ছবি : ইন্টারনেট স্মরণে শ্রীপঞ্চমী শাশ্বতী মুন্সী |
--- কি তাহলে তোরা রাজি তো?
--- হ্যাঁ দিদিমনি, আমরা সবাই রাজি |
--- ঠিক আছে, তাহলে এই বছর শিক্ষাঙ্গনে প্রথম সরস্বতী পুজো হওয়া শুরু হলো. প্রত্যেক বছর এই দিনটিতে বিদ্যার দেবীর পুজো করবো আমরা..,যদি তোরা সবাই মন দিয়ে লেখাপড়া করিস...
--- হ্যাঁ. আ.. আ.. আ.. আ... সমস্বরে বলে উঠলো ঘরভর্তি পড়ুয়ার দল |
শীতঋতুর অবসানে বসন্তের শুভ আগমন বার্তা ধ্বনিত হয় সরস্বতী পুজোর দিন থেকে | বসন্ত পঞ্চমী হিসেবে পরিচিত এই দিনটি স্কুল কলেজ থেকে গৃহস্থ বাড়ি - সর্বত্র দেখা যায় চেনা ছবি | আপামর বাঙালী মেতে ওঠে বাগ্দেবীর আরাধনায় | তবে কোথাও কোথাও বিসদৃশ ছবি দেখা যায় বৈকি | যেখানকার বাসিন্দাদের বসন্তের আমেজে সরস্বতী পুজো করা তো দুরস্ত,লেখাপড়ার সাথেই যাদের যোজন দূরত্ব | তেমনই একটি জায়গা হলো শ্যামনগরের পদ্মপুকুর এলাকা লাগোয়া বস্তিপাড়া | চারপাশের অভিজাত,ভদ্র,শিক্ষিত পরিমণ্ডলে যা একেবারেই বেমানান | অনেক গুলো বছর ধরে শিক্ষার সংস্পর্শ থেকে বিচ্ছিন্ন এক দ্বীপের মতো বসবাস করে আসছে বস্তিপাড়ার বাসিন্দারা |
সর্বক্ষণ চেঁচামেচি,খিস্তিখেউর,আর উচ্চগ্রামে চলা ঝগড়ার পঙ্কিল পরিবেশের বস্তিপাড়াকে এলাকার উঁচুতলার বাবুরা এড়িয়ে চলতেন | কিন্তু হতদরিদ্র শ্রেণীর মানুষগুলোর সংসর্গ থেকে নিরাপদ দূরত্ব রেখে স্বার্থপরের মতো শুধু নিজের ছেলেমেয়ের শিক্ষাগত উন্নতির কথা ভাবতে পারেন নি ভারতীদেবী | কেননা তিনি যে শিক্ষক বাবার মেয়ে | নৈতিক,মানবিক,সামাজিক মূল্যবোধসম্পন্ন সুনাগরিক গড়ার কারিগর বাবার ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে বড়ো হয়ে উঠেছিলেন আশৈশব থেকে | ফলত ভূপেনবাবুর (ভারতীদেবীর বাবা) মতাদর্শে প্রাণিত তার শিক্ষানুরাগী সত্তা কখন যেন দীক্ষিত হয়ে গেছিল " সকলের জন্য শিক্ষা " - এই মন্ত্রে | বাবা নয় বরং একজন শিক্ষকের কাছে নিয়েছিলেন জীবনদর্শনের দীক্ষা | কাকচক্ষু জলের মতো স্বচ্ছ ও মেঘমুক্ত আকাশের তারার মতো স্পষ্ট ছিল তার জীবনদর্শন |
শিক্ষা,সম্মান,অর্থ,আভিজাত্যে উচ্চ-মধ্যবিত্তের মাঝামাঝি জায়গায় অবস্থান করছিল পদ্মপুকুর এলাকার দত্তবাড়ি | এই বাড়ির কর্ত্রী ভারতীদেবী আদতে একজন গৃহবধূ | শিক্ষাগত যোগ্যতার ঝুলিতে মাস্টার ডিগ্রি থাকলেও সাংসারিক কর্মপ্রবাহে জীবন যাপনে স্বচ্ছন্দবোধ করতেন তিনি | তবে শিক্ষার্থী থাকাকালীন স্কুলজীবন থেকে আশেপাশের গরিব দুঃস্থ পরিবারের ছেলেমেয়েদের শিক্ষাদানে নিবৃত্ত ছিলেন,বিনা বেতনে | বিবাহ পরবর্তী জীবনে শুধু নিজ সন্তানদের লেখাপড়া শেখানোর দায়িত্ব স্বস্কন্ধে নিয়েছিলেন | কিন্তু " প্রতিটা শিশুর আছে শিক্ষা গ্রহণের অধিকার " এই আপ্তবাক্যটি তাঁর চিন্তনকে সুস্থির থাকতে দেয় নি | এমন কিছুর সন্ধানে ছিলেন যেখানে দীক্ষামন্ত্রের যথাযথ প্রয়োগ করলে তা কার্যকরী ভূমিকা নিতে পারবে |
দত্তবাড়ির সীমানার ওপ্রান্তে দুপাশে সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বস্তির ঘিঞ্জি ঘরগুলোতে বাস করে অসংখ্য দিনমজুরের পরিবার | লেখাপড়া যাদের কাছে বিলাসিতার নামান্তর | আর্থ সামাজিক অবিচার ব্যাবস্থার দরুন এইসব অতি দরিদ্র এবং অবহেলিত গোষ্ঠীর পরিবারের শিশুরা যেমন সহজে পায় না প্রাথমিক স্কুল,তেমনি না পায় লিখতে ও পড়তে পারার সুযোগ | সুতরাং বংশানুক্রমিক ভাবে দরিদ্র বাবা মায়ের সন্তানেরা দারিদ্র্যচক্রের মধ্যে আটকে যায় | সারাদিন তো বটে এমনকি রাতের বেশিরভাগ সময় বস্তির মধ্যবর্তী রাস্তায় ধুলোবালি মেখে খেলে কাটায় তারা | যাতায়াতের পথে ওদের শৈশব-বাল্যের মূল্যবান দিনগুলোকে এভাবে নষ্ট হতে দেখে দৃঢ় সংকল্প নিয়ে ভারতীদেবী একদিন পৌঁছে গেছিলেন বস্তির প্রত্যেকটা দরজায় |
