![]() |
ছবি : ইন্টারনেট |
বিদ্যাসাগরের ক্রীড়ানুরাগ
অভিজিৎ দাশ
দুশো দুই বছর আগে ১৮২০ খ্রিস্টাব্দে ২৬ শে সেপ্টেম্বর হুগলি জেলার বীরসিংহ গ্রামে (পরে মেদিনীপুর জেলা) এক শিশু ভূমিষ্ঠ হয়েছিল ভগবতী দেবীর কোল আলো করে। জন্মের সময়ই তার ঠাকুরদা তাকে 'এঁড়ে বাছুর' হিসেবে সম্বোধন করেছিলেন। পরবর্তীতে তার জীবনে এই 'এঁড়ে বাছুরপণা' অর্থাৎ একগুঁয়েমি তাকে সব সৎকাজে সফল করে তুলেছিল। ছোটোবেলায় দুষ্টুমি, পড়াশুনা থেকে শুরু করে সংস্কৃত কলেজে সঠিক শিক্ষার পরিবেশ নিয়ে আসা, সাহিত্যসৃষ্টি, বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন, দান-ধ্যান, বিধবা বিবাহ প্রবর্তন প্রভৃতি কাজে তার একগুঁয়েমি তাকে সঠিক পথ দেখিয়েছে। যখন
যে কাজ ধরতেন তখন সেই কাজ করেই ছাড়তেন।।
'গোপাল' এবং 'রাখাল'-- দুই বিপরীত চরিত্র বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন বালক চরিত্রের তিনি স্রষ্টা। 'বর্ণপরিচয়' প্রথম ভাগে গোপাল ও রাখালের দেখা মেলে। "খেলিবার ছুটি হইলে, যখন সকল বালক খেলিতে থাকে, গোপালও খেলা করে। অপরদিকে "রাখাল, পড়িতে যাইবার সময়, পথে খেলা করে, মিছিমিছি দেরি করিয়া, সকলের শেষে পাঠশালায় যায়।" বিদ্যাসাগরের মতে, "অবোধ বালকেরা সারাদিন খেলিয়া বেড়ায়, লেখাপড়ায় মন দেয় না। এজন্য তাহারা চিরকাল দুঃখ পায়।" 'বর্ণপরিচয়ে'র দুটি ভাগ থেকে উক্ত পাঠগুলি পড়ে যে কেউ মনে করতে পারে তিনি লেখাপড়াকে খেলার চেয়ে গুরুত্ব দিয়েছেন। খেলা না করলে যেন ভালো থাকা যায় না। তার জীবন কিন্তু তা বলে না।
বরং তিনি ছোটোবেলায় 'ভালো ছেলে' গোপালের চেয়ে 'দুষ্টু ছেলে' রাখালকে অনেক ক্ষেত্রে ছাপিয়ে যেতেন। দুষ্টুমিতে প্রতিবেশিরা অতিষ্ঠ হয়ে পড়ত। প্রতিবেশির বাড়ির দরজায় মলত্যাগ করে রাখা কিংবা সাদা কাপড় রোদে দেওয়া থাকলে তাতে মল লাগিয়ে দেওয়ার মতো দুষ্টমি করতেন তিনি। ধানক্ষেতের কাছ দিয়ে যাওয়ার সময় অপরিণত ধানের শীষ ছিঁড়তেন। এগুলির মধ্যে কিছু খেতেন, কিছু ফেলে দিতেন। একবার যবের শীষ এভাবে খেতে গিয়ে গলায় আটকে মৃতপ্রায় হয়েছিলেন। তাকে যে কাজ করতে বলা হত তার বিপরীত কাজ করতেন। নোংরা কাপড় ছেড়ে পরিষ্কার কাপড় পরতে বললে তিনি নোংরা কাপড় পরে পাঠশালায় যেতেন। যেদিন স্নান করতে বলা হত সেদিন স্নান করতেন না। এর বিপরীত বললে আবার বিপরীত কাজ করতেন। এজন্য শাস্তি তো ছিলই, তাছাড়া অভিভাকরা তাকে জব্দ করতে উল্টো কাজ করতে বলতেন। তাহলে তিনি ঠিকঠাক কাজ করতেন।
