1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Sunday, April 17, 2022

দৃশ্যকল্প

 

ছবি : ইন্টারনেট 



 দৃশ্যকল্প 

সান্ত্বনা ব্যানার্জী

" এখনো তোমার হলো না! রান্না ঘরে কাজ তো করেই চলেছো!তৈরী হও এবার,কখন যাবে?" বলতে বলতে দোতলায় উঠে যায় রূপসা সাজগোজ করতে।হাতের কাজ গুলো তাড়াতাড়ি সারতে থাকে রীতা। আহা!কোথাও যেতে পায়না মেয়েটা। একটা বিয়েবাড়ি যাবার সুযোগ এসেছে, একটু সাজবে গুজবে।

বিয়ের পরপরই তো চলে যেতে হলো বাইরে,ছেলের সঙ্গে ছেলের চাকরীর জায়গায়।এবার কয়েক দিন ছুটি নিয়ে ছেলে বৌমা এসেছিল।ছেলে চলে গেলো রূপসা রয়ে গেলো রীতার কাছে তিন মাসের জন্য শেষপরীক্ষা টা দিতে।এই বিয়ে বাড়িটায় খুব একটা যাওয়ার ইচ্ছে ছিলনা রীতার। বাড়িতে নানা কাজ,স্কুলের খাতা দেখা, বাবাকে ডাক্তার দেখানো,বড্ড চাপ। তবুও যেতে হবে, নাহলে রূপসার যাওয়া হয়না।

           ওপরে এসে দেখে সাজগোজ প্রায় হয়ে গেছে রূপসার। মেরুন রঙের বেনারসীর সঙ্গে হালকা মানানসই গয়না পরেছে,ভারি মিষ্টি লাগছে। রীতার জন্যও শাড়ী গয়না সব বেড় করে রেখেছে।তাড়াতাড়ি তৈরী হয়ে নেয় রীতা।

সবাই মিলে যাওয়ার জন্য একটা বড়ো গাড়িও ভাড়া করা হয়েছে।নিচের থেকে তাড়া দেয় দুই জা,মিলি আর শ্যামলী। তাড়াতাড়ি নেমে এসে গাড়িতে উঠে পড়ে দুজনে।

              এই বিয়েবাড়িটা যে একটু বিশেষ রকমের হবে এটা সবাই জানে।বিরাট বড়োলোক বলতে যা বোঝায় এরা তাই।প্রাসাদের মত বাড়ী, অনেক গুলো কোল্ডস্টোরেজ, চা বাগান, বাস লরি,আরও নানা ব্যবসা। নেহাতই ভাগ্যের জোরে ওই বাড়ীতে বিয়ে হয়েছে ওর ভাসুরঝি রীনার। এ নিয়ে সবার মত রীতার মনেও একটা গর্ব আছে এটাও সত্যি। রীনার ভাসুরঝি দিয়ার বিয়ে। বিয়ের পরই দিয়া চলে যাবে অস্ট্রেলিয়া বরের সঙ্গে। "কত সময় লাগবে মা যেতে?" জিজ্ঞেস করে রূপসা। "এই মিনিট চল্লিশ মত লাগবে,তবে এবার আর গাড়ী নিয়ে ভিতরে যাবো না।আগের বার রীনার দেওরের ছেলে অর্কর পৈতে তে গাড়ী বার করতেই আধঘন্টা লেগে গেল। আধ মাইল রাস্তা থেকে গাড়ী তে গাড়ীতে ছয়লাপ!"রীতার কথায় সায় দেয় শ্যামলী,"ঠিক বলেছো দিদিভাই,এবার আর ভুল করবো না। গাড়ী অনেক টা আগে রেখে খানিক টা না হয় হেঁটে যাবো। পৈতে বাড়ী তো নয়! যেন রথের মেলা।"

