1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Thursday, July 1, 2021

বোধন

 

ছবি  : ইন্টারনেট

বোধন

বুমা ব্যানার্জী দাস


       সকাল থেকে ঘন মেঘে ঢেকে আছে আকাশ। পাহাড়ের উপর দিয়ে ফুলে ফুলে আসছে গুহার দিকে। হয়তো বেশ কিছুদিন শিকারে যাওয়া যাবেনা। ইব্বাই অন্ধকার হওয়ার আগে ধাজ্জুকে খোঁজার চেষ্টা করলো। দলপতি বেখেয়াল হয়ে গেলে খুব মুশকিল। আজ বেশ কটা চাঁদ পেরোলো ধাজ্জু স্বাভাবিক আচরণ করছেনা। এই যে এরকম বৃষ্টি আসছে, খাবার, ঘাস যথেষ্ট আছে কিনা এগুলো তো তারই দেখার কথা। তা না করে, গুহার একেবারে ভিতরে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে সে কী করছে জানেনা ইব্বাই। গিয়ে দেখে আসাও বারণ। দলপতির কথা অমান্য করার সাহস কারুর নেই, ইব্বাইয়েরও না। কিন্তু অন্ধকার হয়ে এসেছে। আকাশ চিরে উজ্জ্বল নীল আলো পাহাড়ের এপার থেকে ওপার যেন কেটে ফালা করে দিয়ে যাচ্ছে। সঙ্গে কান ফাটানো আওয়াজ। আগে খুব ভয় করতো ইব্বাইয়ের। এখন আর তত করেনা।

        একরাশ পশুর চামড়া শুকোতে দিয়েছিল রোদে। সেগুলো গুহার ভিতর তুলে নিয়ে এলো। বেশ কিছুদিন হলো তাদের দল এই পাহাড়ে এসে উঠেছে। অনেক গুহা এখানে। সব কটা এখনো দেখে উঠতে পারেনি ইব্বাই। এখানে শিকার মেলে সহজে। অফুরন্ত জল পাওয়া যায় পাহাড়ী ঝরনাগুলো থেকে। পাথর গোল করে সাজিয়ে তার ভিতর ধাজ্জু আগুন জ্বেলে দিয়েছিল নিপুণ হাতে। তখন এরকম উদাস আনমনা ছিলনা সে। প্রাণশক্তি যেন ছড়িয়ে পড়ত তার সারা শরীর থেকে। দুই হাতে বল্লম ধরে ছুঁড়ে দিত নীলগাই কী বুনো বরাহের দিকে। এক আঘাতে কাত হয়ে পড়ত জন্তুগুলো। একদিন মাটি খুঁড়ে কী এক কালো মত পিন্ড পেল ধাজ্জু, তারপর যে কী হল তার। দলে ভালো শিকারী অনেকেই আছে, এই তো খেক, ধাগ, ব্রুরক এরা সবাই ষন্ডা, ইব্বাই চাইলেই তারা তাদের সেরা শিকার তার হাতে তুলে দিতে দ্বিধা করবে না। কিন্তু এরা কেউ ধাজ্জু নয়। হালকা একটা হাসি খেলা করে তার মুখে। 


নাহ্ উঠতে হবে, আকাশ ভেঙে জল নেমেছে। দলে অনেকগুলো বাচ্চা আছে। তাদের শুকনো একটা গুহা দেখে ঢোকাতে হবে। আরে – হঠাৎ চমকে ওঠে ইব্বাই। ধাজ্জু কখন এলো। নিভে যাওয়া আগুনের কুন্ডে কী যেন খুঁজছে না ধাজ্জু? পুড়ে যাওয়া কিসব হাতে তুলে দ্রুত গতিতে আবার গুহায় ঢুকে যায় সে। ডাকার সময় পর্যন্ত পায়না ইব্বাই। এবার বড়ো বিরক্ত লাগে তার। ছায়ার মত অনুসরণ করে ধাজ্জুকে। হোক বারণ, তাও একবার দেখা উচিত ব্যাপারটা।


