1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Thursday, July 1, 2021

হঠাৎ ঝড়

 

ছবি  : ইন্টারনেট

হঠাৎ ঝড়

ডাঃ অরুণ চট্টোপাধ্যায়

ঝড় উঠেছে বাউল বাতাস---। মনে মনে গুন গুন করে গেয়ে উঠেছে নন্দিনী। আকাশটা কালো করে এল যেন দু মিনিটের মধ্যে। তারপর গাছের পাতাগুলো একটু একটু করে নড়তে লাগল। প্রথমে আস্তে আস্তে তারপর হঠাৎ জোরে। ভীষণ জোরে। উঠল একটা সাঁই সাঁই আওয়াজ। দূরে রাস্তায় ধুলো গুলো সব খেয়ে গেল কটা পাক। গাছের পাতা আর ডালপালা এলোমেলো নাচতে লাগল। চৈত্রের একটা রোদ ঝলোমলো ভরা দুপুরে আচম্বিতে নেমে এল যেন কালো একটা রাত।

ছাদে মেলা কাপড়গুলো তুলছিল নন্দিনী। বিকেল চারটের মধ্যেই সে এ কাজ সেরে ফেলে। আজ মনে হল আর একটু তাড়াতাড়ি করা দরকার। সাড়ে তিনটেতেই আকাশটা মেঘলা করে এল। ক’দিন যা গরম পড়েছে। ঘেমে নেয়ে যেন একাকার। এই মেঘে ঢাকা আকাশ বেশ একটা স্বস্তি এনে দিল।

টিভির আবহাওয়া বার্তায় আজ অবশ্য মেঘলা আকাশ আর বৃষ্টির কথা বলেছে। আগে তো একদম মিলতই না। ইদানিং তবু মিলছে সে ফোরকাস্ট। তাই সাত তাড়াতাড়ি তার ছাদে উঠে আসা। আজ আম পোড়ার সরবত খেয়ে শুয়েছিল। কার মুখে শুনেছে আম পোড়া খুব ভাল জিনিস। বিশেষ ঘুম হওয়ার পক্ষে তো বটেই। আর দেখলও ঠিক তাই।

দিব্বি ঘুমোচ্ছিল। দেখছিল কেমন একটা মিষ্টি স্বপ্ন। যেন বহুদিন পরে তার কোনও মিষ্টি এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়ে গেছে। কিন্তু আকাশের মেঘ এমন একটা আওয়াজ ছাড়ল যে স্বপ্ন ভেঙ্গে খান খান। উঠে পড়ে আকাশ দেখে দুড় দুড় করে ছাদে উঠে এসেছে। যদি আবহাওয়া গনৎকারের কথা ঠিক হয় তো কখন নেমে পড়বে বৃষ্টি আর সব জামাকাপড় ভিজে যাবে। তার পরিশ্রমের বারটা বেজে হবে তেরোটা।

কাপড় সব তোলা হয়ে গিয়েছিল। রেলিং-এ হাত দিয়ে সামনের রাস্তাটা দেখছিল। সাইকেল, রিক্সা, মোটর সাইকেল, স্কুটি সব চলছে। মোটামুটি সব সময় সরগরম থাকে রাস্তাটা। ছাদ থেকে এত আওয়াজ শোনা গেলেও নিচের তলা মোটামুটি শান্ত। রাস্তার আওয়াজ অতটা পৌঁছতে পারে না। কারণ নিচের তলায় গেটের পরে বাহারি গাছ আর ফুলের ঝোপঝাড় লাগিয়েছে নন্দিনী। উঁচু পাঁচিলঘেরা বাগানের পরিচর্যাও করে নিজে হাতে। একা থাকার দুঃখটা ভোলা যায় এমন করে। এই গাছেরা তার আত্মীয়। তার বন্ধু। কেউ জল না পেয়ে শুকিয়ে গেলে তার কষ্ট হয়। এই ঝোপঝাড়েই আটকে যায় বাইরের অধিকাংশ আওয়াজ।  

মাঝে মাঝে মনে হয় এই ঝোপঝাড় পাতা ফুলগুলো তার সঙ্গে কথা বলে। গল্প করতে চায়। সে যখন সেজেগুজে স্কুলে যায় তখন পাতাগুলো খুশি হয়ে দুলে দুলে ওঠে। ফুলগুলো মুগ্ধ হয়ে স্থিরভাবে তার দিকে তাকিয়ে থাকে সপ্রশংস দৃষ্টিতে। তাড়াতাড়িতে যেতে গিয়ে যদি তাদের গায়ে শাড়ির ঝাপটা লাগে কিংবা মাড়িয়ে ফেলে কোনও লতা, তো সে তক্ষনি দাঁড়িয়ে পড়ে পেছন ফিরে। তার মনে হয় লতাটা বোধহয় ব্যাথা পেল। ফুল যেন তার মাথা নাড়িয়ে বলল, আমায় একটু নজর করতে পারলে না দিদি?

