1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Thursday, July 1, 2021

ফুড কুপন

 

ছবি  : ইন্টারনেট


ফুড কুপন   

ঋভু চট্টোপাধ্যায়

সোফাতে বসেই সুশোভন একবার চারদিকটা দেখে নিল।এই দু’দিন সকাল থেকে খুব পরিশ্রম হচ্ছে।যেটা ভাবা হয়েছিল পরিশ্রম হল তার থেকে অনেক বেশি।সন্ধে হবার একটু আগে পর্যন্ত চারপাঁচটা পরিবার এসেছিল।সুশোভনের স্ত্রী তুষ্টি তাদের  জানায়,‘আপনারা কষ্ট করে একবার আগামীকাল আসুন, আজ কুপন দিলেও কিছু হবে না।আগামীকাল সকালে দোকান খুললে সব কিছু কিনে নেবেন।’ 

সবাই বেরিয়ে যাবার পরে তুষ্টি উপরের ঘরে লম্বা হয়ে কিছু সময় শুয়ে থাকে।নিচে আসতেই সুশোভন জিজ্ঞেস করে, ‘আচ্ছা আমাদের ঠিক কটা কুপন আছে বল তো?’ 

–কটা বলতে, এক হাজারের চারটে, পাঁচশ’র ছটা, আর পনেরো’শর দুটো আছে। 

-তারমানে দু’দিন ধরে পঁচাত্তর হাজার টাকার কুপন বিলি হয়ে গেছে।কাল একবার ভোম্বলদার হোটেলে যেতে হবে।ওখানে আজ দুপুর অবধি ক’জন খেলো দেখতে হবে।কাল পর্যন্ত আশিটা প্লেট হয়েছে। 

-ভোম্বলদা বেশি করে দেখাবে না তো ?

-না না, আমাকে তো কাল বলছিল,‘পুদি, এটা তুই না হয়ে অন্য কেউ হলে আমি বাড়িয়ে লিখতাম।কিন্তু তুই যা করছিস অনেক কোটিপতিরা লোক এমন করে না।তোর মন আছে বলতে হবে।’ যাইহোক প্লেটে ও নিজের থেকেই পাঁচ টাকা কম নিচ্ছে।

ফোনের রিঙ্গটা বেজে উঠতে সুশোভন এগিয়ে ফোনটা রিসিভ করে।উল্টো দিক থেকে একটা গম্ভীর গলায় শোনা যায়,‘সুশোভন বাবু বলছেন?’ 

এদিকে ‘হ্যাঁ।’ শুনেই তাদের কাজের প্রশংসা করে বলে ওঠে,‘আপনার সাথে একটু দেখা করতে চাই।মানে আমরাও আপনাদের মাধ্যমে কিছু দিতে চাইছি।অবশ্য আপনারা যদি রাজি থাকেন।’ 

সুশোভন,‘ঠিক আছে আপনার সাথে কালকে কথা বলব।’ বলে ফোনটা রাখার কিছু সময়ের মধ্যেই আবার ফোনটা বেজে ওঠে।আরেক জন ফোন করে বিভিন্ন কথা জিজ্ঞেস করে।সুশোভন সব কথার উত্তর দিয়ে ফোনটা রাখে।তুষ্টি একটু অবাক হয়ে ‘কি হয়েছে?’ জিজ্ঞেস করতেই সুশোভন ফোনের কথাগুলো বলে।তুষ্টির মাথাটা গরম হয়ে যায়।একটু রেগেই উত্তর দেয়,‘এবার ওদের ফোন এলে আমাকে দেবে তো।এরা এতদিন সব কোথায় ছিল।এই সব মানুষগুলোর দিকে একবার চোখ দিয়ে দেখবার কারোর সময় ছিল না।আজ বেশি কথা বলছে।’ কিছু সময় থেমে বলে, ‘সারাদিন খুব চাপ গেছে, মা ঠাকুর মন্দির থেকে এলেই রুটি করে খেয়ে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ব।তুমিও এখন কোথাও যেও না।চা মুড়ি খেয়ে একটু ঘরে বসে থাকো, দু’দিন অনেক পরিশ্রম হচ্ছে।’ 