ঘরের পরিবেশে শিক্ষার অপ্রতুল পরিস্থিতিতে শিশুদের বেড়ে ওঠা | এরকম বিরুদ্ধ পরিবেশ পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে শিশুর কাছে প্রকৃত শিক্ষক হতে পারাটা অবশ্যই চ্যালেঞ্জ ছিল! লেখাপড়ার গুরুত্ব কি,জীবনে স্বাবলম্বী হবার জন্য তা কতোটা জরুরি,শিক্ষার কোনো বয়স হয় না -- এসব কথা বোঝানোতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছিল তাঁকে | বলা ভালো প্রথমে কেউই তেমন আগ্রহ দেখায় নি | কিন্তু ভারতীদেবীর সহৃদয়তা এবং আন্তরিক আহ্বানে অল্পদিনেই মিলেছিল আশাতীত সাড়া |
নিজের বাড়িতে খুলে বসেছিলেন অবৈতনিক শিক্ষাঙ্গন | জাত-ধর্মের ভেদাভেদ না রেখে সকলের জন্য অবারিত করেন শিক্ষাঙ্গনের দ্বার | প্রাথমিক শিক্ষার অঙ্গনে কচি কাঁচা কোমল সুকুমারমতি শিশুদের নাড়াচাড়া করতে করতে তাদের মনের ভেতরে প্রবেশ করার ক্ষুদ্র প্রচেষ্টায় পেয়েছেন অমলিন আনন্দ | শিশু থেকে কিশোর -- সব বয়সের ছেলেমেয়েদের হাতে ধরে অক্ষর পরিচয় করানো এবং বাংলা,ইংরেজি,অঙ্কি,ইতিহাস, বিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয় পড়ানোর দায়িত্ব নেন স্বইচ্ছায় |
একবছরের মধ্যে বাড়ির পশ্চিমদিকের অব্যবহৃত বড়ো ঘরখানি রূপান্তরিত হয়েছিল ছাত্রছাত্রীদের স্থায়ী শ্রেণীকক্ষে | সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত সপ্তাহে ছ'দিন রুটিন মাফিক পঠন পাঠন চলে সেখানে | বাগান সংলগ্ন শ্রেণীকক্ষের পরিবেশ ওদের কাছে ক্রমেই আকর্ষণীয় হয়ে উঠতে লেগেছিলো | রফিক,জামাল,নন্টে,হাবুল,নাজিমা,বুল্টি,ইকবাল,ঝুনি,রুকু,আসিমা,সাজিদা -- নানা বয়সী পড়ুয়াদের জন্য ছিল সমান শিক্ষা |
অবশ্য এই সাধু উদ্যোগে পাশে পেয়েছিলেন স্বামী পরেশ(দত্ত) বাবু এবং পুত্রকন্যা রিন্টু ও রিম্পিকে | ওদের পূর্ণ সমর্থনে শিক্ষাদানের এমন মহৎ কর্মকাণ্ডে অবতীর্ণ হতে পেরেছেন |
স্ত্রীয়ের মহানুভবতা দেখে অভিভূত হয়েছিলেন পরেশবাবু | তাই সোৎসাহে এক কক্ষবিশিষ্ট এই শিক্ষাঙ্গনের নাম রাখলেন " ভারতীয়ালয় " |
বস্তিবাসীর প্রথম প্রজন্মের পড়ুয়াদের মধ্যে লেখাপড়া শেখার ব্যাপারে বিশেষ আগ্রহ পরিলক্ষিত করেন ভারতীদেবী | তা দেখে বিদ্যার দেবীর আরাধনা করার ভাবনা আসে মনে | ইতিপূর্বে বাড়িতে সরস্বতী পূজো করেন নি কোনোবার | তাই এ ব্যাপার ছেলেমেয়ের মনোভাব জানাটা জরুরি মনে করলেন | সেইমতো ওদের ঘরে গিয়ে "এবছর সরস্বতী পুজো করলে করলে কেমন হয় রে রিন্টু রিম্পি? " --- খাটে বসে কথাটি বললেন তিনি |
সন্ধ্যেবেলা নিজেদের পড়ার ঘরের চেয়ার টেবিলে বসে দুই ভাইবোন পড়ছিল | এ হেন কথায় চকিতে মায়ের দিকে ঘুরলো দুজনে | পড়া থামিয়ে খুশিতে টগবগ করে উঠে ওনার দু'দিকে বসে পরলো | তারপর উৎসকু কণ্ঠে রিম্পি বললো,
--- পূজো করবে মা! তাহলে তো খুব ভালো হবে, আমার কত্ত বন্ধুর বাড়িতে পূজো হয় ওরা স্কুল এবং বাড়ি - দু জায়গাতেই আনন্দ করতে পারে,কিন্তু আমি আর দাদা শুধু স্কুলের পূজোতে যা আনন্দ করতে পারি সকালটুকু...
বোনের কথার রেশ ধরে রিন্টু বললো,
--- হ্যাঁ মা,বাড়িতে পূজো হওয়ার মতো আনন্দ আর কিছুতে হয় না,তাছাড়া তোমার ছাত্রছাত্রীরাও পূজো দেখতে আসবে,আনন্দে সামিল হবে...
ছেলেমেয়ের উৎসাহে খুশি হলেন তিনি | বললেন,
--- পূজো তো করবোই,তবে বাড়িতে নয়...