            এটা ওটা গল্প করতে করতে গাড়ী পৌঁছে যায়। দূর থেকেই দেখা যায় আলোর রোশনাই। "কি বড়ো বড়ো লাইটের গেট গো মা!"চেঁচিয়ে ওঠে অভ্রো, শ্যামলীর ছেলে।"ঠিক আছে ঠিক আছে, সবার সঙ্গে সঙ্গে চল, নাহলে হারিয়ে যাবি কিন্তু," বলে শ্যামলী। সত্যি!বাড়ির সামনে এসে যেনো চোখ ধাঁধিযে গেলো!বিশাল তিনতলা বাড়ীটা আলোয় মোরা। গেটের দুধারে লাল শার্টিনে মোরা সার সার চেয়ার,মাঝখান দিয়ে লাল কার্পেট। বিরাট বিরাট পিতলের ফুলদানিতে সাজানো নানা রঙের ফুল।এক পাশে দোলনা টাঙিয়ে পার্কের মত করা হয়েছে।

তাতে বসে আছে নিখুঁত সাজে সেজে কিছু মেয়ে।"ওরা মনে হয় দিয়ার বোম্বে কলকাতার বন্ধু। পার্লার থেকে একেবারে সেজে এসেছে।"ফিসফিস করে বলে মিলি। ওদিকে রঙিন ছাতা র তলায় চলছে ব্যাফে ডিনার। সার সার আইসক্রীম,ফ্রুট জুস,চা, কফির স্টল। আবার বড়ো বড়ো দুটো প্যান্ডেলে চলছে খাওয়া দাওয়া।

"এইতো কাকিমারা এসে গেছে!"আনন্দে ছুটে এসে রীতাকে জড়িয়ে ধরে রীনা।গা ভর্তি গয়নায়

বেনারসী তে রাজেন্দ্রানীর মত লাগছে রীনাকে!

একে একে বাড়ির সকলে এসে অভ্যর্থনা জানায়

ওদের।এর ওর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়।"আমার কাকীমা, এই আমার ভাইয়ের বউ, খুব ভালো গান গায়। আমাদের বাড়ীর সবাই টিচার।"বাপের বাড়ী নিয়ে সব মেয়েদেরই একটা গর্বের জায়গা থাকে বা খুঁজে নিতে হয়। তবুও লজ্জা পায় রীতা। এত বিত্ত বৈভবের মাঝে এই কথা গুলো বিশেষ প্রাধান্য পাবে কি! অন্য কথায় চলে যায় রীতা,"হ্যাঁ রে রীনা, তোর শাশুড়ি মা কেমন আছেন?".....".ওর থাকা আর না থাকা

শুধু প্রাণ টুকুই আছে!" "চলনা একবার দেখে আসি।"......যাবে?চলো,সেই তিনতলায়। রীনার

পিছন পিছন ওরা সিঁড়ি দিয়ে উঠতে থাকে। দোতলার একটা ঘরে সাজানো হচ্ছে কনেকে।

পার্লারের লোক এসেছে কলকাতা থেকে। তিন তলার সিড়ি তে উঠতে গিয়ে চোখ পড়লো রীতার

পিছনের দিকে ঘোরানো লোহার সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে যাচ্ছে সুসজ্জিত কনে, পিছন পিছন সম্ভবত একটি কাজের মেয়ে চলেছে কনের গোল্ডেন কালারের পেন্সিল হিল পাদুকা দুটি নিয়ে। একবার ওদিকে তাকিয়ে চাপা গলায় বলে রীনা... ঢং!!! তিন তলার ঘরটায় ঢুকেই কেমন বিষাদগ্রস্ত হয়ে যায় রীতা! মৃদু আলোর নিচে মশারীর ভেতরে চাদর জড়ানো ছোট্ট একটা শরীর! রীনার শাশুড়ী!মুখ দেখা যাচ্ছে না,নাকে পড়ানো একটা নল,সামান্য ঘড় ঘড় আওয়াজ শুধু জানিয়ে দিচ্ছে প্রাণের অস্তিত্ব। সেই শান্ত শ্রীময়ী লক্ষ্মী প্রতিমার মত মানুষটি! বড়ো মিষ্টি কথা ছিলো। সারাক্ষণ পুজো নিয়েই থাকতেন।