সুশোভন একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে শোফাতে বসে থাকে।ঠিক এক সপ্তাহ আগে তুষ্টি তার স্কুলের গ্রামে যায়।এমনিতে সরকারি ভাবে স্কুল বন্ধ থাকলেও তুষ্টি প্রায় প্রতিদিন তার নিজের স্কুলে গিয়ে ছাত্র ছাত্রীদের সাথে দেখা করে খাতা পেন থেকে আরম্ভ করে যার যা প্রয়োজন সব কিছু দেবার চেষ্টা করে।স্কুলে দেখা না পেয়ে ছাত্র ছাত্রীদের বাড়ি বাড়িও ঘুরেছে।তখনই এক ছাত্রীর বাড়িতে কিছু পড়া দেখানোর সময় ছাত্রীর মায়ের চরম অস্বস্তি তুষ্টির নজরে আসে।বারবার বলতে আরম্ভ করে,‘দিদিমণি আপনি নিজে এসেছেন, কিন্তু দেখুন আপনাকে বসতে দেবার মতো একটা চেয়ার বা টুল কিছুই নেই।’ 

তুষ্টি নিজেই মাটিতে বসে ছাত্রীটিকে পড়া দেখাতে থাকে।কিছু সময় পরে ছাত্রীটির মা আবার তুষ্টির সামনে এসে বলেন,    “দিদিমণি বলতে খুব খারাপ লাগছে, কিন্তু আপনাকে এক কাপ চা পর্যন্ত খাওয়াতে পারবো না।ওর বাবা কাজের খোঁজে গেছে, ফিরলে চাল ডাল আনাবো।যা ছিল আজ অবধি হয়ে শেষ গেছে।সবই তো বুঝতে পারছেন, বড় সংসার স্কুল আর রেশন থেকে কত আর চাল পায়, এই অবস্থাতে ওর বাবারও কাজ নেই।আজ বলল,‘বাগানের কাজ পেলেও করবে।’ এখন দেখা যাক।” 

তুষ্টি কথাগুলো একমনে শুনে সেই ভদ্রমহিলার মুখের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল,‘শুনুন, আপনাকে এক্কেবারে ব্যস্ত হতে হবে না।আমি এসেছি আমার ছাত্রীকে পড়াতে, তার বাড়িতে চা খেতে নয়।’ 

রাতে কথাগুলো সুশোভনকে বলতে সেই রাতেই দু’জন মিলে সিদ্ধান্ত নেয়।তারপরের দিনেই বাজারের একটা মুদিখানার দোকানের সাথে কথা বলে টাকা জমা করে।কোন কুপনের জন্যে কি কি জিনিস দিতে হবে সেটাও একটা লিস্ট দিয়ে যায়।সবাইকে একই জিনিস শুধু কুপনের টাকার পরিবর্তনে জিনিসের পরিমাণের পরিবর্তন হয়েছে।দুজন এরপর কয়েকটা দিন ধরে আশেপাশে ঘুরে কার কি রকম অর্থনৈতিক অবস্থা সে ব্যাপারেও একটা লিস্ট তৈরী করে।তারপরে সেই লিস্ট ধরে ধরে সবার বাড়ি বাড়ি ঘুরে কুপন দিয়ে আসে।কুপনের টাকার পরিমাণ মত জিনিস সবাই লাইন দিয়ে নির্দিষ্ট দোকান থেকে নিয়ে নেয়।এই পুরো টাকাটাই তুষ্টি ও সুশোভন তাদের নিজের পেমেন্টের জমানো টাকা থেকে দেয়। 

সুশোভন অন্যদিকে একটা হোটেলে টাকা দিয়ে আশেপাশের সব ভবঘুরেদের খাওয়ার ব্যবস্থা করে।সব মিলিয়ে ছোট্ট শহরটাতে একটা আলোড়ন ওঠে।সবাই এই শিক্ষক দম্পতির কথা আলোচনা করতে আরম্ভ করে এমনকি সেই দিনেই বিকালের দিকে বিভিন্ন নিউস পোর্টালে এই নিয়ে খবরও হয়।পরের দিন প্রায় সবকটা বাংলা ও ইংরেজি খবরের কাগজে সুশোভন ও তুষ্টিকে নিয়ে খবর প্রকাশিত হয়।বিভিন্ন জায়গা থেকে সুশোভনদের বাড়িতে লোকজন দেখা করতে আসে। একটা সংবর্ধনা সভাতে দু’জনকেই আসার জন্যে আমন্ত্রণ করে।