--- বাড়িতে নয়!তাহলে কোথায় করবে মা,একসাথে জিজ্ঞেস করলো দুটিতে |
--- বাড়ির সামনে বাগানের পাশে যে ফাঁকা জমি আছে,ওখানে প্যান্ডেল করে মণ্ডপ বানিয়ে পূজোর ব্যবস্থা হবে...আমি চাই বস্তির সকলে দর্শনার্থী হয়ে নয় পূজোর আয়োজকের অন্যতম অংশ হোক,কেননা বাড়ির ভেতর পূজো করলে ওরা স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে পুজোতে যোগদান করতে পারবে না,আর নিজেদের পূজোও ভাবতে পারবে না...ওদের সবাইকার অংশগ্রহণে বিদ্যার দেবীর আরাধনার হয়ে উঠবে সর্বজনীন উৎসব...
মায়ের মনের প্রসারতায় মুগ্ধ হলো রিন্টু রিম্পি! দু'পাশ থেকে দুজনে ভারতীদেবীকে জড়িয়ে ধরেএকসাথে বললো,
--- তুমি কত বড় মনের মানুষ মা... আনন্দ যে সকলের সাথে ভাগ করে নিতে হয়,তা কি সুন্দর করে বুঝিয়ে দিলে...
সন্তানদের স্নেহের আলিঙ্গনাবদ্ধ হয়ে ভারতীদেবী স্মিত হেসে বললেন,
--- আনন্দ ভাগ করে নেবার শিক্ষা আমি কার কাছে পেয়েছি জানিস?..তোদের দাদুর থেকে
তারপর যেন খানিক গল্প বলার মতো বলতে লাগলেন,
এই যে তোরা সরস্বতী পূজোয় সেজেগুজে স্কুলে যাস,আশেপাশে ঘোরাঘুরি করে খাওয়া দাওয়া করিস,আমাদের সময় কিন্তু স্কুলের পূজোতে যাওয়ার তেমন একটা চল ছিল না,
--- কেন মা,তোমাদের ছোটবেলায় কি স্কুলে পূজো হতো না?, সরল কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো বছর এগারোর রিম্পি |
মেয়ের সরলতায় সহাস্যে ভারতীদেবী বলে উঠলেন,
--- ওরে পাগলী মেয়ে,পূজো কেন হবে না... ছোট বড়ো সব স্কুলেই বছরের এই বিশেষ দিনটিতে বিদ্যার দেবীর পুজোআচ্চা করে ছাত্রছাত্রীসহ বিদ্যালয়ের সার্বিক উন্নতির প্রার্থনা জানানো হয় মা সরস্বতীর চরণে,আর আমাদের স্কুলেও বড়ো করে পূজো হতো,এখন যেমন অনেক স্কুলে প্যাকেট সিস্টেম হয়েছে,তখন কিন্তু বসিয়ে খাওয়ানোর রীতি ছিল প্রায় সব স্কুলে... আর একটা বন্ধুদের সাথে লাইন দিয়ে বেঞ্চে বসে খিচুড়ি খাওয়ার মজাই আলাদা... তবে আমি কিন্তু মাত্র একবারই সেই মজা উপভোগ করার সুযোগ পেয়েছিলাম... স্কুলের শেষ বছরের পূজোয়...
অবুঝের মতো মায়ের মুখের দিকে মিনিট কয়েক তাকিয়ে রইলো দুজনে একসাথে বললো,
--- দাদু দিদুন কি তোমায় স্কুলে যেতে দিতো না মা?
ছেলেমেয়ের মুখের ভাবখানা দেখে মনে মনে একচোট হেসে নিলেন,তারপর খাটে পা মুড়ে বসে ওদেরকে সামনে বসিয়ে বললেন,
--- শোন, আমার বাবা মা কক্ষনো স্কুলে যেতে বারণ করেন নি,বরং আমারই তো যেতে ইচ্ছে করতো না...
--- সেকি গো মা...সরস্বতী পূজোয় তোমার স্কুলে যেতে ইচ্ছে করতো না!,সমস্বরে কথাটা এমন ভাবে বললো তারা যেন পূজো স্কুলে যেতে ইচ্ছে না করাটা প্রায় অবিশ্বাস্য ব্যাপার |
--- যেতে ইচ্ছে করবে কি করে!আমাদের তো বাড়িতেই পূজো হতো,যখন আমরা তিন ভাইবোন লেখাপড়া শুরু করেছি,সেই তবে থেকে বাড়িতে সরস্বতী পূজো করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বাবা | তাছাড়া শুধু বাড়ির পূজো নয় এর সাথে আরো দু' দুটো পূজোর আনন্দ করতাম আমরা |
মায়ের কথা শুনে বিস্ময়ে চোখ গোল গোল হয়ে গেছে দুজনের! জিজ্ঞাসু কণ্ঠে রিন্টু বললো,
--- বলো না মা,আর দুটো পূজো কাদের বাড়িতে হতো?
--- তখন পাড়ার সব ঘরেই লক্ষ্মী পূজোর মতো সরস্বতী পূজোও হতো,কিন্তু তোদের দুই মামার কৈশোরে মানে ওই ১৪-১৫ বছর বয়স থেকে আমাদের পাড়াতেই দুটো আলাদা জায়গায় পূজো শুরু করেছিল বন্ধুদের সাথে মিলে,আর সেই পূজোর প্রতিমা কে বানাতো জানিস? তোদের বড়মামা... পূজোর সমস্ত জোগাড় করতাম আমি,তোদের দিদুন আর আমার বান্ধবী সবিতা...
