1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Monday, August 15, 2022

নিঃশব্দ পৃথিবী

ছবি : ইন্টারনেট
নিঃশব্দ পৃথিবী
ডাঃ অরুণ চট্টোপাধ্যায়

একেবারে ভোরের বেলাতেই মাঠে নেমে পড়ে দীপঙ্কর। এ তার সেই ছেলেবেলাকার অব্যেশ। বাবা তাকে ডেকে দিত ভোরে। বলত, যা শুনে যা। পাখিরা কেমন ডাক দিয়ে তুলছে আমাদের রবি ঠাকুরকে।
তখন রবি ঠাকুরের নাম শুনেছিল সে। কত বড় কবি ছিলেন। বিশ্বকবি। মানে সারা বিশ্বের কবি। বাবার মুখে শুনেছিল উনি কত যে গান লিখেছেন তার ঠিক নেই। শুধু লেখাই নয় সুরও দিয়ে গিয়েছেন নিজে।
ঘুম জড়ানো চোখ রগড়াতে রগড়াতে সে বলত, বাবা রবি ঠাকুর এই মাঠে আসবেন কেন? তাঁর তো বাড়ি সেই কোলকাতার জোড়াসাঁকো তাই না?
-আহা আমি ঐ রবি ঠাকু্রের কথা বলছি না। বলছি আমাদের দিনের রবি সূ্য্যি ঠাকুরের কথা। দেখছিস তো আকাশ কেমন লাল হয়েছে? পাখিদের ঘুম ওনার আগে ভাঙ্গে। তারাই উড়তে উড়তে ডেকে ডেকে রবি ঠাকুরকে জাগিয়ে দেয়।
অত সকালে উঠতে ভাল লাগত না তার। খুব বিরক্ত হয়ে পূব দিকে তাকিয়ে থাকত দীপঙ্কর। যার ডাকনাম দীপু। কিন্তু যেই লাল রঙটা ভেঙ্গে গিয়ে সূর্যটা বেরিয়ে আসত অমনি খুশিতে যেন ভেঙ্গে পড়ত সেও। আকাশের ওই রঙটা তার চোখে যেন স্নেহের পালক বুলিয়ে দিত। আকাশের অন্য দিকে নীল জমিতে সাদা মেঘের সারি। তারই মাঝে মাঝে আবার লাল রঙের ছিটে। কত রকমের পাখি আর কত রকমের ডাক। খুব ভাল লাগত তার। বাবা বলত আরও ভোরে তোকে উঠতে হবে। কত রকমের শব্দ। ফুল ফোটার, পাখি ডাকার, সূর্য ওঠার। সূর্য যত উঠতে থাকবে দেখবি চারপাশের কালো আঁধারটা যেতে যেতে তত যেন কাঁদছে।
-কেন বাবা? আঁধার কাঁদে কেন?
-কারণ তার সময় তো শেষ। ভোরের ফর্সা আকাশটা মুখ বাড়াবে এক্ষুনি। আঁধার নিজে হয়ত কাঁদে না। হয়ত একটা প্যাঁচাকে দিয়ে আওয়াজ করে দিল। কিংবা অজানা কোনও পাখি কটকট করে ডেকে দিল। তারপর দেখবি শুরু হবে কত রকমের শব্দ। কত রকমের পাখি আর কীটপতঙ্গ উড়তে থাকবে। মাটি, ঘাস আর গাছের ডাল বা পাতার ওপর দিয়ে চলতে থাকবে। তাদের পায়ে চলার কি শব্দ হয় না? আমরা শুনতে চাই না তাই। কিন্তু চাইলে-
-চাইলে কি হবে বাবা?
