1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Sunday, September 25, 2022

চিরন্তন

ছবি : ইন্টারনেট

চিরন্তন

সৌরভ সুন্দর প্রধান

      আজকের দুপুরটা যেন কামারশালার তপ্ত লোহা। এপ্রিলের শেষে ও এতটা গরম ছিল না, যেই না মে মাস পড়ল হঠাৎ করে গরমটা এলো । দিন দুয়েক আগে একটা কালবৈশাখী হয়েছিল ঠিকই কিন্তু তার প্রভাব তো পরের দিন সকাল অব্দি। কল্যান এর আজই একটু পরে বেরোলেও চলবে, অফিসের একটা কাগজ শুধুমাত্র দমদম পুরসভায় পৌঁছে দিলেই হল। কল্যাণ কলকাতা পুরসভায় কাজ করে তাই প্রতিদিন দমদম থেকে সকাল সকাল ট্রেন ধরতে হয়। আজ অবশ্য বাজার যাওয়ার ব্যাপার ও নেই, কারন কাল বাড়ি ফেরার পথে স্টেশান থেকে আনাজপাতি নিয়ে এসেছিল, আর সারা সপ্তাহ এর মাছ, মাংশ ফ্রিজে মজুত থাকে। ঘুম ভাঙ্গার পর রান্নাঘর থেকে আগত শব্দে বুযতে পারে কবিতা উঠে পড়েছে এবং রান্নার মাসির সঙ্গে রান্নার তদারকি করছে।ওদের ডাবল রুম ফ্লাট এর ছোট রুমটাতে কল্যাণ একাই ঘুমোয় আজ প্রায় চার বছর হল।অন্য রুমটাতে কবিতা আর অরন্য ঘুময়।অরন্য ওদের তিন বছরের ছেলে।অরন্য যখন হব হব করছে তখন কবিতার রাতে ঘুম আসত না ও বই পড়ত, কিন্তু পরের দিনের অফিস থাকার জন্য কল্যাণ এর ঘুমের প্রয়োজন ফলতঃ অন্য রুমে শোয়া।তারপর থেকে এমনই চলছে।কবিতা একটা স্কুলে এডুকেশান পড়ায়। ওদের দেখাশোনা করে বিয়ে। কল্যাণ এর বাবা মা বারাসতে থাকে, কবিতার বাপের বাড়ি হাব্ড়ায়।কবিতার এক কলিগের বর কল্যাণ এর অফিস এ কাজ করে। ওদের সুত্রেই আলাপ, তারপর রেস্তরাঁ , সিনেমা, ঘোরাফেরা কাছে আসা এবং দুই বাড়ির মত নিয়ে সামাজিক বিবাহ। তাই ওদের বিবাহ পুরোপুরি সামাজিক বা গান্ধর্ব মতে নয়। কল্যান তখন থাকত গড়িয়ার একটা মেসে, আর কবিতার স্কুল ছিল বীরাটিতে ও ডেলি প্যাসেঞ্জারি করত।যেদিন পারত না সেদিন দুরগানগরে ওর মাসির বাড়িতে থেকে যেত।বিয়ের কথাবার্তা হওয়ার পর যৌথ লোণ নিয়ে এই আটশো স্কয়ার ফিটের দমদম এর ফ্ল্যাটটা কিনে নেয়।আর এক বছর পর অরন্য আসে কবিতার কোলে, ছেলে হওয়ার পর মেটারনিটির ছয় মাস মা, বাবার কাছে হাবরাতেই ছিল।স্কুলে জয়েন করার পর এখানে এসেছে।প্রথম দিকে কল্যাণ এর মা ও শাশুড়ি পালা করে এখানে এসে থাকত, পরে এখানকার এক অবিবাহিত মেয়ে অরন্যর দেখভাল করে। সকাল নটা থেকে রাত্রি আটটা অব্দি থাকে।

