিয়ে বসল ওর লেখার প্যাড নিয়ে। আগের দিন যতটা লিখেছিল সেটা আর কাটল না। একবার রিভাইস দিয়ে নিয়ে আবার নিচের প্যারায় লিখতে থাকে, “ জানো ইন্দ্র, তোমার কাছ থেকে কোন সারা না পেয়ে আমি ভীষণ হতাশ হয়ে পড়েছিলাম। আমি জানি তুমি আমাকে মনে প্রানে ভালোবাসো। আমার এই ভালোবাসা তোমার পথের পাথেয় আর সেই পাথেয়কে সাথে নিয়েই তুমি সেই সুদুর দিল্লিতে পাড়ি দিয়েছিলে পড়াশুনা করতে। আমাদের দুজনের মনেই ছিল অগাধ বিশ্বাস যে আবার কোন একদিন আমাদের দেখা হবেই এবং আমরা সারা জীবনের বন্ধনে আবদ্ধ হব। আমি তোমার সাথে দেখা হবার সেই দিনটার আশায় বসে আছি গো। ভালো থেকো, সাবধানে থেকো। আমার এক বুক ভালোবাসা নিও। ইতি, তোমার ভালোবাসা, তোমার স্নিগ্ধা।“

চিঠিটা শেষ করে বার বার পড়ে ফেলল সুমী। ভাবল আজ ওর এই প্রথম প্রেম পত্র লেখা। এটাই ঠিক আছে, এর বেশি লিখতে গেলে ধরা পরে যাবার চান্স আছে। এবার এটাকে সোমবার আমহার্স্ট স্ট্রিট পোস্ট অফিসে গিয়ে একটা খাম কিনে ঐ খবরের কাগজের পোস্ট বক্স নম্বর লিখে পোস্ট করে দিতে হবে। তারপর ইন্দ্র বাবু কী উত্তর দেয় দেখা যাক। সুমীর বেশ মজা হচ্ছিল এই ভেবে যে দুই বছর আগের বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া দুজন প্রেমিক প্রেমিকার একজনের রোলে ওকে এখন অভিনয় করতে হবে। নিজে তো কোনদিন কারো সাথে প্রেম ট্রেম করেনি, তাই এই অভিনেত্রীর পার্ট সুমীকে বেশ রোমাঞ্চিত করে তুলল।    

ইন্দ্রজিৎ বুধবার অফিসে গিয়ে পোস্ট বক্সের সমস্ত চিঠির মধ্যে খুঁজে পেল সুমীর লেখা সেই নকল প্রেম পত্র। নিচে দেখে নিলো স্নিগ্ধার নামই লেখা আছে। বুকের মিধ্যে হটাত যেন কেউ দামামা বাজাতে শুরু করে দিয়েছে তখন। চিঠির খামটা পকেটে পুড়ে নিয়ে টেবিল ছেড়ে চলে যায় ক্যান্টিনে। এক কাপ চায়ের অর্ডার দিয়ে বসে পরে ওর প্রেয়সী স্নিগ্ধার চিঠি পড়তে। এই কয়দিন এক অজানা আশঙ্কায় ঠিক মত ঘুম হয়নি ওর। কে জানে স্নিগ্ধা এতোদিন বাদে ইন্দ্রর এই চিঠি কিভাবে নেবে ? আজও কী স্নিগ্ধা ওকে সেই আগের মত ভালোবাসে, আজও কী স্নিগ্ধা ওর পথ চেয়ে বসে আছে ?  

চা খেতে খেতে উদবিঘ্ন ইন্দ্র সুমীর চিঠিটা স্নিগ্ধাই লিখেছে ভেবে গোগ্রাসে পড়ে ফেলল। মাত্র দুই প্যারার চিঠি, কিন্তু এ যেন সাত সমুদ্দুর পার হয়ে ওর রাজকন্যার ইন্দ্রর উদ্দেশ্যে ছুঁড়ে দেওয়া উড়ন্ত চুম্বনকে হাওয়া বয়ে এনেছে এই ক্যানটিনের টেবিলে। সত্যি সত্যিই ইন্দ্র হাওয়ায় হাত বাড়িয়ে স্নিগ্ধার সেই কাল্পনিক চুম্বনকে লুফে নিয়ে ওর ঠোঁটে চেপে ধরে চোখ বুজল। ইতিমধ্যে কখন যেন বিসমিল্লা খানের সানাই বাজতে শুরু করে দিয়েছে মনের গহিনে। ইন্দ্র মনেমনে হাসল, তার মানে ওর স্নিগ্ধা কালের ভিড়ে হারিয়ে যায় নি। আজও স্নিগ্ধা ওর জন্য অপেক্ষায় আছে। মনে হচ্ছিল এখুনি ওকে ফোন করে ইন্দ্র ওর মিষ্টি গলার স্বরটা শুনে চোখের সাথে সাথে ওর কানেরও চিকিৎসা করিয়ে নেয়। এতো দিন যখনই ইন্দ্র স্নিগ্ধাকে ফোন করেছে জবাব এসেছে নাম্বার ‘ডাস নট এক্সিষ্ট’। ভেবেছিল স্নিগ্ধা ওকে ওর নতুন নম্বর দেবে , কিন্তু ইন্দ্রর কপাল খারাপ। চিঠির নিচে বা উপরে স্নিগ্ধা কোন নম্বর দেয়নি। শুধু ওর ভালোবাসাকে স্বিকার করে জানিয়েছে যে আজও সে ওর অপেক্ষায় আছে। 

ll সাত ll

“প্রিয়তমাসু , আমি জানিনা কিভাবে তোমার সামনে গিয়ে দাঁড়াব আর আমার কী কী পরিক্ষা তুমি নেবে সোনা ? তোমার লেখা এই প্রথম এত সুন্দর চিঠিটা পড়ে আমার মন প্রান জুড়িয়ে গেছে। আমি জানি তুমি কখনই আমাকে ফেরাতে পারবে না। আমার লেখা চিঠি তোমার ঐ সুন্দর পটল চেরা চোখের দর্শন পেয়ে ধন্য হয়েছে ভেবেই আমি খুশি স্নিগ্ধা। তোমার মনের শান্ত দীঘির জলে আজও যে আমার নামে পদ্ম ফুল ফোটে, আজও যে তোমার জানালায় বসা পাখীগুলি আমার নাম ধরে তোমাকে গান শোনায়, আজও যে আকাশের মেঘের স্তুপে তুমি আমার মুখের ছবি খুঁজে বেড়াও সেটা ভেবেই আমি শিহরিত হচ্ছি।

সোনা, তোমার সাথে কথা না বলতে পারলে আমার পেট ফুলে যাবে। অনেক অনেক কথা জমে আছে আমার মনের বাস্কেটে। আমি ফেস বুকে তোমাকে অনেক খুঁজেছি, কিন্তু তোমার কোন ফেস বুক একাউন্ট আমি পাইনি। তুমিও তোমার কোন ফোন নম্বর দাওনি। জানিনা তার কারণ কী। তবে আমি নিশ্চিত তুমিও আমার সাথে কথা বলে বা দেখা করে মনটাকে হাল্কা করতে চাও। তাই আমি নিজেই তোমাকে আমার সেল ফোন নম্বর দিলাম। যদি কখনো কথা বলতে ইচ্ছা হয় তবে আমাকে ফোন করতে দ্বিধা করবে না। সাধারণত সন্ধ্যার পর ও ছুটির দিনে আমি ফ্রি থাকি। ভালো থেকো, ফোন কোর। ইতি, তোমার , শুধুই তোমার ইন্দ্র।“ 

পরের সোমবার সন্ধায় ইন্দ্রর এই উত্তর হাতে পেয়ে এক নিঃশ্বাসে চিঠিখানা পড়ে ফেলল সুমী। এই কয়দিন সুমী খুব টেনশনে ছিল, ওর হাতের লেখা দেখে ইন্দ্র যদি বুঝে যায় যে এটা স্নিগ্ধার হাতের লেখা নয়। যদি ইন্দ্রর কাছে স্নিগ্ধার লেখা কোন চিঠি থাকে তাহলেই ওর সন্দেহ হবে এবং ও দুটো হাতের লেখা মিলিয়ে দেখবে। সুমী এবার নিশ্চিন্ত হল যে ইন্দ্র স্নিগ্ধার কাছ থেকে এই প্রথম চিঠি পেল মানে ওর হাতের লেখা ও চেনেনা। আরেকটা জিনিষ লক্ষ্য করল যে ইন্দ্র তার মানে ঐ পোস্ট বক্সে পাঠানো চিঠি হয়ত রোজই চেক করে। তিন দিন বাদে ভালেনটাইন্স ডে। ওকে কালই একটা কার্ড পাঠাতে হবে। আর নিজের ফোন নম্বর তো এখন দেওয়া যাবে না, কিন্তু পাবলিক ফোন থেকে ওর সাথে কথা বলবে সুমী। একবার যখন খেলতে নেমেছে তখন কোমর বেধেই নামবে সুমী।