-দেখবি ওরাও কেমন তালে তালে ছন্দে ছন্দে পা ওঠাচ্ছে আর নামাচ্ছে।  
আর বেশি বলতে হয় নি বাবাকে। পরের দিন থেকে সে অনেক আগে থেকে উঠে পড়ত। গ্রামের বাড়ির সামনে রয়েছে বিরাট মাঠ। কত গাছ। সূর্য ওঠার আগে সেই গাছগুলো থেকে কত আওয়াজ উঠত। কি বিচিত্র সব আওয়াজ। প্রথম প্রথম ভয় করলেও পরে যেন ভালই লাগত।
একটু পরেই চারপাশের কালো রঙটা ফিকে হয়ে আসত। পাখিরা দুদ্দাড় করে উড়ে চলে যেত মাথার ওপর দিয়ে। পূব আকাশে রঙ ধরত। সূর্যটা কেমন ভুস করে উঠে পড়ত লাল মেঘের জমি থেকে। মুগ্ধ হয়ে যেত দীপঙ্কর। যখন সম্বিত ফিরত তখন দেখত হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূর সে চলে এসেছে। সেখান থেকে আবার ফিরে গিয়ে পড়তে বসতে হত।
মাঠ ভরা ছিল সবুজ ঘাসে। একেবারে মাঝে অবশ্য খেলাধুলো হত বলে সেখানে ঘাস জন্মাত না। তাই ধার দিয়ে হাঁটত সে। আশপাশে কত শব্দ। আগাছার ওপর শব্দ। পাশের ঝোপগুলোতে শব্দ। বাতাস যখন তার সারা গায়ে শীতল স্পর্শ বুলিয়ে উড়ে যেত তাতেও একটা শব্দ টের পেত দীপঙ্কর। উড়ে যেতে যেতে বাতাসটা যেন ফিসফিস করে তাকে বলে যেত, এ শুধু শব্দ নয়। ভাল করে খুঁজে দেখ হয়ত কিছু আছে এর মধ্যে। খুঁজলে হয়ত কিছু সুরও খুঁজে পাবি এর মধ্যে।
পাতাগুলো নাড়া খেতে খেতে শব্দ তুলত। তার মনে হত দূর আকাশে সাদা মেঘগুলো উড়ে যাবার শব্দও সে যেন পাচ্ছে। সমস্ত শব্দেরা মিলেমিশে সুর হয়ে তার কানের সামনে যেন তালে তালে নাচছে। মাথা তার নড়ে উঠত অমনি।
বাড়ি ফেরার সময় দূর থেকে শুনত বাইরের বারান্দায় বাবা হারমোনিয়াম নিয়ে গান করছে। বাবার গানের শখ। কিন্তু দারিদ্রের জন্যে শিক্ষক রেখে বা দামি যন্ত্র কিনে গান প্র্যাকটিস করতে পারত না। কিন্তু সেই ভাঙ্গা হারমোনিয়ামে তোলা সুর তার কানে লেগে থাকত। মনে হত এ সুর তার চেনা সুর। ভোরের আকাশ, বাতাস, মা্‌ঠ আর ঘাসের শব্দগুলো সব সুরে হয়ে বাবার হারমোনিয়ামে ঢুকে পড়েছে।
বাড়ি যখন ফিরে পড়তে বসতে হত। পড়ায় মন বসত না। শুধু ভাবত শব্দের কথা। শব্দগুলোর সুর হয়ে যাওয়ার কথা। একটা অদ্ভুত মধুর আবেশ তার শিশুমনকে ভরিয়ে রাখত।  
বাবার কাছে বায়না, বাবা গান শিখিয়ে দাও।
বাবা অবাক হয়ে বলত, কেন কেন হঠাৎ গানে মন?
