1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Thursday, July 1, 2021

অষ্টম গর্ভ


পাঠ-প্রতিক্রিয়া : অভিষেক ঘোষ

অষ্টম গর্ভ
লেখক: বাণী বসু
প্রকাশনাঃ- আনন্দ পাবলিশার্স (ভারত)
মূল্যঃ- ২৯০  টাকা

দ্বাপর যুগে অবতার হিসেবে জন্ম গ্রহণ করলেন শ্রীকৃষ্ণ । কৃষ্ণের কথায় বৃন্দাবনবাসী ইন্দ্রের পুজো বন্ধ করে দিল । ইন্দ্রের ক্রোধে বৃন্দাবনে প্রবল বৃষ্টিপাত শুরু হল । সেই বৃষ্টিতে গোটা বৃন্দাবন ভেসে যেতে বসলে, শ্রীকৃষ্ণ উক্ত বিপদ থেকে বাঁচাতে এগিয়ে এলেন । বৃন্দাবনের গোবর্ধন পাহাড় নিজের আঙুলের ডগায় অনায়াসে তুলে ফেলেন শ্রীকৃষ্ণ । তার নীচে আশ্রয় নেয় বৃন্দাবনের সকল মানুষ ও গবাদি পশু । সেই শ্রীকৃষ্ণই হলেন পুরাণ-প্রসিদ্ধ অষ্টম গর্ভ । কারো কারো মতে, এই আট সংখ্যাটা নাকি আট প্রকার প্রকৃতি-কে নির্দেশ করে, সেগুলো হল - আকাশ, বায়ু, অগ্নি, জল, পৃথিবী, মন, বুদ্ধি, অহংকার ।


বাণী বসুর 'অষ্টম গর্ভ' সেই কাল-খন্ডে শুরু হয়েছে যখন, চারিদিকে সাম্রাজ্য পতনের শব্দ । ধ্বংসস্তূপের ওপর ধিকি ধিকি আগুন জ্বলছে । তার অনতিবিলম্বেই, সেই ধ্বংসস্তূপের আগুনের ওপর দিয়ে গাজনের সন্ন্যাসীদের মতন, খালিপায়ে ছুটতে থাকে উন্মত্ত, উদ্বাস্তু জনতা । তাদের দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে, তারা সব কেড়ে নিতে চায় । চতুর্দিকে রক্তস্রোত, মানুষ দাঙ্গা আর দেশ-ভাগ পেরিয়ে চলেছে । কোথায়, কোন দিকে? আজ তা আর নতুন করে বলে দিতে হয় না - সর্বনাশের পথে । কিন্তু কেন ? কারণ এই কলি-যুগে মানুষ ইন্দ্র-রূপী ইংরেজ-দেবতার পুজো বন্ধ করে দিল । কিন্তু কার কথায় ? নর-নারায়ণের কথায় হয়তো, যিনি সকলের বুকের মধ্যেই কোথাও ঘাপটি মেরে বসে আছেন ! কিন্তু ইংরেজরা যখন ক্রুদ্ধ হয়ে দেশভাগ, দাঙ্গার রক্তের বন্যায় সব ভাসিয়ে দিচ্ছে, তখন মানুষের মাথার উপর ছাতা ধরবে কে ?


