1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Wednesday, March 31, 2021

প্রতিশোধস্পৃহা

 

ছবি  : ইন্টারনেট 
প্রতিশোধস্পৃহা
কৃশানু কুন্ডু


           আজ সংযুক্তার মনটা খুব খুশি। এতদিনে তার অনেকদিনের ইচ্ছে পূরণ হয়েছে। আজ সকালে অমিত আর তার পছন্দ করা জিনিসগুলো বাড়িতে এসে গেছে। দেরি করেনি সে। অমিতকে আর শনিবার সকালে পাওয়া যাবে না। সে থাকবে পাড়ার ক্লাবে,ছোটবেলার অভ্যেস। বাড়ি ফিরতে ফিরতে সেই একটা। অতক্ষণ তর সইবে না সংযুক্তার। তাই বাড়ির সবসময়য়ের কাজের মেয়ে বেনিকে নিয়ে একাই জিনিসগুলো সাজিয়ে ফেলেছে সে।জিনিস বলতে কিছু ফুলদানি, শো পিস, আয়না, দুভে, পুরোনো সাইড টেবিল। সবই তাদের খাট, আলমারি, শ্বেত পাথড়ের টেবিল, ভারি চেয়ার, এ সবের সাথে মানানসই। আসলে অমিতের সাথে বিয়ে হওয়ার পর, ওকে অমিত বলেছিল সে ইচ্ছে করলে রাজারহাটের ফ্ল্যাটে থাকতে পারে, আবার ইচ্ছে হলে সবার সাথে এই পৈতৃক বাড়িতে, অমিতের মা, দাদা, বৌদি, তাদের মেয়ে, এদের সবাইকে নিয়ে তাদের বৃহৎ একান্নবর্তি পরিবারে যোগ দিতে পারে। বাড়ির সবাই তাদের খুশিতে আগ্রহী, কেউ কিছু মনে করবে না। কিন্তু সংযুক্তার মন ঠিক করতে এক মুহূর্তও লাগেনি। তার মত ছোটবেলায় বাপ, মা মরা মেয়ের তো এরকমই চাই। সেও মামাবাড়িতে বড়ো হয়েছে, সেটাও বড়ো পরিবার। ফ্ল্যাটে একা কি করে থাকতে হয় সে তো জানেই না। তাছাড়া অমিতকে এখান থেকে ছিঁড়ে নিয়ে যাওয়ার কোন মানেই হয় না। ফ্ল্যাটটা তো দূরদর্শী অমিতের ইনভেস্টমেন্ট হিসাবে করা।এ বাড়ির সবাইও ভীষণ ভাল। বাড়ি পুরোন হলে কিহবে, বাড়ির সবাই উচ্চশিক্ষিত ও মোটামুটি আধুনিক। এ বাড়িতে, বাড়ির ঐতিহ্য অনুযায়ি নিয়ম আছে কিন্তু গোঁড়ামি নেই। এই বাড়িও বেশ ছড়ান, ছেটানো, অনেকটা জায়গা জুড়ে। আসলে যখন তৈরী হয়েছিল তখন বাড়িতে অনেক ভাই, বোন, জ্ঞাতি, সবার জন্য তৈরী করা হয়েছিল। এখন মূল পরিবার ছাড়া বাকিরা এক এক করে নিজেদের পথে চলে গেছে, কিছু এদেশে, বেশিরভাগই বিদেশে। তাই ছোটছেলের বিয়ের পর তিনতলার একটা সম্পূর্ণ অংশ এখন তাদের, নিজের মত সাজিয়ে নিতে কোন অসুবিধে নেই। সংযুক্তার কাছে এ হাতে চাঁদ পাওয়ার মত। সে সাজাতে ভালোবাসে। কলেজে থাকতে সখের বশে ইন্টেরিয়র ডিসাইনিঙের কোর্সও করেছিল। তাই এই সুযোগ তার কাছে অতুলনীয়। সেই মত নকল এন্টিক না খুঁজে অমিত আর ও পৌঁছে গিয়েছিল পার্ক স্ট্রিটের কিউরিওর দোকান গুলোয়। সেখান থেকেই কিছু আসবাবপত্র আর শো পীস পছন্দ করেছিল। সেগুলোই আজ পৌঁছে গেছে বাড়িতে।অমিতকে কখন দেখাবে এই ভাবতে ভাবতে স্নান করতে গেল সংযুক্তা। নিজের মনে গুন্ গুন্ করে গান করতে করতে সে ভাবছিল অমিতকে দেখানোর পর বৌদিকে ডেকে দেখাবে। বৌদির যা স্বভাব চেঁচামেচি করে, বাড়ির সবাইকে ডেকে নিজেই দেখাবে। তার রুচিবোধের সাথে প্রথম পরিচয় হবে বাড়ির সবার।