মায়ের ছোটবেলায় সরস্বতী পূজোর দিনের কথা বেশি করে জানাতে আগ্রহী দুই ভাইবোনে ওনার কাছ ঘেঁষে সরে আসলো | তারপর,
--- আরো কি কি করতে বলো না মা,বলে উঠলো সমস্বরে |
সন্তানদের উৎসুকতা উস্কে দিলো তাঁর কিশোরীবেলার স্মৃতি | তারপর স্মৃতির সরনী বেয়ে পিছনে হাঁটতে হাঁটতে বলতে লাগলেন,
জানিস,বাড়ির পূজো এবং তোদের মামাদের দুটো পূজোতে খুব আনন্দ করতাম আমরা | বাবা প্রতি বছর নতুন শাড়ি কিনে দিতেন,দুপুরে মায়ের রান্না করা খিচুড়ি ভোগ খেতাম সকলে মিলে... দাদা ও ভাইয়ের বন্ধুরাও খেত আমাদের সাথে..তবে রাতের আয়োজন হতো এলাহী,তোদের দাদুর ইচ্ছা মতো পাড়ার ছোট ছেলেমেয়েদের নেমন্তন্ন থাকতো আমাদের বাড়িতে.. বেগুনি,কড়াইশুঁটির কচুরি,আলুরদম, চাটনি,পায়েস... দরাজ হাতে খাওয়ানো হতো...
বছরের এই বিশেষ দিনটি নতুনত্বের অনুভূতি নিয়ে বারবার ফিরে আসতো ভারতীদেবীর মেয়েবেলায় |
--------------
ইংরাজি নববর্ষে সরস্বতী পূজো পড়েছে জানুয়ারির শেষের দিকে | বাপেরবাড়িতে পুজো করার অভিজ্ঞতালব্ধ ভারতীদেবী পূজার্চনার আয়োজনে যথেষ্ট করিৎকর্মা | বিয়ের পরে এটা যেহেতু তাঁর প্রথম পূজো,সেহেতু মনস্থ করলেন বিদ্যার দেবীর উৎসবকে সর্বজনীন ভাবে পালন করার | তাই এব্যাপারে খোলাখুলি আলোচনার জন্য ছাত্রছাত্রীদের অভিভাবকসহ বস্তির অন্যান্য বাসিন্দাদের এক রবিবারের সন্ধ্যেবেলা বাড়িতে ডেকে পাঠালেন | পড়ানোর ঘরে সকলে জড়ো হলে পরিকল্পনা মতো প্যান্ডেল তৈরী করা,মণ্ডপ সাজানো,প্রতিমা আনা,বাজার করা,আল্পনা দেওয়া,ইত্যাদি পুজোর আনুষঙ্গিক কাজগুলো মহিলা ও পুরুষদের মধ্যে ভাগ করে দিয়ে বললেন,
--- তোমাদের কারো কোনো অসুবিধা নেই তো... থাকলে নিঃসংকোচে এখুনি বলতে পারো,
সকলে গলা মিলিয়ে বলে উঠলো,
--- আপনি যখন মাথার ওপরে আছেন তাহলে আর মোদের কিসের অসুবিধা...
--- তবে কোনো পূজোর জোগাড় জন্তি আগে কখনো করি নি..,শুধু একটু দেখিয়ে দেবেন কিভাবে করতে হয়,মোরা হাতে হাত মিলিয়ে সব কাজ করে দেবো,বললো নন্টের মা খেন্তি |
--- আচ্ছা আচ্ছা,সেসব আমি শিখিয়ে দেবো'খন..
তারপর যেন একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতেই ভুলে যাচ্ছিলেন এমন ভাবে বললেন,
--- ওহো তোমাদের তো আসল কথা বলা হয় নি,শোনো সরস্বতী পূজোর দিন দুপুরে ও রাতে দু' বেলা সকলের এখানে নেমন্তন্ন রইলো, রান্নার ঠাকুর দিয়ে খাওয়া দাওযার বন্দোবস্ত করবো...ঐদিন মেয়ে-বৌদের রান্না থেকে ছুটি, সারাদিন রাত শুধু উৎসবের আনন্দে কাটাবে তোমরা..
ভারতীদেবীর কথায় সকলে বিস্মিত হয়ে মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলো!হতদরিদ্র মানুষগুলোর কাছে এমন নেমন্তন্ন পাওয়া শুধু অভাবনীয় নয় অবিশ্বাস্য বটে... তা বলে ওরা তো আর হ্যাংলা নয় যে দু বেলা পেটপুরে খেতে পাবার লোভে চকচক করে উঠবে অগণিত চোখজোড়া.. তাই মুখমণ্ডলে অবাক হবার ছাপ ফুটে উঠলো সকলের...
মিনিট কয়েকের বাকরুদ্ধ নীরবতার পর দুটি ছাত্রছাত্রীর অভিভাবক চপলা ও ফতেমা বললো,
--- আজ্ঞে দিদিমণি,আমরা এতো জনা থাকতে রান্নার ঠাকুর কেন লাগবে! এই বস্তির মেয়ে-বৌরা মিলে হাতে হাত লাগিয়ে সব রান্না করে নিতে পারবো |
--- আহা.. তোমরা বুঝছো না আমার কথাটা.. আমি চাইছি একটা দিনের জন্য তোমাদের রান্নার কাজ থেকে ছুটি দিতে,আর তাছাড়া অতোগুলো লোকের রান্না করাও যে চাট্টি খানি কথা নয়,সেটা ভেবে দেখেছো কি..?
এবার বুল্টির মা সনকা বেশ জোর দিয়ে বললো,
--- রাঁধুনে বামুনরা তিন চারজন জোগাড়ে নিয়ে কাজবাড়িতে কত শত মানুষের খাবার রাঁধতে পারে যখন,তাহলে এতোগুলান মেয়েমানুষেরা একসাথে নিচ্চয় সব রান্না করি দিতে পারবো |
ওর কথায় সায় দিয়ে ঘরে উপস্থিত মেয়ে বৌদের কণ্ঠ থেকে একযোগে হ্যাঁসূচক শব্দ বের হলো |
ব্যাস এরপর ভারতীদেবীর দ্বিমত প্রকাশের জায়গা থাকে না | তাই হাসিমুখে তিনি বললেন,
--- ঠিক আছে,তোমরা যেমন চাইছো তেমনটি হবে | আরো একটা কথা আছে তা হলো,পূজোর এবং খাওয়া দাওযার যাবতীয় খরচ কিন্তু আমি দেবো.. কি এতে তোমাদের আপত্তি নেই তো..?