বুনবুন-পুনপুন-বুবু - তিন ভাই-বোন এই উপন্যাসের অষ্টম গর্ভ জাতক - যমজ নয়, 'তেমজ' । দুগগি ডাক্তারের বিরাট পরিবার - অনেকগুলি সন্তান - ইন্দ্র, ঋদ্ধি, সূর্য, ভক্তি, শ্রদ্ধা, অংশু, ঋতি আর অষ্টমগর্ভ-জাতক তিনজন, বিদ্যা - বরুণ -পাবন । সেইসঙ্গে রয়েছে পালিত পুত্র পুলক তথা পালক (পরবর্তীতে বর্মার জ্যাঠামশাইয়ের পরপরই যে দুগগি ডাক্তারের মনে দাগা দেবে) । হোমিওপ্যাথি ডাক্তার দুর্গাপ্রসাদ সিংহ ও তাঁর বাবা (তিনিও ডাক্তার, তবে অ্যালোপ্যাথিক) পারিবারিক শিক্ষায় ও বিশ্বাসে আস্থাবান ছিলেন, তাঁদের পরিবারেই অবতারের জন্ম হবে । সুভাষ তখনও জনমানসে একমাত্র যুগাবতার ! কিন্তু তিনিও সহসা একদিন হারিয়ে গেলেন জাতির দৃশ্যপট থেকে । এখনই তো তাঁকে প্রয়োজন । দুর্গাপ্রসাদ ও দেবহূতির সেই অষ্টম গর্ভে এরপর এল একেএকে তিন জন । কংস বধ করতে হবে, এ যুগের কংসও যে একজন নয়, জনে-জনে কংস হয়ে উঠেছে । কংস আর মানুষ নয়, কংস লোভ, কংস লালসা, কংস অনুদার বিবেক-বর্জিত ঘৃণার উত্থান । তাই কি অবতার-ও এলেন তিন ভাগে ? এদিকে বুবু শৈশবেই ম্যানেনজাইটিসে কাবু, তার কংস হয়ে এসেছিল বর্মার জ্যাঠাবাবু, একদিন চিংড়ি ছাড়াতে ছাড়াতে নিজের অজান্তেই তাকে বধ করেছিল ছোট্ট বুবু । কিন্তু তারা যে জানে না, কীভাবে তাদের অন্তর্শক্তি জাগ্রত করতে হবে ! তাহলে কী হবে ? তারা ভুলে গিয়েছে, তারা কারা ! তারা প্রাণপণে মনে করবার চেষ্টা করে, 'কোথায় লুকিয়ে আছে সেই নীলাভ শরীর, সেই বিশ্ব জনমোহন বাঁশি, সেই কালভৈরব চক্র ?' মনে করার চেষ্টা করতে করতেই তিনটি শিশু ছাদে ঘুমিয়ে পড়ে । আসলে দেবতা ও যে ঘুমিয়ে পড়েছেন ! কীভাবে, কেন, তা জানতে হলে, বুঝতে হলে, আপনাকে উপন্যাসটি পড়তে হবে । আশ্চর্য এই যে, গোটা উপন্যাসটিই শিশুর চোখে, শিশুর বোধে লেখা । ফলে উপন্যাসটিতে রচিত হয়, এক স্বতন্ত্র ভুবন, অভিনব এক আলো ছড়িয়ে থাকে পাতায় পাতায় । এই উপন্যাসে অনেক চরিত্রেরই পয়েন্ট অব ভ্যিউ প্রতিষ্ঠা করতে, বিশ্বাসের ভরকেন্দ্র স্থাপন করতে লেখিকা সংলাপের পরিবর্তে নির্ভর করেছেন বর্ণনার উপরে । সময়ে সময়ে এত কথার কচকচি, ব্যাখ্যা ও দীর্ঘ শাব্দিক বিশৃঙ্খলা (লেখিকা যেমন খুশি দেশি-বিদেশি শব্দের সমন্বয় ঘটিয়েছেন) ক্লান্তিকর মনে হয় । অধিকাংশ চরিত্রগুলিকে যেভাবে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ও দীর্ঘ জীবন-যন্ত্রণার ফলশ্রুতিতে দেখাতে পেরেছেন লেখিকা, সেটি যথেষ্ট ইতিবাচক ও প্রশংসনীয় । দুর্গাপ্রসাদের জীবনের আর্ক খুবই আকর্ষণীয়, তার বিশ্বাস ও মূল্যবোধ একটা সময়ের পর কীভাবে ঘরে-বাইরে বারংবার ধাক্কা খেতে থাকে, বাবার চিকিৎসা-পদ্ধতির সাথে তার প্রাথমিক বিরোধ দিয়ে যার শুরু, তা কীভাবে দেশ-কাল-নৈতিকতার বৃহত্তর ক্ষেত্রে প্রবেশের পথ পায়, বাহ্যি যন্ত্রণাই কীভাবে মানসিক মুক্তির পথ হয়ে ওঠে, তা এমনকি পাকুমা-চরিত্রটির ('প্রায়োপবেশন'-এ মৃত্যু) মাধ্যমেও লেখিকা অসামান্য দক্ষতায় দেখিয়েছেন । তবে, লেখিকা যে বিষয়টিতে সবকিছু ছাপিয়ে গিয়েছেন, সেটি হল পর্যবেক্ষণ অভিনিবেশ শক্তি । দুর্গাপ্রসাদ চরিত্রটির ক্ষেত্রে লেখিকার সযত্ন মনোনিবেশ বুঝিয়ে দেয়, কেন তিনি এই উপন্যাসটি উৎসর্গ করেছেন তাঁর পিতা, ঈশ্বর সূর্যপ্রকাশ চৌধুরীর স্মৃতি-তে ।