বাবার কথার উত্তর দেবে কি দীপঙ্করের কানের কাছে তখন শব্দেরা ভিড় করেছে। যে শব্দরা শুধু শব্দ নয়। তারা সুর, তা্‌ল, লয় আর ছন্দ। যদিও দীপু ভাল করে চেনে না এদের একটাকেও। তবু তার মনে হচ্ছে একমাত্র বাবাই পারে তাকে এগুলোকে চেনাতে।
- বাবা ভোরের ওই আকাশ, বাতাস, পাখিরা আর পোকারা যা বলে সেগুলোকে আমার যেন কেমন গান গান মনে হয়। আমার মাথাটা কেমন যেন নড়তে থাকে আপনি। যেমন নড়ে তুমি যখন গান গাও। আমি দেখব বাবা ওদের বলা এই কথাগুলো কি গান নাকি আর কিছু।
বাবা ম্লান হাসত, কিন্তু বাবা তোকে গান শেখানোর ক্ষমতা আমার নেই। আমি খুব অল্প মাইনের চাকরি করি। এই ভাঙ্গা হারমোনিয়ামে চলে যায়। কিন্তু তোকে তো আর হেলাফেলা করে শেখাতে পারি না। আবার বেশি পয়সা খরচ করলে মা যদি বকে। গরিবের সংসার বাবা বুঝিস তো?
কিছুতেই শুনল না দীপু। বলল, আমি তোমার কাছেই শিখব আর তোমার ভাঙ্গা হারমোনিয়ামেই শিখব। পরের দিন থেকেই গান শুরু হয়ে গেল। বাবার সেই ভাঙ্গা হারমোনিয়ামেই। এরপর থেকে দীপুর শুধু চেষ্টা ভোরের আকাশে, বাতাসে লুকিয়ে থাকা শব্দগুলোকে সে হারমোনয়ামের রিড টিপে টিপে বার করে ফেলবে।
সেই চেষ্টা করতে করতে বড় হয়ে গেল। শুধু ভাবছে না না মাঠের সেই শব্দগুলোকে এখনও ঠিক ভাবে তোলা হয় নি। বাবার ভাঙ্গা হারমোনিয়ামেই তার যা কিছু গান। বাবাকে বারণ করেছে নতুন হারমোনিয়াম কিনে দিতে। তার জন্যে বাবা তার মায়ের বকুনি খাক এটা সে চায় নি। বেচারি বাবাটার তো আর দোষ কিছু নেই। দোষটা তো তার নিজের। দোষ তার এই গান শেখার অদম্য ইচ্ছেটার।
মাধ্যমিক চলে এল। পড়ায় তেমন মন দিতে পারে নি দীপু। মা শুধু দিনরাত গজগজ করে আর বাবাকে যা খুশি বলে। ছেলেটাকে গান শিখিয়ে কি হবে? লেখাপড়া শেখালে তো কিছু কাজ হত। একটা চাকরি পেতে পারত ভাল। বাবার তো আর কটা বছর। এরপর রিটায়ার করলে কি হবে? এদিকে ওর দিদির বিয়েটাও তো দিতে হবে। আবার একটা বোনও রয়েছে। পাঁচ পাঁচটা লোকটা সংসার সে কি কম বড়?
মাধ্যমিকটা কোনওমতে পাশ করল দীপঙ্কর। দিদির বিয়ে হয়ে গেল। হায়ার সেকেন্ডারিতে আর মন নেই দীপুর। সমস্ত মন সে ঢেলে দিয়েছে গানের পেছনে। পাড়ার বোধিসত্ত্ব দাস একদিন তাদের বাড়ির পাশ দিয়ে যেতে যেতে তার গানে মুগ্ধ হয়ে ঢুকে পড়েছিল বাড়িতে।
-এমন চমৎকার গান গায় আপনার ছেলে?
মা নিস্পৃহ হয়ে বলেছিল, আর কি বলব ঠাকুর পো। এই এক বাজে স্বভাব ছেলেটার। পড়ায় মন দিল না এক ফোঁটা। এখন হায়ার সেকেন্ডারিটা ভাল হবে তার লক্ষণ দেখছি না। একটা মাস্টার দেবার ক্ষমতা নেই ওর বাবার। অথচ দেখ মানুষটা রিটায়ার করবে আর কিছুদিনের মধ্যে। এখন ছেলেটা না দাঁড়ালে কি করে হবে?