ঘরের শান্ত পরিবেশ যেন সহসা মুখরিত হয়ে উঠলো প্রত্যেকের সরব কণ্ঠের টুকরো টাকরা কথার গুঞ্জনে.. কেননা এমন অচিন্তনীয় কথা শুনতে তাদের কানজোড়া যে এক্কেবারে অভ্যস্ত নয়!
নিচু স্বরে চলা ওদের কথাবার্তায় কিছুটা আন্দাজ করতে পারছিলেন তিনি | তবু ওরা কি চায় সেটা জানার জন্য বললেন,
--- তোমরা নিজেদের মধ্যে কথা বলবে নাকি আমাকেও জানাবে?
বস্তির এক বয়স্ক বাসিন্দা হারান গলুই বিনীত কণ্ঠে বললো,
--- ছোট মুখে একখান বড় কথা বলচি দিদিমণি,আপনের কথায় আপত্তি আছে আমাদের..
জিজ্ঞাসু চোখে হারানের মুখের দিকে উনি তাকালে সে বলতে লাগলো,
--- আমরা অত্যন্ত গরিব মানুষ,মাইনে দিয়ে বাচ্চাদের ইস্কুলে পড়ানোর সাধ্যি কোথায় বলুন! আপনে দয়াপরবশ হয়ে বিনি পয়সায় ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শেখাচ্চেন বলে ওদের কেউ মুখ্যু বলতি পারবে নি.... এরওপর পূজো ও মোদের খাওয়া দাওয়ার সব খরচও আপনে একা দেবেন তা কেমন করে হয় দিদিমণি!
ওনার কথার খেই ধরে হাবুলের বাবা রতন বললো,
--- হারান জ্যাঠা ঠিক কইচেন দিদিমণি,আমরা দিন আনা দিন খাওয়া মানুষ,রোজগারের বেশিরভাগটাই লেগে যায় পেটের খিদে মেটানোর দু'মুঠো ভাতের যোগান দিতে... তাও যার যার সামর্থ মতো কিছু টাকা দিতে চাই |
--- আরে এটা তো আর চাঁদা তুলে পূজো হচ্ছে না.. উপযাচক হয়ে পূজো করার কথা আমি যখন ভেবেছি,তখন তোমাদের থেকে টাকা নেওয়া যে অনৈতিক হবে রতন..
--- না না দিদিমণি,চাঁদা তুলে তো পাড়ার অল্প বয়সী ছেলেরা পূজো করে, মোদের আর কতটুকুন সাধ্যি বলুন! তবুও লেখাপড়ার ঠাকুরের পূজোর জন্যি যতটুকু পারি দেবো,আপনে আর অমত কইরবেন না দিদিমণি,হাতজোড় করে কথাগুলো বললো রতন |
অশিক্ষিত মানুষগুলোর আন্তরিকতা এবং সর্বসম্মত ভাবে ইচ্ছাপ্রনোদিত হয়ে পুজোয় যোগদানের আর্জিতে খুশি হলেন ভারতীদেবী | হৃষ্ট চিত্তে বললেন,
--- তোমাদের কথাই মেনে নিলাম | দিও তবে সকলের সাধ্য মতো অল্প কিছু কিছু করে |
লহমায় প্রত্যেকের মুখভঙ্গীতে হাসি ও স্বস্তির মিশ্র অভিব্যক্তি দেখা গেল |
-----------------
সরস্বতী পূজোর দিন সাতেক আগে বাগানের পাশের ফাঁকা জমি পরিষ্কার করে প্যান্ডেল তৈরী করে দিয়েছে বস্তির ছেলে ছোকরারা | রঙিন কাগজের শিকলি এবং রং,জরি,চুমকি,সুতো দিয়ে তৈরী শোলার হস্তশিল্পে সজ্জিত হয়েছে মণ্ডপের অভ্যন্তরীণ অঙ্গসজ্জা | দেবীপ্রতিমার আসনকে পুষ্পশোভামন্ডিত করে রাখা হয়েছে বাগানের হলুদ কমলা গাঁদা,ডালিয়া,গোলাপ,চন্দ্রমুখী ফুলের টব দিয়ে |
আগামীকাল মাঘ পঞ্চমীর পুণ্য তিথি | সেকারণে আগের দিন রাতে পুজোর প্রস্তুতির শেষ মুহূর্তের কাজ চলছে জোরকদমে |
পশ্চিমের ঘরের পেছনের উঠোনে বড়ো করে আরেকটা প্যান্ডেল হয়েছে | যেখানে একদিকে রান্না হবে আর অন্যদিকে চেয়ার টেবিলে খাওয়ানো হবে | ছাত্রছাত্রীদের পড়ার ঘরে পরের দিনের দু'বেলার রান্নার জোগাড়ের জন্য সবজি কেটে,মশলা বেটে যথাসম্ভব কাজ এগিয়ে রাখছে মেয়ে বউরা | আজ রাতে বস্তির কারো উনুনে হাঁড়ি চড়বে না | ভারতীদেবীর হেঁশেলেই সব্বাইয়ের খাওয়ার বন্দোবস্ত হয়েছে | সেইমতো মেয়ে বউরা দুটি দলে ভাগ হয়ে আজকের ও কালকের রান্নার আয়োজনে ব্যস্ত রয়েছে | তবে ঠাকুরের ভোগ নিজে হাতে রাঁধবেন তিনি |