স্নান সেরে বেরিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখছিল সে। আজ দিনটা মেঘলা তাই ঘরটা আধো অন্ধকার। জানলার রঙিন কাঁচের মধ্যে দিয়ে আসা আবছা আলো বিছান চাদরের মত আলুথালু পরে রয়েছে ঘরময়। কাপড় পড়ার আগে পাখার হাওয়ায় গা শুকান সংযুক্তার অভ্যেস। ঘরের মাঝখানে নিজের চিন্তায় বিভোর হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল সে। সামনে খাটের উপর তার পরিধেয় অন্তর্বাস ও জামাকাপড়। হঠাৎ মনে হল কেউ যেন তাকিয়ে আছে তার নগ্ন পিঠের দিকে। তার কঠিন দৃষ্টি নিবদ্ধ সংযুক্তার উপরেই। চমকে পিছন ফিরে কাউকে দেখা গেল না। কেউ থাকবে কি করে ? ঘরের দরজা বন্ধ করে স্নান করতে গিয়েছিল সে। তার মুখ এখন দরজার দিকে, দরজা বন্ধ, পিছনে একটু দূরে দেওয়াল, কোন আলমারি নেই ওদিকে, জানলাও নেই। মনের ভুল ভেবে নিচু হয়ে খাটে রাখা জামাকাপড়ের দিকে হাত বাড়াল সে আর বাড়িয়েই চিৎকার করে বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মত সোজা হয়ে দাঁড়াল। সে স্পষ্ট অনুভব করল তার পিঠের উপর দুটো হিমশীতল হাতের ছোঁয়া আর ঘাড়ের কাছে একটা ঠান্ডা নিঃশাস। তার খুব কাছে যেন আর একটা শরীর তার নগ্নতার সুযোগ নিতে চাইছে। ধীরে ধীরে তাকে বন্দি করছে এক শীতল, কঠিন আলিঙ্গনে। এক মুহূর্ত না দাঁড়িয়ে জামাকাপড় হাতে করে দরজা খুলে ছিটকে বেরিয়ে এলো সে। বাইরের বারান্দায় কেউ নেই, কোনরকমে গায়ে কাপড় দিয়ে ছুটে নিচে নেমে গেল সে আর সিঁড়ির গোড়ায় সজোরে ধাক্কা খেল অমিতের সাথে। অমিত ধাক্কা সামলে বলল, "কি হয়েছে ? এরকম অবস্থা কেন তোমার?" কি বলবে ঠিক বুঝে উঠতে না পেরে সংযুক্তা অমিতকেই বলল, "একটা বেজে গেছে, এতো দেরি করো কেন তুমি? খেতে বসে গেছে নিশ্চই সবাই।" "সরি ম্যাডাম, এখুনি স্নান সেরে আসছি," বলে অমিত উপরে চলে গেল। তার এই অদ্ভূত অভিজ্ঞতার কথা অমিতকে বলতে পারল না সে। নতুন শ্বশুরবাড়িতে পাগল প্রতিপন্ন হওয়ার কোন ইচ্ছে সংযুক্তার নেই।

      খাবার টেবিলে সে কথা ভাবতে ভাবতে জলের গেলাস প্রায় উল্টে ফেলছিল। তার শ্বাশুড়ী মা হালকা তিরস্কারের গলায় বললেন, "কিরে , তোর হয়েছে কি? ভূত দেখেছিস নাকি?" "না, কিছুনা," বলে কোনরকমে কাটিয়ে গেল সে। খাবার টেবিল থেকে উঠতেই বৌদি হাত ধরে টেনে বললেন, "দুপুরে , একলা ঘরে অমিতকে পেয়ে কি করবি তার এতো চিন্তা?" বলে চোখ টিপে এগিয়ে গেলেন তিনি। সংযুক্তা কিছুই বলে উঠতে পারল না।অমিতকে নিয়ে সবাইকে নতুন জিনিসগুলো দেখিয়ে বাকি দিনটা কেটে গেল সংযুক্তার। বাড়ির সবারই খুব পছন্দ হয়েছে। তার দাদা, বৌদি তো সংযুক্তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ, শ্বাশুড়িমাও যখন খুঁটিয়ে দেখে গম্ভীরভাবে ভাল হয়েছে বলে চলে গেলেন তখন যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল সংযুকতা। দরজার কাছে দাঁড়ানো অমিতের মুখেও তখন একটা গর্বিত, মুচকি হাঁসি। রাতে শুতে এসে অমিত যখন তাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরল নিজের অজান্তেই শরীর আড়ষ্ঠ হয়ে উঠল সংযুক্তার। পিছনে ঘনিষ্ঠ হয়ে আসা অমিতের হঠাৎ পিছিয়ে যাওয়াতে সম্বিৎ ফিরলো তার।

অমিত জিজ্ঞাসা করল, "তোমার পিঠে এ কিসের দাগ?" "দাগ? কোথায়?" চমকে বলল সংযুক্তা। অমিত তাকে টেনে আয়নার সামনে এনে দেখাল। ঠিক যেন নখের আঁচড়, ঘাড়ের ঠিক নিচে ডান দিকে আর কোমড়ের ঠিক উপরে বাঁ দিকে। অমিত অবাক হয়ে বলল, "ঠিক যেন হাতের ছাপ।" তারপর হেঁসে বলল, "আমি বাড়িতে না থাকলে এসব কি হচ্ছে ম্যাডাম?" তারপর নিজেই বলল, "ওই পুরোন বাক্স প্যাটরা টানাটানি করতে গিয়ে নিশ্চই কোথাও ঘষা লাগিয়েছ।" সংযুক্তা টের পেল পিঠের উপর দিকে একটা জ্বালা জ্বালা ভাব আছে ঠিকই। এখনও মুখ খুলে কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারল না। কি করে বলে একথা যে তার মনে হয়েছিল কোন অশরীরী তার শরীরে হাত দিয়েছিল আজ। অমিত যদি ভাবে এ তার বিকৃত মানসিকতার পরিচয়। অমিতকে সে চেনে, সে এরকম নয়, কিন্তু অনেক কষ্টে অমিতের মত মানুষ আর এত সুন্দর একটি পরিবার পেয়েছে সে, একটা মনের ভুলের জন্য ঝুঁকি নিতে পারবে না সে। সারা রাত বৃষ্টির আওয়াজ শুনে আর আধো ঘুমে কেটে গেল সংযুক্তার। মাঝে মাঝে মনে হোল বিছানার কাছে কেউ দাঁড়িয়ে তাদের দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে কিন্তু জোর করে চোখ বুজে শুয়ে থাকল সে। দেখবে না, দেখতে চায় না সে। কিছু নেই, তার কেন এসব মনে হচ্ছে ?