বোধিসত্ত্ব কতকটা যেন নিজের মনেই বলল, কিন্তু ছেলেটা বড় ভাল গান করে।
দীপঙ্করের মা নিস্পৃহ হয়েই রইল। ছেলের গলার গানের থেকেও সংসারের পেটের ভাতের ওপরেই তার টান বেশি।
-ঠিক আছে বৌদি ওকে পাঠিয়ে দিন। আমি দেখে দেব। আমি কিছু নেব না তবে যে তবলা বাজাবে সে তো আর বিনা পয়সায় কিছু করবে না।
মা কিছুতেই রাজি নয়। ছেলের গান শেখার বাতিক অবিলম্বে ঘোচানো দরকার। বাবা কিন্তু ভরসা দিয়ে বলল, বোধিকাকু যখন বিনাপয়সায় শেখাচ্ছে তখন শেখ। আমি নাহয় তবলা বাদকের টাকা দিয়ে দেব যে করেই হোক।
পরের দিন থেকে দীপঙ্কর যেতে শুরু করল আর ক’দিনেই বেশ শিখে ফেলল। বোধিসত্ত্ব খুব খুশি হয়ে বলল, বেশ পারফরমেন্স রে দীপু। তবে আর কটা বছর তোকে আরও খাটতে হবে।
মায়ের ঘোর অপছন্দ। তার মনে খুব আশংকা যে এরপর বাবা রিটায়ার করলে সংসার চলবে কি করে? কিংবা মানুষটার হঠাৎ কিছু হয়ে গেলে? বয়েস তো হচ্ছে নাকি? একেই তো প্রফিডেন্ট ফান্ড থেকে লোন নিয়ে বড় মেয়ের বিয়েটা দেওয়া হয়েছে। সে লোন শোধ হওয়ার আগেই তো চাকরির মেয়াদ ফুরিয়ে যাবে। হাতে যা পাবে সেটাও যে কম। এদিকে আরও একটা মেয়ে রয়েছে ঘাড়ে। দীপুর থেকে ছোট হলেও সেও যে এখন মাধ্যমিকের দরজায়।
বাবা শুধু তাকে সান্ত্বনা দিয়ে যায়। তুই বড় ভাল গা-স দীপু। আমার প্রাণটা জুড়িয়ে যায়। আমি তো কিছুই করতে পারলুম না। তোর তবু ভগবানের কৃপায় একটা বিনা পয়সার মাস্টার জুটেছে। আমি তো নিজে নিজেই যা পারি তুলেছি একটু আধটু।
মা আড়াল থেকে শুনে ফেলে। ছুটে এসে মুখ ঝামটা দেয়, তোমার আদিখ্যেতা কেন এই ছেলের ওপর? পড়াশোনা কিছু করে না শুধু গান আর গান?
-তা যে যেটা ভালবাসে সেটা একটু করলে দোষের কি?
-আছে আছে দোষের আছে। ওর ছোট বোনটা তবু একটু লেখাপড়ায় ভাল। চাকরি করুক আর না করুক বিয়ে তো দিয়ে হবে একটা? আর সে দায় কিন্তু তোমার। ওই ছেলের নয়।
বাবা অসহায় হয়ে বলল, কিন্তু তার সঙ্গে এর কি?
মা আরও রেগে গিয়ে বলল, আছে আছে এর সঙ্গেই আছে। ভেবে দেখ ছেলেকে গান না শিখিয়ে মেয়েটার জন্যে যদি একটু বলতে বোধিদাদাকে তো কত ভাল হত? মেয়েটার পাত্র দেখার সময় যদি জ্জিজ্ঞেস করে গান জানে কিনা তো কি উত্তর দেবে শুনি? আমি তবু যাহোক পারি রান্নাটা একটু শিখিয়েছি। নিজের চেষ্টায় ঘর গোছাতেও পারে এখন একটু গান শেখালে তো তোমার সুবিধেই হত নাকি?