হয়ত এগুলো তার একা থাকার প্রতিক্রিয়া। একা কোনও মানুষ থাকতে পারে না। তার নিকটতম কাউকে সে আঁকড়ে ধরতে চায়। এটাই প্রকৃতির নিয়ম। নিকটতম কেউ না থাকলে কাউকে সে নিকটতম বানিয়ে নেবার চেষ্টা করে। কেউ সাজগোজের পেছনে অনাবশ্যক দীর্ঘ সময় ব্যয় করে। কেউ রান্নাবান্নায়। কেউ টি-ভি দেখায়। কেউ অন্য কোনও কাজ।

যেমন নন্দিনী বেছেছে এই বাহারী ঝোপ তৈরি করার আনন্দে। স্কুলে যাবার আগে রান্নায় ব্যস্ত থাকে। স্কুল থেকে ফিরে লেগে পড়ে এই বাগান পরিচর্যায়। সন্ধ্যের মুখে মুখে উঠে পড়ে ছাদে। গোধূলি প্রকৃতির মনোরম শোভা তখন তার সঙ্গী। তাছাড়া ছাদের আলসেতেও কিছু টব বসিয়েছে ফুলের। সেই শোভা দেখে সে আলসেতে হেলান দিয়ে। মাঝে মাঝে গুনগুনিয়ে ওঠে গান। সুরের তরঙ্গে ভেসে যায় তার মন। তখন মনে হয় না সে একা।

শনিবারের দিনটা অবশ্য একটু আলাদা। এটা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল। তাই শনিবার ছুটি থাকে। সেদিন তাকে কুঁড়েমিতে পেয়ে বসে। বিছানা ছাড়ে বেলা নটায়। তারপর চা খেয়ে নিজের জামা কাপড়ের ডাঁই নিয়ে বসে কাচার জন্যে। লন্ড্রিতে সে কিছুই দেয় না। সব কাচে নিজের হাতে। পরিশ্রম হোক তবু তো কিছুটা সময় কাটানো যায় কাজের মধ্যে। এরপর ছাদে সেগুলো মেলে নিচে এসে রান্নাঘরে ঢোকে। যদিও একার জন্যে পঞ্চ ব্যঞ্জন রান্না করতে তার ভাল লাগে না। কিন্তু রোজ তো আর আলুভাতে ভাত খেয়ে থাকা যায় না। মুখে রোচে না।  

দুপুরে নিদ্রা দিয়ে বিকেল চারটে নাগাদ ছাদ থেকে জামাকাপড় তুলে নেয়। তারপর সে ছাদে দাঁড়িয়ে দেখে প্রকৃতির শোভা। একঘেয়ে জীবনের এই হল তার ধরাবাধা রুটিন। রুটিনে বাঁধুনির ছন্দ থাকলেও মনে কোনও ছন্দ নেই। গন্ধ নেই জীবনের পাতাগুলোতেও।

আজ একটু রুটিনের ছন্দ পতন হল মেঘের ডাকে। সব কাজ গুছিয়ে ছাদের পাঁচিলে যখন হেলান দিয়ে দাড়িয়েছে নন্দিনী তখন হাতের ঘড়িতে বাজল সবে তিনটে চল্লিশ। অন্যদিন হলে থাকে কড়া রোদ। কিন্তু আজ অকাল সন্ধ্যায় মন যেন উড়ু উড়ু করছে তার। রেলিং-এ ভর দিয়ে গান ধরেছে। এলোমেলো হাওয়ায় উড়ে চলেছে তার শাড়ির আঁচল আর মাথার চুল।