পরের দিন অমিত ঘরে থাকতে থাকতেই স্নান সেরে তৈরি হয়ে নিল। অমিতকে বলল আজ সে ওর বান্ধবি, অনসুয়ার বাড়ি যাবে, বিয়ের পর থেকে আর দেখা হয়নি। অনসুয়া, সংযুক্তার স্কুলের বন্ধু, বিয়ে হয়ে এসেছে কলকাতায়, ওকে সকালেই ফোন করেছিল সংযুক্তা। চিন্তাগুলো মাথা থেকে বার করতে হবে, মনটা অন্যদিকে ঘোরানো দরকার। সারাদিন গল্প করে, দুপুরে সিনেমা দেখে, কিছু কেনাকাটি করে মনটা ভাল হয়ে গেল। বিকেলে যখন অমিতের সাথে বাড়ি ফিরল, তখন মনে হচ্ছিল গতকালের সবকিছু তার মনের ভুলই হবে। হয়তো কোন সিনেমায় এরকম কিছুই দেখেছিল, মনের মনিকোঠায় গেঁথে ছিল সেটা, একলা ঘরে, আলো আঁধারিতে বেরিয়ে এসেছে। পরের দিন অমিতের অফিস। তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়ল দুজনে। রবিবার রাতটা অমিত নিজের মনে থাকে। আগত সপ্তাহের নানা কাজের নিদারুন চাপ সাঁড়াশির মত চেপে ধরে তাকে। এসময় সংযুক্তা বিশেষ ঘাটায় না অমিতকে। টেবিল ল্যাম্পের আলোয় একটা বই পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়েছিল সংযুক্তা।

একি? সে স্নান করছে? এ কোন জায়গা? এ কোন বাড়ি? এ কুঁয়োতলায় সে কি করে এলো? বালতি দিয়ে জল তুলছে সে, এবার মাথায় ঢালবে, সন্ধে হয়ে এসেছে। একি? কে দাঁড়িয়ে আছে ওখানে? তাকে ভেজা কাপড়ে দেখে এভাবে তাকিয়ে আছে কেন? অন্ধকারে লোকটাকে চেনা যাচ্ছে না। সে লোকটার দিকে তাকাতেই লোকটা তার দিকে হাত তুলে চিৎকার করে উঠল। কি প্রচন্ড সে আওয়াজ, কানের পর্দা ফেঁটে যাবে মনে হচ্ছে, অতি তীব্র, ট্রেনের হুইসেলের মত, কান দিয়ে রক্ত বেরিয়ে আসছে তার, হাতের উপর রক্ত লেগে গেছে যে, চিৎকারের শব্দে ধড়মড় করে উঠে বসল সংযুক্তা। না, সে চিৎকার করেনি। চিৎকার করেছে অমিত। সে করেই চলেছে চিৎকার, সোজা সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে। অমিতের বুকে ঝাঁপিয়ে পরে, অমিতকে ঝাঁকিয়ে তুলল সংযুক্তা।

তাদের অংশটা তিন তলায় ও বেশ খানিকটা জায়গা নিয়ে, নয়তো সবার ঘুম ভেঙে যাওয়ার কথা। অমিত উঠে , তাকে বলল, "আমি তাকাতে পারছি না, উপরে ওটা কি ? ওটা কে?" "কোথায় কে ?" “ওই লোকটা," বলে উঠল অমিত। “আমার ঘুমটা ভেঙে গিয়েছিল ছাদের দিক থেকে আসা আওয়াজে, ঠিক যেন সিলিং এ কেউ হেঁটে চলে বাড়াচ্ছে, ছাদে না, সিলিং এ। চোখ খুলতেই দেখলাম একটা লোক, সিলিংয়ের সাথে যেন আটকে রয়েছে, চোখগুলো উল্টে যাওয়া, সাদা, সোজা তাকিয়ে আছে আমার দিকে, কপালে ভ্রূকুটি, যেন রাগে বেঁকে গেছে মুখের অবয়ব আর ঠোঁটের কোনা থেকে টপ টপ করে গড়িয়ে পড়ছে লালা, ঠিক আমার কপালের উপরে।" একটু থেমে অমিত নিজেই বলল, "বাবা রে, কি দুঃস্বপ্ন। তোমাকে আজ একটু জ্বালাব বুঝলে, ঘুমোতে পারবো না আর। চলো, দুজনে গিয়ে কফি বানাই।" বলে এক রকম টেনেই নিয়ে গেল সংযুক্তাকে। সংযুক্তার মনে হলো, এঘরে থাকতে চাইছে না অমিত, তাকেও ছেড়ে সে যাবেনা। তাই এই কফির আয়োজন। কফি বানিয়ে দুজনে কফি নিয়ে ব্যালকনিতে বসল। পাঁচটা প্রায় বাজে, আলো ফুটে যাবে কিছুক্ষণের মধ্যে। অমিত কোন কথা না বলে দূরে কোথাও তাকিয়ে ছিল। হঠাৎ নিজেই বলে উঠল, "এরকম কেন দেখলাম বলো তো?" তারপর নিজেই বলল, "দুঃস্বপ্ন, কোন কারণের তো দরকার নেই। স্বপ্নের কি কারণ থাকে? এ নিয়ে তো নানা রিসার্চ চলছে। না, এ নিয়ে আর ভাববো না।" সংযুক্তা বলল, "তোমার সত্যি মনে হয় তুমি যা দেখলে তার পিছনে কোন কারণ নেই। শুধু শুধুই এরকম একটা ভয়ঙ্কর দৃশ্য তোমার স্বপ্নে এলো?" “কি বলছ সংযুক্তা, আর কি হবে?" সংযুক্তা কোন উত্তর দিল না। একটু চুপ করে থেকে সে বলল, "আমি যদি তোমায় কিছু বলি তা বিশ্বাস করবে? যদি বলি পরশু আমার সাথে ভর দুপুরে এক অদ্ভূত অভিজ্ঞতা হয়েছে, আমাকে পাগল ভাববে কি? যদি বলি আমি খুব ভয় পেয়ে গেছি, তাই তুমি বাড়িতে না থাকলে এ ঘরে থাকতে আমি রাজি নই, তাই কাল অনসূয়ার বাড়ি গিয়েছিলাম, তাহলে তুমি কি বলবে ?" "কি হয়েছে সনজু?" এবার নরম স্বরে বলতে বাধ্য হল অমিত। "কি হয়েছে ?" নিজের আওয়াজ উচ্চ তারে পৌঁছেছে জেনেও সংযুক্তা থামল না। বলে যেতে লাগল সেদিন দুপুরের ঘটনা। শুনে কিছুক্ষন চুপ করে বসে রইল অমিত। তারপর আস্তে আস্তে বলল, "তোমাকে অবিশ্বাস করার কোন প্রশ্নই ওঠে না সনজু। তবে কি, আমরা না হয় আজকের দিনটা দেখি। যদি আর কিছু না হয় তাহলে ভাল, যদি হয় তখন অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নিতে হবে। আমাদের দুজনের একসাথে মাথার ব্যামো হয়েছে, এ আমার বিশ্বাস হয় না। তবে যদি ডাক্তার দেখাতে হয়, সেটাও একসাথেই করব আর যদি অন্যকিছু হয়, সে ব্যবস্থাও দেখতে হবে। তুমি হয়ত জানো না, কলেজে পড়ার সময় আমি ড্রিম, স্লীপ এপনিয়া, এ সব নিয়ে পড়েছি । তাছাড়া এরকম অভিজ্ঞতার অন্য দিক, যা বিজ্ঞান মানতে চাই না, ডিমনিক পসেশন, ডিবুক, ঘুল, জীন, ভ্যাম্পেরিক বিহেভিয়ার, নানারকম অকাল্ট ও প্যারানরমালের দিকে খুব আকৃষ্ট হয়ে পড়েছিলাম একসময়। নেহাত মন্দ লাগে না পড়তে, তবে বিশ্বাস আমি করি না। সব কিছুর পিছনেই কারণ আছে, সেই কারণটাই খুঁজে বার করতে হবে। আমরা একসাথেই করব, শোন আজ আমি অফিস যাবো না, দেখি কি হয় আজ।"

