1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Sunday, April 17, 2022

যাত্রাবৃত্ত

ছবি : ইন্টারনেট

যাত্রাবৃত্ত

জয়দীপ মুখোপাধ্যায়

জামালপুর থেকে সন্ধ্যায় বেরিয়ে কিউল স্টেশনে যখন নামলাম তখন রাত নটা।রাত এগারোটায় পাটনা থেকে আসা টাটা যাবার এক্সপ্রেস ট্রেনটা ধরতে হবে।ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে রাত নটায় এই কিউল স্টেশন এতটাই সুনসান যে মাঝরাত বলে মনে হচ্ছে।গুটিকয় যাত্রী যারা জামালপুর থেকে আসা ট্রেনে সারা গা মুড়িঝুড়ি দিয়ে আমার সাথে এখানে নেমেছিলেন, মিনিট দশেকের ভিতরেই তারা স্টেশন চত্বর ছেড়ে অন্ধকারে মিশে গেলেন।সবাই স্থানীয় লোক।নতুবা এই কনকনে ঠান্ডায় রাতবিরেতে কে আর কিউল ঘুরতে আসবে?দেখারই বা কি আছে আধো অন্ধকার এই ভুতুড়ে স্টেশনে।মিনিট সাতেকের মধ্যেই দেখি যে ট্রেনটা থেকে আমি প্লাটফর্মে নামলাম সেটা মানবশূন্য হয়ে  ঘটাং ঘটাং ধাতব শব্দ করতে করতে ধীর গতিতে প্লাটফর্ম ছেড়ে দক্ষিণ দিকে রওনা দিলো।চারটে প্ল্যাটফর্মই খালি। গোটা দুয়েক লোক কম্বলমুড়ি দিয়ে প্লাটফার্মের সিমেন্টের সিটের ওপর গুটিসুটি হয়ে বসে আছে।গোটা তিনেক কুকুর এঁটো ফেলে যাওয়া খাবারের সন্ধানে প্লাটফর্ম থেকে রেললাইনে নেমে শোঁকাশুঁকি করছে।

নিস্তব্ধ খাঁ খাঁ করা প্লাটফর্মে আমার প্রথম কাজ হলো চৌধুরীবাবুকে খুঁজে বার করা।জামালপুর থেকে আমার পরিচিত মিস্রাজি কিউল স্টেশনের এর কোনো চৌধুরীবাবুকে ফোন করে বলে দিয়েছে আমায় যেন পাটনা থেকে আসা টাটা যাবার ট্রেনে তুলে একটা বার্থ করে দেয়।মিস্রাজির কথামতো সেই চৌধুরীবাবু নাকি মহা প্রভাবশালী লোক।স্টেশনমাস্টার থেকে স্টেশনের সবাই নাকি ওনাকে সমঝে চলেন।সেইমতো আমি চৌধুরীবাবুকে খুঁজতে ওনার ঘরে উঁকি দিলাম।দেখি চেয়ার ফাঁকা।পাশের রুমে আরামে বসে সিগারেটে সুখটান দিতে দিতে চার্ট মেলাতে ব্যস্ত এক কালো কোটের টিটিকে চৌধুরীবাবুর ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করতে উনি চার্ট থেকে মুখ না তুলেই জানালেন যে এখন কোনো ট্রেন নেই বলে চৌধুরীবাবু কোয়ার্টারে চলে গেছেন।

সর্বনাশ-আমি মনে মনে প্রমাদ গুনলাম।চৌধুরীবাবু না থাকলে তো আমাকে টাটার ট্রেনে উঠতেই দেবে না।উনি বলে কয়ে আমার একটা সিটের বন্দোবস্ত করবেন বলে আমার জামালপুরের বন্ধুকে কথা দিয়েছেন।এখন আসল সময়ে ঝুলিয়ে দিলে আমাকে এই ডিসেম্বরের শীতে সারারাত এই জনমানবহীন স্টেশনে বসে কাটাতে হবে।টাটা যাবার পরের ট্রেন পরের দিন ভোর ছটায় কিউলে আসবে।মহামুস্কিলে পড়া গেল।টিটিসাহেবকে জিজ্ঞাসা করলাম, "চৌধুরীবাবুর কোয়ার্টারটা ঠিক কোথায় বলুন তো?"