মাঘের মাঝামাঝি সময়ে বাতাসে ঠান্ডার আমেজ ভালোই অনুভূত হচ্ছে | ঘরের এককোনে আসন পেতে বসে ঠাকুরের ভোগ রান্নার উপকরণ একলাই গুছিয়ে রাখছেন ভারতীদেবী | পরনে পাটভাঙা তাঁতের শাড়ির ওপর ফুলহাতা সোয়েটার | হঠাৎ কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন তিনি | অদৃশ্য কোনো জাদুকরের জাদুকাঠির মায়াবলে সামনের দৃশ্যপট পলকে বদলে গেল অতীতে | ফেলে আসা কিশোরীবেলার স্মৃতির সমুদ্রে অবগাহন করামাত্র ভেসে আসতে লাগলো একের পরে এক দৃশ্য... যেন টাইম মেশিনে চড়ে তিনি পৌঁছে গেছেন এমনই এক সন্ধ্যা উত্তীর্ণ শীতের রাতে,যেখানে কিশোরী বয়সী ভারতীদেবী সরস্বতী পূজোর জোগাড় করছেন বান্ধবী সবিতার সাথে... পাশে ভোগের আয়োজনে ব্যস্ত রয়েছেন ওনার মা...শুনতে পাচ্ছেন দুই বান্ধবীর অস্ফুট কথাও... এবার দৃশ্য বদলে গেল পূজোর সকালে...চিরপরিচিত বাপেরবাড়ির বৈঠকখানা ঘরে আল্পনা দেওয়া ছোট জলচৌকির ওপর দেবী মূর্তি বসিয়ে পূজার্চনা চলছে... স্নান সেরে নতুন কাপড় পরে দুই বান্ধবীতে বসে আছেন প্রতিমার সম্মুখে... শঙ্খ-ঘন্টা-কাঁসরের মিশ্রিত ধ্বনি,করজোড়ে ঠাকুর মশাইয়ের সাথে পুষ্পাঞ্জলির মন্ত্রোচ্চারণ... পঞ্চপ্রদীপের আরতি,হোমের প্রজ্জ্বলিত আগুন,মায়ের রান্না করা ভোগ নিবেদন,ধূপ ধুনোর সৌগন্ধে স্বর্গীয় বাতাবরণ...পরক্ষনেই দেখলেন দৃশ্য একই রয়েছে শুধু পূজোর স্থানটি হয়ে গেছে প্যান্ডেলের ভেতর...দাদা ও ভাইয়ের বন্ধুরা মিলে করা দুটি পূজোতে তাঁরা রয়েছেন... দুপুরে বাবা মা সবিতা,দাদা ভাই ওদের বন্ধুরা একসাথে ভোগ খাচ্ছেন ঘরের দালানে বসে ---- সবাক চিত্রের ন্যায় চলমান দৃশ্যগুলি ত্রিশোর্ধ ভারতীদেবীর মনের পর্দায় প্রতিভাত হয়ে উঠলো...
কাজ করতে করতে চপলা লক্ষ্য করছিল দিদিমণি কেমন যেন আনমনা হয়ে গেছেন | সেদ্ধ আলুর খোসা ছাড়ানো বন্ধ রেখে স্থির দৃষ্টিতে সামনের দেওয়ালের পানে তাকিয়ে রয়েছেন | নিশ্চল পাথরের মূর্তির মতো | কালকের দুপুরের মেনুতে বাঁধাকপির তরকারি হবে,তাই-ই কুটছিল সে | কিন্তু আর কতগুলো কুটবে তা জানার জন্য ভারতী দেবীকে জিজ্ঞেস করতে গিয়ে ওনার মৌন অবস্থা চোখে পড়ে চপলার | একটুক্ষণ দোনোমোনো করে মৃদু স্বরে সে ডাকলো,
--- দিদিমণি,ও দিদিমণি.. বলতেছিলাম কি..
সময় নদীর স্রোতের বিপরীতে ভাসমান স্মৃতির ভেলায় চড়ে কিশোরীবেলার কোনো এক সরস্বতী পূজোর সোনালী দিনে চলে গেছিলেন তিনি | অতীতের যাপন করা ভূমিতে ঘুরে বেরিয়ে ফিরে আসছিলেন তখুনি মেয়েলি কণ্ঠস্বরের পরিচিত সম্বোধনে সম্বিৎ ফিরলো তাঁর | দেখলেন সব ক'টি মেয়ে বৌয়ের অবোধ্য চাহনি ধাবিত রয়েছে তাঁরই মুখমন্ডলে | বুঝলেন সরস্বতী পূজোর প্রাক পর্বের প্রস্তুতির আবহে ক্ষণিকের তরে স্মৃতি মেদুরতায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলেন!এক লহমায় বর্তমানে ফিরে এসে বললেন,
--- কেউ কি কিছু বলছিলে?
--- আমি বলছিলাম দিদিমণি,কিন্তু আপনাকে দেখে মনে হতিছিল কিছু যেন ভাবতি ছিলেন,খানিক দ্বিধা জড়িত স্বরে বললো চপলা |
--- হুম ভাবছিলাম বৈকি,তোমাদের সহযোগিতায় সরস্বতী পূজো করতে নেমে আমার মেয়েবেলার এমন এক পূজোর দিনের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিলো
--- বিদ্যের ঠাকুরের পূজো আপনে ছোটবেলায় করেছিলেন দিদিমণি!, চোখের তারায় বিস্ময় ফুটিয়ে বললো ফারিদা ও জবা |
ক্ষণিক আগের মুহূর্তগুলির বর্ণনা বিশদে না দিয়ে সংক্ষেপে বললেন,
--- হ্যাঁ আমাদের বাড়িতে পূজো হতো,মায়ের সাথে পূজোর উপাচার সামগ্রী কেনাকাটা থেকে জোগাড় যন্ত করা সবই করতাম... পূজোআচ্চার দিকে আমার আগ্রহ দেখে থাকায় কোন পূজোয় কি কি উপকরণ লাগে,একেকটি পূজোর আচার বিধি কেমন হয় ইত্যাদি মায়ের কাছে শিখে নিয়েছিলাম..