ঠান্ডা ঠান্ডা সেই হাওয়াটা বেশ ভালই লাগছিল। কিন্তু ক্রমে তার জোর বাড়ল। দামাল হাওয়া চরিত্র বদলে ঝড় হল। প্রচন্ড শোঁ শোঁ শব্দ। আকাশ ঘন মেঘে ঢেকে গেল। কালো মেঘ জটলা পাকিয়ে তুলল। আর সেই জটলার ফাঁক দিয়ে ঝিলিক দিয়ে উঠল বিজলির চমক।

কালবৈশাখী -- এই বছরের এটা বোধহয় প্রথম। যেন সেই শৈশবে ফিরে গেল সে। মায়ের সাবধান বানী শুনতে পেল, ওরে তনু ভেতরে আয়। এখুনি বৃষ্টি নামবে। ভিজিস না এই অসময়ে। অসুখ করবে মা।

চমকে সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল সব ফাঁকা। মায়ের জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে একটা জমাট বাঁধা অন্ধকার। কিন্তু সত্যি তো আর ছাদে দাঁড়ানো যাচ্ছে না। জল না পড়ুক এই ঝড়ে আশপাশের একটা গাছের ডাল যদি হুড়মুড় করে ভেঙ্গে পড়ে গায়ের ওপর? কিংবা বাজ এসে--। বাজকে ছোটবেলা থেকেই খুব ভয়। তার এক আত্মীয় মাঠের মধ্যে চাষ করতে করতে মাথায় বাজ পড়ে মারা গিয়েছিল। সেই থেকে তারা চাষ আর করে নি। জমি জায়গা সব বেচে দিয়ে কিসের একটা দোকান খুলেছিল শহরে গিয়ে।

সিঁড়ির ঘর বন্ধ করে নিচে নেমে আসছে নন্দিনী। হঠাৎ মনে হল যেন একটা শব্দ কোথায় অনবরত হয়েই যাচ্ছে। ঝড়ের সময় কত রকম শব্দ নানা দিক থেকে থাকে। উৎকট উদ্ভট সব শব্দ। তার মধ্যে প্রবল শোঁ শোঁ শব্দটাই বেশি। বাচ্চারা কেউ কেঁদে ওঠে এ শব্দে। বড়রা কেউ কেঁপে ওঠে।

কিন্তু এ শব্দটা যেন একটু অন্য রকম। কেউ যেন দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে। এ আবার কে রে বাবা কলিং বেল থাকতেও অসভ্যের মত ধাক্কা দেয় দরজায়? আচম্বিতে মনে হল ইলেক্ট্রিসিটি একটু আগেই চলে গেছে। হয়ত ঝড়ে কোনও তারটার ছিঁড়ে গিয়ে থাকবে।

কথাটা এত পরে কেন নন্দিনীর তা ভেবে পেল না সে। আসলে ডাইনিং-এ বোর্ডে একটা ইন্ডিকেটর বসান আছে। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে এটা চোখে পড়লেও হয়ত অন্যমনস্ক থাকার জন্যে ভুলেই গিয়ে থাকবে।  

দরজাটা খুলতে গিয়েও থমকাতে হল। তার বাড়িতে তো কোনও কাজের লোক নেই যে আসবে? আর এই ঝড়ের তান্ডবে কোন প্রতিবেশিই বা আসতে পারে গল্প করার সুবাদে? এই অসময়ে যদি কোনও বাজে লোক আসে? চোর ডাকাত গুন্ডা বা ---। কথাটা ভেবে সে বেশ কাঁটা হয়ে গেল ভয়ে।

এদিকে বাইরের দরজায় শব্দের বিরতি নেই। সেই সঙ্গে এবার কন্ঠস্বর। উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠার আকুতি, প্লিজ দরজাটা একটু খুলুন। বাইরে খুব বৃষ্টি পড়ছে। আমি – আর থাকতে পারছি না। প্লিজ—

এতক্ষনে খেয়াল হল বৃষ্টি নেমে গেছে। শুধু নেমে যাওয়াই নয় বেশ বড় বড় ফোঁটায় পড়ছে। তাতে এলোমেলো বিশাল পাগলা হাওয়ার দাপট। বাইরে যে আছে তার অবস্থাটা বুঝতে পারল নন্দিনী। খুব দ্রুত গিয়ে খুলে দিল দরজাটা।