সারা দিন একসাথে কাটাল ওরা দুজন। বাড়িতে সবাইকে বলা হল অমিতের রাতে জ্বর এসেছিল। এখন নেই তবে আজ ও সারাদিন বিশ্রাম নেবে। সকালে সে বিছানাতেই খেলো, মাঝখানে মা এসে দেখে গেলেন অমিতকে। দাদা সকাল সকাল ব্যবসার কাজে বেরিয়ে গেছিলেন। একে একে বৌদি, দুপুরবেলা স্কুল থেকে ফিরে দাদার মেয়ে রুকু, সবাই দেখা করে গেল অমিতের সাথে। কোন বিঘ্ন ছাড়াই কেটে গেল দিন, আর সন্ধেবেলার মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে এলো। দুজনেরই মনে হল হয়ত ওরা অকারণেই ভয় পেয়েছিল। রাতে দুজনে শুয়ে পড়েছিল তাড়াতাড়ি। সকালে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বেরোবে অমিত, সোমবারের সব কাজ পড়ে আছে।

একটা টানা হেচঁড়ার আওয়াজে সংযুক্তার ঘুম যখন ভাঙলো, পাশের ঘড়িতে তখন প্রায় আড়াইটে। আওয়াজটা আসছে বাথরুম থেকে আর প্রচন্ড ভয়ে কাঠ হয়ে যেতে যেতে সংযুক্তা লক্ষ্য করল যে তার পাশে অমিত নেই। কয়েক মুহূর্ত পাথর হয়ে থাকার পর, ছুটে বাথরুমে গেল সংযুক্তা। আওয়াজটা থামে নি আর তার সাথে যোগ হয়েছে একটা গোঁ গোঁ আওয়াজ। অমিত বাথরুমের দরজা বন্ধ করে না তাই ছুটে গিয়ে দরজা ঠেলতেই তা খুলে গেল আর যা দেখল তাতে এক জায়গায় পা আটকে গেল সংযুক্তার। অমিতকে যেন দেওয়ালে ঠেসে ধরেছে কেউ, গলায় দুহাত দিয়ে কারও অদৃশ্য হাত ছাড়াতে চেষ্টা করছে সে, কিন্তু তার গলার উপর চেপে বসছে আঙুলের নীল দাগ। দিগ্বিদিগ জ্ঞানশূন্য সংযুক্তা সামনে থাকা খালি বালতিটা তুলে ছুঁড়ে মারল সেই দিকে যেখানে কারও থাকার কথা কিন্তু নেই। বালতিটা সজোরে গিয়ে লাগল অমিতের কাঁধে আর তখনি সংযুক্তাকে ধাক্কা মেরে ফেলে কিছু একটা বেরিয়ে গেল দরজা দিয়ে, ধড়াম করে বন্ধ হয়ে গেল দরজাটা।মাথা মেঝেতে ঠুকে যাওয়ায় একটু ঘোর লেগে গিয়েছিল সংযুক্তার। উঠে বসে দেখল কপালের পাশে কেটে গেছে, হাতে লাগছে ভেজা ভেজা কিছু, বোধহয় রক্ত। হঠাৎ খেয়াল হল, আলোটা নিভে গেছে। উঠে, চেনা জায়গায় হাতে সুইচ পেলেও, আলো জ্বলল না। একটা প্রচন্ড অস্বস্তি হতে লাগল সংযুক্তার, আবার সেই অজানা অস্তিত্ব টের পেল সে, তার গলার কাছে, বুকের উপর, কোমড়ে, কিছু যেন জড়িয়ে যাচ্ছে, অনেকগুলো মানুষের হাতের মত। চিৎকার করে অমিতকে ডাকল সে কিন্তু কোন সাড়া পেল না। অমিত তো বাথরুমের ভিতরেই ছিল, তবেকি অজ্ঞান হয়ে গেছে? আলোর আশা একমাত্র বাইরে তাই টেনে দরজা খুলে ফেলল সংযুক্তা। কিন্তু একি ? বাইরে একটা রাস্তা, ছোট ছোট টিনের ঘর দুপাশে, দাউ দাউ করে জ্বলছে, আর তার দিকে তাকিয়ে আছে একদল লোক। তাদের সারা গায়ে রক্ত মাখা, আর তাদের হাতে ছট ফট করছে একটা বছর পনেরোর মেয়ে। মেয়েটা প্রায় সম্পূর্ণ উলঙ্গ, ফালাফালা করে ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে তার গায়ের কাপড়, কপাল দিয়ে ঝরছে রক্ত, গড়িয়ে পড়ছে বুকের উপর দিয়ে আর লাল করে দিচ্ছে উরু থেকে পা পর্যন্ত। কোনো ধারাল অস্ত্র বুলিয়ে দেয়া হল মেয়েটার গলার কাছে আর ফাঁক হয়ে গেল গলাটা, মসৃন চামড়া ছিঁড়ে যাওয়ায় গুটিয়ে গেল আর ফিনকি দিয়ে ছুটল রক্ত। হাঁটু অবশ হয়ে গেল সংযুক্তার, মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল সে।