       বিছানা থেকে উঠে এক ঝলকে অন্য রুমটাতে দেখে ছেলে এখনো ঘুমচ্ছে আর টেবিল এ বসে কবিতা কিছু করছে, একটু আগের কোনো ভারী কাজের জন্য ওর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘামের ফোঁটা।মাঝারি গড়নের কবিতা মোটের ওপর সুন্দরী, ছেলে হওয়ার পর চেহারায় খুব একটা পরিবর্তন ও হয়নি।রাস্তা ঘাটের উঠতি ছেলেদের চোখ থাকতো কবিতার দিকে যা গর্বের সঙ্গে সঙ্গে বিরক্তির ও উদ্রেক করত।বন্ধু মহলে সবাই বলত কপাল বটে কল্যাণের, সুন্দরী বউ, আবার মাস গেলে এক থোক টাকা।মুখে কৃত্রিম বিরক্তি প্রকাশ করলেও মনে মনে একটা চাপা গর্ব অনুভব করত। সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে বাথরুম এর বাইরে বার হতেই ছেলে ছুটে ওর কোলে উঠে পড়ে আর কবিতা ব্রাশ নিয়ে ওর পিছনে আসে। সময় থাকার জন্য আজ ওকে তৈরি করার দায়িত্ব নেয় কল্যাণ আর কথায় কথায় কবিতা কে বলে আজ যদি ও একটু তাড়াতাড়ি ফেরে তাহলে একটা সিনেমা দেখা যেতে পারে।জবাবে কবিতা জানায় নতুন বড়দি খুব কড়া, ওকে অনুরোধ করার মানে হয় না।এই হয়েছে এখনকার কবিতা, কোনও কিছুতেই আর আগ্রহ বা উৎসাহ নেই।প্রথমের দিকে কল্যাণের শুধু একটু সময় কাটানোর জন্য কাজের পরে বাড়ি না ফিরে দুরগানগরে ওর মাসির বাড়িতে থেকে যেত। একবার অ্যাকাডেমি তে একটা নাটক দেখার কথা ছিল কিন্তু কল্যাণের অফিস এর একটা কাজ এসে যাওয়াই শেষ মুহূর্তে যেতে পারেনি, একটা পুরো সপ্তাহ কথা বন্ধ ছিল।পরে রাগ ভাঙাতে দুটো ছুটি নিয়ে থিয়েটার দেখাতে হয়েছিল।ছেলে হওয়ার পর সব কিছুতেই ওর দোহাই দিতো, পরে স্কুলের দোহাই দিল।প্রথম দিকে অতটা পাত্তা না দিলেও বিবাহিত জীবনের শীতলতা এখন ওকে প্রায় কাতর করে তলে।বিয়ের মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যে জীবনটাতে এমন মোড় আসবে তা আশা করেনি।চেষ্টা যে একদম করেনি তা নয়, বন্ধুর মত কবিতা কে বোঝাতে গেছে, কিন্তু কবিতার শীতলতা এবং নিঃস্পৃহ ভাব ওকে নিবৃত করেছে। আজ অনেক কথাই কল্যাণ এর মনে পড়ে যাচ্ছে আলাপের প্রথম দিকে হঠাৎ একদিন একটা ব্যাগ নিয়ে কল্যাণকে দেয় যার ভেতর প্রায় দশ পনেরোটা নানান আকৃতির খামে ওর কথামত এখনো পর্যন্ত পাওয়া প্রেমপত্র। যার প্রথমটা মাধ্যমিক, এবং শেষটা ইউনিভার্সিটিতে পাওয়া। কবিতা নাকি কোনটারই উত্তর দেয়নি, আর জীবনের প্রথম লেখা প্রেমপত্রটা সেদিন কল্যাণ এর হাতে তুলে দিয়েছিল।সেদিনের সেই রাত্রিটা কেমন একটা ঘোরের মধ্যে কেটেছিল আর জেনেছিল এক অবিবাহিত মেয়ের স্বপ্ন আশা, চাওয়া, পাওয়া ও ভালবাসার গল্প।এই গল্প কে বাস্তবায়িত করার দায়িত্ব যে এখন থেকে তার তা ভেবে খুব অন্যরকম লেগেছিল। তাই এখনকার এই শীতলতা যে বিবাহ বহির্ভূত কোনও কারনে হতে পারে তা কল্যান ভাবতেও পারে না। সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে ছেলেকে খাওয়াতে বসলো কল্যাণ এর মধ্যে নুপুর ও চলে এলো। ব্যস্ত কবিতা নুপুরকে সারা দিনের কাজের দায়িত্ব বুঝিয়ে ওদের কাছ থেকে বিদায় নিল, আলগোছে কল্যাণ দেখল আজ কবিতাকে খুব ভাল লাগছে।