বাইরে অন্ধকার। বেশ গাঢ়। আবার ঘরের ভেতরে সেই গাঢ়ত্ব আরও বেশি। বাইরে থেকে একটা মানুষকে নিয়ে ঝড়টা ঢুকে পড়ল। কিংবা ঝড়ের ধাক্কায় ঘরে একটা গাছের ডাল মেঝেতে পড়ল যেন। কী যে ঢুকল আর কে যে ঢুকল বোঝার কিছুমাত্র উপায় নেই।

হাঁপানি শেষ করে একটা পুরুষ কন্ঠ বলল, দেখুন রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলাম। এমন সময় ঝড়। সেটা মাথায় নিয়েও চলেছিলাম। কিন্তু জোর বৃষ্টিটা নেমে যেতেই—

অন্ধকারে মুখ দেখা যাচ্ছে না ব্যক্তির। কিন্তু গলার স্বরে একটা লজ্জা, সংকোচ আর কুন্ঠার ভাব। এদিকে বাইরে থেকে জোর ঝাপটা আসছে। দরজাটা বন্ধ করতেই হবে। নন্দিনী সেটা বন্ধ করতে গিয়েও ইতস্তত করছে দেখে লোকটা বলল,  বন্ধ করলেই বোধহয় ভাল। মানে ঝাপটাটা যা—

এরপর আর উপায় নেই। কিন্তু বন্ধ করেও দরজার পাশেই দাঁড়িয়ে রইল। কোনও বিপদের সম্ভাবনা দেখলে দরজা খুলে নিজেই বেরিয়ে যাবে। একটু ছুটে গেলেই সুব্রতাদের বাড়ি। এ পাড়াতেই থাকে।

--ম্যাডাম আপনার কোনও ভয় নেই। সেই অজানা লোকটি বলল, আমি চোর ডাকাত গুন্ডা বদমাশ এসব নই। বিশ্বাস করুন সত্যি একটা বাড়ি খুঁজতে গিয়ে পড়েছিলুম ঝড়ের মুখে। আর—

গলার স্বরটা বিশ্বাস এনে দিল নন্দিনীর। দরজায় ছিটকিনি এঁটে একটা চেয়ার এগিয়ে দিল সে, বসুন। দাঁড়ান একটা তোয়ালে এনে দিই। বোধহয় ভিজতে হয়েছে বেশ।

বলে সে আর আগন্তুকের সম্মতির অপেক্ষা না করেই ঢুকে গেল ভেতরে আর এনে দিল একটা বড় তোয়ালে। সেটা নিয়ে মুছতে মুছতেই লোকটা বলল, দিন দুপুরে হঠাৎ ঝড়বৃষ্টি। কী জ্বালা বলুন তো?

--কার বাড়ি খুঁজছিলেন? স্বাভাবিক ভদ্রতার খাতিরে নন্দিনী প্রশ্নটা করে বসল। আসলে আগন্তুকের হাঁড়ির খবরে তার তত উৎসাহ নেই।

এমন সময় ডাইনিং-এ রাখা ফ্রিজটা শব্দ করে চালু হয়ে গেল। তার মানে কারেন্ট এল। সুইচে হাত দিতে যাবে এমন সময় লোকটার কথায় থমকে যেতে হল নন্দিনীকে।

--—ডাকনাম ছিল তনু। হ্যাঁ, এখনও বেশ স্পষ্ট মনে আছে। ভাল নামটা—

এতদিন পরে এক উটকো অচেনা এক লোকের মুখে নামটা শুনে কৌতূহলী হয়ে উঠল নন্দিনীর। সুইচে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল চুপ করে। তার পরিচিতির বেষ্টনী এত ছোট হয়ে এসেছে যে এই নামটা এখন প্রায় কারোর মুখেই শোনা যায় না।

--আলোটা জ্বালুন না প্লিজ। কিছুই তো দেখা যাচ্ছে না।

কথা যেন কানেই যাচ্ছে না এমনিভাবে দাঁড়িয়ে রইল নন্দিনী। তার প্রবল চিন্তার স্রোত তাকে এখন একটা অন্ধকার অতীতের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

লোকটা তখনও বলে যাচ্ছে, নাম বলতে একজন এদিকেই দেখিয়ে দিল। কিন্তু ভাল করে বোঝার আগেই সে তার দরজা বন্ধ করে দিল। খুঁজে পাওয়ার আগেই এই প্রবল ঝড়বৃষ্টি। সরি টু ডিস্টার্ব ইউ। ইচ্ছে ছিল  না নেহাত প্রকৃতি বিদ্রোহ করল বলেই---

