1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Wednesday, March 31, 2021

আশুর প্রিয় উপহার

 

ছবি  : ইন্টারনেট 
আশুর প্রিয় উপহার 
অভিষেক ঘোষ 


          পড়ার টেবিলের উপর পাড়াসুদ্ধু লোকের নজর এখন । চার্জে লাগিয়ে রাখা, নতুন নোট এইট প্রো ফোনটার দিকে তাকিয়ে অন্তত এমনটাই মনে হয়, ক্লাস ফাইভের আশুর । উপস্থিত সকলেই চৌষট্টি এম. পি.-র ক্যামেরা বা, গরিলা গ্লাসের কথা আলোচনা করছে । সে চেয়েছিল ছবিওয়ালা গল্পের বই অথবা, নতুন ওয়াটার কালারের সেট অথবা হ্যারি পটারের অল-ইন-ওয়ান ডিভিডি প্যাক । অবশ্য বিকল্পগুলো তার মাথার মধ্যে ঘুরতে থাকলেও আসলে তার পছন্দ ঝকঝকে নতুন একটি গল্পের বই । তার বদলে তাকে নতুন বছরের প্রথম দিনে হাতে ধরিয়ে দেওয়া হল, এই কালো লম্বা বিরক্তিকর জিনিসটা । হ্যাঁ মানছি এটা দিয়ে সেলফি তোলা যায় দারুণ, অনলাইন গুগল-মিট ক্লাসের ক্ষেত্রেও আর অসুবিধা থাকবে না মোটেও । সেই সঙ্গে সব আধুনিক পরিষেবা, এডিটের সুবিধা, চাইলে ভালো ভালো গেমও ইনস্টল করা যেতে পারে এই ফোনে । কিন্তু আশুর যে ওসব চাই না । তার জন্ম থেকেই সে দেখেছে, মা রান্না করতে করতে 'প্রথম আলো' পড়ছে, বাবা অফিস থেকে ফিরে হাত-মুখ ধুয়েই ম্যাগাজিনের পাতা ওল্টান । এমনকি তার ক্লাস এইটে পড়া দাদা পর্যন্ত টিভিতে ভারতের ক্রিকেট ম্যাচ বা, ফেডেরারের ম্যাচ না থাকলে টিনটিন, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় বা, সত্যজিৎ রায়ের বই পড়ে । তার পিসির মেয়ে সিমুই সেবার গরমের ছুটি-তে ওদের বাড়ি এসেছিল সাত-সাতখানা রঙচঙে গল্পের বই নিয়ে । দেখলে কারো মাথা ঠিক থাকে বলো ? সে তখনই তার জামশেদপুর-প্রবাসী প্রিয় মাসিমণি-কে মেইল করেছিল । বাবার ল্যাপটপ থেকে - লিখেছিল, "...এবারে আসার সময় অবশ্যই গল্পের বই (অন্তত আটটা) কিনে এনো । আমি অনেক আশা করে থাকবো কিন্তু !" তাহলেই বোঝো !

সুতরাং গালে হাত দিয়ে পড়ার চেয়ারে বসে আশু ভাবতে থাকে মোবাইল ফোনের কী কী অপকারিতা আজ অবধি তার চোখে পড়েছে ! একে একে অনেকগুলো ঘটনা মনে পড়তে থাকে তার । অভিযোগগুলোও একা একা সাজাতে থাকে মনের মধ্যে ।