সুমী এসব কেন করছে, এর শেষ কোথায়, ধরা পড়ে গেলে সুমী সামলাবে কিভাবে, কিছুই কখনো ভেবে দেখেনি। কিন্তু ওর বেশ মজা লাগছে। ব্যাপারটা যত এগোচ্ছে ততোই সুমীর মনে কল্পনার জাল বুনে একটা স্বপ্নিল পরিবেশ তৈরি হয়ে চলেছে। কল্পনার উলের কাঁটায় রোজ সন্ধায় সুমী ওর ভবিষ্যতের সোয়েটার বুনে চলেছে। সুমীর খুব ইচ্ছা হতে থাকে ইন্দ্রকে দেখবার, ওর সাথে কথা বলবার। এই কয়দিনেই সুমী যেন ইন্দ্রজিত নামের অচেনা অজানা এই যুবকটার প্রেমে পড়ে গেছে। ওর শয়নে স্বপনে এখন শুধু ইন্দ্র। সুমী ঠিক করল ইন্দ্রর ফেস বুক পেজ চেক করে দেখবে ওকে কেমন দেখতে।

ফেস বুকে ইন্দ্রজিৎ মল্লিক নামের অনেক মানুষের দেখা পাওয়া গেল। সুমী ফিলটার করে শুধু কলকাতার ইন্দ্রজিৎ মল্লিকদের খুঁজতে থাকে। মোট বারো জনের দেখা মেলে। তাদের প্রোফাইল চেক করে শেষে তিনজনের নাম বেড় হল। এর মধ্যে একজন মাঝ বয়সী, প্রায় পঁয়ত্রিশ বছরের, আরেকজন তিরিশ বছরের কিন্তু বিবাহিত। শুধু একজন ইন্দ্রজিৎ মল্লিক দেখা গেল স্ট্যাটাসে লিখেছে এম বি এ, ব্যাচেলর, গান শুনতে আর পুরানো হিন্দি ফিল্ম দেখতে ভালোবাসে, তবে থাকে দিল্লিতে। কিন্তু ওর টাইম লাইনে শেষ ছবি পোস্ট করেছে দিল্লির ইন্ডিয়া গেটের। কয়েকটা মাত্র ছবি পোস্ট করেছে ইন্দ্র। বেশিরভাগ ছবিই প্রকৃতির ও ঐতিহাসিক জায়গার। মোট বন্ধুর সংখ্যা মাত্র পঞ্চান্ন, একাউন্ট খোলা হয়েছে দু বছর আগে। সুমী বেশ বুঝতে পারল এই হল ওর স্নিগ্ধার ফিয়াসে ইন্দ্র। হয়ত দিল্লিতে থাকতে ফেস বুকে জয়েন করে ও পুরানো কিছু বন্ধুর সাথে ফেস বুকে বন্ধুত্ব করে ফেলে। কিন্তু স্নিগ্ধার কোন একাউন্ট না খুঁজে পেয়ে হতাশ হয়ে আর বেশিদুর এগোয় না। সুমী কী ভেবে ইন্দ্রকে ফলো করা শুরু করে দিল। যদি কোনদিন কিছু ভেবে ইন্দ্র ওর কোন ছবি পোস্ট করে এই আশায়।

ll আট ll

কাল ভালেনটাইন্স ডে। কলকাতায় আজকাল ইংরেজদের এই অনুষ্ঠানটা বেশ রমরম করে পালিত হচ্ছে। বিভিন্ন ধরনের রঙিন কার্ড, ব্যান্ড, টুপি, পোস্টার বিক্রি হয় খুব। খদ্দেররা সবাই পনের থেকে পঁয়ত্রিশ বছরের ছেলে মেয়ে। এই দিনটাতে এখন সমস্ত রেস্তোরায় চূড়ান্ত ভিড় হয় বলে লোকে আগে থেকেই টেবিল বুক করে রাখে। প্রেমিক প্রেমিকাদের প্রেমোৎসবের দিন কাল। অফিসে এসে পোস্ট বক্সের ডাক নাড়াচাড়া করতে গিয়েই ওর নামের একটা গ্রিটিংস কার্ড চোখে পড়ল ইন্দ্রজিতের। হাতে নিয়ে গন্ধ শুঁখে দেখল একটা মেয়েলি সেন্টের গন্ধে ভুরভুর করছে খামটা। 

ইন্দ্র তাড়াতাড়ি টেবিল ছেড়ে চলে গেল টয়লেটে। এই সময় সাধারানত কেউ ওদিকে যায়না। ঠিক যা ভেবেছিল তাই। স্নিগ্ধা ইন্দ্রকে একটা দারুন সুন্দর ভালেনটাইন্স ডের শুভেচ্ছার কার্ড পাঠিয়েছে। এক কোনায় আবার একটা তীর বিদ্ধ হার্টের ছবি পেন দিয়ে এঁকে দিয়েছে। কার্ডটা দেখে খামের ভিতরে আরেকটা ছোট্ট কাগজ খুঁজে পেল ইন্দ্র। তাতে শুধু লেখা, “ কাল বিকেলে তোমাকে ফোন করব ইন্দ্র। ভালো থেকো।” ব্যাস আর কিছুই লেখা নেই। ইন্দ্র কার্ডটা পেয়ে যতটা উল্লসিত হয়েছিল, এখন মাত্র এক লাইনের চিঠি পেয়ে তার চেয়ে বেশি হতাশ হল। তার মানে কাল পর্যন্ত ওকে অপেক্ষা করতে হবে। যাই হোক, স্নিগ্ধার মিষ্টি গলা এতোদিন বাদে শুনবার জন্য ওর মন ছটফট করতে থাকে।   

চোদ্দই ফেব্রুয়ারি ভালেনটাইন্স ডে শনিবার পড়েছে। সুমী ঠিক বিকেল সাড়ে পাঁচটায় ওদের গলির মোরের ওষুধের দোকানে গিয়ে তাদের পাবলিক টেলিফোন থেকে ইন্দ্রর নম্বরে ফোন লাগাল। মনের ভিতর ওর বেশ উত্তেজনা হচ্ছে সুমী সেটা বুঝতে পারছিল। একটু রিং হবার পরেই ওপার থেকে ইন্দ্রর গলা পাওয়া গেল, “হ্যালো, কে বলছেন ?” 

ইন্দ্রর গলাটা বেশ গম্ভীর। ফোনেই সুমী শুনতে পেল ওর আসে পাশে কিছু লোক উচু গলায় কথা বার্তা বলছে। তার মানে ইন্দ্র এখন অফিসে ব্যস্ত আছে। সুমী ভাবতে থাকে কী বলবে ওকে ? ওপার থেকে ইন্দ্র আবার বলে ওঠে, “হ্যালো, কে বলছেন ?” এরপরই ইন্দ্র গলা নামিয়ে বলে “স্নিগ্ধা, এটা কী তোমার ফোন স্নিগ্ধা ? কথা বলো স্নিগ্ধা।“ সুমী বুকে সাহস এনে ফিসফিস করে শুধু বলে, “হ্যাঁ, আমি বলছি। এখন কি কথা বলা যাবে ইন্দ্র, তুমি কি অফিসে আছ ?”