এতগুলো বলা কথায় লোকটার গলার স্বর আরও স্পষ্ট হয়ে এল নন্দিনীর কাছে। গলার মালিকের পরিচিতি সম্পর্কে সে নিশ্চিন্ত হল। কী করে রেহাই পাবে এটা ভাবতেই সে চুপ করে রইল। 

কিন্তু গলাটা চেনা চেনা তো বটেই। মাঝখান দিয়ে বাইশটা বছরের স্রোত গড়িয়ে চলে গেলেও এই গলাটা এখনও ভোলে নি সে। লোকটার কথায় গা-টা তাই চিড়বিড় করে উঠল নন্দিনীর। মনে হচ্ছে অনেক দিন পরে আবার সে এসেছে। আর আশ্চর্য তাকেই খুঁজতে এসেছে। কিন্তু যা হবার তা হয়ে গেছে। আবার নতুন করে খুঁচিয়ে ঘা করে কী হবে? একদিকে তার মনের তীব্র বিতৃষ্ণা আর অন্যদিকে এই দুর্যোগে লোকটির অসহায়তা। এ যেন কুয়ো আর খাদের মধ্যে যে কোনও একটাকে বেছে নেওয়ার আমন্ত্রণ নন্দিনীর কাছে।

আলো জ্বালার বদলে কয়েক পা এগিয়ে দরজার সামনে দাঁড়াল সে। ছিটকিনিটা টান মেরে খুলে দিয়ে বলল, দেখে আর কী হবে? একটু পরেই ঝড়বৃষ্টি থেমে যাবে। আশা করি যেতে আপনার অসুবিধে হবে না।   

ছিটকিনি খুলতেই পাল্লটা শব্দ করে খুলে গেল। আর শব্দ করে ঢুকল একটা ঝাপটা। প্রবল বেগে। ঘরের অর্ধেক প্রায় জলে জলময় হয়ে গেল বলতে গেলে। সেই সঙ্গে ঢুকল বিদ্যুতের একটা ঝলক। সেই আলোতে আন্দাজ করে লোকটা একটু এগিয়ে ঝট করে দেওয়ালের সুইচ বোর্ডে পৌঁছে গেল।

--আমিই দিচ্ছি ম্যাডাম আলোটা জ্বেলে। আপনাকে আর কষ্ট করতে হবে না।

আলোয় মুহূর্তে আলোময় হয়ে উঠেছে ঘরটা। আলোটা পাশের দেওয়ালে হওয়ায় দুজনের মুখেই পড়েছে সমান আলো। হ্যাঁ, সেই লোকটা। আজ প্রায় বাইশটা বছর হয়ে গেলেও লোকটা দেখতে এতটুকু পালটায় নি। মাথার সেই ঘন কালো কোঁকড়া চুলের ঘনত্ব একটু কমেছে বটে। চারপাশের বড় বড় চুলগুলো মাথার মাঝখানের টাকটাকে গোপন রাখার একটা প্রাণপণ চেষ্টা করছে। চুলে কাঁচাপাকার মিশ্রণ। চামড়া সামান্য হলেও কুঁচকেছে।  

লোকটা যেন অবাক হয়ে নিরীক্ষণ করছে তাকে। তারপর বলল, একি তনু! লোকটা বলে উঠল, আমার নন্দিনী—   

লোকটার স্বরে আবেগ স্পষ্ট। কিন্তু যেন ফুঁসে উঠল নন্দিনী, ও নামে ডাকার আর কোনও প্রয়োজন দেখি না। আমি যে খারাপ মেয়ে সে তো জানই। যাকে তোমার বাবা মা—

কান্নায় গলা বুজে এল নন্দিনীর।

--জানি, মানে জেনেছি অনেক কষ্টে। খুঁজেছি প্রায় এই বাইশটা বছর কিন্তু পাই নি। লোকটা বলল। এবার যেন একটু সংকোচ কমেছে তার। সাহসের পরিমাণও বেড়েছে। কিন্তু নন্দিনীর একটা অস্বস্তি হচ্ছে। ভেবে পাচ্ছে না এই লোকটার হাত থেকে রেহাই কী করে পাওয়া যায়? আর এত বছর পরে কী উদ্দেশ্যেই বা এসেছে? দুজনেই তো যৌবনের শেষ প্রান্তে। আবেগ বা তাড়না কোনও কিছুরই তো আজ অবশেষ নেই। এখন প্রতুলের আসা বিশেষ এত খুঁজে খুঁজে আসা বেশ আশ্চর্যের শুধু নয় যথেষ্ট সন্দেহের। কথায় বলে হাতি দঁকে পড়লে চামচিকেকেও হাত ধরে টেনে তুলতে বলে। তবে প্রতুল আজ কি দঁকে পড়েছে? কোনও পুলিশ কেস ফেস নয় তো?