এইতো দু বছর আগেই তারা বেড়াতে গিয়েছিল জিম করবেট ন্যাশনাল পার্কে । সেবার কী হয়েছিল মোবাইল ফোনের জন্য, নিশ্চয় সকলের মনে আছে ! দু'পাশে ঘন জঙ্গলের মধ্য দিয়ে যে রাস্তা গেছে, তার ওপর দিয়েই ওদের জিপগাড়িটা যাচ্ছিল । এমনিতে চারিদিক নিস্তব্ধ এবং সকলেই অপেক্ষায় রয়েছে কখন কী দেখা যায় । এমন সময় দারুণ জোরে বাঘের গর্জন শোনা গেল । স্বভাবতই তখন সবকটা গাড়ি পরপর দাঁড়িয়ে গিয়েছিল । সব টুরিস্টই তখন অপেক্ষা করছে কখন বাঘ দেখতে পাবে । চারিদিকে কোথাও কোনো শব্দ নেই । বাতাসও যেন থেমে গেছে কিছুক্ষণের জন্য । ড্রাইভার আশুর কানে কানে তখন বলছে, এই সময় যেন কেউ কোন শব্দ না করে । কারণ বিন্দুমাত্র শব্দ পেলেই বাঘ আত্মগোপন করবে । সবে জঙ্গলের ফাঁক দিয়ে বাঘের মুখটুকু দেখা গেছে, ঠিক এমন সময় আশুর মেসোমশাইয়ের পকেটে বেজে উঠল মোবাইল ফোনটা, উচ্চগ্রামের রিংটোনে - "ধুম্ মচা দে..." ! ব্যাস্ বাঘমামা অমনি হাওয়া !

তারপরে এই যে গতবছর ছোটোমামার মেয়ে জন্মদিনে মোবাইল উপহার পেল, ঠিক তার পরপরই তো তার চোখে চশমা হলো ? তার মানে ওই মোবাইল ঘেঁটে ঘেঁটেই চোখ খারাপ করেছে । তার উপর সারাক্ষণ গেম খেলে আর দিন-রাত্তির ফেসবুক করে । তাহলে বাড়ির লোকের সঙ্গে কখন কথাবার্তা বলবে বলো ?

হ্যাঁ তোমরা বলতে পারো যে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে জগতের কত খবরা-খবর ঘরে বসে পাওয়া যায় । কিন্তু একথাও তো ঠিক, প্রচুর ফেক্-নিউজ ছড়িয়ে পড়ে দ্রুত । এইতো কয়েকদিন আগেই দাদা মা-কে বলছিল, কোনো একজন বিখ্যাত লোক্ নাকি আদৌ মারা যান নি, কিন্তু ফেসবুকে সবাই পোস্ট করেছে তিনি মারা গেছেন বলে ! ভাবো তো তাঁর এই খবর-টা জেনে কেমন লাগে ?

তাছাড়া সারাক্ষণ মোবাইল ফোন নিয়ে বসে থাকলে, দাদু-দিদার সঙ্গে কথা বলবে কে ? হ্যাঁ মানছি অনেকেরই থাকে না, কিন্তু আশুর তো আছে ! আর তাদের আশু ছাড়া আর বন্ধু কই ? একটু সময় পেলে সেই জন্যই তো আশু তাদের কাছে বসে থাকেে গিয়ে, গল্প করে গল্প শোনে ।

এতসব চিন্তা করে আশু এবার সোজাসুজি মায়ের কাছে গিয়ে বলে, - "আমাকে কি একটা গল্পের বই কিনে দেওয়া যেত না ?"

একমুখ হেসে মা তখুনি একটা রঙিন কাগজে-মোড়া কিছু এগিয়ে ধরেন আশুর দিকে । মুখে বলেন, - "পাগল ছেলে আমার ! তোমাকে কি বই না দিয়ে পারি ?"

আনন্দে ভ'রে ওঠে আশুর মুখটা... হাতে নিয়ে মোড়ক ছাড়িয়ে দেখে, চৌকো মতো নীল বইটার উপরে সোনালি রঙে লেখা, শ্রীদক্ষিণারঞ্জন মিত্রমজুমদারের লেখা 'ঠাকু'মার ঝুলি', বাঙালির চিরকালীন রূপকথা ।

abhisek1988ghosh@gmail.com
কলকাতা


No comments:

Post a Comment