1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Wednesday, March 31, 2021

চাপ মুক্ত হওয়ার সহজ উপায়

 

ছবি  : ইন্টারনেট 
চাপ মুক্ত হওয়ার সহজ উপায়
দেবানন্দ মুখোপাধ্যায় 


এই তো কয়েকদিন আগেকার কথা, একটা কাজে উত্তরবঙ্গ গেছিলাম।ফিরছিলাম আসানশোলে।নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে রাত দশটায় ট্রেন, আসছে ডিব্রুগর থেকে, যাবে কন্যাকুমারী।কি যেন নাম ট্রেনটার? মনে পড়েছে,বিবেক এক্সপ্রেস। গেছিলামও ওটাতেই,তবে সেটা পরিকল্পিত ভাবে যাওয়া ছিলো।কিন্তু ফেরার দিনটা জানতে পারলাম  অনেক দেরী করে,তাই তাড়াহুড়োতে থ্রি টায়ার স্লিপার জুটলো,তাও আবার একদম ওপরের সীট!সুরক্ষার দিক থেকে ভালোই, কিন্তু ওঠা নামা করতেই ভীষণ অসুবিধে। বিশেষ করে আমার মত মধুমেহ রোগীর জন্য মোটেই ভালো জায়গা নয় ওটা।

তা ট্রেন যথারীতি সময়েই এলো,আমিও আমার শয্যা খুঁজে নিয়ে চাদর পেতে শোয়ার উদ্যোগ নিলাম।সারাদিন যা খাটাখাটুনি গেছে তাতে একবার বডি ফেলতে পারলেই হোলো,ঘুম আসতে দেরী হবেনা।

তা ঘুমানোর তোরজোড় করছি এমন সময় নজর পড়লো আমার কোনাকুনি একদম নিচের সীটটার দিকে।একজন মাঝবয়সী ভদ্রলোক শুয়ে আছেন,তা সে তো সবাই শুয়েই থাকে,এমন আর কি? তবে যেটা দৃষ্টি আকর্ষন করছিলো সেটা হোলো ভদ্রলোকের কোলে রাখা ব্যাগটা।সেটাকে এমনভাবে আঁকড়ে ধরে আছেন যেটা দেখে সবাই হাসছে।সবাই নিজের নিজের লাগেজ নিয়ে একটু টেনশনে থাকে,এটা তো দেখাই যায়,কিন্তু লোকটার আঁকড়ে ধরার কায়দাটাই সবার মুখে হাসি ফোটাচ্ছে।কি জানি বাবা কি সম্পত্তি আছে ওতে! আর তাছাড়া মাঝে মাঝে যা সন্দেহের চোখে চারিদিকে তাকাচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে কামরার সবাই এখনই ঝাঁপিয়ে পরবে ব্যাগটার ওপর।ব্যাগটা বড়োও নয়,কি আছে কে জানে? থাক যা আছে, আছে, আমার ভেবে কি লাভ? হয়তো খুব দামী কিছু আছে,কিংবা কোনো গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র, যাক্ আমি ফেলুদা,ব্যোমকেশ নই,সাতপাঁচ ভেবে ঘুম নষ্ট করে কি লাভ আমার?এই সব ভাবতে ভাবতে এক সময় সত্যিসত্যিই কখন ঘুমিয়ে পড়লাম বুঝতে পারলাম না।