টেবিলের গায়েই মাঝারি ডাইনিং টেবিল। একটা চেয়ারে বসে প্রতুল বলল, দরজাটা খোলা রেখে অহেতুক ভিজছ তনু।

অতীত ভাবছিল নন্দিনী। সম্বিত ফিরতে বন্ধ করে দিল দরজাটা। বাইরের ঝাপটের দাপট একটু কমল। ঘরটাও একটু গরম হল। এই ঠান্ডা বাতাস প্রথম একটু স্বস্তি দিলেও এখন বেশ শীত করছে।

--বস না তনু? প্রতুল বলল, নাকি এখনও আমাকে সমান ঘৃণা কর? কিন্তু আমি যতদিন তোমার সঙ্গে ছিলাম ততদিন তো ভালবেসেই ছিলে। 

একটু দূরে একটা চেয়ারে বসে নন্দিনী বলল, এতদিন পরে হঠাৎ কী মনে করে? বৌ ছেলেমেয়ে সুখের সংসার ছেড়ে –

--আমি বিয়ে করি নি সে খবর পাও নি বুঝি? তোমার সঙ্গে ডিভোর্স তো হয় নি এখনও অবধি। তাই বিয়ে করার প্রশ্ন ওঠে কী করে?  

--ওসব খবর নেবার চেষ্টাও করি নি। প্রতুলের কথায় নাকমুখ কোঁচকাল নন্দিনী।

নন্দিনীর দিকে তাকাল প্রতুল। যৌবনের জোয়ার স্তিমিত হয়ে এসেছে তার দেহে। সেটাই স্বাভাবিক। এখন হল সাতচল্লিশ। তখনই বয়েস ছিল পঁচিশ। এক জোড়া দ্বিতীয় বন্ধনীর মত পাতলা ঠোঁট। মারাত্মক আকর্ষণ ছিল গলার তিলটা। নাকে একটা নাকছাবি পরত আর তাতে তার সৌন্দর্য বেড়ে উঠত বহুদূর।

প্রতুল ত্রকদিন নন্দিনীকে মেট্রোতে দেখে চমকে যায় রীতিমত। পোশাকে আশাকে খুব সাধারণ এক মেয়ে। বিশেষ রূপসী তো নয়। তবু সেই অদ্ভুত বৈশিষ্টের জন্যে পঁয়ত্রিশ বছরের অবিবাহিত প্রতুল প্রেমে পড়ে যায় তার। বিয়ের কথা বলে তার বাবাকে।

--মেয়েটা আমাদের জাতের নয় বাবা। একটা জাতধর্ম তো পালন করতে হবে নাকি? তাতে আবার গরিব ঘরের। বাবার এই আপত্তিকে পাত্তা দেয় নি প্রতুল। রেজিস্ট্রি করে নিয়েছিল। বাবা মা বিশেষ ঝামেলা পাকায় নি দেখে আশ্বস্ত হয়েছিল বেশ। বিয়ের পর কেরালায় মধুচন্দ্রিমা হয়েছিল। একঝাঁক সুখের শিকারায় ছুটির ক’টা দিন কেটে গিয়েছিল বেশ মজা করে।

বিয়ের পর কুড়ি দিনের মাথায় দেশের চাকরি ছেড়ে দুবাই চলে যেতে হল প্রতুলকে। কী করবে কেমিক্যাল ইঞ্জিয়ারদের তেলের দেশে খুব দাম। কিন্তু কন্ট্রাক্ট অনুযায়ী বছরে একবারের বেশি ফেরা যাবে না দেশে।

শ্বশুর শাশুড়ি বিশেষ পছন্দ করত না তনুকে। গরিব ঘরের মেয়ে। বিয়েতে তো কিছুই দিতে পারে নি। শিক্ষা যে একেবারে নেই তা নয়। গ্র্যাজুয়েট পাশ। তবু খুব নরম স্বভাবের নন্দিনী। ছেলের মুখ চেয়ে মানিয়ে নিয়েছে তারা।

