1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Sunday, April 17, 2022

শিকল ভেঙে স্বাধীন

ছবি : ইন্টারনেট 

 শিকল ভেঙে স্বাধীন

শাশ্বতী মুন্সী

  ছুটির ঘন্টা পড়তে চকিত হয়ে উঠল বান্টি। বেঞ্চে রাখা খোলা বক্সে পেন পেন্সিল ঢুকিয়ে, খাতা বই গুছিয়ে নেয়। বোতল নেড়ে জলের পরিমান বুঝে নিল। ব্যাগের চেন টেনে কাঁধে নিয়ে বেঞ্চ ছেড়ে বেরিয়ে এল। অন্য ছাত্রদের ভিড় ঠেলে দ্রুত পায়ে ক্লাসের বাইরে যায়। ছুট লাগায় মেন গেটের দিকে। দারোয়ানের নজর এড়িয়ে গেটের পাশের অপেক্ষাকৃত সরু গলি ধরে দৌড়তে লাগল।

  মোবাইল ঘড়ির অ্যালার্মের শব্দ ঘুমের দফারফা ঘটাতে ওস্তাদ। রোজ সক্কাল বেলায় ওস্তাদের উৎপাতে শান্তির ঘুম জোটে না বান্টির কপালে। ভোরের আলিস্যি ছেড়ে ঝটপট বিছানায় ছাড়তে হয়। শনি, রবি ছুটির দিনে নিয়মের হেরফের হয় না।

 ক্র্যা.. ক্র্যা.. ক্র্যা...

 কর্কশ শব্দ রোমিতাকে টেনে আনল রান্নাঘর থেকে। ছেলের গায়ে এক ঠেলা মেরে বলল,

-" তোর ঘুম ভাঙাতে কি ঢাক ঢোলের ব্যবস্থা করব?"

যান্ত্রিক সতর্কতায় যা হল না, মায়ের শাসানির তিক্ত বচনে তা হতে বাধ্য। নিমেষে ঘুম উধাও। ঝটিতি খাট থেকে নেমে বাথরুম গেল। মুখ চোখ ধুয়ে বেরোতে জগিং এর পোশাক নিয়ে রোমিতা দাঁড়িয়ে। সেগুলো পরে বাবার সঙ্গে নিচে গেল বান্টি। আবাসনের উল্টোদিকের পার্কের মাঝের পুকুর ধরে দশ পাক দৌড়তে হবে। স্বাস্থ্য সচেতন মানুষদের সঙ্গে তিমিরও জগিং করতে করতে পুরো পার্ক চক্কর দেয়। তবে নজর থাকে ছেলের ওপর। এক পাক কম হওয়ার জো নেই। পঁয়ত্রিশ-চল্লিশ মিনিট পরে ঘেমে নিয়ে বাড়ি ফিরে আসে। একঘেয়ে ব্রেকফাস্টে মুখ ব্যাজার! বাটিতে চামচ নাড়তে নাড়তে বলল,

-" ছুটির দিনে লুচি তরকারি, বা এগ চাউমিন করে দিতে পারো তো ?"

হটপটে তিমিরের লাঞ্চ প্যাক করছিল রোমিতা। রাগী গলায় বললে,

-" সকালবেলা অয়েলি খাবার খাইয়ে লিভারের বার'টা বাজাই আর কি.. যা দেব চুপচাপ খাবি।"

 বান্টি বুঝল প্ৰিয় খাবার খেতে চাওয়ার বায়না করা যেন অপরাধের সামিল.. অগত্যা দুধে ভেজা কলা কর্ণফ্লেকসই গলা দিয়ে নামাতে লাগল।

   ক্লাস সিক্স এর ছাত্র বান্টির দৈনন্দিন জীবন প্রবাহ ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে সামনে তালে বহমান। ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ার চাপ তো আছেই। তদুপরি এক্সট্রা এক্টিভিটিস'এ পারদর্শী হওয়ার জন্য মায়ের প্রবল চেষ্টা। পাঠ্য বিষয়ের টিউশন ছাড়াও সাতটি দিনরাতের সময় বিভাজিত হয়েছে সাঁতার, জিমন্যাস্টিক, আবৃত্তি, ড্রয়িং, গিটার, ক্যারাটে। রুটিনে বাঁধা ছকে আবদ্ধ বান্টির দৈনন্দিন কাজকর্ম। একেক সময় মনে হয়, সে যেন রেসের মাঠের ঘোড়া। শ্রান্তিহীন ভঙ্গিতে অবিরাম দৌড়ে যেতে হবে। ক্লান্ত দেহে ছোটার গতি কমালে বকুনির সাথে পিটুনি ফ্রি! মাপা সময়ের নির্দিষ্ট কাজের বাইরে ওর নিজস্ব কোনও স্পেস নেই।