সুশোভন ও তুষ্টি দু’জন বিকালের দিকে ঐ সভাতে যায়।দু’জনকেই একটা করে মিষ্টির প্যাকেট সহ বেশ কিছু জিনিসপত্র দেওয়াও হয়।কিন্তু বাড়ি ফিরতেই একটা ফোনে সুশোভন চমকে ওঠে।ওপাশ থেকে একজন খুব মিষ্টি করে বলে,‘স্যার এই রকম প্রচারের জন্যে এই সব নাটক নাই বা করলেন।তারপরে আবার বিরোধী পক্ষের মিটিংএ গিয়ে সংবর্ধনা নিচ্ছেন।একটা কথা ভুলে যাবেন না, আমরা কিন্তু এখনও ক্ষমতায় আছি।আর আপনার মিসেস বাড়ির কাছের স্কুলে  চাকরি করলেও আপনি তো এখনও সেই আশি কিমি দূরেই পোস্টিং, আমরা ছাড়া তো কোন বিরোধী পক্ষ এই ব্যাপারে আপনাকে কোন সাহায্য করতে পারবে না।’ 

কথাগুলো শুনে সুশোভন একটু অবাক হলেও কিছু সময় কিছু কথা বলতে পারে না।কথাগুলো সত্যিই।তাকে প্রতিদিন দু’শ কিমি যাতায়াত করে স্কুল করতে হয়।তার উপরে হেডমাস্টার গোস্বামী বাবু ছিলেন খুব পাজি।কোন কথা শুনতেন না বুঝতেনও না।এক মিনিট দেরি হলেও এমন কথা শোনাতেন যেন স্কুলটা ওনার বাবার বাড়ি, আর এই সমস্ত টিচার সবাই ওনার বাবার ঘরে কাজ করে।তার উপর নিজে কোন দিন ভালো করে স্কুল করতেন না।কাঁধে একটা ব্যাগ ঝুলিয়ে বেরিয়ে পড়তেন।মুখে শুধু সংগঠন, দাবি আদায় এই সব বাজে বকা।সুশোভনকে বাড়ি থেকে প্রথমে বাইকে চেপে স্টেশন,ওখান থেকে ট্রেন তারপর বাস, বাস থেকে নেমে সাইকেল, এতো কিছু করে তবে স্কুল পৌঁছাতে হয়।এই রকম অবস্থা আরো অনেকের  ছিল, কিন্তু বেশির ভাগ জন কোন এক গোপন অর্থনৈতিক বোঝাপড়ার মাধ্যমে নিজের পছন্দ মত স্কুলে বদলি নিয়ে চলে আসে।পড়ে থাকে সুশোভনের মত কিছু অভাগা।অনেকেই সুশোভনকে টাকা দিয়ে ট্রান্সফারের চেষ্টা করতে বললেও ও নিজে রাজি হয় নি।জীবনে কোন কিছুতেই টাকা দেয় নি, সেখানে বদলির জন্যে টাকা দেবে!এটা ভাবাও পাপ।যখন অসুবিধা ছিল তখনও কিছু করল না, এখন তো গোস্বামী বাবু রিটার্য়াড হয়ে গেছেন।সুশোভন স্কুলের হেডমাস্টার না হলেও স্কুলের পুরো কাজ কর্ম তার হাত দিয়েই হয়।এখন আবার সব কাজ অন লাইন, আর এই কাজে স্কুলের বাকিরা এক্কেবারে জয় মা।এই সময় কিছুটা হলেও সুশোভন এই সুযোগটা নেয়।স্কুলে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সংগঠনের চাঁদা নিতে আসে।কিছু বললেই ট্রান্সফারের কথা বলে।সুশোভন শুধু হাসে।

কিন্তু ফোনের ওপারে এই ভদ্রলোক কে হতে পারে? ভদ্রলোক কিছু সময় চুপ থেকে আবার বলে ওঠেন,‘তারপর ধরুন আপনি যে এত বড় একটা কাজ করলেন আমরা না বললে তার জন্যে কোন স্বীকৃতিও পাবে না।সব সরকারি পুরস্কার তো আমাদের রেকমণ্ডেসেনই হয়।’ 

এবার সুশোভনের হাসি পায়।হাসতে হাসতে উত্তর দেয়,‘শুনুন, আমার বাবা কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে কাজ করতেন।এখনও যে’টাকা পেনেসেনে পান আপনাদের সরকারের কল্যানে আমার পেমেন্ট তার ধারে কাছে পোঁছায় নি।এর আগে আমার বাবা  অনেককে অনেক ভাবেই সাহায্য করেছেন।এখন আমি চেষ্টা করছি মাত্র।আমার মিসেসও করছে।কিন্তু বিশ্বাস করুন কোন দিন পুরস্কার পাবো এই ভাবনা থেকে কিছু করিনি, এবং ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি আমার এই ভাবনাও যেন কোন দিন না হয়।আপনার যদি প্রয়োজন হয় নিজের নামটাই রেকমেণ্ড করুন, আর নিজের যদি কোন ফুড কুপন লাগে তবে আনায়াসে আজ রাতে বা কাল সকালে চলে আসতে পারেন।’ 