নন্দিনীর বড় মন খারাপ। বিয়ের আগে প্রতুল বলেছিল বটে সে দেশের বাইরে একটা ভাল চাকরি খুঁজছে। বৌকে নিয়ে যাবে বলেও ভেবেছিল কিন্তু পাসপোর্ট ভিসা এসব করতে যা সময় লাগে সেটা পেল না প্রতুল। বাবা বলল, আরে তনু তো আর জলে পড়ে যাচ্ছে না।

--হ্যাঁ আমরাই ওর দেখাশোনা করব। তুই কী তোর বৌয়ের জন্যে অমন ভাল চাকরিটা হাতছাড়া করবি বাবা?

পরম নিশ্চিন্তে তিনমাস বিদেশে কাটল প্রতুলের। প্রতিদিন প্রায় খবর পায় নন্দিনীর। একদিন বৌয়ের প্রেগন্যান্সির খবরও এল। খুব খুশি। তারপর আরও একদিন এল ডেলিভারির। একটা মৃত ছেলে প্রসব করে পাগলের মত হয়ে গেছে নন্দিনী।

কোম্পানী বলল, দেশে যেতে তুমি পার। তবে রেজিগনেশন করে। তোমার একমাস অনুপস্থির জন্যে কোম্পানীর যা লস হবে কোম্পানি তা বিয়ার করতে চায় না।

এক বছর হতে বাকি ছিল মাত্র দিন পনের। তর সইল না প্রতুলের। চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে চলে এল দেশে। নন্দিনী ভাল থাকলে বিদেশে না হোক দেশেই জুটবে অনেক চাকরি।

কিন্তু নন্দিনী তো বাড়িতেই নেই। মা বলল, প্রথমে বুঝতে পারি নি বাবা এত নষ্ট মেয়েটা। একটা ছেলের সঙ্গে ভেগে পড়েছে বাবা।

বিশ্বাস অবিশ্বাসের একটা দ্বন্দ্ব। মন ভেঙ্গে যাওয়ার রাগ আর অভিমানে মাথা প্রচন্ড গরম হল প্রতুলের। যাক যার সঙ্গে ওর পোষায় তার সঙ্গেই থাকুক। ওর ঠিকানায় একটা ডিভোর্সের ফর্ম পাঠিয়ে দিয়ে বলেছিল, চাইলে এতে সই করে দিতে পার। যা খোরপোষ চাইবে দিয়ে দেব।  

কিন্তু জবাব আসে নি। ফর্ম ফেরত এসেছিল। উদ্বিগ্ন প্রতুল ছুটে গিয়েছিল সে ঠিকানায়।

--না না সে তো এখন থাকে না এখানে। দাদুর সঙ্গে কোথায় চলে গেছে। বাড়িওলা বলল, শুনেছি ওর শ্বশুর বাড়ি থেকে ওকে তাড়িয়ে দিয়েছে। কি আহাম্মক শ্বশুর শাশুড়ি বলুন তো। অমন সুন্দর একটা মেয়েকে কেউ বাঁজা বলে তাড়িয়ে দেয়? আর ওর বরটাই বা কেমন? শুনেছি বাইরে থাকে। বছর কেটে গেল একবারের জন্যেও খোঁজ করে নি বৌটার। যতসব পাজি নচ্ছার লোকজন।

চোরের মত মাথা নিচু করে দাঁড়িয়েছিল প্রতুল। ভদ্রলোক ঝাঁঝিয়ে উঠলেন, তা আপনি কে মশায়? এতদিন পরে খোঁজে এসেছেন?

মানে মানে কেটে পড়ল প্রতুল। এর কিছুদিন পরেই আবার দুবাইতে ডাক পড়ল তার। কাজের লোককে কি তারা ছাড়তে পারে এত সহজে? প্রতুল ভাবল এই বেশ। তার ছাই হয়ে যাওয়া সংসারটার ওপর তাকে আর বসে থাকতে হবে না। কিন্তু যাবার আগে নন্দিনীর ওপর তার বাবা মায়ের অত্যাচারের কথার তদন্ত করে গেল ভাল করে।