ওর বোনের খুব কৌতূহল ছিল দাদা রোজ কেন সূর্য ওঠার আগে মাঠে হাঁটতে যায় তা জানার। খুব উৎসাহে সে খুব ভোরে উঠে দাদার সঙ্গে হাঁটতে বেরিয়েছিল মাঠে। তখন পাখিরাও গাছের বাসা থেকে বেরোয় নি। মাঠের মধ্যে ঝোপের পাশে চুপ করে দাঁড়িয়ে পড়ল দীপু। কান খাড়া করে শুনতে লাগল কিছু।
বোন তৃণা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, কি শুনছিস রে দাদা?
নিজের ঠোঁটে আঙুল চাপা দিয়ে চুপ করতে ইঙ্গিত করে দীপু ফিসফিস করে বলল, কিছু শুনতে পাচ্ছিস?
-না তো।
-ঘাসের শব্দ। কত রকমের পোকা মাকড় আর পিপড়ে হাঁটছে ঘাসের ওপর দিয়ে। ওদের চলার শব্দ সুর হয়ে আসছে না তোর কানে?
তৃণা কিছু বুঝতে না পেরে বলল, কি জানি।
একটু পরে আকাশ লাল হল। দীপু বোনের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, আকাশ থেকে একটা সুর ভেসে আসছে জানিস তৃণা?
-না তো? আমি তো কিছু শুনছি না?
একটু পরে সূর্যটা সিঁদুরে মেঘের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসতেই দীপু আনন্দে চেঁচিয়ে উঠে বলল, ওই দেখ আমাদের রবি ঠাকুর কেমন প্রভাতী গাইছে।
অবাক তৃণা শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে দাদার দিকে। দীপু সুন্দর সুরে একটা প্রভাতী গাইল। তৃণা বলল, দাদা তোর গান বেশ ভাল লাগল। কিন্তু এটা তো তুই গাইলি?
-আমি নয়, আমি নয়। আমি শুধু সুরে সুর মিলিয়েছি। গেয়েছে ওই ওরা- আকাশ, বাতাস, গাছপালা, পাতা আর পাখি। আর সেই সঙ্গে আমাদের রবি ঠাকুর।
পরের দিন থেকে আর দাদার সঙ্গে আসে নি তৃণা। তার মনে হয়েছে এটা দাদার পাগলামী। গান গেয়ে গেয়ে এমনটা হয়েছে। মা বাবাকে সেদিন ধমকেছে মেয়েটাকে কেন গান শেখায় নি বলে। তৃণা এখন মনে হচ্ছে বাবা যেন ঠিক করেছে। সে গান শিখতে চায় না। শিখলে হয়ত দাদার মত পাগলামী করতে শুরু করবে।
দীপু কিন্তু রোজ আসে। এখানে না এসে সে থাকতে পারে না। তার ধারণা মানুষকে গান শিখিয়েছে আমাদের চারপয়াশের এই প্রকৃতি। এই আকাশ, বাতাস, জল-জঙ্গল, মেঘ-সূর্য এইসব। শুধু শিখিয়েছে তাই নয়, গান গাইতে উৎসাহিতও করেছে। মাঝে মাঝে মন খারাপ করে সে। বোধিকাকু জানতে চাইলে বলে, বাবার রিটায়ারমেন্ট এগিয়ে এল কাকু। আচ্ছা আমি কি কোনও ফাংশনে চান্স পাব না?
সে শুনেছে ফাংশনে নাকি দুটো করে পয়সা তবু পাওয়া যায়। একটা ভাল স্কেল চেঞ্জার হারমোনিয়াম তবে কেনা যেত।
-এখন থেকে ফাংশনে ঝুঁকলে তোর প্র্যাক্টিস খারাপ হয়ে যাবে দীপু। এখনও তোকে অনেক শিখতে হবে। ভাবছি-
সাগ্রহে দীপু জিজ্ঞেস করল, কি কাকু?