  সারাদিন স্কুলে ইংরেজিতে কথোপকথন করে  ওর বালক মনে চায় ঘরের পরিবেশে মাতৃভাষায় কথা বলতে। কিন্তু অভ্যাস ভাঙার নিষেধে সেই আরামটুকু পায় না।

  দোতলায় ফ্ল্যাটে একটি গুজারাটি পরিবার থাকে। দুজন খুদে সদস্য আছে। ভাইবোনে কত মজা করে, খেলে, গান চালিয়ে নাচে। বান্টির খুব ইচ্ছে হয় ওদের ঘরে গিয়ে খেলতে। গুজরাটি ভাষা বোঝে না, তবে হিন্দিটা খারাপ বলে না। কিন্তু ভিনভাষীদের সঙ্গে মেশাতেও মায়ের বারণ। এমনকি জন্মদিনের নিমন্ত্রণ পড়া বা অন্য কোনও ক্লাসের মিথ্যে অজুহাতে কাটিয়ে দেয়।

 সি ব্লকের পিঙ্কি ওর স্কুলে পড়ে। এক বছরের সিনিয়র। পড়াশোনায় ভালো। দারুন গানের গলা। ইংলিশ সঙ্গে বাংলাতে মেধাবী। অপর্ণা কাকিমা অন্য স্কুলের বাংলার টিচার। স্থানীয় লাইব্রেরিতে মেয়ের আলাদা কার্ড করে দিয়েছে। বলেন, নিজের ভাষার সাহিত্য পড়তে, বুঝতে না জানলে বাঙালি জাতিকেই অবমাননা করা হয়। আবাসনে বসবাসের সূত্রে আলাপ আছে রোমিতার সঙ্গে। একদিন বলেছিলেন,

-" সপ্তাহের দুটো দিন বান্টিকে আমার কাছে পাঠিও। ওকে শিশু সাহিত্য পড়াব।"

 সাড়ে নয়'শ স্কোয়ার ফিটের ফ্ল্যাটের একটা ঘরের দেওয়াল জোড়া আলমারিতে শুধু বই বই। ঢুকলে নতুন পুরোনো বইয়ের গন্ধ বান্টির চিত্তে নেশা জাগায়। সহজ, চলতি বাংলা নিয়ে মিসেস গুপ্তর এত বাড়াবাড়ি মোটেই পছন্দ নয় রোমিতার। ওঁর লাইব্রেরি দেখে বাংলা বই পড়ার দিকে ছেলে উৎসাহী হচ্ছে বুঝে, রুক্ষ স্বরে ধমক দিয়ে বলেছিল,

-" ওসব বেমক্কা আবদারকে প্রশ্রয় দিই না। অবাধ্য হয়েছিস কি বাড়ির সুখ স্বাচ্ছন্দ্য ঘুচে সোজা বোডিং-এ পাঠাব..."

  উল্টে জবাব দিতে বান্টির জিভের ডগায় এসেছিল,

-" হ্যাঁ হ্যাঁ, সেখানেই পাঠিয়ে দাও.. তোমাদের মর্জির পুতুল হয়ে বাঁচার যন্ত্রনা থেকে রেহাই পাব..!"

 কিন্তু বোডিং জায়গাটা কেমন, শাসন বারণের কড়াকড়ি কতোটা, সে সম্বন্ধে কিছুই জানে না বান্টি। তাই মুখ ফস্কে বেরতে চাওয়া কথাটা সুরুৎ করে গিলে নিয়েছিল।

  মায়ের অনাগ্রহে অন্যের ছেলেকে সাহিত্যের সঙ্গে পরিচয় ঘটানোর ব্যাপারটা পুনরুচ্চারিত করেননি।  তবু গতবার বান্টির জন্মদিনের নিমন্ত্রণে বাক্স ভরা ক্যাডবেরি, ড্রয়িং বুকস, রং পেন্সিল সেট এর সঙ্গে উপহার দিয়েছিল ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায় এবং নারায়ণ দেবনাথের দুটি বই।

 বছর ঘুরতে চলল সেই বই দুটো হাতে পায়নি বান্টি। তবে নিশ্চিত মা ওর নাগালের বাইরে সরিয়ে রেখেছে।

  সব কিছুতে অন্যদের হারিয়ে সেরা হওয়ার লক্ষ্যে আর সে দৌড়বে না। পরাধীনতার বেড়ি ভাঙা উদ্যমে মা বাবার ইচ্ছে অনিচ্ছের দাসত্ব থেকে মুক্তির উপায় খুঁজে বেরিয়ে পড়েছে অজানা গন্তব্যের উদ্দেশ্যে।

...(সমাপ্ত)...


No comments:

Post a Comment