এই আনন্দ মুখর পরিবেশে সম্পূর্ণ বিপরীত এক দৃশ্যের মুখোমুখি হয়ে বড়ো কষ্ট হয় রীতার। তাড়াতাড়ি সবাইকে নিয়ে নিচে নেমে আসে আবার। ইতিমধ্যেই রীনার স্বামী সোহম দুটো টেবিল ধরে রেখেছে ওদের জন্য। অগত্যা সবাইকে বসেযেতে হয় খাবার টেবিলে। নানা রকমের আমিষ নিরামিষ পদআসতেই থাকে।একটু একটু করে খেতে খেতেই পেট ভরে যায়। খেতে খেতেই শ্যামলীকে জিজ্ঞেস করে রীতা,"হ্যাঁ গো,রীনার সেজো জা তখন এসে দেখা করলো আমাদের সঙ্গে,কেমন যেন ম্রিয়মাণ লাগলো!" "ওমা! তুমি জানোনা? ওর মেয়েটি তো পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করেছে একেবারে খুব গরীব বাড়ীর ছেলেকে, ভাড়া বাড়ীতে থাকে, খুবই খারাপ অবস্থায় আছে। মনের কম কষ্ট!তাই তো ও রকম হয়ে গেছে।" চাপা স্বরে বলে শ্যামলী। মনটা খুব খারাপ হয়ে যায় রীতার। ওদের বাড়ীর মধ্যে সব চেয়ে ভালো আর আন্তরিক রীনার ওই সেজো জা আর ভাসুর। ওদের পরিবারের এত সমৃদ্ধির পিছনে ওদের ভূমিকাই সবচেয়ে বেশি। ওদের কপালে এমন হলো! ফেরার সময়  রীনা জড়িয়ে ধরে রীতাকে,"আবার এসো সবাই। তোমরা ছাড়া আর আমার কে আছে বলো!" চোখে জল এসে যায় সবারই। ওকেও আদর করে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় রীতা,"তুইও তো অনেক দিন যাস নি আমাদের কাছে, ছেলে মেয়ে সোহম সবাই মিলে চলে আয় একবার। বড়দা বড়দি নেই তো কি, আমরা তো আছি। যখন ইচ্ছে চলে আসবি"। সবার কাছে বিদায় নিয়ে ওরা হাঁটতে শুরু করে

গাড়ী পর্যন্ত পৌঁছতে। এটা ওটা গল্প করতে করতে বাড়ীও পৌঁছে যায় নির্বিঘ্নে।

                   বাড়ী ফিরেও গল্প যেন ফুরোতেই চায়না।"মা একটা অ্যান্টাসিড খেতে পারতে", বিছানা করতে করতে বলে রূপসা। "নারে, বেশি কিছু খাইনি তো, দুটো পান খেয়েছি জানিস", বলতে বলতে আরাম করে বিছানায় শুয়ে পড়ে রীতা। চোখ বন্ধ করেও সিনেমার মতো আলো ঝলমলে বাড়ী, বিত্ত বৈভব এর উজ্জ্বল প্রদর্শনীচোখের ওপর ভাসতে থাকে,আর ঘুম এসে পড়ে কখন অজান্তে.......।

                          চেতনার কোন অতল গভীরে এক ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে রীতা! একটা অচেনা জায়গায়  বারান্দার এক কোনে এক চিলতে কাপড় দিয়ে প্রাণপণে নিজের অনাবৃত শরীরটাকে ঢাকার চেষ্টা করছে রীতা!আর সামনের মাঠে এক বিরাট জনতার মাঝখান থেকে কারা যেন হেসে চলেছে......একটানা.....

অট্টহাসি....!ঘামে ভিজে গেছে সারা শরীর!ঘুম ভেঙে ধড়মড়িয়ে উঠে বসার চেষ্টা করেও বসতে পারেনা রীতা!হাত পা আতঙ্কে অসার হয়ে গেছে!

একটু সামলে নিয়ে পাশে রাখা বোতল থেকে ঢক ঢক করে জল খায় রীতা,আর নিজেই অবাক হয়ে যায় ! গত রাতের সব আলো, রোশনাই,ছাপিয়ে তার চোখের ওপর ভেসে উঠলো রীনাদের তিনতলার ঘরের মৃদু আলোয় মশারীর ভিতর ওর শাশুড়ি মায়ের চাদর ঢাকা ছোট্ট শরীরটা!!!

...(সমাপ্ত)...          

No comments:

Post a Comment