অমিতের ঝাঁকানিতে যখন জ্ঞান হল তখন মাথা ছিঁড়ে যাচ্ছে ব্যাথায়। ভোরের আলো দেখা যাচ্ছে জানলা দিয়ে আর অমিতকে দেখে মনে হচ্ছে সারা রাত একটা ঝড় বয়ে গেছে তার উপর দিয়ে। ভোর রাতে বাথরুমে আওয়াজ পেয়ে সে উঠে বসে। পাশে সংযুক্তাকে না দেখে বাথরুমে দেখতে ওঠে সে কিন্তু কিছু একটা ঝাঁপিয়ে পড়ে তার উপর। বুকের উপর চেপে বসে তার গলা টিপতে থাকে কোন অশরীরী। আস্তে আস্তে ফুটে ওঠে একটি অবয়ব। সেই একই রূপ, চোখ উল্টোন, হালকা দাড়ি, মুখের শিরাগুলো বেরিয়ে এসেছে, মুখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে লালা, খালি গা আর পাজামা। প্রায় যখন জ্ঞান চলে যেতে বসেছে তখন দরজা দিয়ে ছিটকে বেরোয় সংযুক্তা আর তখনই মিলিয়ে যায় সে। নিজেকে সামলে কোনরকমে সংযুক্তার কাছে যখন অমিত যায়, সংযুক্তা তখন যেন অন্য কোন জগতে। তার পরেই মেঝেতে লুটিয়ে পরে সে। ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে যখন সংযুক্তা সম্বিৎ ফিরে পায়, ততক্ষণে অমিত নিজেকে অনেকটা সামলে নিয়েছে। অমিত কম কথার মানুষ। সংযুক্তাকে বিছানায় শুইয়ে বলল, "আমাদের জানার বাইরেও একটা জগৎ আছে, সেই জগৎ সম্বন্ধে আমরা বিশেষ কিছু জানিনা। আমাদের উপর কোনভাবে নজর পড়েছে তাদের কারোর। কিছু একটা করতে হবে। দাঁড়াও, আমি একটা ফোন করি।" অমিত নিজের ফোন নিয়ে একটা নম্বর ডায়াল করল। ফোনটার উত্তর আসায় সংযুক্তার দিকে পিছন ঘুরে কথা বলল সে। কিছুক্ষন পরে ফোনটা রেখে বলল, "বাড়িতে একটা সত্যনারায়ণ পুজো করতে হবে, আজই, সন্ধ্যায়। আমি বাড়ির সবার সাথে কথা বলব। সমস্ত ব্যবস্থা অমিত করে ফেলল। সংযুক্তাকে নিয়ে বেরোল একটু পরে। গাড়িতে যেতে যেতে জিজ্ঞাসা করল, "বাড়িতে নতুন জিনিস যা যা এসেছিল, তা মধ্যে কি বাক্স জাতিও কিছু ছিল?" সংযুক্তা বলল, "কেন বলতো?" তারপর নিজেই বলল, "আমার খুব পছন্দের জিনিস, তোমার মনে থাকা উচিত, সেই সুন্দর কাজ করা বাক্সটা, উপরে উর্দুতে কিছু লেখা। জানো, খুলে দেখলাম ওটাতে রয়েছে কিছু চুল, একটা স্পিরিটের মতো গন্ধওয়ালা শিশি, একটা হলদে হয়ে যাওয়া চটি বই আর কিছু কালো পালক। শিশিটা খুলে উৎকট গন্ধ বলে শিশি আটকে, বাক্স বন্ধ করে রেখে দিয়েছিলাম। ভাবলাম একসময় ওটা ধুয়ে গয়নার বাক্স বানাব, ড্রেসিং টেবিলের উপরে রাখব, ওটার কি দরকার?" অমিত বলল, "শোন, আমি কাকে ফোন করেছিলাম জানো ? অর্কদাকে। অর্কদা কলেজে আমার সিনিয়ার ছিল। হোস্টেলে থাকতেই লক্ষ্য করেছিলাম প্যারানরমাল নিয়ে ওর প্রচুর পড়াশোনা। পরে জানতে পারি অর্ক ভট্টাচার্য এক সাধক পরিবারের ছেলে, ওর বাবা, দাদু , সবাই বিখ্যাত সাধক ছিলেন। তাছাড়া ব্যাঙ্গালোরে নিজের স্টার্ট আপ চালানোর সাথে সাথে প্যারাসাইকোলজি নিয়ে ডক্টরেট করেছে। অকাল্ট লেজেন্ডস নিয়ে বই লিখছে এখন। অর্কদা বলল এই ঘটনাগুলো এ বাড়ির সাথে জড়ান হওয়া কঠিন, কারণ এই প্রায় একশ বছরের পুরোন বাড়িতে আগে কখনও এ ঘটনা ঘটেনি। তাহলে এ বাড়িতে নতুন আসা তুমি এর কারণ হতে পারো। কিন্তু যদি তুমি কারণ হবে তাহলে গত দুমাসে কিছু হয়নি কেন ? তারপরে ও আমায় জানায় যে অনেকসময় কোন জিনিসের সাথে জড়িয়ে থাকতে পারে কোন অশুভ শক্তি যে শুধু মুক্তি পেতে চায়, সে বিরক্ত করে, ভয় দেখায়, কিন্তু বিরাট কোন ক্ষতি করে না। অনেকে তো এরকম ঘটনার সাথে অভ্যস্ত হয়ে যায়। আবার এরকম জিনিস, আসবাবের সাথে জড়িয়ে থাকতে পারে কোন গল্প যা শুনে অনেকে এরকম ইলুশন দেখে, যা পুরো সিনেমার মত হয়,যার সাথে হয় তার মনে হয় সম্পূর্ণ সত্যি। কিন্তু আমরা দুজনেই একসাথে নানারকম ঘটনা দেখেছি, কোন গল্পও কেউ আমাদের বলেনি। কিন্তু সব চেয়ে ভয়ের হচ্ছে যদি কোন মন্ত্রবলে আটকে রাখা আত্মাকে আমরা না বুঝে মুক্তি দিয়ে থাকি। তাহলে সে ভয় দেখাবে, আর খুঁজবে একটা খালি শরীর যা সে ধারণ করতে পারে। যতক্ষণ না সে এটা পারছে , তার শক্তি পুরো মাত্রা পায়না। আমাদের দুজনের উপরেই সেটা সে করতে পারেনি, এটা ভাল কথা। সেই আত্মাকে নিশ্চই ওই বাক্সে বন্দি রাখা ছিল, এবার আমাদের খুঁজতে হবে এই বাক্স এলো কোথা থেকে। ভেবেছিলাম ওই এন্টিকের দোকানে গিয়ে যা যা কিনেছি, সব নিয়েই জিজ্ঞাসা করতে হবে, এখন দেখছি বাক্সটা নিয়ে জিজ্ঞাসা করলেই হবে। অর্কদা কৌটো বা বাক্সের কথাই বলেছিল।"