--- লেখাপড়া ছাড়াও কতকিছু জানেন আপনে,সেই জন্যি পূজোর ব্যাপার স্যাপার কেমন সোন্দর করে বুঝিয়ে দিলেন,অবাক ও উৎফুল্ল মেশা গলায় বললো তারা |
স্মিত হাসলেন ভারতী দেবী | তারপর একটু আসছি বলে উঠে গেলেন | মিনিট তিনেক পরে দুটো বড়ো বিগ সপার হাতে নিয়ে ঘরে এসে বললেন,
তোমাদের সকলের জন্য হলুদ রঙের শাড়ি,জামা,ফতুয়া,পাঞ্জাবী কিনেছি | কাল নতুন পোশাক পরে পূজোর অঞ্জলি দেবে...
বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যাওয়া ওদের মুখগুলোর দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে বললেন,
--- ভেবো না যে শুধু তোমাদের জন্য নতুন জামা কাপড় কিনেছি,আমরা চারজনও কাল নতুন পোশাক পরে অঞ্জলি দেবো... আর এসব কেনার টাকা তোমাদের দাদাবাবু দিয়েছেন |
---------------
বাঙালীর বারোমাসে তেরো পার্বন | প্রত্যেক ঋতুতে চক্রাকারে আবর্তন করেই চলা কিছু না কিছু ব্রত পূজো পার্বনের অন্তর্ভুক্ত হয় | তেমনই বিদায়ী শীত আর আগত বসন্তের সন্ধিক্ষণে পালিত হওয়া সরস্বতী পূজো হলো বসন্তের প্রথম উৎসব তথা অন্যতম পার্বন | কিন্তু নিম্নবিত্ত এই বস্তিবাসীরা দেবদেবীর পূজো কেন্দ্রিক উৎসব বলতে মূলত দুর্গোৎসবকেই বুঝে এসেছিলো | সরস্বতী পূজোর আনন্দোৎসব থেকে এযাবৎকাল বঞ্চিত ছিল ওরা | তবে এবছর ভারতীদেবীর বদান্যতায় আরেক উৎসবের সামিল হবার সৌভাগ্য হলো তাদের |
মণ্ডপের ভেতরে বড়ো চৌকির উপর রাখা আছে কাঠের পিঁড়ি | যেটাতে সালমার হাতে অঙ্কিত খড়িমাটির আল্পনার বেষ্টনীতে অধিষ্ঠিত রয়েছেন শ্বেতপদ্মাসনা বীণাপানির কাঠামোর মূর্তি | পঞ্চমী তিথি পড়ে গেছে ভোররাতে | বস্তির মেয়ে-বউরা সক্কাল সক্কাল উঠে পড়েছে | স্নান সেরে নতুন শাড়ি পরে সদলবলে হাজির হয়েছে পূজা প্রাঙ্গনে | আজকে ভারতী দেবী পূজোর জোগাড়ের কাজে হাত লাগান নি,বরং উনি যেভাবে বলেছেন সেইভাবে মেয়ে-বউরা মিলে পূজোর উপাচার সামগ্রী দিয়ে গোছগাছ করে ফেলেছে |
যথাসময়ে এসে পড়লেন পুরোহিত মশাই | আমের মুকুল,যবের শিষ,অভ্র,আবির, হলুদ গাঁদা দোয়াত,কলম,ফুল,শ্বেত চন্দন,পুস্তক ইত্যাদি অর্ঘ্য উপাচারে শুরু হয়ে গেল বাগেশ্বরীর আরাধনা | শাস্ত্রমতে পূজাপাঠের অনুষঙ্গে মুহুর্মুহ বেজে উঠছে শঙ্খ-কাঁসরের মিশ্রধ্বনি | বস্তির বাসিন্দারা নতুন পোশাক পরে উপস্থিত রয়েছে পূজো প্রাঙ্গনের অন্দরে | রয়েছেন পরেশবাবুসহ রিন্টু,রিম্পি | ধূপ ধুনো ফুল চন্দনের সুবাসে বিরাজ করছে স্বর্গের পবিত্রতা | উৎসবের আমেজে গা ভাসানোর খুশিতে উদ্বেলিত হয়ে উঠেছে সকলে |
একটুক্ষণ পরে ভারতীদেবীকে উদ্দেশ্য করে পুরোহিত মশাই বললেন,
--- এবার পুষ্পাঞ্জলি হবে,যারা যারা দেবেন এগিয়ে আসুন..
প্রত্যুত্তরে উনি বললেন,
--- এখানে উপস্থিত সবাই অঞ্জলি দেবে ঠাকুর মশাই,
--- ও,তা বেশ... তাহলে পুষ্পপাত্র থেকে সবাইকে ফুল দিয়ে দিন,তারপর আমার সাথে পুষ্পাঞ্জলির মন্ত্র মনে মনে বলবেন...