যদিও সুমী ফিসফিস করে বলল কথা গুলি, কিন্তু ওর বুকটা ঢিব ঢিব করতে থাকে। যদি ইন্দ্র ওর গলার স্বর শুনে কিছু প্রশ্ন করে বসে ? কিন্তু ইন্দ্র সেটা না করে বলল,”এক মিনিট সোনা, আমি বারান্দায় বেড়িয়ে আসছি। এখন আমি অফিসেই আছি। এখানে কথা বললে তুমি শুনতে পাবে না সোনা।“

ইন্দ্র ওকে দুবার সোনা বলে সম্বোধন করল। সুমীর মনে একটা খুশীর ঢেউ উঠল যেন। মনে হল সত্যিই ওর ভালবাসার মানুষটার সাথে কথা বলছে সুমী। ওর মনে হল শুধু এই একটা ফোনের জন্যেই ইন্দ্র অপেক্ষা করছিল, কারন ও জানত আজ স্নিগ্ধা ওকে ফোন করবে। একটুক্ষণ চুপ থাকার পর আবার ওপার থেকে ইন্দ্রর গলার স্বর শোনা গেল, “হ্যাঁ বল স্নিগ্ধা। তোমার কার্ড আমি পেয়েছি সোনা। কী যে ভালো লেগেছে কি বলব তোমাকে। আমি তো ভেবেছিলাম তুমি আমার উপর ভীষণ রেগে আছ। সত্যি তোমার ঐ সুন্দর চিঠিখানা পেয়ে আমার এত ভালো লেগেছে যে কি বলব তোমায়। কেমন আছ সোনা, তোমার আর তোমার মায়ের শরীর স্বাস্থ্য সব ঠিক আছে তো ?”

“হ্যাপি ভালেনটাইন্স ডে ইন্দ্র। আমরা ভালো আছি, তুমি ভালো আছতো ?” সুমী ভেজা গলায় বলে ওঠে।

ইন্দ্র ওপার থেকে ,” আমি ভালো আছি। সেম টু ইউ স্নিগ্ধা। কিন্তু তোমার গলায় আবার কী হল ? কেমন যেন খস খস লাগছে। কি ঠাণ্ডা লেগে গেছে নাকি সোনা ? আর তুমি কি কাঁদছ নাকি ? কেঁদো না সোনা। আমি তো এসে গাছি এবার। শিগগির আমাদের দেখা হবে। তুমি আমাকে ব্যস একটু সময় দাও শুধু। এর মধ্যেই আমি বাবা মার সাথে কথা বলে তারপর তোমাদের বাড়িতে আসছি।“ 

ll নয় ll

আসলে জীবনে এই প্রথম একটা অচেনা অজানা যুবকের মন নিয়ে ছিনি মিনি খেলতে গিয়ে হটাৎই সুমী একটু বেশি ইমোশনাল হয়ে পড়ে। যদিও ও বেশ ভালো করেই জানে যে এই মুহূর্তে ও শুধু স্নিগ্ধার রোল প্লে করছে, কিন্তু আজ কেন যেন ইন্দ্রর ভরাট গলায় বার বার ওকে সোনা বলা শুনে সুমী একদিকে যেমন খুশির জোয়ারে ভাসছিল আরেক দিকে ইন্দ্রর ভালোবাসা ওকে ছেড়ে অন্য মানুষের গলায় মালা পরিয়ে আজ তার ঘর সংসার করছে ভাবতেই ইন্দ্রর জন্য ওর বুকের ভিতরটা মোচর দিয়ে উঠল। ভয় করতে থাকে যে ইন্দ্র আসল সত্যিটা জানতে পারলে কত বড় আঘাত পাবে আর কতোটা ভেঙে পরবে মানুষটা। ফলে সুমীর গলা শুকিয়ে গিয়ে কান্নার আভাসটা প্রকাশ পেয়ে যায়, যেটা ইন্দ্র ধরে ফেলে।

সুমী তাড়াতাড়ি ম্যানেজ করবার জন্য নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,”ও কিছুনা, একটু ঠাণ্ডা লেগে গলা বসে গেছে। তুমি আমাকে নিয়ে চিন্তা করোনা ইন্দ্র। আমি ঠিক আছি।“

ইন্দ্র একটু ধাতস্থ হয়ে বলে,”তুমি সাবধানে থাকবে স্নিগ্ধা। আমার তোমাকে নিয়ে খুব চিন্তা হয়। হাল্কা  গরম জল দিয়ে গলায় গারগেল করবে রাতে। আমি এখন রাখছি সোনা। অফিসে একটা জরুরী মিটিং চলছে। তুমি আমাকে পরে আবার একদিন ফোন কোর , কেমন ?”

সুমী শুধু “আচ্ছা, ঠিক আছে। রাখছি।” বলেই ফোনটা রেখে দিল। মনে মনে ভাবল আজ না হয় ঠাণ্ডা লেগেছে বলে ম্যানেজ করা গেল, এরপর কী হবে ? তবে ইন্দ্রর কথা বলার মধ্যে যে আন্তরিকতা দেখতে পেল সুমী সেটা সত্যি ওকে খুব অবাক করে দিল। প্রেমে পড়ে মানুষ কত বেশি রেস্পন্সিবল হয় সেটা ও আজ ইন্দ্রর সাথে কথা না বললে জানতে পারত না। ওর কথা বার্তা বেশ মার্জিত, তাতে শিক্ষা দীক্ষার পরিচয় ফুটে ওঠে। সুমী ওর নিজের জন্য ঠিক এরকমই একজন দায়িত্ববান ও ভদ্র ছেলেকে মনে মনে কল্পনা করত এতোদিন। সুমীর ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল স্নিগ্ধার বিয়ের কথা ইন্দ্র জানে না সেই কথাটা ভেবে।    

কিন্তু সুমীই বা কী করবে ? ওর ভিতরে একটা আস্ত সাহারা মরুভূমি বাস করে। একটু ভালোবাসা নামক জলের তেষ্টায় ওর বুকটা ফেটে যায়। ওর অন্যান্য বন্ধুদের মত সুমী কি পারতো না একটা ভালো ছেলেকে বিয়ে করে ঘর সংসার নিয়ে মজে যেতে। ওর বাবাও তো কত চেষ্টা করেছে ওকে বিয়ে দেবার জন্য। কিন্তু সুমী নিজেই তো মায়ের মৃত্যুর পর থেকে সংসারের দায়িত্ব, ভাইয়ের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিল আর কোনদিন নিজের ব্যক্তিগত সখ আলহাদের কথাকে গুরুত্ব দিতে চায়নি। এর ফলে ওর মনের উচ্ছল নদীটা কবে যে শুকিয়ে সাহারা মরুভূমিতে পরিনত হয়ে গেছে সেটা সুমী জানতেই পারে নি। আর আজ ভালোবাসা নামের জোয়ার বর্ষার দামোদর নদের মত উচ্ছল হয়ে ওর দরজায় এসে ধাক্কা মারছে।

কিন্তু এই ভালোবাসা তো সুমীর প্রাপ্য নয়। এই প্রেম স্নিগ্ধা নামের অন্য একটি মেয়ের জন্য গচ্ছিত রাখা তার প্রেমিকার বুকের গহিনে। সুমীর কী কোন অধিকার আছে সেই ভালবাসার জোয়ারে গা ভাসিয়ে দিয়ে একটা ভালো ভদ্র ছেলেকে মিথ্যা খেলায় মাতিয়ে তোলা ? এটা কী সুমী ঠিক করছে ? ওপরে ভগবান সব দেখছেন, তিনি কী সুমীকে এর জন্য কখনো ক্ষমা করবেন ? সুমী এক অদ্ভুত দো টানায় পড়ে গেল। 

ইন্দ্রজিৎ স্নিগ্ধা ওকে এতোদিন বাদেও সেই একই রকম ভালোবাসে ভেবে মনে মনে খুব খুশি হল। ঠিক করল এবার স্নিগ্ধার সাথে দেখা করে ওর সাথে বিয়ের কথাটা আগে পাকা করে নিয়ে তারপর বাবা মার সাথে কথা বলবে ইন্দ্র। অনেক দিন যাবত তাড়া দচ্ছেন ওঁরা। কিন্তু সন্ধায় অফিস থেকে বেড়িয়ে সেন্ট্রাল এভেন্যুয়েরউল্টো দিকের ফুটপাথে সি ই এস সির অফিসের গেটের ঠিক সামনে বা দিকে স্নিগ্ধা দাঁড়িয়ে আছে দেখতে পেয়ে চমকে উঠল ইন্দ্র। তাহলে কী স্নিগ্ধা ইন্দ্র অফিস থেকে বেড় হবে ভেবে ফোন করবার পরেও এসে দাঁড়িয়ে আছে ওরই জন্য অফিসের সামনে। কিন্তু না, ইন্দ্র ভুল ভেবেছিল। সি ই এস সির গেট দিয়ে বেড়িয়ে এলো একজন যুবক, আর স্নিগ্ধার হাত ধরে ধর্মতলার দিকে এগিয়ে গেল দুজন। ইন্দ্র লক্ষ্য করল ওর ভালোবাসা, ওর স্নিগ্ধার সিঁথিতে সিঁদুর কলকাতার রাস্তার আলোয় তখন জ্বলজ্বল করছে।     