এগারোটা নাগাদ দোকানে পৌঁছে দোকানের ম্যানেজারকে পেয়ে গেল। কিছু দামি মূর্তি কিনবে বলে তাকে আগেই দোকানে থাকতে বলেছিল অমিত। তাদের পর পরই দোকানে ঢুকল আরেকজন ভদ্রলোক, লম্বা, দোহারা চেহারা, প্যান্টের উপর দিয়ে পরা চেক জামা। অমিত সোজা ম্যানেজারের কাছে জানতে চাইল তার আগের কেনা জিনিস গুলো কোথা থেকে কেনা হয়েছে ? ম্যানেজার নানা রকম ভনিতা করার চেষ্টা করছিল, এই নিলাম, মুর্শিদাবাদ এই সব বলে। কিন্তু এবার ওই ভদ্রলোক এগিয়ে এসে শুধু বললেন,"বলুন ঠিক করে নইলে কিন্তু অসুবিধায় পরবেন। " বলে শুধু নিজের পকেট থেকে একটা কার্ড বার করে দেখালেন। ম্যানেজার আর ভনিতা না করে জানালেন এগুলো বাংলাদেশের কুমিল্লার এক জমিদার বাড়ির নিলাম থেকে আনা । তাদের লোক বাংলাদেশ কিনে চোরাপথে এদেশ পাঠায় যাতে ট্যাক্স দিতে না হয়। ম্যানেজার ভয়ে বাড়ির নামও বলে দিলেন। দোকান থেকে বেরিয়ে সংযুক্তা লক্ষ্য করল অমিতের কপালে চিন্তার ভ্রূকুটি। জিজ্ঞাসা করায় ওই ভদ্রলোকের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল, "অনেক ধন্যবাদ ভাই, তোকে এখানে ডাকার যে কারণ ছিল তা তো বুঝতেই পারছিস। সংযুক্তা, আলাপ করিয়ে দি, অনিকেত, আমার স্কুলের বন্ধু, এখন লালবাজার স্পেশাল ক্রাইমস ইউনিট।" সংযুক্তা বলল, "ও, তাই আমি ভাবি, এতো সহজে ম্যানেজার সব বলল কিকরে?" অনিকেত বলল, "তবে কি জানিস, এদের আমি জানি, এই দোকানের মালিক মীরচান্দানি খুব কানেকটেড, কিছু করা যাবে না। তবে আর কোন ঝামেলা হলে বলিস, লোকাল থানায় আমি বলে দেব। বৌদি পরে এসে একদিন চা খাবো, আলাপটা তখন ঠিক করে হবে, আজ আসি ভাই, একটু ব্যস্ত আছি।" দোকান থেকে বাড়ির দিকে ফিরে চলল ওরা।

