1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Wednesday, October 6, 2021

বসন্তপুরের বাস্তুভূত

 

ছবি : দিব্যেন্দু গড়াই
বসন্তপুরের বাস্তুভূত
                                                         দিব্যেন্দু গড়াই

-‘স্যর, এবারের মত ছেড়ে দিন স্যর। আর করবো না স্যর। মরে যাব স্যর। পিলিজ স্যর।’

পাছায় হাত বুলোতে বুলোতে, তেড়েবেঁকে লাফাতে লাফাতে একনাগাড়ে বলে যাচ্ছিল নগেন। কান ধরে থাকার ইচ্ছে থাকলেও চুলকানির চোটে পারছে না ক্লাস এইটের রামবিচ্ছু নগেন পাল। উদোম গায়ে সে লাফাচ্ছে আর তার সামনে বেত হাতে দাঁড়িয়ে আছেন হেডস্যর রমাপদ ঘোষাল। যদিও হেডস্যরের হাতের বেত নগেনের গাত্রস্পর্শ করছে না। তবু নগেন কেঁদেকেটে একশা। আধঘন্টা আগে জামার ভেতর মৌমাছি ঢুকেছিল। কামড়ের চোটে জামা-টামা খুলে ফেলেছে। তবু মৌমাছির হাত থেকে রেহায় পায়নি। প্রতি কুড়ি সেকেন্ড অন্তর হাফপ্যান্টের ভেতরে কামড়ের ঠ্যালায় অস্থির হয়ে পড়ছে নগেন। জায়গাটা স্কুলদালানের বড়ঘড়ির সামনে না হলে এতক্ষণে ও হাফন্যাংটা থেকে ফুলন্যাংটা হয়ে যেত। দোষের মধ্যে নগেন হাফইয়ার্লি অঙ্ক পরীক্ষায় পাশমার্কস পায়নি আর হেডুর বেতের হাত থেকে বাঁচার জন্য গতকাল বিকেলে স্কুলের সব বেতগুলো নিয়ে বাথরুমে লুকিয়ে রেখেছিল। তার শাস্তি আজকের এই মৌমাছির অত্যাচার। আজ প্রার্থনাসঙ্গীত শুরু হওয়ার পরই প্রথম কামড় টের পায় নগেন। তারপর থেকে ক্রমশ বাড়ছে কামড়ের পরিমাণ। একমাত্র গ্যান্ডফাদার ক্লক বা বড়ঘড়ি ওকে বাঁচাতে পারে। আর কেউ নয়। তাই বড়ঘড়ির উদ্দেশ্যে আকুলিবিকুলি কান্না ছাড়া নগেনের পরিত্রাণ নেই। পাশে দাঁড়িয়ে অঙ্কের টিচার আর সঙ্গীত-রসিক হেডস্যর তাল-ছন্দের নিয়ম মেনে বেতটাকে বাতাসে আন্দোলিত করে চলেছেন। বসন্তপুর উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সকল শিক্ষক-ছাত্রকে অবশ্য অঙ্ক বা সঙ্গীত যে কোন একটা বিষয় সম্পর্কে জানতে হয়। এটাই নিয়ম। ওপর ওপর জানা নয়, ডুবুরির মত ডুব দিয়ে গভীরে গিয়ে জানা। তা নাহলে খুব মুশকিল।

মুশকিল আসে ভিন্ন ভিন্ন রূপে। বার্ষিক পরীক্ষার অঙ্কে কেউ ফেল করলে দিনসাতেক সে আমাশয় রোগে ভোগে। সরস্বতী পুজো উপলক্ষ্যে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে হারমোনিয়াম-তবলা বাজানোয় ভুলচুক হলে তার পাত আসার আগেই খিচুড়ি-আলুরদম শেষ হয়ে যায়। আর গানের সময় ভুল হলে তার শাস্তি গোরুর গুঁতো খাওয়া। 