ll দশ ll

আচ্ছা ঐ মেয়েটি কী স্নিগ্ধাই ছিল নাকি অন্য কেউ ? স্নিগ্ধার কী তাহলে বিয়ে হয়ে গেছে ? ঐ ছেলেটি  কী ওর স্বামী, সি ই এস সি তে চাকরি করে ? আজ ভালেনটাইন্স ডে, তাই কী ওরা দুজন এসপ্ল্যানেডে ঘুরতে যাচ্ছে , ডিনার করে বাড়ি ফিরবে ? কিন্তু ইন্দ্র কিছুতেই এসব বিশ্বাস করতে পারছিল না। বেশ কিছুটা দুরত্ব রেখে রাস্তার অপর দিকের ফুটপাত ধরে স্নিগ্ধাদের ফলো করতে থাকে। মনে মনে ভাবে এই ঘণ্টা খানেক আগেই তো কথা হল স্নিগ্ধার সাথে। কী করে তাহলে আজই স্নিগ্ধা ওর হাসব্যান্ডকে নিয়ে বেড়াতে বেড়িয়েছে। ওর তো এখন বিয়েও হয়নি। ওর সোনা যে আজও ওর অপেক্ষায় বসে আছে।

এদিকে স্নিগ্ধা আর ওর স্বামী চিৎপুর রোডের মোর থেকে একটা ট্যাক্সি নিয়ে পার্ক স্ট্রিটের দিকে রওনা দিয়েছে। তাই দেখে ইন্দ্র আরেকটা ট্যাক্সি নিয়ে ওদের ফলো করতে থাকে। পার্ক স্ট্রিটে ফিরপো রেস্তোরায় এসে ট্যাক্সি থেকে নেমে ভিতরে ঢুকবার জন্য পা বাড়াল স্নিগ্ধা আর ওর হাসব্যান্ড। ইতিমধ্যে ট্যাক্সি ছেড়ে একদম ওদের সামনে এসে দাঁড়াল ইন্দ্র। স্নিগ্ধা ভুত দেখবার মত চমকে উঠল ইন্দ্রকে দেখে। ইন্দ্র অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল স্নিগ্ধারই দিকে। স্নিগ্ধার সত্যিই তাহলে বিয়ে হয়ে গেছে। হতভম্বের মত দাঁড়িয়ে থাকা ইন্দ্রর কানে গেল স্নিগ্ধার কথাটা, “ আরে ইন্দ্র, তুই এখানে ?এই যে শোন, একটু দাঁড়াও, দেখ এই আমার ক্লাস মেট ইন্দ্র। আমি তো ভাবতেই পারছিনা তোর সাথে কলকাতায় দেখা হবে। কবে এলি দিল্লি থেকে ?”

ইন্দ্রর কানে সব কটা কথাই ঢুকেছে। স্নিগ্ধা যেভাবে ওর বরের সাথে আলাপ করিয়ে ওর বিস্ময়টা লুকিয়ে ফেলল সেটা দেখেই ইন্দ্র অবাক হয়ে গেছিল। ধ্যান ভাঙ্গল একটা শক্ত হাত এগিয়ে এসে ওর হাত চেপে ধরে যখন বলল,”হাই, আমি বিনয়। আপনার কথা স্নিগ্ধার কাছে অনেক শুনেছি। আপনারা নাকি খুব ভালো বন্ধু ছিলেন আর আপনি দিল্লিতে চলে গেছিলেন এম বি এ করতে। তা কবে এলেন কলকাতায় ?”

ইন্দ্র নিজের চোখ আর কাণকে তখনও বিশ্বাস করতে পারছিল না। কিন্তু মুহূর্তে নিজের অবাক হয়ে যাবার ভানটা কাটিয়ে নিয়ে বলল,” আরে স্নিগ্ধা, তোর বিয়ে হল কবে ? বেশ তো ফাঁকি দিলি আমাদের ! কোথায়, নিমন্ত্রন করলি না তো ? বাঃ, খুব ভালো করলি এটা।“ বলেই বিনয়ের দিকে তাকিয়ে বলল,” তুমি ঠিকই শুনেছ বন্ধু, কলেজে আমার কয়েকজন বন্ধুর মধ্যে স্নিগ্ধা ছিল সেরা। তোমার ভাগ্য খুব ভালো ভাই যে তুমি আমাদের কলেজের সেরা ছাত্রীটাকে বিয়ে করে ফেললে। অল দ্য বেস্ট টু বোথ অফ ইউ।“

কথাটা বলে ইন্দ্র লক্ষ্য করল স্নিগ্ধা মাটির দিকে তাকিয়ে চুপ করে আছে। ইন্দ্রর কথা শেষ হতেই স্নিগ্ধা বলে উঠল,’” আরে বলিস না। তোর দিল্লির ঠিকানাটা কারো কাছেই পেলাম না রে। যাক গে, আমরা কাছেই বেলেঘাটাতে থাকি। তা একদিন চলে আয় আমাদের ফ্ল্যাটে। তোর নম্বরটা আমাকে দিয়ে দে। আমি তোকে আমাদের এড্রেসটা মেসেজ করে দেব। কী বল তুমি ?” বলেই ওর স্বামীর দিকে তাকাল স্নিগ্ধা। বিনয় ছেলেটির চেহারা বেশ সুন্দর। বোঝাই গেল বেশ মিশুকে প্রকৃতির। হৈ হৈ করে বলে উঠল, ”সেটাই বেস্ট হবে বুঝলেন ভায়া। চলে আসুন এক রোববার। খাওয়ায় দাওয়া আর চুটিয়ে আড্ডা হবে।“   

ইন্দ্র হেসে বলল,” নিশ্চয়ই হবে, তা আর বলতে ?” বলে নিজের সেল ফোন নম্বরটা স্নিগ্ধাকে দিয়ে ওদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে “এদিকে একটু কাজ আছে রে । চলি তাহলে।” বলেই উল্টো দিকে ফিরে চলল ইন্দ্র। স্নিগ্ধা আর ওর স্বামীকে দেখে বিস্ময়ে ওর তখন ভিরমি খাওয়ার মত অবস্থা। স্নিগ্ধা যদি আজই ওর বরের সাথে বেড়াতে বেরিয়ে রাতের ডিনার করতে ফিরপো রেস্তরায় এলো, তবে ইন্দ্রকে ও কিছুই জানায় নি কেন ? স্নিগ্ধা কী তাহলে ওর বরকে লুকিয়ে ইন্দ্রর সাথে সম্পর্ক রাখতে চায় ? তাই কী ও ইন্দ্রকে ওদের বিয়ের ব্যাপারটা চেপে গেছে ? কিন্তু ওর পুরানো ঠিকানায় পাঠানো চিঠি ও পেলই বা কিভাবে ? ওর মা কী ওকে এই ব্যাপারে সাহায্য করেছেন নাকি অন্য কোন রহস্য আছে এর পিছনে ? ইন্দ্র দেখেছিল স্নিগ্ধা যতই স্মার্ট ভাবে ওর সাথে বিনয়ের পরিচয় করিয়ে দিক না কেন, ও বেশ কিছুক্ষন মাটির দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। তাহলে কী তখন স্নিগ্ধা আজই এইভাবে ধরা পরে গেছে বলে লজ্জা পাচ্ছিল নাকি ওদের পুরানো দিনের কথা ভাবছিল। কিন্তু স্নিগ্ধা বেলেঘাটায় থাকে, ঐ চিঠি গুলি পেল কিভাবে ? 

ll এগার ll

সারা রাত ইন্দ্র ঘুমতে পারল না। মাঝরাতে উঠে ওর ব্যাগ থেকে স্নিগ্ধার লেখা চিঠি আর ভালেনটাইন্স ডের কার্ডটা বেড় করে ভালো করে লক্ষ্য করে দেখল দুটোতেই আমহার্স্ট স্ট্রিট পোস্ট অফিসের স্ট্যাম্প দেওয়া। তার মানে স্নিগ্ধা হয়ত খবর পেয়ে ওর মায়ের কাছে গিয়ে চিঠিখানা পেয়ে তারপর জবাব দিয়েছে এবং আমহার্স্ট স্ট্রিট পোস্ট অফিস থেকেই চিঠি পোস্ট করে এক ঝুড়ি মিথ্যা কথা লিখেছে। কিন্তু সেটাই বা কী করে সম্ভব ? স্নিগ্ধার বিয়ে হয়ে গেছে , ওর এখন ইন্দ্রকে এই ভাবে ঠকিয়ে কী লাভ আছে ? স্নিগ্ধা তো ইন্দ্রর চিঠিখানা ছিঁড়ে ফেলেও দিতে পারতো।