বাড়ি পৌঁছে নিচের কমন বাথরুমেই স্নান করল। পুজোর আয়োজন হয়েছে একতলায়, উঠোনে। সংযুক্তার শ্বাশুড়ী নিজে সব দেখছেন, সঙ্গে বৌদি, দাদাও একটু পরে বাড়ি চলে এলো, রুকুও আজ বাড়িতে। সংযুক্তা খুব অবাক হলেও মুখে কিছু বলল না। পুজো শুরু হতে না হতেই হল এক ভীষণ বিপদ। কোথা থেকে ছুটে এলো এক দুরন্ত হাওয়ার ঝাপটা আর পচা, গন্ধময় কিছু নোংড়া এসে পড়ল নারায়ণশীলার উপর। লক্ষী নারায়ণের ছবির সামনে পড়ে তখন রক্তমাখা একটা কালো বেড়ালের দেহ, চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে পূতিগন্ধময় কালচে রক্ত। হাওয়ার দাপটে উল্টে পড়ল পুজোর প্রদীপ আর আগুন লেগে গেল ঠাকুরের ছবিতে। সবাই চিৎকার করে ছিটকে সরে গেল আর তখনি গমগমে গলায় কেউ আদেশ দিল, "থামুন,কেউ নড়বেন না।" আদেশ যে দিল সে বাড়ির কেউ নন, জিন্স আর সাদা শার্ট পরিহিত এক ভদ্রলোক। উষ্কখুষ্ক চুল আর দাড়ি। ভদ্রলোক আগুনের একদম সামনে গিয়ে বসে পড়লেন আর বাড়িময় গম গম করে উঠল ওনার মন্ত্রোচ্চারণের শব্দ। কিছুক্ষণ পরে হাওয়া থেমে গেল, ঝিমিয়ে পড়ল আগুন। উঠে দাঁড়ালেন ভদ্রলোক আর অমিত এবার বলল, "ইনি অর্ক ভট্টাচার্য, ওনাকে আমি আসতে বলেছিলাম।" কোন আলাপের মধ্যে না গিয়ে অর্ক বললেন,"সত্যনারায়ণ পুজো আমি করতে বলেছিলাম অমিতকে, তাই অমিত কোন ভূমিকা না দিয়ে আপনাদের সবাইকে জোর করেছিল বাড়িতে থাকতে আর এই পুজোর আয়োজন করতে। সবাই একজায়গায় না হলে বিপদ আলাদা ভাবে আপনাদের যেকারোর হতে পারত। পুজো করা যে সম্ভব হবে না তা আমি জানতাম। এবাড়িতে যে এসেছে সে পুজো করতে দেবে না। কেউ যে এসেছে তা সম্পূর্ণ নিশ্চিত হতেই পুজো করতে বলেছিলাম আমি।"

এবার সংযুক্তার দিকে ফিরে অর্ক বললেন,"বাক্সটা কি দেখতে পারি আমি?" সংযুক্তা ইতস্তত করে উপরে যাওয়ার চেষ্টা করতেই অর্ক বললেন, "আমাদের সবাইকে একসাথে যেতে হবে, কেউ একা থাকতে পারবেন না। আত্মা এখন একটা দেহ খুঁজছে, একা পেলে যে কাউকে ধারণ করার চেষ্টা করতে পারে।" সবাই উপরে গেলে বাক্সটা দেখাল সংযুক্তা। লেখাটা দেখে অর্ক বললেন, "এটা উর্দু নয়, পুরোন আরাবিক। এটাতে লেখা আছে, 'এ বাক্স যেন কখনও খোলা না হয়। খুললে ধেয়ে আসবে ভীষণ ক্ষতি ও মৃত্যু।' এবার সংযুক্তার শ্বাশুড়ীর দিকে ফিরে বললেন, "এ বাক্স যে এ বাড়িতে এসেছে তার নিশ্চই কোন কারণ আছে। আপনি ভেবে বলতে পারবেন আপনার ছোটবেলার কোন ঘটনা যেখানে কোন মুসলিম ধর্মাবলম্বি মানুষের মৃত্যু হয়েছিল?" এবার অমিতের মায়ের অবাক হওয়ার পালা।

তিনি কি যেন চিন্তা করতে করতে ধপ করে বসে পড়লেন খাটের উপর। তারপর কম্পিত কণ্ঠে বললেন, "আমার ছোট বয়সে শোনা গল্প। আমার মামাবাড়ি কুমিল্লায়, বিখ্যাত রায় বাড়িতে। সে সময়ে দেশে খুব বিপদের সময় চলছে, শোনা যাচ্ছে পুরো বাংলা নাকি হয়ে যাবে পূর্ব পাকিস্তান। হিন্দুরা ভয়ে কাঁপছে আর কয়েকশ বছর একসাথে থাকার পরও অবিশ্বাসের আবহাওয়া বইছে চারপাশে। একদিন সন্ধ্যায় হঠাৎ শোনা গেল বাড়িতে কাজ করা এক মুসলমান ছেলে নাকি লুকিয়ে দেখেছে বাড়ির এক মেয়েকে স্নান করার সময়। বাড়িরই কিছু ছেলে টানতে টানতে নিয়ে আসে ছেলেটিকে। বাড়ির মধ্যেই তাকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়। তারপর পুঁতে দেওয়া হয় নদীর চরে। পরে যারা মেরেছিল তাদের এক এক করে মৃত্যু হয় বীভৎস ভাবে, কারও গলা দেহের থেকে আলাদা পাওয়া যায়, কারও ছিন্ন ভিন্ন দেহ পাওয়া যায় নদীর ধারের অশত্থ গাছের ডালে। ভয়ে যখন কাঁপছে সারা গ্রাম তখন বাড়িতে আসেন এক গুনিন। তিনি সব শুনে কিছু একটা ব্যবস্থা করেছিলেন। তারপর আর কেউ মারা যায়নি।" অনেকক্ষণ বলে মা দম নিলেন। অর্ক বললেন, "বাকিটা আমি আন্দাজ করতে পারি। এরকম কৌটোর কথা পাওয়া যায় এই বাংলাদেশের নানান গল্পে, এদেশেও ছড়িয়ে রয়েছে এরকম নানা লেজেন্ড,তেমনই এর উল্লেখ আছে ইহুদীদের মধ্যে, আরবদের গল্পে, পূর্ব ইউরোপে। আলাদা আলাদা নাম হলেও এরা একই। এদের চালিত করে প্রতিশোধস্পৃহা যা সহজে মেটে না আর তাই এদের বন্দি রাখা হয় বাক্সে।"