এই কারণেই ছাত্ররা তো বটেই, শিক্ষকেরাও অঙ্ক আর সঙ্গীতের ব্যপারে খুব সতর্ক হয়ে থাকে। এইতো বছর দুয়েক আগে অঙ্কস্যর সর্বেশ্বর বাবু পাক্কা একমাস বিছানায় শুয়ে ছিলেন। শুধু শুয়ে ছিলেন বললে ভুল হবে। বাথরুমে বসে থাকা ছাড়া বাকি সময়টা শুয়ে ছিলেন। কোন ওষুধেই কিছু হচ্ছিল না। শেষে শ্বশুরবাড়ির সাহায্যে কোলকাতার এক ডাক্তারকে দেখানোর পর একমাসের মাথায় উনি সুস্থ হন। তবে বসন্তপুরের ছাত্র-শিক্ষকেরা দেখেছে সর্বেশ্বরবাবু একমাসের মাথায় স্কুলদালানের বড়ঘড়ির সামনে দাঁড়িয়ে বিড়বিড় করে কি যেন বলছিলেন আর দু কানের লতিতে আঙুল ঠেকাচ্ছিলেন। হাফইয়ার্লি পরীক্ষার অঙ্কের কোয়েশ্চন পেপারে একটা সমীকরণ ভুল ছিল। আর তাই ছাত্রদের ক্ষেত্রে যেটা এক সপ্তাহ লাগে, স্যরের ক্ষেত্রে তার স্থায়িত্ব ছিল একমাস।

তবে অঙ্ক অথবা সঙ্গীত। যে কোন একটা বেছে নিলেই হল। অঙ্কে মোটামুটি দখল থাকলে সে যদি সঙ্গীতের ‘স’ ও না জানে তাতে সাতখুন মাপ। আবার গান-বাজনায় পারদর্শী হলে অঙ্ক পরীক্ষায় সাদা খাতা জমা দিলেও চলে। তবে দুটোর কোনটায় আগ্রহ না থাকলে তার পক্ষে বসন্তপুর উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে টেকা দুষ্কর। খটখটে শুকনো দিনেও ঘনঘন সে পা পিছলে পড়ে, বেছে বেছে তার মাথায় ও জামায় পক্ষীকুল বিষ্ঠাত্যাগ করে। একবার তো ক্লাসরুমের ভেতর এক সদ্যাগত গানের টীচার নরহরিবাবুর মাথায় পায়রার গু পড়েছিল। সেদিন সকাল থেকে মোট সাতবার মাথা ধুতে হয়েছিল স্যর’কে। ফলে পরেরদিন মাথাব্যথা আর সর্দিতে কাহিল হয়ে নরহরিবাবু শরণাপন্ন হয়েছিলেন হেডস্যরের। ওনার কথামত স্কুলদালানের বড়ঘড়ির সামনে বিড়বিড় করে শেষঅব্দি নিস্তার পান নরহরিবাবু।

এমনিতে বসন্তপুর বেশ নিরুপদ্রব জায়গা। আমবাগান, বাঁশবাগান, নয়ানজুলি, ছোট্ট নদী বাসন্তী.... বসন্তপুরকে চারিদিক দিয়ে ঘিরে রেখেছে। এখানকার মানুষজনও বেজায় ভালো। খুব ছোটোখাটো চুরি ছাড়া আর কোন দুষ্কর্ম ঘটে না এখানে। থানার বড়বাবুও পারিষদসহ নিশ্চিন্তে দিন কাটান। কার বাগানের মাচা থেকে দুটো কুমড়োফুল চুরি বা সরস্বতী পুজোর সময় ফুলচুরি তো আর থানায় রিপোর্ট  করার মত অপরাধ নয়! তবে থানায় একবারই রিপোর্ট হয়েছিল। আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে। করেছিলেন বসন্তপুর উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠতা ও প্রথম হেডস্যর রাগানুজ সেনগুপ্ত।