অনেক ভেবেও ইন্দ্রর মাথায় কিছুই ঢুকছিল না। স্নিগ্ধাই যদি ওর চিঠির উত্তর দিয়ে থাকে বা ওকে ভালেনটাইন্স ডের কার্ড পাঠায় তাহলে ওর ফোন নম্বর থেকে ইন্দ্রকে ফোন করেনি কেন ? কেনই বা ও ইন্দ্রকে পাবলিক টেলিফোন থেকে ফোন করল ? নাঃ, নিশ্চয়ই কোথাও একটা গণ্ডগোল হয়েছে। আর তখন স্নিগ্ধা যেভাবে আন্তরিক ভাবে ইন্দ্রকে ওদের ফ্ল্যাটে যাবার নিমন্ত্রন করল তাতে কিন্তু বেশ স্বাভাবিক লাগল ওকে, মনেই হচ্ছিল না যে আজই ওদের মধ্যে ফোনে কথা হয়েছে। শুধু একটাই ভুল হয়ে গেছে, ইন্দ্র স্নিগ্ধার ফোন নম্বরটা নেয়নি। নাহলে ফোন করে ওর মায়ের খোঁজটা নিলেই সব রহস্যের সমাধান হয়ে যেত। কারন ইন্দ্রর চিঠি ওর মায়ের হাতেই পড়েছে সেটা ইন্দ্র একদম সিওর।

এদিকে সুমী সেই রাতে ফেস বুকে অনেকক্ষন যাবত ইন্দ্রজিতের বন্ধুদের প্রোফাইল ঘাঁটা ঘাঁটি করে ওর এক দিল্লির মাড়োয়ারি বন্ধুর বিয়ের বেশ কিছু ছবির মধ্যে একটা কমন মুখ, আবার তার কলেজের ফাংশনের ছবিতেও সেই একই মুখ দেখে আন্দাজ করল যে এই হচ্ছে ইন্দ্রজিৎ। বয়সে ওর চেয়ে ছোট। তবে খুব সুন্দর হ্যান্ডসাম চেহারা ছেলেটার, বয়স খুব বেশি হলে সাতাশ আটাশ হবে। কনফার্ম হবার জন্য সুমী আরও কয়েকজন বন্ধুর প্রোফাইল ঘাঁটতেই কলকাতার দুই বন্ধুর প্রফাইলে সেই একই রকম ভাবে ইন্দ্রর মুখের ছবি দেখতে পেল গ্রুপ ফটোর মধ্যে। ফর্সা, বেশ লম্বা ইন্দ্র আগে সরু করে গোফ রাখত, কিন্তু পরে সেটা উড়িয়ে দেয়। ওর শেষ ছবি গুলিতে ইন্দ্রর মুখটা একদম ফ্রেস লাগছে। মাথা ভর্তি চুল ও বেশ ভদ্র  চেহারা ছেলেটার। সুমী অনেক বার ঘুরে ফিরে সেই ছবি গুলি দেখে ইন্দ্রর বর্তমান চেহারার একটা ধারনা মনেমনে তৈরি করে ফেলল। ভাবল এখন শুধু তোমায় সামনা সামনি দেখবার অপেক্ষা ইন্দ্র।

তিন দিন বাদেই ইন্দ্রর আরেকটা চিঠি হাতে এসে পৌছল। সুমী রাতে বিছানায় শুয়ে চিঠি খানা পড়ে অবাক হয়ে গেল। ইন্দ্র নাকি ওর বাবা মার সাথে কথা বলে ওকে, মানে স্নিগ্ধাকে বিয়ে করবার কথায় রাজি করিয়ে ফেলেছে। সুতরাং এই রবিবার বিকেলে পাঁচটার সময় ইন্দ্র কফি হাউসে এসে ওর সাথে দেখা করবে। কফি হাউসের একটা কোনায় টেবিলে বসে স্নিগ্ধার জন্য অপেক্ষা করবে ইন্দ্র। স্নিগ্ধা যেন কোন ভাবেই ভুলে না যায়। এতোদিন পর স্নিগ্ধাকে দেখবার জন্য ও ব্যাকুল হয়ে আছে ইত্যাদি ইত্যাদি।   

সুমী এবার পড়ল বেশ মুশকিলে। ইন্দ্র যে স্নিগ্ধার ব্যাপারে এতোটা সিরিয়াস হয়ে তড়িঘড়ি ওর বাবা মার সাথে বিয়ের কথাও সেরে ফেলবে সেটা সুমীর কল্পনায় আসেনি। মাত্র তিন চারদিন আগেই ইন্দ্র বলেছিল আমায় একটু টাইম দাও সোনা। আর আজ একেবারে কথা পাকা করতে দেখা করার জন্যে ডেট টাইম ফিক্স করে চিঠি পাঠিয়েছে। এবার সুমী কী করবে ? ইন্দ্রর সাথে দেখা করে ওকে কী সত্যি কথাটা বলে দেবে নাকি আরও একটু লম্বা করবে নাটকের দৃশ্যটা। নাটক যে ইতিমধ্যে ক্লাইমেক্সের দিকে এগিয়ে চলেছে সেটা তো সুমী আর জানতেও পারল না।

ইন্দ্র লিখেছে স্নিগ্ধার যদি কোন অন্য অসুবিধা না থাকে তাহলে কাল একবার ফোন করে ওকে কনফার্ম করতে। ওর জন্য স্নিগ্ধার কোন ঝামেলায় পড়তে হয় সেটা ইন্দ্র চায় না। চার পাঁচ বছরের ছোট এই ছেলেটার এরকম সভ্য ব্যবাহার ও মেয়েদের সন্মান করবার অভ্যাস দেখে সুমী ওর প্রতি আরও আকৃষ্ট হয়ে পড়ল। সত্যিই তো, একটা মেয়ের রবিবার কত রকম কাজ থাকে। ইন্দ্র যে সেটা বোঝে আর ওর ভালবাসার মানুষটাকে কোন সমস্যায় ফেলতা চায়না, সেটাই সুমীকে মুগ্ধ করল আবার।

ll বারো ll

সুমী শনিবার বেলা এগারটা নাগাদ সেই মেডিক্যাল স্টোর থেকে ফোন করল ইন্দ্রকে। ইন্দ্র ফোন তুলে “হ্যালো” বলতেই সুমী নিচু স্বরে মিষ্টি গলায় বলল “আমি বলছি। তোমার চিঠি পেয়েছি ইন্দ্র।“ ইন্দ্র যেন এই ফোনটার জন্যই দুদিন যাবত অপেক্ষায় ছিল। সম্ভবত ইন্দ্র তখন বাইরে ছিল। কারন দুরে রাস্তার গাড়ির আওয়াজ কানে আসছিল। উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে উঠল,”কে স্নিগ্ধা ? তুমি পেয়ে গেছ আমার চিঠি ?  আমি খুব চিন্তায় ছিলাম জানো। সেই কারনেই তোমাকে ফোন করতে লিখেছিলাম। তা তুমি কাল কফি হাউসে আসছ তো সোনা ? ইস কতো দিন বাদে আমাদের দেখা হবে বলতো ?”

অনেক ভেবে সুমী ঠিক করেছে রবিবার বিকেলে ইন্দ্রর সাথে দেখা করে ওকে সব খুলে বলবে আর ওর কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে নেবে। এ ভাবে একটা ভালো ভদ্র মানুষকে বিভ্রান্তির মধ্যে রাখাটা ওর ঠিক হচ্ছে না। ইন্দ্র যখন আসলটা জানতে পারবে তখন খুব ভেঙে পরবে বেচারা। কেন জানি সুমী ইন্দ্র কোনরকম কষ্ট পাক সেটা ভাবতেই পারছিল না। ইন্দ্রকে কী তাহলে ও সত্যিই ভালোবেসে ফেলল। সে যাই হোকনা কেন কাল ও ইন্দ্রর সামনে গিয়ে দাঁড়াবে। ওকে সব খুলে বলবে। ফিস ফিস করে বলল,”হ্যাঁ, কাল অনেকদিন বাদে তোমাকে দেখব ইন্দ্র। আমি পাঁচটার সময় পৌঁছে যাব। রাখছি তাহলে ?”