শেষের কথাগুলো বলেই সুশোভন ফোনটা কেটে দেয়।

সুশোভনের মা তখনই মন্দির থেকে বাড়ি ফিরে আসেন। সুশোভনের সব কথাগুলো শুনে বলে ওঠেন,‘আজ বিকালে তোর বাবাকে, সুদীপদা খেলার মাঠের কাছে অনেক কথা বলছিল।তুই আগে ওদের দলের কাজে যেতিস এখন নাকি প্রচারের জন্যে এইসব কাজ করছিস।’ 

সুশোভন মুচকি হেসে উত্তর দেয়,“সুদীপ কাকু গতকাল পঁচিশজনের নামের একটা লিস্ট এনেছিল।আমি তখন গজুদার বাড়িতে এই ফুড কুপনগুলো বাছছিলাম।আজ দেখব বলেছিলাম।ওনার মন ভরল না।ভাবল হয়ত দেবো না।তাই ফিরে চলে গেল।আজ এসব কথা বলছে।আমাকে দেখা হলে বলে,‘ভাইপো আমাদের আমলে চাকরি পেয়েছ, এই আমলে আর পেতে না।সবই বুঝছো, এখন রেট বেঁধে দিয়েছে।পাটি ফাণ্ডে এত টাকা, ছোট নেতা এতটাকা....’ আমি দু’বার জবাব দিলাম,        ‘পোস্টিংটার তো একদম পি মেরে দিয়েছ, চাকরি পেলে উঠতে বসতে গাল দিচ্ছি।” 

–তুই বাবা এই সব কুপন টুপন ছাড়।যদি সাহায্য করবার প্রয়োজন হয় সোজা কোন সেবা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে তাদের মাধ্যমে দে।এখানকার লোকজন এক্কেবারে ভালো নয়।কাউকে কিছু দিবি তাতেও পার্টি।  

সুশোভনের মায়ের মুখে কথাগুলো শুনে তুষ্টি সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দেয়, ‘শোনো মা, এরা সব এমনই লোকজন, তুমি যা করবে তাতেই বিরোধীতা করবে, বাদ দাও।এই মাসে এই কয়েকটা কুপন বেঁচে আছে, সামনে মাসে আবার দেখবো।’ 

–মা, বাবা কই গো? 

–কে জানে সেই তো দুপুরে বেরিয়েছে।বিকালে একবার কয়েক মিনিটের জন্যে এসে চা খেয়ে ঐ কয়েকটা কথা বলে আবার কোথায় চলে গেল।একবার ফোন করে দেখ তো। 

সুশোভনের কথাগুলো শেষ করবার সঙ্গে সঙ্গে বাইরে থেকে ‘বেটু..’ সুর তুলে সুশোভনের বাবা ঢোকে।

সুশোভনকে দেখেই বলে উঠে,“বেটুরে তোদের কথা এই শহরটার মোড়ে মোড়ে সবাই আলোচনা করছে।আমাকে বলছে,‘তোমার আর কি, টাকা পয়সা পেয়েছ, এখন একটু নাম কিনলেই হয়ে গেল।এবার ভোটে দাঁড়াবে।’ আমি কিছু উত্তর দিই না।” 

কিছু সময় থেমে আবার বলে ওঠে, ‘তুই এই সব ছাড়।আমিও কিছু টাকা দিচ্ছি, কোন একটা আশ্রমে গিয়ে টাকা বা চাল যা লাগে দিয়ে আয়।’  

পরিবেশটা আচমকা খুব নিস্তব্ধ হয়ে গেল।একটা ভালো কাজে যে এতটা সমালোচনা আসবে কোন দিন ভাবে নি।চারজন বসে থাকলেও কেউ কোন কথা বলছে না।এমন সময় দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজ পাওয়া গেল।সুশোভনের মা উঠে গিয়ে দরজা খুলতেই দেখল বাইরে ছেলে মেয়ে মিলে দশ বারো জন দাঁড়িয়ে আছে।সুশোভনের মাকে দেখেই একজন বলে উঠল “ও, কাকিমা, তুমাদের ঘর থেইকে চাল ডাল দিছে, আমাদের দিবে নাই।আমরাও খুব গরিব বটি গো।জানতোম নাই, তাই আইসতে পারি নাই।” 

সুশোভনের মা তখন বাকি সবার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।

wribhuwriter.dgp@gmail.com
পশ্চিম বর্ধমান

No comments:

Post a Comment