সমবেত কণ্ঠে উচ্চারিত হতে লাগলো,
"ওঁ জয় জয় দেবী চরাচর সারে,কুচযুগশোভিত মুক্তাহারে।
বীণারঞ্জিত পুস্তক হস্তে,ভগবতী ভারতী দেবী নমহস্তুতে॥
নমঃ ভদ্রকালৈ নমো নিতং সরস্বতৈ নমো নমঃ।
বেদ-বেদাঙ্গ-বেদান্ত-বিদ্যা-স্হানেভ্য এব চ॥
এস স-চন্দন পুষ্পবিল্ব পত্রাঞ্জলি সরস্বতৈ নমঃ॥"
দেবী সরস্বতীর ঐশ্বরিক প্রভা এবং প্রার্থিত বিদ্যে,বুদ্ধি,জ্ঞানের বন্দনায় হাতের মুঠোয় হলুদ গাঁদা,দোপাটি ফুলের লাল সাদা পাপড়ি,বেলপাতা কুচি নিয়ে মুদিত নয়নে অঞ্জলি দেওয়া বহু চেনা প্রায় মুখস্থ হয়ে যাওয়া মন্ত্রোচ্চারণ ভারতীদেবীকে শৈশব-কৈশোরের সুখস্মৃতির নস্ট্যালজিয়ার আবেশে ভরিয়ে দিলো |
তিনবার পুস্পাঞ্জলির মন্ত্র পাঠ করার পরে পুরোহিত মশাই বললেন,
এখন আমার মন্ত্রপাঠ শুনে শুনে আপনারা দুই হাত জোর করে নত মস্তকে সরস্বতীর প্রণাম মন্ত্র বলতে থাকুন,
" নমো সরস্বতী মহাভাগে বিদ্যে কমললোচনে |
বিশ্বরূপে বিশালক্ষ্মী বিদ্যাংদেহি নমহস্তুতে ||
ওঁ জয় জয় দেবী চরাচর সারে,কুচযুগশোভিত
মুক্তাহারে |
বীণারঞ্জিত পুস্তক হস্তে,ভগবতী ভারতী দেবী
নমহস্তুতে ||"
এরপর ঘন্টাধ্বনি সহযোগে পঞ্চপ্রদীপের আরতি,ঘি-বেলপাতা-বেলকাঠ দিয়ে হোম প্রভৃতি পূজা বিধি অনুযায়ী বাগ্দেবীর আরাধনা সম্পন্ন হলো |
পুরোহিত মশাই প্রস্থান করার কিয়ৎক্ষণ পরে ঠাকুরকে নিবেদন করা ফলপ্রসাদ সকলকে বিতরণ করে দিলেন ভারতীদেবী | তারপর মেয়ে-বউরা চলে গেল বাগানের পেছনদিকের প্যান্ডেলে | দুপুরের খাবার তৈরীর কাজে একজোট হয়ে লেগে পড়লো তারা |
এবছর রিন্টু রিম্পি স্কুলে যায় নি | আর যাবেই বা কেন! সরস্বতী পূজোর উৎসব যে তাদের বাড়ির বাগানে পালিত হচ্ছে... তাই উৎসবের আনন্দের আতিশয্যে একটা বছর স্কুলের ঠাকুর নাই বা দেখলো... ক্ষতি তো কিছু নেই! অঞ্জলি দিয়ে,প্রসাদ খেয়ে দুই ভাইবোনে মায়ের ছাত্রছাত্রীদের সাথে হৈ হুল্লোড়ে মেতে,হাসি মজার অনাবিল স্রোতে ভেসে মুখরিত করে তুললো পূজা প্রাঙ্গনের মিঠে রোদমাখা পরিবেশ |
রন্ধন বিষয়ে বস্তির মেয়েরা বেশ কর্মঠ | তাদের প্রভূত তৎপরতায় বেলা ১টার কিছু আগেই তৈরী হয়ে গেল মধ্যাহ্ন ভোজনের পদগুলি,যথা -- সবজি খিচুড়ি,বেগুনি,বাঁধাকপির তরকারি,টোম্যাটো খেঁজুর আমসত্বের চাটনি,পাঁপড় ও পায়েস | রান্নার দায়িত্ব শেষ ওদের | এখন ছেলে যুবকদের পালা, খাবার পরিবেশনের | পূজো সংক্রান্ত কাজকর্মের দায়িত্ব মহিলা পুরুষের মধ্যে ভাগ করে দেওয়ার মিটিঙে ভারতীদেবী পূর্বেই যেমনটি বলে দিয়েছিলেন |
নারী পুরুষ নির্বিশেষে পূজোয় অংশগ্রহণের উৎসাহ উদ্দীপনা দেখে ভীষণ খুশি হয়েছিলেন ভারতীদেবী | সারাদিনের ঘটমান দৃশ্যাবলীর সাথে নিজের কিশোরীবেলার সরস্বতী পূজোর দিনগুলোর সাদৃশ্য তাঁকে বারংবার নস্ট্যালজিক করে তুলছিল...
সেই ভোর থেকে পূজোর জোগাড়,এতোগুলো লোকের রান্না করার ঝক্কি সামলেও ক্লান্তির চিহ্নটুকুও ফুটে ওঠে নি কারো চোখে মুখে | বরং দ্বিগুন কর্মোৎসাহে রাতের মেনুতে থাকা ফুলকপির পকোড়া,কড়াইশুঁটির কচুরি,আলুরদম বানিয়ে ফেলেছিল মহিলাকুল,আর শেষপাতে 'ভারতীয়ালয়ে'র শিক্ষয়িত্রীর হাতে তৈরী রসালো বোঁদে | উচ্চ-নীচের শ্রেণীবিভাজন মুছে দু'বেলা সকলের সাথে বসে খাওয়া দাওয়া করার মধ্য দিয়ে পারস্পরিক সহাবস্থানের দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন |
ভারতীদেবীর অমায়িকতায় বস্তিবাসীর রোজকার একঘেঁয়ে জীবনে ঘটলো অনাকাঙ্খিত অথচ আনন্দজনক ছন্দপতন | উৎসবময় নির্মল খুশিতে ভরা একটি দিনের প্রাপ্তি ওদের মনে চিরটাকাল অমূল্য হয়ে থাকবে |
দুই পক্ষের সম্মিলিত সহযোগিতায় সর্বাঙ্গীন সুন্দর ভাবে বন্ধিত হলো উৎসবের মূল সুর --সম্প্রীতির বন্ধন |
সমাপ্ত
No comments:
Post a Comment