      দস্যি অরণ্যকে সামলানো মুখের কথা নয় এইটুকু সময়ে ভালই বুঝল কল্যাণ ।কখন যে সাড়ে দশটা বেজে গেছে খেয়াল ছিল না।সকাল থেকে চা ছাড়া কিছু না খাওয়ার জন্য বেশ খিদে খিদে পাচ্ছিল, তাই চান সেরে তাড়াতাড়ি খেতে বসে গেল।কবিতা নিজের হাতে পরিপাটি করে সব গুছিয়ে গেছে, টিফিন ক্যারিয়ার এ কিছু ফল ও কেটে গেছে বিকেল এর জন্য ।খেতেখেতে মনে হল সত্যি কি সব কিছু খুব পালটে গেছে? মনে হতে লাগলো মাতৃত্ব এর মত কঠিন দায়িত্ব পালনে কবিতা হয়ত সাময়িক পরিবর্তিত কারন ভালবাসা চিরন্তন।এইসব মনে হতে, একটা ভাল মন নিয়ে কাজে বেরোল কল্যান।আজ সাইকেল নিয়ে বেরোল কারন অটো করে গেলে দুবার পালটাতে হবে আবার দুপুর এর দিকে অটো কমে আসে।বাইরে বেরতেই রোদের তাপ গায়ে লাগলো । লু বইছে, রাস্তা ঘাট প্রায় ফাঁকা, ঘড়িতে সবে পৌনে বারোটা। ওদের ফ্ল্যাট থেকে মেন রাস্তায় যাওয়ার পথে একটা ঝিলের পাস দিয়ে যেতে হয়।ঝিলটা খুব বড় আর পাড়টা বাঁধানো, বিকেলের পর থেকেই কাপলরা বসতে শুরু করে, উলটো দিকটাতে আবার একটু সন্ধ্যার দিকে কিছু সমাজবিরোধী কার্যকলাপের খবর ও পাওয়া যায়।পুলিশ এর আনাগোনা লেগেই থাকে তাই সন্ধ্যের দিকে এদিকে পারত পক্ষে আসে না ওরা। এই তীব্র দাবদাহে ঝিলের পাশ দিয়ে যেতে ভালই লাগছে, জলো হাওয়ায় গরমটা একটু কম করছে। পাড়ে কিছু বড় গাছ ও আছে, কোনও কোনও জায়গায় আবার খুব ঘন গাছপালা।দুর থেকে কল্যান দেখল এইরকমই এক গাছের ছাওয়াতে বসে আছে এক নর নারী, দূরে একটা রিকশা দাড়িয়ে।ওদের কাছে এসে সাইকেলটা একটু আস্তে করলো কল্যান। দেখল পচা নামের যে রিকশাওয়ালাটি ষ্টেশন সংলগ্ন রিকশা স্ট্যান্ডে থাকে ও ওর বউ এর সাথে বসে এক মনে খাচ্ছে, বউটি একটু দূরে বসে ওর কথা শুনছে।দুজনেই পাশের ঘটে চলা দুনিয়া থেকে অনেক দুরে।গ্রীষ্মর এই প্রখর দাবদাহে যখন সবাই অস্থির, অসহ্য পরিস্থিতিতে যখন সবাই কাতর,  অথচ এই দুই নরনারির মুখের প্রশান্তি দেখে বোধ হয় কোনও পাঁচতারা হোটেলের শীততাপ নিয়ত্রিত রেস্টুরেন্ট এ বসে কোনও বিখ্যাত শেফের রান্না পরখ করছে।