ইন্দ্র বোধ হয় কোন কাজে বেড়িয়েছিল। শুধু বলল,” ও কে, ঠিক আছে। কাল দেখা হচ্ছে।“ ইন্দ্র মনে মনে বেশ নিশ্চিত হয়ে গেল আজ যে এই মেয়েটি আর যেই হোক কিছুতেই ওর স্নিগ্ধা হতে পারে না। স্নিগ্ধার গলার স্বর এখনো ওর কাণে ভাসছে। স্নিগ্ধার গলা মোটেই এতো মিষ্টি নয়। ইন্দ্র চিন্তায় পড়ে যায় কে এই মেয়েটি যে ওর চিঠি পড়ছে, স্নিগ্ধা সেজে চিঠির জবাব দিচ্ছে আবার ওর সাথে ফোনে স্নিগ্ধা সেজে কথা বার্তাও চালিয়ে যাচ্ছে ? মেয়েটির কী উদ্দেশ্য থাকতে পারে এর পিছনে। তার মানে এই মেয়েটি ওর আর স্নিগ্ধার সম্পর্কের ব্যাপারে সব জানে এবং কোন একটা বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে ইন্দ্রকে বোকা বানিয়ে যাচ্ছে। ইন্দ্রর সুমীর উপর ভীষণ রাগ হচ্ছিল। কিন্তু আবার এই অত্যন্ত চালাক মেয়েটিকে দেখবার জন্য ইন্দ্র ব্যাকুল হয়ে উঠল। যদিও এখনো ইন্দ্র বিশ্বাস করতে পারছে না যে নকল স্নিগ্ধা কাল আসবে কফি হাউসে ওরই সাথে একদম সশরীরে দেখা করতে। মেয়েটার সাহস আছে বলতে হবে।

পরদিন সুমী কিন্তু পাঁচটার একটু আগেই পৌছে গেল কফি হাউসে। রবিবার হলেও বেশ ভিড় ছিল তখন। সুমী একটা ফিস ফ্রাই অর্ডার করে দরজার দিকে সাইড করে একটা টেবিলে এমন ভাবে বসল যাতে ও প্রধান দরজার দিকে নজর রাখতে পারে, কিন্তু ইন্দ্র এলে ওকে প্রথমত চিনতে পারবে না আর দ্বিতীয়ত ওর সাইড করে বসবার কারণে সুমীর মুখটা দেখা যাবে না। ঠিক পাঁচটা নাগাদ নীল রঙের জিনস ও আকাশী রঙের একটা টি সার্ট পরে গগলস চোখে ইন্দ্র এসে ঢুকল কফি হাউসে। এদিক ওদিক দেখে নিয়ে কোনার একটা খালি টেবিলে গিয়ে বসে পড়ল ইন্দ্র। ওর হাব ভাব দেখেই বোঝা যাচ্ছিল ইন্দ্র কারও আসবার অপেক্ষায় আছে আর তাই বারবার গেটের দিকে তাকাচ্ছে। 

ফিস ফ্রাই খেতে খেতে সুমী বারবার ইন্দ্রর দিকে তাকিয়ে ওকে আপাদ মস্তক দেখতে থাকল। ফেস বুকের বন্ধুদের প্রোফাইলে দেখা সেই সাতাশ আটাশ বছরের ইয়ঙ হাণ্ডসাম ছেলেটাই ইন্দ্র, সুমী একদম ঠিক আন্দাজ করেছিল। ইন্দ্র যেহেতু কল্পনাও করতে পারবে না যে ওই হল নকল স্নিগ্ধা তাই সুমীর ভীষণ মজা হচ্ছিল তখন। বেশ একটা গোয়েন্দা গল্প যেন। আসলে আজ সকালেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে সুমী। স্নিগ্ধার জন্য ইন্দ্র কতোটা ব্যাকুল আর সত্যিই স্নিগ্ধাকে ইন্দ্র কতোটা ভালোবাসে আজ তার পরীক্ষা নেবে সুমী। ইন্দ্রর কাছে আজই সুমী আত্ম সমর্পণ করবে না। দেখাই যাক না ওর কতোটা ধৈর্য। 

প্রায় আধা ঘণ্টার উপর বসে দুই কাপ কফি শেষ করে ফেলল ইন্দ্র, কিন্তু ওর স্নিগ্ধা বা নকল স্নিগ্ধা এলো না আর। বার বার হাতের ঘড়ি আর গেটের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে হতাশ হয়ে একসময় উঠে বিরক্ত মুখে বিল মিটিয়ে বেড়িয়ে গেল ইন্দ্র। সুমীর পাশ দিয়েই গেল ইন্দ্র, একবার তাকাল পর্যন্ত ওর দিকে। কিন্তু সুমী দেখেও না দেখার ভাণ করে মুখ ঘুড়িয়ে নেয়, আর  হতাশ ইন্দ্র সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যায়।  

ll তেরো ll

ইন্দ্র বেশ বুঝতে পারল যে নকল স্নিগ্ধা আজ ওর সাথে দেখা করতে আসেনি ধরা পরে যাবার ভয়ে। কিন্তু কেন তাহলে মেয়েটি ওকে ফোন করে কনফার্ম করল গতকাল। ও আসলে কী চাইছে ইন্দ্রর কাছ থেকে। আচ্ছা, মেয়েটা আবার ওকে ব্ল্যাক মেল করবে নাতো ? ওর নিজের হাতে লেখা তিন খানা চিঠি আছে মেয়েটির হাতে। যদি কোন বদ উদ্দেশ্য থাকে তাহলে ইন্দ্র ওর সুনাম হারাবে আর একদম ভেঙ্গে পরবে। একেই স্নিগ্ধা ওকে ছেড়ে অন্য একজনকে বিয়ে করে নিয়েছে। তার উপর এই মেয়েটির নাটকবাজি ইন্দ্রকে বেশ চিন্তায় ফেলে দিল। 

চার দিন কেটে গেল, নকল স্নিগ্ধার কোন ফোন বা চিঠি এলো না। শুক্রবার সন্ধ্যায় অফিস থেকে একটু দেড়ি করেই বেড় হল ইন্দ্র। একটা ট্যাক্সি নিয়ে চলে এলো সুখিয়া স্ট্রিটে। সাইবাবা মন্দিরের গলিতে ঢুকে একটু খোঁজ করতেই পেয়ে গেল স্নিগ্ধাদের ঠিকানা, মালতী ম্যান্সন, ২১/৮, সুখিয়া স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০০০৬। ইন্দ্র ফ্লাট বাড়িটার গেটের সামনে টুল নিয়ে বসে থাকা সিকিউরিটির সামনে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল,” ভাই, ২০৪ নম্বর ফ্লাটের দিদিমণি কী ঘরে আছেন নাকি বাইরে বেরিয়েছেন ?”

সিকিউরিটি লোকটা ইন্দ্রকে একবার ভালো করে দেখে নিয়ে জবাব দিল, ”কে, সুমী দিদিমণি ? হ্যাঁ, আছেন ঘরে। আপনি কোথা থেকে আসছেন আর কী নাম, ফোন নম্বর সব ওই রেজিস্টারে লিখে দোতলায় চলে যান। ইন্দ্র ঘাড় নাড়িয়ে বলল,” হ্যাঁ, হ্যাঁ,। আমি সুমী দিদিমণির ঘরেই যাব। আমি ওর আত্মীয় হই।“ বলেই আর সময় নষ্ট না করে ইন্দ্র ওর নাম, ও ফোন নম্বর লিখে ঊঠে গেল দোতলায়। তার মানে এই মেয়েটির নাম সুম, স্নিগ্ধারা এখন আর এই বাড়ীতে থাকে না। তাই ইন্দ্রর পাঠানো সব চিঠি এই মেয়েটির হাতেই এসে পড়েছে আর ও ইন্দ্রর সাথে নাটক করে চলেছে।