-এখন আমার থেকে বড় কারোর কাছে গিয়ে শিখতে হবে তোকে। সেই ব্যবস্থা করছি।
সাতদিন পরে বলল, একটা ভাল চান্স এসেছে দীপু। তুই যদি মুম্বাই যেতে পারিস তো তোর অনেক উন্নতি হবে। দুটো বছর রামানুজমের কাছে শিখলে মুম্বাইয়ে তোর অনেক সুযোগ আসবে। রামানুজম ক্লাসিক্যাল ফিল্ডে এখন বেস্ট। আর ক্লাসিক্যাল জানিস তো?- সঙ্গীতের ভিত্তিভূমি। ক্লাসিক্যাল না শিখলে কিছুই হয় না। আর ভাল করে শিখলে অনেক কিছুই হয়।
মনের মধ্যে আবার সেই মাঠের শব্দ সুর-তাল-লয় হয়ে বাজতে লাগল দীপঙ্করের কানের সামনে। আর সেই সঙ্গে আশার আলো। এ যে তার সামনে আকাশে চড়ার একটা সিঁড়ি। খুশি চাপা থাকল না। চোখেমুখে ঠিকরে বেরিয়ে আসতে লাগল। বলল, সত্যি কি তেমন সুযোগ হবে কাকু?
-হবে। কাকু বলল, তবে-
মনটা আবার মিইয়ে গেল দীপুর। এর মধ্যেও আবার একটা ‘তবে’ আছে নাকি?
-দেখ উনি কত বড় মাপের শিক্ষক। ওনার ফিস আছে। মুম্বাইতে তোর থাকা-খাওয়ার ব্যাপার আছে। আমাকে একটু সময় দে। আশা করি কিছু হবে। আজকাল ট্যালেন্টের দাম সর্বত্র।
বাবা তো খুব খুশি। অতবড় ছেলেকে জড়িয়ে ধরে বলল, আমি যে কত খুশি হয়েছি কি বলব।
মা শুধু খুশি নয়। একমুখ রাগ নিয়ে বলল, তবে আর কি নিজের খুশিতে ড্যাং ড্যাং করে মুম্বাইতে গিয়ে প্যাঁ পোঁ কর। আমি শুধু ভেবে মরছি সংসারটা চলবে কি করে? কত করে বললুম একটু পড়ায় মন দে যাতে একটা যাহোক অন্তত চাকরি পেতে পারিস। সামনের মাসেই যে তোর বাবার রিটায়ারমেন্ট সে খেয়াল আছে?
বোধিসত্ত্বের কাছে গিয়ে মুখ কাঁচুমাচু করে বলল, হবে না কাকু।
-কি হবে না?
-একটা যাহোক চাকরি দেখে দিতে পারেন? মা বলেছে। বাবা আগামী মাসেই রিটায়ার করছে।
বোধিসত্ত্ব খানিক ভেবে বলল, একটা উপায় আছে।
-কি উপায়?
-দেখ অনেক প্রতিষ্ঠান আছে যারা গরিব শিল্পীদের গান শেখার জন্যে স্কলারশিপের ব্যবস্থা করতে পারে। স্কলারশিপের টাকায় মাইনে টাইনে হয়ে যায়।
আশায় আবার ভরে উঠল দীপঙ্করের মুখ। সে চুপ করে রইল।
-তবে সেটাও তো এমনি এমনি হবে না। তোকে অডিশন দিতে হবে। অডিশনে পাশ করতে হবে।
আবার দমে গেল দীপু। তার মুখের দিকে চেয়ে বোধিসত্ত্ব আবার বলল, ঘাবড়ানোর কিছু নেই। আমি জানি তুই ঠিক পাশ করে যাবি।
দীপঙ্কর ঠিক করল মাকে আর কিছু জানাবে না। বাবা শুনে বলল, এ তো খুব ভাল খবর। চান্স যদি পাস মুম্বাইতে তো বেশ ভাল কথা। চলে যাবি।
ভয়ে ভয়ে দীপু বলল, কিন্তু মা-
বাবা অভয় দিয়ে বললেন, সে আমি দেখব। আমি তো রিটায়ার করছি মরে তো আর যাচ্ছি না বাবা। রিটায়ারের পর আমি না হয় যাহোক একটা কাজ দেখে নেব। তোর এতবড় সুযোগ হারাবি কেন বাবা?