জগত সংসার এর কারোর বিরুদ্ধে যেন এদের অভিযোগ নেই, যা পেয়েছে তার বেশী আর যেন দরকার ও নেই। আরো কাছে আসাতে কল্যাণ দেখতে পেলো ডাল, ভাত এর সঙ্গে এক কুচি পেঁয়াজ ওদের গ্র্যান্ডল্যাঞ্চে। একটু আগে কল্যাণ দুটো সবজি, ডাল ও মাছের ঝোল খেয়ে বেরিয়েছে, এতোটা তৃপ্তি কি ছিল ওর খাওয়ায়? কিসের অভাব ছিল ওই খাওয়ায়, কাঁচের টেবিল এ, ফারনিশ করা তেতলা শীততাপ নিয়ন্ত্রিত ডাইনিং হলে? পচার এই খাওয়া কি স্পেশাল শুধু ওর সঙ্গিনীর উপস্থিথি, ওর কথা, ওর খাওয়ার নিয়ে আসা এবং ত্বতাবধানে। আজ রাতেই হয়তো বা বাড়ি ফিরে নেশার ঘোরে ওর বৌ মার খাবে, ওদের বাচ্চাদের হয়ত আজ ও সেদ্ধভাত কারন নিজের রোজগারে বাবা নেশা করেছে। সারাদিন বাবুদের বাড়ি কাজ করে ওর বৌ হয়তো আজ ও বরকে শুইয়ে নিজে তাড়াতাড়ি ঘুমবে কালকে তাড়াতাড়ি কাজের জন্য বা এই ভেবে কাল হয়ত ওদের একটা ভালো দিন আসছে, ওর বরের ভালো আয় হবে আর রাতে ভালো খাওয়া দাওয়া। ওদের চালের ফুটো দিয়ে আসা চাঁদের আলো ও যেন ওদের আদর করে ঘুম পাড়িয়ে দেবে। আর নিজের দামি বিছানায় কৃত্রিম নাইট লাম্পপের মায়াবি আলোয় কল্যাণ এর ঘুম আসবে না। বিধাতা বোধকরি সবটুকু ভালো নিজে ছাড়া কারোকেই দেয় না। নাহলে কে সুখী কল্যাণ না ওই মাতাল রিকশাওয়ালা। এর উত্তর বোধহয় বিধাতাই দিতে পারবেন।

সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে ষ্টেশন এর কাছাকাছি চলে এসেছে কিন্তু দূর থেকে দেখল কবিতা হনহন করে এইদিকেই আসছে হাতে ফুলের তোড়া আর একটা গিফট এর বাক্স।কাছে এসে কবিতা ওকে দেখে হেসে ওকে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে বলে কাজ সেরে। কল্যাণ জানতে চায় এত তাড়াতাড়ি স্কুল ছুটি হল কেনো? জবাবে মুচকি হেসে জানায় আজ ওর একটা স্পেশাল ডে, স্কুল এ যায়ই নি। তাড়াতাড়ি আসতে বলে কবিতা হাঁটা লাগায়। ওর চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে কল্যান এর মনে পড়ে আজ নিজের জান্মদিন। এখন অফিসের কাজে যাবে না, ছুটে কবিতার পেছনে গিয়ে ওকে সাইকেলে বসিয়ে বাড়ি ফিরবে এই দোলাচলে ভুগিয়ে অলখে কেউ তৃপ্তি পেলো না তো? হঠাৎ করে সূর্যটা কি চাঁদ হল? আনন্দে কল্যানের চোখের কোনটা একটু ভিজে উঠলো।

...(সমাপ্ত)...

No comments:

Post a Comment