উনি কথা না বলে বাঁ হাতটা উত্তরকোন বরাবর দেখিয়ে সিগারেট টানতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।কিউলের এক নম্বর প্লাটফর্ম থেকে বাইরে যাবার রাস্তা দিয়ে বেরিয়ে এলাম।বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার।কোনো জনপ্রাণী নেই।একটা হালকা কুয়াশার চাদর ধীরে ধীরে গাঢ় হয়ে পুরো কিউল স্টেশনচত্বর ও তার আশেপাশের জায়গাগুলিকে যেন আস্তে আস্তে গিলে ফেলছে।কোনো রিক্সা নেই, টাঙ্গা নেই।অটো এ অঞ্চলে চলে না।রাস্তা দুভাগ হয়ে অন্ধকারের কালোতে গিয়ে মিশেছে।আকাশে চাঁদ,তারা কিছুই দেখা যাচ্ছে না।একটা পোড়া কাঠের গন্ধ আকাশে বাতাসে ছড়িয়ে আছে।বোঝা যাচ্ছে বেশ কিছুক্ষণ আগে লোকজন শুকনো কাঠ জ্বালিয়ে শীতের রাত্রে শরীরের উত্তাপ বাড়িয়েছে।একটা রাস্তা রেললাইন এর সমান্তরাল আর অন্যটা একটা বড় গাছের তলা দিয়ে যেন অজানার উদ্দেশ্যে চলে গেছে।দূরে নিভু নিভু  কয়েকটা লাইট দেখা যায়।বহু দূর থেকে সম্মিলিত কণ্ঠে ভোজপুরি গানের আর ঢোলের বোল যেন অন্ধকার আর কুয়াশার চাদরে ছাওয়া আমার ভীতু মনটাকে একটু সাহস যোগাচ্ছে।আমি রেললাইনের সমান্তরাল রাস্তা দিয়ে গুটি গুটি পায়ে এগোতে থাকি।গায়ে মোটা সোয়েটার,মাথায় বাঁদরটুপি আর পায়ে মোজা জুতোতেও ঠান্ডা যায় না।বিহারের এই অঞ্চলের পাড়াগাঁ আর মফস্বলে ঠান্ডাটা বেশ জাঁকিয়ে পড়ে। তার ওপর ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ।আমার সর্বশরীর মোড়া আর জুতোর মচমচ শব্দে উৎসাহিত হয়ে একটা কুকুর আমার পিছু নিলো।আমি হাঁটার স্পিড বাড়ালাম।সেই নিরীহ প্রাণীটিও নিজের স্পিড বাড়ালো।কুকুরটা বোধহয় নিজের ভয় ভাঙাতে সঙ্গী খুঁজছে।আর মানুষের সঙ্গ ছাড়া ওদের আর কে আপন আছে?

মিনিট তিনেক হাঁটার পর দেখি পর পর কয়েকটা ঘর, ঠিক যেমন লাইনের ধারে কোয়ার্টার গুলো দেখা যায়।রাতের অন্ধকারে মেটে রং কিনা বোঝা দায়।সব ঘরের দরজা জানালা আঁটোসাঁটো বন্ধ করা।অবশ্যি কোন বুরবক আর শীতের রাত্রে দরজা জানালা খুলে রাখবে?

কুকুরটা আমার থেকে দু ফুট দূরে থমকে দাঁড়িয়েছে।ও আমার পরবর্তী পদক্ষেপ কি হতে চলেছে সেটা অনুমান করার চেষ্টা করছে।আমি চৌধুরীবাবুর কোয়ার্টার চিনি না।তবে এই কয়েকটার ভিতরেই হবে সেটা নিশ্চিত।একটা  কোয়ার্টারের বাবান্দায় দাঁড়িয়ে দরজার কড়া নাড়ালাম।ভাবলাম দরজা খুললে চৌধুরীবাবুর কোয়ার্টারটা কোনটা জেনে নেব। ভিতর থেকে কোনো শব্দ নেই।দরজার নীচে হালকা আলোর রেখা দেখা যাচ্ছে।তার মানে কেউ না কেউ তো ভিতরে আছেই।আবার কড়া নাড়ালাম।ভিতর থেকে পুরুষালি গলায় হিন্দিতে একটা গালমন্দ করে কেউ জিজ্ঞাসা করলো যে এত রাত্রে কে ভাই জ্বালাতে এলে।

আমি আমার নাম বললাম।আবার কিছুক্ষন সব চুপচাপ।ভিতরে এক নারিকণ্ঠ কানে এলো।লোকটিকে দরজা খুলতে বলছে।একটু পরেই দরজা খুলে গেল।এক মাঝবয়সী লোক; মাফলারে কান,মুখ ঢাকা।গায়ে কম্বল জড়িয়ে উনি দরজা খুললেন।দরজা খুলতেই সেই পরিচিত গঞ্জিকার গন্ধটা নাকে ভেসে এলো।ঘরের ভিতরেও গঞ্জিকার ধোঁয়ার হালকা ধোঁয়াশা।

" এটা কি চৌধুরীবাবুর ঘর?"