#

ঘুম ভাঙলো একটা হৈ চৈ এ।কোন স্টেশন ঘুমের ঘোরে ঠিক বুঝতে পারলাম না,শুধু ঘুম চোখে দেখলাম কিছু লোক উঠলো কামরাটায়।পূর্ব অভিজ্ঞতায় জানি এই লাইনে রিজার্ভ কামরায় লোক ওঠা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার।উঠেই কেউ কেউ মেঝেতে চাদর পেতে শুয়ে পড়লো,কেউ বা নীচের লোয়ারবার্থের ঘুমন্ত লোকের পায়ের দিকে বসে পড়লো।কথায় বুঝলাম এদের মধ্যে কারুর কারুর ওয়েটিং লিস্টে নাম আছে,কারুর আর এ সি,তবে অধিকাংশই ম্যানেজ করে উঠেছে,যেটা এ লাইনের অলিখিত নিয়ম।আড়চোখে দেখলাম সেই লোকটার পায়ের কাছেও একজন বসে আছে।যাক্ বাবা, এই তিনতলার সুফল এবার পেলাম,নো ঝামেলা,নো ঝঞ্ঝাট।কিন্তু মুশকিল হোলো ঘুম একবার ভেঙে গেলে আর আসতে চায়না।অগত্যা এপাশ ওপাশ করা ছাড়া আর এখন কিছু করার নেই আবার ঘুম না আসা পর্যন্ত।অধিকাংশ লোকই ঘুমাচ্ছে,কিছু আমার মত লোক  ঘুম ভেঙে জেগে উঠেছে,বা ঘুমায়ইনি।ঘুম আসছেনা,অগত্যা নিচের লোকটির দিকে নজর গেলো, যার পায়ের ওপর একটা লোক বাবার ঢলে পড়ছে।লোকটি ব্যাগ আঁকড়ে একবার এপাশ ওপাশ করছেন,আর নীচে বসা লোকটি ঢুলে ঢুলে পায়ে পড়ছে-- ভদ্রলোকের আজকে দফারফা।মনে মনে একচোট খুব হেসে নিলাম,আর নীচের সীট না পাওয়ার জন্য রেলকোম্পানীকে মনে মনে ধন্যবাদ দিলাম।

#

চোখ জুড়ে আসছিলো,হঠাৎই নিচের কথোপকথনে কান গেলো,সেই আমার কোনাকুনি নীচের বার্থের ব্যাগ আঁকড়ে থাকা লোকটি আর তার পায়ে বারবার ঢলে পড়া মেঝেতে বসা লোকটির মধ্যে কথাবার্তা চলছে।ঘুম অল্প এলেও কৌতুহল মারাত্মক জিনিস,পরের ব্যাপারে নাক না গলানো আমিও একটু শোনার লোভ সামলাতে পারলাম না।বিশেষ করে ব্যাগ আঁকড়ানো ভদ্রলোকের কি হাল হচ্ছে সেটা শোনাটার জন্য মনটা বড়ই ছটফট করছে।

তা যা শুনলাম সেটা এরকম--

শোয়া ভদ্রলোক ঃ ও দাদা শুনছেন? আপনি এখানে বসে থাকলে আমার খুব অস্বস্তি হচ্ছে।উঠে যাবেন?

বসা ভদ্রলোক ঃ কি করবো দাদা ওয়েটিং টিকিট কনফার্ম হলোনা,আর আমাকে আসানশোল যেতেই হবে।আর তাছাড়া এই লাইনের এটাই তো দস্তুর।আর আমি চলে গেলেও অন্য কেউ আসবে।আশেপাশে দেখুন সবারই এক অবস্থা। আমি তো আপনার গায়ে বা সীটে বসিনি,শুধু মাথাটা আপনার পায়ে লেগে যাচ্ছে, তাও সবসময় নয়,মাঝে মাঝে।একটু সমঝোতা করে চলুন না।আপনি ঘুমান।

শোয়া ঃঃঃঘুম আসছে না,আসবেও না আপনি পায়ের কাছে বসে থাকলে।

বসা ঃঃঃআসবে আসবে, ঠিক আসবে।চেষ্টা করুন ঠিক ঘুম আসবে।

শোয়াঃনা দাদা আমি জানি ঘুম আসবে না।

বসাঃকেনো দাদা? আমি কি এমন করছি যে ঘুম হবে না আপনার? ওই দেখুন ওনারা কি সুন্দর ঘুমাচ্ছেন। পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নিন।

শোয়াঃনা,মানে কিছুদিন আগে আমাদের বাড়িতে চোর এসেছিলো, বিশেষ কিছু নিতে পারেনি অবশ্য,বিরাট একটা এ্যলশেসিয়ান আছেনা আমার বাড়িতে?  তবে চোরটাকে আমি দেখে ফেলেছিলাম শেষ মুহূর্তে। কি চাউনি তার।তা তারপর থেকেই চোরকে আমার বড্ড ভয়!

বসাঃতার মানে? আপনি কি আমাকে চোর বলতে চাইছেন?

জানেন আমি সরকারী চাকুরে? এতো বড় সাহস আপনার?আমাকে চোর বলছেন?