*****

বাবা শুভঙ্কর সেনগুপ্ত ছিলেন অঙ্কের পন্ডিত আর মা সন্ধ্যারাগ সেনগুপ্ত রাগসঙ্গীতের ওস্তাদ। মা-বাবা দু’জনার যৌথ উদ্যোগে রাগানুজ ধীরে ধীরে দুটো বিষয়েই সমান দক্ষতা অর্জন করে। আশেপাশের পাঁচ-দশটা গ্রাম তো বটেই, কোলকাতাতেও নাম ছড়িয়ে পড়ে। নানান সন্মানে ভূষিত হন উনি ওনার জীবদ্দশায়।

অবিবাহিত রাগানুজ সেনগুপ্ত নিজের পৈতৃক ভিটেখানি দান করলেন স্কুল তৈরীর জন্য। তার আগে বসন্তপুরে স্কুল বলতে ছিল শুধু প্রাইমারী স্কুল। সরকারী অনুমোদনের ব্যবস্থাও হল। স্কুলের প্রচার-পরিচিতি আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পড়ল আশেপাশে। সাথে অঙ্ক আর সঙ্গীতের খবরটাও। রাগানুজ বাবু স্কুলের প্রথম দিন থেকেই ঘোষণা করেছিলেন, এই স্কুলের প্রতিটি শিক্ষক ও ছাত্র যেন অঙ্ক ও সঙ্গীতে পারদর্শী হয়। অদ্ভুত গোঁ। তবে খুব তাড়াতাড়ি নিজের ভুল বুঝতে পেরে অর্ধেক গোঁ ছাড়লেন। অঙ্ক অথবা সঙ্গীত এই দুটোর মধ্যে অন্তত একটা বিষয়ে উৎসাহ থাকা জরুরী। না থাকলে এই স্কুলে তার স্থান নেই। 

স্কুলের সুখ্যাতি যেমন বাড়ছিল, তেমনই পাল্লা দিয়ে বাড়ছিল শত্রুর পরিমাণ। তারই ফলস্বরূপ চল্লিশ বছর আগে এক শীতের রাতে ঘটল সেই দূর্ঘটনা। সেই রাতে স্কুল থেকে চুরি যায় দুটো জিনিস। মিরাজ ঘরাণার তানপুরা ও একটি দুষ্প্রাপ্য অঙ্কের বই। নাম আরিথমেটিকা ইউনিভার্সালিস। লেখক আইজ্যাক নিউটন ও আরও দুজন। প্রাণের থেকেও প্রিয় তিনটে জিনিসের মধ্যে দুটো জিনিস চুরি হওয়ায় প্রথমে প্রচন্ড শক্ পেয়েছিলেন রাগানুজ বাবু। তারপর রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে থানায় রিপোর্ট লেখান। যথারীতি চোর ধরা পড়েনি। প্রাণাধিক প্রিয় জিনিস দুটো হারিয়ে শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়েন উনি। এই ঘটনার পর বেশীদিন বাঁচেননি। তবে ওনার মৃত্যুর পর বসন্তপুর উচ্চমাধ্যমিক স্কুলের একটি আলপিনও আর কক্ষনো চুরি যায়নি। সাথে জুটেছে শিক্ষক ও ছাত্রদের অঙ্ক আর সঙ্গীতে অবহেলার শাস্তিপ্রদান। আর এসব করে প্রয়াত রাগানুজ সেনগুপ্তর ভূত। হ্যাঁ,বাস্তুভূত। বাস্তুভূত হয়ে তিনি রয়ে গেছেন বসন্তপুর উচ্চমাধ্যমিক স্কুলের দালানে রাখা মস্ত গ্র্যান্ডফাদার ঘড়ির মধ্যে। তানপুরা আর দুষ্প্রাপ্য অঙ্কের বই ছাড়া এই গ্র্যান্ডফাদার ঘড়ি ছিল ওনার তিন নম্বর প্রাণাধিক প্রিয় বস্তু। অত্যধিক ওজনের জন্য চোর যা চুরি করতে পারেনি।

dibyendugarai.dg@gmail.com
কলকাতা 

No comments:

Post a Comment