আসলে তিনি পড়াশুনো বাদ দিয়ে শুধু খেলা, মারামারি করা, অন্যের ক্ষতি করা ইত্যাদিকে ভালো নয় বলেছেন। 'বর্ণপরিচয়', দ্বিতীয় ভাগে তার সৃষ্ট যাদব ও নবীন পড়াশুনা না করে সারাদিন খেলে বেড়ায়। তারা অন্যদের পড়া বাদ দিয়ে খেলতে বলে। এ অভ্যাসকে বিদ্যাসাগর ত্যাগ করার কথা বলেছেন। তিনি পড়ার সময় পড়া ও খেলার সময় খেলা করার শিক্ষা দিয়েছেন। তাই খেলার জন্য নবীন এক বালককে টানাটানি করলে সে বলে, "আমি পড়িতে যাইতেছি, এখন খেলিতে পারিব না। বাবা আমাকে পড়িবার সময় পড়িতে ও খেলিবার সময় খেলিতে বলিয়া দিয়াছেন। আমি যে সময়ের যে কাজ, সে সময়ে সে কাজ করি।" এটাই তো হওয়া উচিত। বিদ্যাসাগরও পড়াশুনায় পাশাপাশি খেলাধুলা করতেন। তাছাড়া খেলা মানে মারামারি নয়, তিনি খেলাকে সংহতির অঙ্গ হিসেবে দেখেছেন। তাই তার সৃষ্ট সুবোধ বালকেরা কিংবা তিনি নিজে খেলার সাথীদের ভাই ও বোনের মতো দেখতেন।
মেধাবী ও দুষ্টু এই ছেলেটির শিক্ষার সাথে সাথে খেলাধুলার প্রতি যথেষ্ট আগ্রহ ছিল। গ্রামের ও বাড়ির বালকদের নিয়ে গঠিত তার খেলার দলে রোগাটে ছেলেটি (বিদ্যাসাগর) তার অদম্য প্রাণশক্তির বলে বলীয়ান হয়ে অন্যদের হারিয়ে দিতেন। এক্ষেত্রেও তিনি চাম্পিয়ন।
বাড়িতে থাকলে 'শচী বামনী' নামে গ্রামের একটি পুকুর পাড়ে ছিল তার খেলার স্থান। ছোটো দেহের মানুষটি মাঝে মাঝে অসুস্থ হয়ে পড়তেন। তবু তাকে কুস্তির লড়াইয়ের হারানো যেত না। এক্ষেত্রেও জেদ তার সফলতার অস্ত্র ছিল। "তাহার গ্রাম্য সহচরদিগের মধ্যে দুই একজন বিশালদেহ ও বলশালী ছিলেন। গদাধর পালের নামই বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। দেহের আয়তন এবং শক্তি-সামর্থে নিজ নামের সার্থকতা সম্পাদন করিতেন। ইশ্বরচন্দ্র ভিন্ন অন্য কেহ তাহাকে পরাস্ত করিতে পারিতেন না। ক্রীড়াক্ষেত্রে ঈশ্বরচন্দ্রের আক্রমনে গদাধর যখন ধরাশায়ী হইতেন, তখন সকল বালকই আনন্দে দিশেহারা হইয়া করতালি অট্টহাস্যে পুষ্করিনী ও প্রান্তর প্রতিধ্বনিত করিত।"১ এরকম লড়াই তার প্রিয় ছিল।
বাড়িতে থাকলে তিনি ছোটো বালকদের সাথে কপাটি খেলতেন। শুধু তাই নয় লাঠি খেলা, কুস্তি লড়াই ছিল তার ক্রিয়াচর্চার অঙ্গ। কলকাতায় যখন পড়াশোনা করতেন তখন তার এইসব খেলাধুলা বজায় ছিল। বীরসিংহে ফিরলে তিনি তার খেলার সাথীদের জুটিয়ে নিতেন। তার খেলার সাথী ছিল পাড়ার বালকরা এবং নিজের ছোটো ভাইরা।
তার খেলার প্রতি অনুরাগ আরেকটি ঘটনায় প্রকাশ পায়। ঘটনাটি তাদের বাড়িতে ডাকাতিকে কেন্দ্র করে। একরাতে ৪০/৫০ জন ডাকাত অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে তাদের বাড়ির সদর দরজা ভেঙে ঢুকে পড়ে। এতজন সশস্ত্র ডাকাত দেখে বিদ্যাসাগর, ভাই-বোন, বাবা ও মা সবাই পিছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে যান। ফাঁকা বাড়িতে অবাধে ডাকাতরা তাদের কাজ সেরে চলে গেল।