অর্ক থামার সঙ্গে সঙ্গে বেজে উঠল সদর দরজার ঘন্টা। সবাই নিচে আসার পর অমিত দরজা খুলে দিল আর উঠোনের আলোয় এগিয়ে এলেন এক লম্বা মানুষ। পরনে কালো জোব্বা, মাথায় বাঁধা একটা সবুজ কাপড়। গায়ের রং মিশকালো, চোখগুলো শুধু দেখা যায়।

অর্ক বললেন, "উনি নবি হোসেন, উনি একজন গুনিন, আমার রিসার্চের কাজে ওনার সাথে আমার অনেকদিনের আলাপ।"

নবি বললেন ,"আপনারা সরে যান, আমায় কাজ শুরু করতে হবে, সময় নেই।"

সময় কেন নেই এই প্রশ্নের উত্তর নবিকে দিতে হল না, সিঁড়ির ল্যান্ডিং থেকে একটা অট্টহাসি শোনা গেল আর ছিটকে পড়লেন অর্ক। অট্টহাসিটা এলো রুকুর মুখ থেকে কিন্তু গলাটা একজন পুরুষের। অর্কর হাত থেকে বাক্সটা পরে গেছিল আর সেটার দিকেই ছুটে গেল রুকু। ছুটে গেল না উড়ে গেল তা ওরা ঠাওর করতে পারল না। হাতের চামর দিয়ে রুকুর দিকে ঝাপটা মারলেন নবি আর রুকু বাক্সর কাছে পৌঁছনোর আগে ছিটকে পড়ল। গজরে উঠল রাগে, মার খাওয়া হিংস্র জানোয়ারের মত। বাক্সটা এক নিমেষে হাতে তুলে নিল অর্ক আর খুলে ফেলল ডালাটা। নবি কিছু একটা বলতে বলতে এক অজানা ভাষায় কোন এক আদেশ করতে লাগলেন রুকুকে। বার বার ঝাপটাতে লাগলেন তার চামর আর রুকু শিউরে শিউরে উঠতে লাগল। থর থর করে কাঁপতে লাগল তার দেহ। অমিত গিয়ে তার দাদাকে আঁকড়ে ধরল যাতে সে রুকুর দিকে ছুটে না যায়। ঝর ঝর করে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে বৌদির চোখ দিয়ে আর নবির উচ্চারণ করা প্রত্যেকটি শব্দের সঙ্গে বেঁকে যাচ্ছে রুকুর শরীর। বাড়ির সমস্ত আলো কেঁপে উঠে নিভে গেল কিন্তু নবি যেন আগে থেকেই জানতেন তাই কিছু একটা ছুঁড়ে দিলেন রুকুর সামনে, মেঝেতে আর জ্বলে উঠল নীল আগুন। সেই অপার্থিব আলোয় ভোরে গেল উঠোন। এরকম ভাবে কেটে গেল প্রায় ঘন্টা খানেক, রুকুর আওয়াজ পরিণত হল এক চাপা গোঙানিতে। একটু পরে দেখা গেল মানুষের আদলের একটা ধোঁয়ার কুন্ডলি যেন রুকুকে ছেড়ে বেরিয়ে এলো, তারপর অনেক কষ্টে গিয়ে ঢুকল মাটিতে রাখা বাক্সটির মধ্যে আর সশব্দে বন্ধ হয়ে গেল বাক্সের ডালা।বাড়ির আলো আপনা থেকেই জ্বলে উঠল। সবাই ছুটে গেল রুকুর দিকে। রুকু অজ্ঞান হয়ে পরে আছে। অমিতের দাদা পাঁজা কোলা করে তুলে নিলেন নিজের মেয়েকে।

অর্ক বললেন, "ওরা এমন কারোর দেহতেই ঢুকতে পারে যারা নিষ্পাপ, নির্মল। যাদের মস্তিষ্ক এখনও পরিপক্ক হয়ে ওঠেনি।" অর্ক বলে চললেন ,"সংযুক্তা, প্রথমে ও তোমাকেই কব্জা করার চেষ্টা করেছিল কিন্তু তোমার মিষ্টি, সুন্দর চেহারার মধ্যে আছে একজন দৃঢ়, সচেতন মানুষ, তাই দুবার চেষ্টা করেও তোমাকে ও ব্যবহার করতে পারেনি। অমিতকে ভয় দেখালেও সে বুঝেছিল যে বশে রাখা সহজ হবে না। তাই রুকুই একমাত্র ছিল যাকে সে ব্যবহার করতে পারত। এটা আমার ভুল, রুকুকে আগেই আড়াল করা উচিত ছিল। এতদিন বাক্সটা অমিতের ঘরে থাকায় রুকুর কাছে যেতে পারেনি। আমরা বাক্সটা বার করে আনায় আজ সে সুযোগ পেয়েছিল। রুকুকে শুইয়ে দিন, জ্বর থাকবে ওর, নরমাল ওষুধ দিতে পারেন, জ্বর এক দুদিনের মধ্যে চলে যাবে।"

পরের দিন ভোরের প্রথম আলোর সাথে অমিতদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো অর্ক আর নবি। দুজনে চলে গেল শহরের বাইরে, এক পুরোন মসজিদের পিছনের কবরখানায়। বাক্সটি পুঁতে দেওয়া হল মাটিতে। অর্ক বলল, "আবার কেউ যদি মাটি খুঁড়ে বার করে আনে?" নবি বলল, "আমি থাকব পাহাড়ায়,আমরা আছি পাহাড়ায়, হাজার বছর ধরে, এ এক দিনের লড়াই নয়।"

সমাপ্ত

krishanukundu@gmail.com



No comments:

Post a Comment