" কেন কোনো ডিরেলমেন্ট বা একসিডেন্ট হয়েছে নাকি যে এখন ডাকতে এসেছেন?" আমার প্রশ্নের জবাবে লোকটির মুখ থেকে আর একটি প্রশ্নবাণ নিক্ষেপ হলো।

" না, না সেসব নয়।জামালপুরের মিস্রাবাবু আমাকে পাঠিয়েছেন টাটার ট্রেনে একটা জায়গা করে দেবার জন্য।" আমি গদগদ হয়ে বলি।

" ঠিক আছে আপনি স্টেশনে ফিরে যান, চৌধুরীবাবু টাটার ট্রেন প্লাটফর্মে ঢোকার আগেই পৌঁছে যাবেন।"

" আপনিই কি চৌধুরীবাবু?" আমি আবার প্রশ্ন করি।

কিন্তু গঞ্জিকার গুনেই হোক বা আমাকে নিতান্ত কমবয়সী রোগা-পাতলা বাঁদরটুপি পরা নিরীহ লোক বলে সেই ভদ্রলোক আমার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বললেন," আপনি যান,আপনার কাজ হয়ে যাবে।"

ফিরে আসছি, দেখি কুকুরটা আবার আমার পিছু নিয়েছে।পাশেই লোহার রেলিং।রেলিংয়ের অপর প্রান্তে সমান্তরাল রেলের লাইন চলে গেছে।চার নম্বর লাইনে একটা বগীছাড়া ডিজেলইঞ্জিন ভসভস করে ঢুকছে।দূরের ভোজপুরি সমবেত সংগীত এখন স্তব্ধ।বোধহয় সবাই নামগান সেরে শুতে গেছে।আমার ঘড়িতে রাত দশটা।পেটে ছুঁচো ডন মারছে।সেই দুপুরে খেয়েছি।তারপর দানাপানি দূর অস্ত,জল পর্য্যন্ত পেটে পড়েনি।স্টেশন চত্বরে কোনো খাবার দোকান দেখিনি।ঠিক করলাম অন্য রাস্তাটা দিয়ে কিছুটা হেঁটে দেখি খাবার পাওয়া যায় কিনা।যদিও সে সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে।ওদিকে কুকুরটা আমাকে ছাড়ছেই না।

রেললাইনের সমান্তরাল রাস্তাটা ছেড়ে যখন ডানদিকে বেঁকে নিঝুম অন্ধকারে গাছের তলার রাস্তাটা নিলাম তখন একটু দ্বিধায় ছিলাম।কিছুটা যেতেই দুচারটে বন্ধ দোকান দেখা গেল।একটা বড় বটগাছের তলায় সিমেন্টের বেদির ওপর গোটা কয়েক লোক আপাদমস্তক কম্বলমুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে।ভবঘুরে হবে হয়তো।ওদের মাথার কাছে একটা প্রদীপ টিমটিম করে জ্বলছে।একটা কম্বলের ওপর জোনাকির আলোর বিন্দু দেখে বোঝা যায় আড়াআড়ি শোয়া লোকটি বিড়ি টানছে।

আরো কিছুটা এগোতে একটা পচা গন্ধ নাকে এলো।পাশের নর্দমা থেকে আসছে।ফেলে দেওয়া পচা সবজি,কপি থেকে বিষাক্ত পুতিগন্ধময় গ্যাস চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে।তার মধ্যে ঘোঁৎ ঘোঁৎ করে কিছু শুয়োরের দল এত রাত্রেও ঘোরাঘুরি করছে।আরও কিছুটা এগোতে অন্ধকারে বন্ধ বাজারটা কিছুটা নজরে এলো।টিমটিম করে একটা বাল্ব নিজের হলদে আলো ছড়িয়ে জায়গাটা আরো বিষাদময় করে তুলেছে।

নাহ, কোনো খাবারের দোকান নেই।আবার স্টেশনের দিকে ফিরে আসতে লাগলাম।আমার সাথে একটা পিঠে বাঁধা রুকসাক।তাতে আছে একটা পাজামা,জামা, মাফলার,টুথপেস্ট আর ব্রাশ।তাড়াহুড়োয় জলের বোতলটা আনতে ভুলে গেছি।সঙ্গের কুকুর বন্ধুকে বিদায় জানিয়ে কিউল স্টেশনে ঢুকলাম।রাত এগারোটায় টাটা যাবার ট্রেন।সাড়ে এগারোটায় আছে থ্রু গৌহাটি এক্সপ্রেস , যেটা এখানে দাঁড়ায় না।