বোধিকাকু বলেছে সামনের বছরের অডিশন আসতে এখনও মাস পাঁচেক লেগে যাবে। এই পাঁচ মাস যেন ভাল করে প্র্যাক্টিস করে দীপু। পরের মাসে বাবা চাকরি থেকে অবসর নিল। সরকারী চাকরি নয় যে পেনশন পাবে। পি-এফ গ্র্যাচুইটির কিছু টাকা ব্যাংকে রেখে তার সুদ কি আর চাকরি কালীন মাস মাইনের সমান হতে পারে? মা এসে এবার কেঁদে পড়ল, দেখ বাবা। দেখছিস তো সংসারের অবস্থা। ওসব ছাইপাশ ছেড়ে দিয়ে একটা কাজের চেষ্টা কর বাবা। আমার লক্ষ্মী সোনা।
বাবা তবু তাকে মায়ের আড়ালে আশ্বাস দিয়ে বলল, তুই ভাবিস নি। আমি একটা কাজ ঠিক জুটিয়ে নেবই।  
তাই হল। বাবার বয়েস এখন পঁয়ষট্টি। বেসরকারী চাকরি তাই অবসর একটু বেশি বয়েসেই হয়েছে। একটা কাজ অবশ্য জুটল। তবু এই বয়েসে এত খাটুনি পোষায় কখনও? দীপঙ্করের খুব খারাপ লাগল। মাঝে মাঝে মনে হল এসবের দরকার নেই। সকলের স্বপ্ন সফল হয় না। কিন্তু বোধিকাকু শুধু আশ্বাস দিয়ে যায়। আর তো সবে কটা মাস মাত্র। সবুরেই তো মেয়া ফলে।
কিন্তু সবুরে তো শুধু মেয়াই ফলে না। ফলতে পারে বিষফলও। রিটায়ার করার মাস দুয়েকের মধ্যেই দীপঙ্করের বাবা অতীত হয়ে গেলেন। আর বর্তমানের সব দায়িত্ব এসে পড়ল দীপঙ্করের কাঁধে। এখন সে একটা ভারবাহী পশু মাত্র যে সংসারের জোয়াল শুধু টেনেই যাবে আর টেনেই যাবে। চোখ তার ঠুলি দিয়ে ঢাকা। স্বপ্ন আর দেখবে কি করে? সব কাজ মিটে যাবার পরে অন্যদিনের মত আজও সে গেল। অন্যদিন যেমন উৎসাহে উজ্জ্বল মুখে নিয়ে যেত বোধিসত্ত্বের কাছে তেমন নয়। আজ গেছে মুখ কালো করে। অন্যদিন আবদার করে বলত, কাকু স্কলারশিপটা আমি পাব তো? আজ হয়ত আবার সেই কথাটাই বলবে, কাকু, স্কলারশিপটা আমি পাব তো?