ইন্দ্র জানে না মেয়েটি বা ওর বাড়ির লোক ওর এই ভাবে হটাত এসে একেবারে বাড়িতে ওর ঘরের দরজায় দাঁড়ানোটা কিভাবে নেবে। কিন্তু ইন্দ্রর এছাড়া আর কোন উপায়ও ছিল না। অনেক চিন্তা করে ইন্দ্র এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এভাবে একদম বাড়িতে এসে দাঁড়ালে ওই চালাক মেয়েটা কিভাবে ওকে এভয়েড করে দেখাই যাক না। মনে মনে একটা চূড়ান্ত ঝগড়া ঝাটির জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে কলিং বেলে হাত রাখল ইন্দ্র। দু বার বাজানোর পরেই দরজার ভিতর থেকে মিষ্টি গলা শোনা গেল, ” আসছি।“ ইন্দ্র লক্ষ্য করল এই সেই চেনা মিষ্টি গলার স্বর, তার মানে ও সঠিক লোকের কাছেই এসেছে আজ।

দরজা খুলে দাঁড়াল একটা বছর বত্রিশ তেত্রিশ বছর বয়সের মহিলা, পড়নে রঙিন পাজামা আর কুর্তি। ভীষণ ফর্সা আর সুন্দর চেহারার যুবতী মেয়েটি ইন্দ্রকে চমকে দিয়ে হাসি মুখে আন্তরিক ভাবে বলে উঠল,”ও ইন্দ্র, তুমি এসেছ ? এসো, ভিতরে এসো। আমি জানতাম তুমি আজ না হয় কাল আসবে ইন্দ্র। এসো ভিতরে, বসো এই সোফাটায়।“ ইশারায় সোফাতে বসতে ইঙ্গিত করে সুমী। ওর কথা বার্তা শুনে মনে হল ইন্দ্র যেন ওর ভীষণ পরিচিত কেউ, আর সুমী ওর আসবার অপেক্ষাতেই ছিল যেন। আসলে সুমী ইন্দ্রকে হটাত একদম দোরগোড়ায় দাঁড়ানো দেখেই চমকে উঠেছিল। কিন্তু একজন পাকা অভিনেত্রীর মত অসম্ভব ভালো অভিনয় করে নিজের হতভম্ব ভাবটা কাটিয়ে একদম সহজ সরল ভাবে কথাগুলি বলে উল্টে ইন্দ্রকে ধন্দে ফেলে দিতে চাইল সুমী। কোথায় একবার ও শুনেছিল যে অফেন্স ইস দ্য বেস্ট ডিফেন্স। আর আজ ইন্দ্র কী না কী মুডে এসেছে কে জানে। সুতরাং ওকে কোন সুজোগ দেওয়া নেই।

যন্ত্র চালিত রোবটের মত অবাক দৃষ্টিতে সুমীর দিকে তাকিয়ে সোফায় বসে পড়ল ইন্দ্র। মেয়েটার মুখটা কোথায় দেখেছে কিছুতেই মনে করতে পারল না। তার মানে এই সুমী নামের ভদ্র মহিলাই এতো দিন ওর সাথে ছলনা করছিল। ইন্দ্র অবাক হয়ে গেল মহিলা ওকে চিনলো কিভাবে আর জানলো কী ভাবে যে ইন্দ্র এই ফ্লাটে আসবে ? দেখতে এতো সুন্দরী এই মহিলাটি আসলে কে আর কেনই বা ওর সাথে এরকম ছলনা করে চলেছেন ইনি ? অথচ কথা বললেন এভাবে যেন কত দিনের চেনা জানা।

ll চোদ্দ ll

সুমী ইন্দ্রর অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকা দেখে ফিক করে হেসে ফেলল। মিষ্টি করে বলল,” আমি জানি তোমার মনে অনেক প্রশ্ন জমা হয়ে আছে ইন্দ্র। আমি সব বলছি তোমাকে। আগে একটু চা বসিয়ে আসছি, বসো একটু। গলাটা আগে ভিজিয়ে নাও। “ বলেই ইন্দ্রকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সুমী চলে গেল চা বসাতে। ইন্দ্র হাঁ করে তাকিয়ে রইল এই সুন্দরী মহিলাটির পিছন দিকে। 

মহিলা যে ওর চেয়ে বয়সে বেশ বড় সেটা ওর কথা বলার ধরণ দেখেই বোঝা গেল। কেমন একটা দিদি দিদি ভাব। কথার মধ্যে একটা আদেশের সুর বাজছিল। ইন্দ্র সেই আদেশকে উপেক্ষা করতে পারছিল না। সুমী দেবী ওর মনে তার প্রথম দর্শনেই প্রভাব ফেলতে শুরু করে দিয়েছেন। ইন্দ্র লক্ষ্য করল ছোট এক কামরার ফ্লাট হলেও ঘরটা বেশ সাজানো গোছান। দেখেই বোঝা যায় ভদ্র মহিলার বেশ রুচি আছে। ইন্দ্র ভাবতে লাগল মহিলাকে ও কী বলে সম্বোধন করবে। আবার ওর লেখা প্রেমপত্রগুলি ওঁর হাতে পরেছিল ভেবেই ইন্দ্র লজ্জা পেয়ে মুখ নিচু করে বসে রইল। এরকম একজন বয়সে বড় মহিলার সামনে ওকে পড়তে হবে ইন্দ্র সেটা আদৌ বুঝতে পারে নি। এ যেন বিড়াল ধরতে এসে বাঘের মুখে পড়ে যাওয়া।

একটা ট্রেতে দুই কাপ চা আর বিস্কুট নিয়ে এসে সামনের টেবিলে রাখল সুমী। ছোট করে স্টেপ কাট করে কাটা চুলের কয়েকটা গোছা মুখের সামনে এসে পড়েছিল। হাত দিয়ে সেটা ঠিক করে নিয়ে সুমী বলতে শুরু করল,” নাও, চা খেতে খেতে শোন আমার কথা। আমার নাম সুমী, সুমী বোস। তোমার প্রেয়সী স্নিগ্ধা ও তার মা এই ফ্লাটেই ভাড়া থাকতেন। আমি গত তিন মাস  হল এখানে এসেছি, রাম মোহন কলেজে টিচারি করি, একা থাকি এখানে। আমার বাবা ভাই ও তার বৌ ওরা থাকে জামালপুরে, আমাদের নিজেদের বাড়িতে। আমি তোমার লেখা প্রথম চিঠিটা পড়ে মুগ্ধ হয়ে স্নিগ্ধার জায়গাটা বেদখল করে নিয়েছিলাম।“ কথাটা বলেই খিল খিল করে হেসে উঠল সুমী। আর ইন্দ্র সরু চোখে তাকিয়ে রইল ওর দিকে।

এখন পর্যন্ত ইন্দ্র একটা কথাও বলেনি সুমীর সাথে। ও বুঝতে পারছিল না যে ও এই মেয়েটির উপর রাগ করবে না অনুরাগ করবে। এত সুন্দর মিষ্টি একটা মেয়ে কী তাহলে শুধুই মজা করে এসব করেছে এই কয়দিন। কিন্তু ওর কাছে এই মজাটা ভীষণ বেদনা দায়ক হলেও ইন্দ্র কিন্তু সুমীর এই সরলতায় মুগ্ধ হল। একটু গম্ভীর হবার চেষ্টা করে চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে বলল,” কিন্তু আপনি আমাকে চিনলেন কি করে বলুন তো ? আমিই যে ইন্দ্র সেটা জানলেন কি ভাবে ? আমাদের তো আগে কোনদিন দেখা হয়নি।”

“এমা, তুমি আমাকে আপনি করে বলছ কেন ইন্দ্র ? যদিও আমি বয়সে তোমার চেয়ে বড় তাই বলে তুমি আমাকে আপনি বললে কিন্তু আমি তোমার সাথে কথা বলব না।“ সুমী মিষ্টি করে অভিমানী ও আদুরে গলায় বলল কথাটা। সেদিন চাক্ষুস ইন্দ্রকে দেখে আরও গভীর ভাবে ওর প্রেমের বিজয় স্তম্ভ গেড়ে বসে গেছে ওর মনের অন্দরে। কী দারুন স্মার্ট হ্যান্ড সাম ছেলেটা। আহারে, ওর প্রেমিকার বিয়ে হয়ে গেছে সেটা আজও জানে না। কত আগ্রহ নিয়ে সেদিন ওর প্রিয়তমা স্নিগ্ধার জন্য অপেক্ষা করছিল ইন্দ্র। সুমীর ওর জন্য বেশ কষ্ট হচ্ছিল। একবার ভেবেওছিল গিয়ে আলাপ করবে, কিন্তু সাহস হয়নি। পরে বাড়ি এসে চিন্তা করেছে ইন্দ্র যদি ওকে না পায় তাহলে এই বাড়িতে নিশ্চয়ই একদিন আসবে। তখন দেখা যাবে।

ইন্দ্র এবার হেসে ফেলল। বলল,“ ঠিক আছে সেটা নাহয় হবে, কিন্তু আমাকে চিনলে কি ভাবে তুমি ?”