বিদ্যাসাগর ওই রাতেই পুলিশকে খবর দিলেন। কিন্তু পুলিশ এল পরের দিন। হেলতে দুলতে এসে দারোগা উল্টে যে বাড়িতে ডাকাতি হল সে বাড়ির মালিকের কাছে ঘুষ চেয়ে বসল। ঠাকুরদাস কিছুতেই ঘুষ দেবেন না। তবে কুলীন ব্রাহ্মণ হিসেবে কিছু দিতে পারেন। এতে দারোগা রেগে গেলেন। এত বড়ো আস্পর্ধা। ঠাকুরদাস ও দারোগার কথাবার্তা চলার সময় বিদ্যাসাগর কিন্তু ভাইদের সাথে কপাটি খেলছিলেন। এ দেখে দারোগাটি বলল, "এই বুড়ো বামনাটার খুব মেজাজ দেখছি। আর ঐ ছোড়াটাই বা কী রকম! কাল বাড়িতে ডাকাতি হলো, আর ও কিনা স্বচ্ছন্দ মনে কপাটি খেলছে।" একথা শুনে চৌকিদার দারোগাকে বললে, "হুজুর, যাকে আপনি ছোড়া বলছেন, উনি কিন্তু সামান্য লোক নন। বড়োলাট ও ছোটোলাট বাহাদুর ওকে বিশেষ খাতির করেন।"
একথা শুনে দারোগাটি আর তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতে সাহস পেলেন না। তিনি বিদ্যাসাগর এবং তার বাবাকে সমীহ করে কথা বলতে লাগলেন। তবে তারা দারোগাকে ঘুষ দেননি।২
ঘটনাটি থেকে এটা পরিস্কার, বড়ো হয়ে যখন বিদ্যাসাগর বাংলা ও ভারতের ব্রিটিশ শাসকদের কাছ থেকে যোগ্য সম্মান পাচ্ছেন তখনও কপাটি খেলা ছাড়েননি। এমনকি বাড়িতে সদ্য ডাকাতি হওয়ায় সাধারণ মানুষদের মনে যে শোকের আবহাওয়া থাকে তা ক্রীড়ারত বিদ্যাসাগরকে ক্রীড়া থেকে দূরে রাখতে পারেনি।
আসলে ক্রীড়া মানুষের দৈহিক স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটায়। তাছাড়াও ক্রীড়া মানসিক শক্তির বিকাশ ঘটাতে সাহায্য করে। ক্রীড়া সুস্থ দেহ, সুস্থ মন গড়ে-- এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। ক্রীড়াক্ষেত্রে তার স্বাধীনচেতা মনোভাব পরবর্তীতে তার কাজের ক্ষেত্রে বিকশিত হয়েছিল। চণ্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, "যে স্বাধীন ভাব তাহার শৈশবের ক্রীড়া-কৌতুকে, বাল্যকালের চপলতা ও দৌরাত্ম্যে মুকুলিত হইয়াছিল, যাহা ছাত্ররূপে তাহাকে সর্বোচ্চ সম্মানের অধিকারী করিয়াছিল, সেই স্বাধীনচিত্ততাই কর্মক্ষেত্রে পূর্ণরূপে প্রস্ফুটিত হইতে আরম্ভ করিয়াছে।"৩ এক্ষেত্রেও তিনি অনন্য।
--------------------------------------
তথ্যসূত্র--
১/ বন্দ্যোপাধ্যায় চণ্ডীচরণ-- বিদ্যাসাগর, পৃ ৩৫
২/ সেনগুপ্ত সত্যপ্রকাশ-- বিদ্যাসাগর স্মৃতি (১৯৯২), ক্যালকাটা বুক হাউস, পৃ ৮৪--৮৫
৩/ বন্দ্যোপাধ্যায় চণ্ডীচরণ, প্রাগুক্ত, পৃ ৭৪
...(সমাপ্ত)...
No comments:
Post a Comment