স্টেশনের কলে জল পান করে খিদে কমানোর চেষ্টা করছি।এই ছাব্বিশ বছর বয়সে খিদেটা যেন ভীষণ বেশি পায়।প্লাটফর্মের একটা ফাঁকা বেঞ্চে বসে বসে আকাশ পাতাল ভাবছি।মশাগুলো শরীরের অন্যান্য জায়গা ঢাকা থাকায় কেবল বোমারু বিমানের মতো চোখ-নাক আর মুখের পাশেই চক্কর কাটছে।আমি বাঁদরটুপিটা দিয়ে কায়দা করে মুখ আর নাকটা ঢেকে ফেলতে ওদের আক্রমণের ক্ষেত্রটা কমে গেল।প্রায় পৌনে এগারোটা নাগাদ নিস্তব্ধ ঘুমন্ত স্টেশনের মাইকে ঘোষণা হলো টাটা যাবার গাড়ি তিরিশ মিনিট দেরিতে আসবে।

আমি চৌধুরীবাবুর ঘরে উঁকি মারলাম।দেখি কোয়ার্টারে দেখা লোকটিই নিজের বসার চেয়ারে হেলান দিয়ে শুয়ে অন্য একটা চেয়ারে দুপা তুলে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।মাথাটা পিছনে অনেকটা ঝুলে পড়েছে।ভদ্রলোককে দেখে মায়া হলো।সামনে রাখা টেবিলে গোটা তিনেক কালো রঙের ঘোরানো ডায়ালের আদ্দিকালের ফোন।পিছনের দেওয়ালে রেললাইনের মানচিত্র আঁকা।তাতে লাল, হলুদ আর সবুজ টুনি বাল্ব জ্বলছে-নিভছে,ঘন ঘন রং পরিবর্তন করছে। উঁকি মেরে দেখি পাশে স্টেশনমাস্টারের ঘরে তালা মারা।

" চৌধুরীবাবু।" আমার ডাকাতে উনি ধড়মড় করে উঠলেন।চোখগুলো জবা ফুলের মতো লাল।মুখের একপাশে বেরিয়ে আসা লালাকে ডান হাতের কনুই দিয়ে মুছে উনি বললেন," কৌন রে?"

লালার রসটা কনুইয়ের ওপর সোয়েটারের হাতায় সেঁধিয়ে গেছে।

আমি আমার পরিচয় দিয়ে জামালপুরের মিস্রাজির খবর বললাম।কেমন একটা ফ্যালফ্যাল করে আমার দিকে চেয়ে একটু সময় নিয়ে ধাতস্থ হয়ে চৌধুরীবাবু হাত প্রসারিত করে আমাকে আশ্বাস দিয়ে বললেন," সব হয়ে যাবে।কুছু চিন্তা করবেন না।আমি আপনাকে নিজে ট্রেনে চড়িয়ে দেব।আপনি এখানেও বসে আরাম করতে পারেন।"

চৌধুরীবাবুর ঘুমে ব্যাঘাত ঘটাতে ইচ্ছে হলো না।বেচারা ক্লান্ত হয়ে আছেন।

বললাম," আমি প্লাটফর্মে ঘোরাঘুরি করছি।ট্রেন আসার আগে কি আপনার কাছে আবার আসবো?"

" আমি আপনাকে খুঁজে নিয়ে ট্রেনে চড়িয়ে দেব।তবে ওই সময় আবার বাথরুমে চলে যাবেন না।" চৌধুরীবাবু বুজে আসা চোখ কোনোমতে জোর করে খুলে আবার আমাকে মাথা নেড়ে আশ্বাস দিলেন।আমি নিশ্চিন্ত হয়ে ওনার ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম।

ইতিমধ্যে আবার জানানো হলো টাটা যাবার গাড়ি আরো কুড়ি মিনিট দেরিতে চলছে।এগারোটা পঞ্চাশে গাড়ি আসবে।আমি খালিপেটে প্লাটফর্মের বেঞ্চিতে বসে গুনগুনিয়ে রবীন্দ্রসংগীত ধরলাম। 

বিকট ঘড়ঘড় শব্দে হটাৎ ঘুমটা ভেঙে গেল।একটা ট্রেন স্টেশনে ঢুকে পড়েছে।ঘড়িতে এগারোটা সাতচল্লিশ।আমি তড়াক করে লাফিয়ে উঠলাম।সামনে প্লাটফর্মে ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে।চৌধুরীবাবুকে এদিক ওদিক খুঁজছি।দৌড়ে ওনার ঘরে গেলাম।চেয়ার খালি।তার মানে উনিও আমার খোঁজ করছেন।ওনার ঘর থেকে বেরোতেই দেখি চৌধুরীবাবু প্লাটফর্মের দিকে আমায় খুঁজতে হনহন করে এগিয়ে যাচ্ছেন।গিয়ে ধরলাম।