সুমী চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে হেসে বলল,” সেটা গোপন ব্যাপার, বলা যাবে না। তবে বিশ্বাস কর তোমার পিছনে আমি কোন গোয়েন্দা লাগাইনি কিন্তু ইন্দ্র, মাইরি বলছি।“ আবার খিল খিল করে হেসে উঠল সুমী।

ইন্দ্র সুমীকে যতই দেখছিল ততই অবাক হয়ে যাচ্ছিল। কত সরল সোজা মেয়েটা। মনে হচ্ছে যেন ওর খুব কাছের এক বন্ধু, অনেক দিনের চেনাশুনা ওদের। কিন্তু ওদের যে এই কয়েক মিনিট আগেই প্রথম দেখা হল তার কোন প্রভাব বা জড়তা নেই সুমীর মধ্যে। ভীষণ স্মার্ট মানতেই হবে। কথা বলার ধরনও খুব সুন্দর। চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে সেটা নামিয়ে রেখে ইন্দ্র এবার আসল প্রশ্নটা করে বসল। 

ll পনের ll

“একটা কথা আমার মাথায় আসছে না, তুমি হটাত স্নিগ্ধার জন্য লেখা অন্য একজনের চিঠি খুলে পড়লে কেন, আর যদিও বা পড়লে স্নিগ্ধা সেজে এই ভাবে আমার সাথে খেলা করছিলে কেন ?”

সুমী এতক্ষন হাসছিল আর কথা বলছিল। এবার একটু গম্ভীর হয়ে তাকিয়ে রইল ইন্দ্রর দিকে। বুঝতে পারছিল না স্নিগ্ধার বিয়ে হয়ে যাবার কথাটা কিভাবে খুলে বলবে এই শান্ত ভদ্র ছেলেটাকে। ইন্দ্রর যে শকটা এক্ষুনি লাগতে যাচ্ছে তার পরিণামটা ভেবে দুঃখে ও ভয়ে ওর বুক ফেটে যাচ্ছিল। ইন্দ্রর সহজ সরল মুখটার দিকে তাকিয়ে সুমীর চোখে জল চলে এলো। ভেজা গলায় বলল,” ইন্দ্র, তোমাকে একটা ভীষণ খারাপ খবর দিচ্ছি। আমি তোমার চিঠি পেয়েই খোঁজ নিয়ে জেনেছি তোমার ভালোবাসা স্নিগ্ধা চার মাস আগেই একটা অন্য লোককে বিয়ে করে চলে গেছে। আর তারপর ওর মা শিলিগুড়িতে ভাইয়ের বাড়ি চলে গেছেন। সত্যি বলছি ইন্দ্র তোমার চিঠি পড়ে আমি চাইনি তোমার মনটা ভেঙে দিতে।“ কথা শেষ করার আগেই সুমীর দুচোখ বেয়ে দু ফোটা জল ঝরে পড়ল গাল বেয়ে।

ইন্দ্র অবাক হয়ে গেল সুমীর ওর ব্যাপারে এতোটা কন্সারন দেখে। একটা অচেনা অপরিচিত ছেলের জন্য মেয়েটির এই অনুভূতি ইন্দ্রকে বিবশ করে ফেলল। তবুও ইন্দ্র জানাল, “হ্যাঁ, আমি সেটা জানি সুমী। তোমার সাথে শেষ যেদিন কথা হল, সেদিনই আমি স্নিগ্ধা আর ওর হাস ব্যান্ড বিনয়কে দেখেছি, কথাও হয়েছে। আর তখনই আমি বুঝতে পেরে যাই যে আমার চিঠি অন্য কেউ পড়ছে আর উত্তর দিচ্ছে। এমন কি তুমি আমার সাথে ফোনে কথাও বলেছ। সেদিন কফি হাউসে তাই তোমার সাথে আলাপ করতেই তোমাকে ডেকেছিলাম সুমী। তুমি এলেনা, তাই আমাকেই তোমার কাছে চলে আসতে হল।“ 

এবার সুমীর অবাক হবার পালা। স্নিগ্ধার বিয়ে হয়ে গেছে জেনেও ইন্দ্র ওকে চিঠি পাঠিয়েছে, ফোনে ওর সাথে কথা বলেছে, কিন্তু ওকে কিছুই বুঝতে দেয়নি। তার মানে কি ইন্দ্র এবার ওর উপর বদলা নেবার মনোভাব নিয়ে এসেছে এখানে। এখন সুমী কী করবে, কিভাবে সব ম্যানেজ করবে সুমী ? হটাত সুমী হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলল। ফিস ফিস করে শুধু বলতে লাগল,”আমাকে মাফ করে দাও ইন্দ্র। আমি না জেনে তোমার মনে আঘাত দিয়েছি। কিন্তু বিশ্বাস কর আমি চাইছিলাম না স্নিগ্ধার জন্য গভীর কষ্ট পেয়ে তুমি কিছু একটা অঘটন ঘটিয়ে বসো। এই সবের জন্য আমিই দায়ি ইন্দ্র। আমাকে ক্ষমা করে দাও।“

ইন্দ্র থতমত খেয়ে তাড়াতাড়ি সোফা ছেড়ে উঠে এসে পাশের সোফায় বসা সুমীর হাত চেপে ধরে বলল, ”আরে আরে, তুমি কাঁদছ কেন সুমী। আমি তোমার উপর মোটেই রাগ করিনি। উল্টে অন্তত কিছুদিনের জন্য স্নিগ্ধার হয়ে প্রক্সি দিয়ে তুমি আমার মনে স্নিগ্ধার প্রতি প্রেমটা জাগিয়ে রেখেছিলে এতেই আমি ধন্য। আজ স্নিগ্ধা অন্য কারো গৃহিণী। আর একা এই পৃথিবীতে আমি এবার কালের অতলে হারিয়ে যাব। কিন্তু তুমি কেঁদো না তার জন্য সুমী। এতে তোমার কোন অন্যায় হয়নি। আমি কিছুই মনে করিনি।“ সুমী নিজেও উঠে দাঁড়িয়েছিল। দুই হাত ছেড়ে নিয়ে ইন্দ্রর মুখের দিকে তাকিয়ে আদুরে গলায় ফিস ফিস করে ছল ছল চোখে শুধু বলল,”কেন তোমার এই নকল স্নিগ্ধাকে তুমি কি পারোনা এখন তোমার আসল সোনা ভেবে ভালোবাসা দিয়ে ভরিয়ে দিতে ইন্দ্র ? আমি যে তোমাকে ভালবেসে ফেলেছি গো। আমি এখন আর তোমাকে ছাড়া বাঁচব না ইন্দ্র। পারবে না তুমি মনে করতে আমিই তোমার স্নিগ্ধা, তোমার সোনা ?” 

ইন্দ্র সুমীর এই আন্তরিক ও গভীর আবেদনে নিজেকে সপে দিল ওর কাছে। দুই হাতে সুমীর ভেজা গাল তুলে ধরে নামিয়ে নিয়ে এলো ওর ঠোঁট। সুমীকে গভীর চুম্বনে ডুবিয়ে দেবার আগে শুধু ফিস ফিস করে বলল ,” আমি তো নকল স্নিগ্ধাকে চাইনা সুমী। আমি তোমার সান্নিধ্য চাই সোনা। একজন সহজ সরল মিষ্টি মেয়ে, যার মনে কোন হিংসা বা জটিল প্যাঁচ নেই। আমাকে বিয়ে করবে সুমী ? কথা দাও আজ এই অভাগাকে। বলতে বলতে ইন্দ্র জড়িয়ে ধরে সুমীকে, আর গভীর ভাবে চুম্বন করে। সুমী ঐ অবস্থাতেই শুধু গভীর আবগে বলে ওঠে, “উঁ”। গাঢ় আলিঙ্গনে লিপ্ত হয় দুই অতৃপ্ত দেহ এক নতুন দিগন্তের শুরুতে।                  

uttamchakraborty306@gmail.com
ব্যাঙ্গালোর


No comments:

Post a Comment