( আস্তে আস্তে গোলমালটা বাড়ছে,আর আমি এবং সদ্য ঘুমভাঙা কয়েকজন শুনছি, সময়টা কাটছে ভালোই।)

শোয়াঃহতেও তো পারেন।আপনাকে আমি চিনিও না,জানিও না।

বসাঃ আমার কিন্তু এবার প্রচন্ড রাগ হচ্ছে। জানেন আমি পুলিশের চাকরি করি?

শোয়াঃ কি করবো দাদা,আমি সহজ সরল লোক,ব্যাপারটা মন থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারছিনা যে!অনেক্ষন ধরে ভাবছিলাম বলা উচিত কি না,বলেই ফেললাম।ভাবনাটা কিছুতেই মাথা থেকে যাচ্ছেনা যে।

বসাঃ আপনি মশাই একটা যা তা লোক।অন্য কেউ হলে এতক্ষণে মেরে নাক ফাটিয়ে দিতাম,নেহাৎ আপনাকে কি রকম ভালো লোক মনে হচ্ছে  তাই ছেড়ে দিচ্ছি। আর আপনি আমাকে চোর ভাবছেন,সত্যি দাদা আপনার ক্ষুরে ক্ষুরে দন্ডবৎ।ঘুমান আমি তো আছিই জেগে।

শোয়াঃনা দাদা,ঘুম আসবেনা কিছুতেই। কিছু মনে করবেন না,আমি ঘুমালেই আপনি ব্যাগটা নিয়ে কেটে পরবেন,এই ভাবনাটা আমার মন থেকে যাচ্ছেনা কিছুতেই।( আমার ঘুমের তো দফারফা,তবে ব্যাপারটা খুব উপভোগ করছি।দুজনেই বেশ রসিক লোক বটে!)

বসাঃ তাজ্জব লোক মশাই।আমি পুলিশের চাকরি করি, ঘোরতর সংসারী,বৌ আছে,দুটো বাচ্চা আছে,ছোটটির শরীর খারাপ শুনে এই হঠাৎ যাওয়া।তবু আপনি বিশ্বাস করতে পারছেন না আমাকে?

শোয়াঃ সে তো আপনি বলছেন।আর তা ছাড়া চোরদের কি সংসার হয়না? আপনিই বলুন? অনেক চোর তো দেখেছেন নিশ্চয়ই। তা যাই বলুন আপনার কথা বিশ্বাস করলেও মনকে তো বিশ্বাস করাতে পারছিনা।অনেক রাস্তা দাদা,প্লিজ অনয় কোথাও গিয়ে বসুন।ঘুম আসছেনা।ঘুমানেটা বড় দরকার।

বসাঃযাবো না।কি করবেন করুন। 

শোয়াঃ ঠিক আছে,ঠিক আছে,আপনি ন্যায়ের রক্ষক,অবশ্য আপনার কথা যদি সত্যি হয়,আপনিই একটা উপায় বলে দিন।ঘুমটা আমার খুব দরকার।

বসাঃ একটা সমাধান আমার মাথায় অনেক্ক্ষণ ধরে এসেছে।

শোয়াঃ কি? কি? প্লিজ বলে ফেলুন।

বসাঃ এক কাজ করুন,আমি আপনার জায়গায় শুয়ে পড়ছি,আপনি আমার জায়গায় বসে যান।চাইলে ব্যাগটাও দিতে পারেন আমাকে।আপনি বসে বসে ঘুমান,আমার পায়ের ওপর যত খুশী পড়ুন,গায়েও পড়ে যেতে পারেন,আমার কোনো অসুবিধা হবেনা।বা না ঘুমিয়ে দেখতেও পারেন আমি ঘুমালাম কিনা।যাই হোক আমি একবার শুয়ে পরলে আপনাকে গ্যারান্টি দিচ্ছি আপনার বয়াগ নিয়ে আমি পালাবো না।

শোয়াঃ যাঃ তা কি হয়? আমি বরং জেগে জেগেই শুয়ে থাকবো।বসুন যত ইচ্ছে।এই আমি পাশ ফিরলাম।

বসাঃ তবে? এই তো পথে এলেন।ঘুমাবার চেষ্টা করুন।

চারিদিক এখন নিস্তব্ধ, শুধু ট্রেনের আওয়াজ ছাড়া।

আস্তে আস্তে আমার চোখের দু' পাতা জড়িয়ে এলো।

iamdebananda@gmail.com
বাঁকুড়া

No comments:

Post a Comment