দাঙ্গা, দেশভাগ, উদ্বাস্তু সমস্যা - এই জাতীয় বৃহত্তর রাষ্ট্রীয় সংকট নিয়ে বাণী বসু যেমন নিঃসঙ্কোচ ও স্পষ্টবাদী, ততটাই নির্দ্বিধায় তিনি ঘরোয়া সন্ত্রাস ও শিশুদের উপরে ঘটে চলা প্রায় অদৃশ্য যৌন-নিপীড়ন নিয়েও তিনি সমান সোচ্চার । এই ঘটনা বাংলা সাহিত্যে দুর্লভ এবং এই সাহস একজন লেখিকা হিসেবে পক্ষে যতটা কার্যকর হয়ে উঠেছে, সম্ভবপর হয়ে উঠেছে; হয়তো পুরুষ লেখকরা তা পারতেন না । অসম্ভব একটা ব্যাপ্তি অনুভব করা যায় উপন্যাসটি পড়তে পড়তে । আমরা সবিস্ময়ে দেখি, কীভাবে আপাত-নিরপেক্ষ, একটি বৃহৎ যৌথ পরিবারে ক্রমশ প্রবেশ করে রাষ্ট্রীয় বিপর্যয়, গোপনে ক্ষইয়ে দেয় বাড়ির মানুষগুলোকে । 'বালবিধবা' মনোরমা পিসিমা-র মতো চরিত্রদের ক্ষেত্রে লেখিকার অভিপ্রায় অবশ্য এই জায়গায় খুব স্পষ্ট নয় ! দুর্গা ডাক্তারের নিয়মিত রিফিউজি শিবিরে গমনাগমন মনে করিয়ে দেয় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্মরণীয় গল্প, 'কে বাঁচায়, কে বাঁচে!' গুটিকয়েক মানুষের স্বার্থসিদ্ধি ও ক্ষমতার প্রতি লোভ কীভাবে জন-জীবনে অপূরণীয় ক্ষতিসাধন করে বা, ঠেলে দেয় সার্বিক বিপর্যয়ের দিকে, অবতার-হীন সময়ে দাঁড়িয়ে তার অনবদ্য চিত্র এঁকেছেন লেখিকা । প্রথম খন্ডের তিনটি স্কন্ধ ও অজস্র এপিসোডের মধ্যে ছড়িয়ে থাকা গল্পের ঝাঁপিতে যার কয়েকটি প্রকৃতই অবিস্মরণীয় ।

'নরক গুলজার' নাটকের সেই গান আছে না ! 'কেউ কথা বলো না, কেউ শব্দ করো না, ভগবান নিদ্রা গিয়েছেন, গোলযোগ সইতে পারেন না ।' ঠিক তেমনি, সেই প্রবল সংকটময় সময়ের আবর্তেও, ছাদে প্রবল হাওয়ায় মাদুরে শুয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমায় বুনবুন-বুবু-পুনপুন । স্বপ্নে তারা অনেক কিছু করে মানব-কল্যাণে । তারা জানে তাদের অবতার হয়ে উঠতে হবে, তাদের অনেক দায়িত্ব । কিন্তু এর উপায় তারা জানে না ! তাই তারা স্বপ্নে সব সম্ভব করে । আগেকার ভুলগুলো শুধরে নেয়, তারপর নিশ্চিন্তে নিদ্রা যায় । এই অপূর্ব উপন্যাসটি পাঠের অনবদ্য অভিজ্ঞতার পর এবার অপেক্ষা বইটির দ্বিতীয় পর্বের ।

abhisek1988ghosh@gmail.com
কলকাতা

No comments:

Post a Comment