 এক গুহা থেকে আর এক গুহা, আর কত ভিতরে যাবে- অন্ধকারে ভালো দেখাও যায়না। হঠাৎ আলো চোখে লাগে তার। সেকি - গুহার ভিতরে আগুন জ্বেলেছে ধাজ্জু? কেন? আর এক পা এগিয়েই পাথর হয়ে যায় ইব্বাই। এ কী দেখছে সে- গুহার দেওয়াল জুড়ে কী করেছে ওগুলো ধাজ্জু !! কি উজ্জ্বল লাল রং -ওটা -ওটা তো একটা হরিণ বলে মনে হচ্ছে। ঠিক যেন জ্যান্ত।শিং উঁচিয়ে গর্বিত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে কতগুলো লম্বা লম্বা দাগ,উপরদিকটা গোল। যেন  খেক, ব্রুরক, ধাজ্জু ওরা নিজেরাই হরিণ শিকার করছে। এসবের মানে কী! গুহার মেঝেতে চোখ পড়ে ইব্বাইয়ের। কত কী ছড়ানো চারপাশে। আগুনের পাশে সেই যে পিন্ডটা খুঁড়ে পেয়েছিল সেটা সবার মাঝখানে রাখা, ঘষা খেয়ে একদিকটা প্রায় সমান হয়ে গেছে। আরে ওটা ঘষে ওরকম লাল রং বেরোয়। তার পাশে খানিক কাদার তাল আর গলানো পশুর চর্বি রাখা। কী হবে ওগুলো দিয়ে? তার বিস্ফারিত চোখের সামনে ধাজ্জু হাতে তুলে নেয় একটা পোড়া হাড়। পাথর দিয়ে একদম মিহি করে গুঁড়িয়ে নেয় সেটা। তারপর হাতে তুলে নেয় একটা ছোটো কাঠি ,কোনও গাছের সরু ডালের টুকরো হবে হয়ত। এবার কী করছে ধাজ্জু? হাঁ করে দেখতে থাকে ইব্বাই। আলো পড়েছে ধাজ্জুর কপালে, মাথায়। কেমন যেন অন্যরকম দেখায় তাকে। এ যেন এতদিনের চেনা ধাজ্জু নয়। সরু কাঠিটার মাথায় এক গুচ্ছ পশুর লোম যত্ন করে বেঁধে নেয় ইব্বাই। তারপর সেই হাড়ের গুঁড়ো গলানো পশুর চর্বিতে মিশিয়ে খুব সাবধানে তুলে নেয় কাঠির মাথায় বাঁধা পশুর লোম দিয়ে। চোখের কাছে এনে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে সেটা। একবার গুহার মুখের দিকে চোখ পড়ে ধাজ্জুর। লহমায় চমকে পিছিয়ে যায় ইব্বাই। কিন্তু তার দরকার ছিল না। ধাজ্জুর চোখ গুহার মুখে পড়লেও সে চোখের দৃষ্টি যেন অন্য কোথাও। ধীর পায়ে এগিয়ে যায় ধাজ্জু গুহার গায়ের হরিণটার দিকে। হরিণের মাথার কাছে আলতো করে ছুঁইয়ে দেয় সেটা। দুই হাত দিয়ে নিজের মুখ চেপে বিস্মিত চিৎকার আটকায় ইব্বাই। গুহার দেওয়ালে তখন হরিণের চোখ জ্বলজ্বল করে উঠেছে।

গুহাবাসী মানুষের সভ্যতার দিকে হয়ত বা প্রথম পদক্ষেপ। পেট ভরানোর জন্য শিকার, আশ্রয়ের জন্য গুহা, শীতের হাত থেকে বাঁচার জন্য পশুর লোমশ চামড়ায় বানানো পোশাক বা হিংস্র প্রাণীর হাত থেকে বাঁচার জন্য আগুন জ্বালানো - এসবের নিতান্ত প্রয়োজনের বাইরে ভাবতে শেখার সেই বোধহয় শুরু। সভ্যতার বোধন মুহূর্ত।

১৯৫৭ সালে রোমাঞ্চিত প্রত্নতত্ত্ববিদ ডক্টর বিষ্ণু ওয়াকাঙ্কর ভীমবেটকা গুহাচিত্র আবিষ্কার করেন। অবিশ্যি ধাজ্জুর কথা কেউ জানতে পারেনা। মানবসভ্যতা তো নাম লিখতে শেখেনি তখনও। যেমন ধাজ্জু জানতনা তার লাল রং বের করার পিন্ডটিকে বলে হেমাটাইট।

banerjee.buma@gmail.com
কানাডা

No comments:

Post a Comment