আশা তাকে ছাড়ে নি এখনও। তার আশা তাকে বলছে যদি একবার মুম্বাইতে যেতে পারে তবে সেখানে রামানুজমের কাছে শিখতে শিখতেও হয়ত দুটো গানের টিউশনি পেতে পারে। আর যদি তা হয় তবে তো সোনায় সোহাগা। নিজের থাকা খাওয়ার খরচ চালিয়েও বাড়িতে কিছু পাঠাতে পারবে।
বোধিকাকুর বাড়িতে ঢোকার আগেই বাইরে থেকে মায়ের গলা শুনল। তবে নিশ্চয় কাকুকে তার কথাই বলতে এসেছে মা। যাতে সে মুম্বাই যেতে পারে আর সেখানে গান শিখতে শিখতেও গানের টিউশনি পেতে পারে। মায়ের মন মুখে যাই বলুক মনে আর এক রকম।
-ঠাকুর পো বুঝতেই তো পারছ এখন আমার অবস্থা। মা কেঁদে পড়েছে, তোমার দাদা নেই। মেয়েটার বিয়েও তো দিতে হবে। সে নাহয় দুটো বছর দেরি। এই দুটো বছর মেয়েটাকে আমার যা হয় একটু শিখিয়ে দাও। গরিবের বাড়ি। কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা তো দিতে পারব না। উচ্চমাধ্যমিক পাশটা করে যাবে মনে হয়। ওর দাদার মত গবেট তো আর নয়। আর একটু গানটা শেখা থাকলে –বুঝতেই তো পারছ মেয়েটাকে আমার পার করতে যদি পারি। এইটুকু সাহায্য কর ভাই। ভগবান তোমার ভালই করবেন।  
বাইরেই থমকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনছিল দীপু। এখন আর চেষ্টা করেও চলতে পারছে না। অবশ পা দুটো যেন আর টেনে নিয়ে সে ঢুকতে পারবে না বাড়ির ভেতর।
বোধিসত্ত্ব বলল, কিন্তু দীপু-
-আরে দূর দূর। দুদিনের খেয়াল ছেলেটা এমনিই ভুলে যাবে। আর এখন সংসারটা তো ওকেই টানতে হবে যে ভাই। ওর কথা তুমি ছেড়ে দাও। বাবা যেমন পাগল ছিল ছেলেকেও তেমন পাগল করেছিল।
মা বেরিয়ে এল বোন তৃণার হাত ধরে। একটু আড়ালে সরে গেল দীপু। তারা চলে গেলে ভাবল আর বোধিকাকুর সঙ্গে দেখা করে লাভ কি? আবার ভাবল লাভ তো একটা আছেই। ঢুকে গেল সে। আশা নিয়ে কাকুকে স্কলারশিপের কথাটা বলতেই এসেছিল সে। কিন্তু ভিক্ষাপ্রার্থীর মত তাকে বলতে হল, কাকু একটা যাহোক কাজ দেখে দিতে পারেন না আমার জন্যে? মায়ের কষ্ট যে আর দেখতে পারি না। ওপরে ওপরে মা আমাকে গালাগালি করে কিন্তু আড়ালে যে আমার জন্যে কান্নায় তার বুক ভেসে যায়।
তার দিকে অবাক হয়ে তাকাল বোধিসত্ত্ব। দীপু আবার বলল, বুঝতেই তো পারছেন বাবা আর নেই। সংসারটা টানতে তো হবে?
আগেকার সেই অভ্যাস এখনও তার বজায় আছে দীপুর। সূর্য ওঠার আগে সে ওঠে।  এখনও সে মাঠের ঘাসজমি দিয়ে হাঁটে। তবে ঘাসের জমি দিয়ে হেঁটে মাঠ পেরিয়ে সে যায় স্টেশনের দিকে। স্টেশনে ওঠে হাওড়ার গাড়িতে। এখন সে যায় বড়বাজারে কাজ করতে। যে আঙ্গুলগুলো একদিন হারমোনিয়ামের রিডে সুমধুর সুর তুলত সেগুলো সম্মিলিত ভাবে আজ বস্তার ভার তোলে এই যা পার্থক্য।
আর একটা পার্থক্যও আছে। আজ মাঠের ঘাস, গাছপালা, ফড়িং প্রজাপতি, আকাশের মেঘ কেউ আওয়াজ করে না। কেউ আর সুর তোলে না তার কানের সামনে। সব যেন কেমন চুপচাপ হয়ে গেছে। নিঃশব্দেই মাঠটা পেরিয়ে আসে দীপঙ্কর।
...(সমাপ্ত)...

No comments:

Post a Comment