" চলুন, এস ফাইভে সিট নম্বর নয়।সব বন্দোবস্ত হয়ে গেছে।টিটিকে বলে দিয়েছি।কোনো চিন্তা নেই।"

এস ফাইভ একটু দূরেই।প্লাটফর্মের ম্লান আলোয় সবটা ভালো করে দেখা যায় না।হটাৎ যেন ঘুমন্ত স্টেশন জেগে উঠেছে।চা ওয়ালার দল হাজির। পুরি-সবজি বিক্রি হচ্ছে।কিনতে গিয়ে একটু দেরি হলো।হাতে পুরোনো খবরের কাগজে পুরি-সবজির প্যাকেট নিয়ে চৌধুরীবাবুর পিছন পিছন দৌড়ে গিয়ে দেখি দাঁড়িয়ে থাকা ট্রেনের বগির সব দরজা বন্ধ।শীতকাল।সব প্যাসেঞ্জার জানালা নামিয়ে রেখেছেন।আমি আর চৌধুরীবাবু দু একটা জানালায় ধাক্কা দিলাম।কেউ খুললো না।এস থ্রীর একটা দরজা খোলা।চৌধুরীবাবু ওটায় আমায় তুলে দিয়ে বললেন,

"ভেস্টিবিউল আছে।নিজের সিটে চলে যান।হ্যাপি জার্নি।"

আমরা পরস্পরের দিকে হাত নাড়ালাম।ট্রেন আস্তে আস্তে প্লাটফর্ম ছেড়ে এগিয়ে যেতে লাগলো।

ভেস্টিবিউল দিয়ে এস ফাইভে যখন পৌঁছলাম দেখি এটা মিলিটারি বগি।প্রচুর জওয়ান গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।আমার সিটেও জলপাই পোশাকে একজন শুয়ে।পাশে রাইফেলও শুয়ে আছে।মনের দুঃখে বাথরুমের সামনে দাঁড়িয়ে আছি।মনে মনে ভাবছি টিটি এলেও কি আমি আদৌ আমার সিট পাবো?মিলিটারি সরানো টিটির কম্ম নয়।যদি অন্য জায়গায় সিটের বন্দোবস্ত করা যায় এই আশায় আমি টিটির অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে রইলাম।প্রায় তিরিশ মিনিট পর দেখি কালো কোটে দুজন টিটি হনহন করে বগির মধ্যে দিয়ে এগিয়ে আসছেন।হাতে চাঁদ পেলাম।

" স্যার, আমার সিটে মিলিটারি শুয়ে আছে।অন্য কোথাও যদি একটা জায়গা করে দেন।চৌধুরীবাবু আপনাদের কারুর সাথে কি আমার ব্যাপারে কথা বলেছিলেন?"

দুজনাই আমার দিকে এমন চোখ করে তাকালেন যেন আমি কিছু বিরাট অন্যায় করে ফেলেছি।

ওনাদের একজন বললেন " আপনি মিলিটারি কামরায় উঠলেন কিকরে? এটা তো রিজার্ভ কামরা।আর কোনো চৌধুরী আমাদের কিছু জানায়নি।এক্ষুনি অন্য কামরায় চলে যান।"

আমি ওনাদের পিছন পিছন এগোচ্ছি দেখে বেশ অসন্তুষ্ট হলেন।

একজন পিছনে ঘুরে জিজ্ঞাসা করলেন," আপনি কোথায় যাবেন বলুন তো?"

" কেন টাটা।" আমি জোর দিয়ে বললাম।

" আরে এটা তো ভাগলপুর হয়ে গৌহাটি যাচ্ছে।কিউল এ সিগনাল না পাওয়াতে ট্রেন দাঁড়িয়েছিল।"

আমি আকাশ থেকে পড়লাম।

" সামনে জামালপুর স্টেশনে গাড়ি থামবে।আপনি নেমে যান।" ওই দুজনের মধ্যে যিনি বয়স্ক , তিনি আমার দুর্দশা দেখে আমাকে উপদেশ দিলেন।চৌধুরীবাবু অতি উৎসাহে আমাকে টাটার বদলে গৌহাটির ট্রেনে তুলে দিয়েছেন।

রাত একটায় আমি আবার জামালপুরে নামলাম। 

...(সমাপ্ত)...

              

No comments:

Post a Comment