সেই থেকে কেটে গেছে আজ প্রায় বাইশ বছর। মাত্র সাতান্ন বছরেই রিটায়ারমেন্ট নিয়ে নিয়েছে প্রতুল। কোথা থেকে কী একটা সূত্রে খবর পেয়েছে নন্দিনী এখন এই শহরে একটা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ায়। পুরুলিয়ার এক স্কুলে। ওর দাদুর দেশের বাড়ি। লোকটা মারা গেল এখানে আসার বছর দুয়েকের মধ্যেই। সেই থেকে নন্দিনী একা বাস করছে এখানে।

এই গল্পটা ছিল প্রতুলের এক তরফা। বাকি অর্ধেক শোনাল নন্দিনী। তার প্রিয়া তনু। ছেলের জেদে বিয়েটা মেনে নিলেও মনে মনে মেনে নিতে পারে নি তার বাবা মা কেউ। এমন মেয়ে কি তাদের স্ট্যাটাসের উপযুক্ত? অছিলা খুঁজছিল তাকে সরাবার। প্রতুল দুবাইয়ে চলে যাবার পর সুযোগ মিলল। ঠিক ছিল মেয়ের যদি ছেলে বাচ্চা হয় তো নাহয় তাকে রেখে দেবার কথা ভাবা যাবে। তাই তাকে জানতে না দিয়ে বেআইনি ভাবে তার সোনোগ্রাফি করান হয়।  

মেয়ে হবার খবরে নিশ্চিত হয়ে তার গর্ভপাত ঘটান হয়। ডাক্তারকে দিয়ে তাকে জানানো হয় তার বাচ্চা খুব সংকটে। প্রতুলকে ফোন করতে চেয়েছিল নন্দিনী। কিন্তু বাবা মা মিথ্যে বলেছিল যে এটা প্রতুলের নির্দেশেই করা হচ্ছে। তার মোবাইল কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। মোবাইলে নাকি ইনফেকশন হতে পারে।

প্রতুল হতবাক গল্পের দুটো অংশকে জুড়ে দিয়ে এক করতে গিয়ে। বলল, তুমি বিশ্বাস কর তনু। আমি এসব কিছুই বলি নি। তোমাকে ফোন করার অনেক চেষ্টা করেও পাইনি। ফোন বার বার কেটে দেওয়া হচ্ছিল। তারপর যখন বলা হল তুমি অন্য একজনের সঙ্গে চলে গেছ আমাকে ছেড়ে—

শান্ত হয়ে এসেছে নন্দিনীর মনটা। বাস্পরুদ্ধ স্বরে বলল, তুমি এটা বিশ্বাস করতে পারলে? তোমার নন্দিনী এমন করতে পারে?

--উপায় ছিল না তনু। তোমার ঠিকানাতেও আমি পাই নি তোমাকে। তুমি তখন দেশের বাড়িতে দাদুর সঙ্গে চলে এসেছিলে। আমি তো কিছুতেই এই ঠিকানা পাই নি। ভাবলাম যদি তুমি অন্য কাউকে নিয়ে তুমি সুখে থাকতে পার তো—

সেই ডিভোর্স পেপার নন্দিনীর ঠিকানা থেকে নট ফাউন্ড বলে ফেরত এসেছিল। সেটা ফেরত আসার আগেই বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিল প্রতুল। আবার দুবাইতে কাজের ডাকে।

--আমাদের জীবনগুলো তছনছ হয়ে গেল। শুধু বাবা মায়ের ছল চাতুরিতে। আচ্ছা নন্দিনী এই মা-ই কি আমাকে পেটে ধরেছিল? এই বাবা-ই কি স্নেহ দিয়ে আমাকে প্রতিপালন করেছিল?

এখন আর প্রতুলের ওপর কোনও রাগ নেই নন্দিনীর। প্রতুলের বুকে মুখ গুঁজে শুধু বলল, কিচ্ছু হারায় নি গো। যা হারিয়েছে তা হল দুজনের যৌবন। কিন্তু ভালবাসা নয়।

দুজনে দুজনকে জড়িয়ে ধরেছে প্রবলভাবে। বিগতযৌবন দুই নারী-পুরুষ আজ এই দিনে একজন আর একজনের পরম অবলম্বন হয়ে উঠেছে।

বাইরে তখনও প্রবল ঝড়। শীতল এলোমেলো বাতাসের দাপট। ঘরের মধ্যেও একটা ঝড়। সে ঝড় উষ্ণ। আবেগে উষ্ণ।

chattopadhyayarun@gmail.com
হুগলি

No comments:

Post a Comment