1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Sunday, September 25, 2022

মানবতা

ছবি : ইন্টারনেট

মানবতা 

সুমন বেরা


গ্রামের নাম আমডোবা। মেদিনীপুর রেল স্টেশন থেকে তিন কিলোমিটার দূরে গ্রামের অবস্থান। এই গ্রামে প্রায় একশোজন মানুষের বসবাস। ইন্দ্র তাদের একজন। ইন্দ্র তেরো বছরের বাপ - মা মরা ছেলে, এখন তার ঠিকানা আমডোবা গ্রামের মাসির বাড়ি। ইন্দ্রর মাসি - মেসো নিঃসন্তান দম্পতি, পাঁচ বছর বয়সে যখন ইন্দ্রর মা-বাবা পথ দুর্ঘটনায় মারা গেলেন, তখন থেকে ইন্দ্রর মাসি আর মেসো ইন্দ্রকে কোলে-পিঠে করে মানুষ করছেন, নিজের ছেলের মতোই তারা ইন্দ্রকে ভালোবাসেন। ইন্দ্র খুব মেধাবী ছেলে, বড় হয়ে ডাক্তার হবে, বিনে পয়সায় মানুষকে চিকিৎসা করবে। মনে মনে সে এমন ইচ্ছা লালন করে চলেছে। কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে আর্থিক অভাব - অনটন । ইন্দ্র সবই বুঝতে পারে, তাই তাকে উপার্জনের তাগিদে ছুটির দিনে চকলেট, ছোলাভাজা, মটরভাজার প্যাকেটগুলো নিয়ে বাইরে বেরিয়ে পড়তে হয়। আগের দিন পাইকারি দরে পাড়ার দোকান থেকে মাসি চকলেট, ছোলাভাজা, মটরভাজা কিনে এনে দেন আর ইন্দ্র তা ছোট ছোট প্যাকেটে ভরে নেয়। ইন্দ্রর মাসি সুভদ্রাদেবী গৃহবধূ আর মেসো আকাশ হালদার ভাগচাষী, লোকের জমি ভাগে চাষ করে অন্নসংস্থান করেন। ব্যক্তিগত জমি-জমা কিছুই নেই। মাটির দেওয়াল তোলা টিনের ছাওয়া দু'কামরা ঘর, তার একটিতে থাকে ইন্দ্র আর অন্যটিতে তার মাসি আর মেসো। 

                            আজ শনিবার,  ঘর থেকে স্কুলে যাওয়ার সময় তার বই - খাতার ব্যাগটার সাথে  চকলেট, ছোলাভাজা, মটরভাজা ভরা ব্যাগটাও সঙ্গে নিয়েছে। রেল স্টেশনের কাছেই স্কুল, সে স্কুল ছুটি হওয়ার পর স্টেশনে গিয়ে ওগুলো বিক্রি করবে। স্কুলে ছুটির ঘন্টা পড়তেই ইন্দ্র ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে পড়ল , স্টেশনের দিকে সে হাঁটতে শুরু করল, কিন্তু মাঝপথেই হটাৎ ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি শুরু হল, ইন্দ্র এক নিশ্বাসে দৌড়ে গিয়ে তাড়াতাড়ি করে স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে উঠে পড়ল। সে প্রায় অর্ধসিক্ত, বই-খাতার ব্যাগটাও খানিকটা ভিজে গেছে। আজ স্টেশনে যাত্রী তেমন নেই, তাই স্টেশনের যাত্রী প্রতীক্ষালয়ে ঢুকে সে নিজেকে প্রস্তুত করে নিচ্ছে, নিজেকে প্রস্তুত করে নিচ্ছে এক ক্ষূদ্র বিক্রেতা হিসেবে, সে যাত্রী প্রতীক্ষালয়ের চেয়ারে বসে অপেক্ষা করছে ; কোন ট্রেন স্টেশনে থামলে সে সেইদিকে এগিয়ে যাবে। ইন্দ্রর পাশেই একজন ভদ্রলোক বসে আছেন, তার পরনে ইস্ত্রি করা সাদা রঙের ফুলহাতা জামা আর কালো প্যান্ট, পায়ে চামড়ার চকচকে কালো বুটজুতো, ডানহাতে একটি ফাইল আর বামহাতে সোনালী রঙের হাতঘড়ি, সাথে চোখে চশমা আর বামদিকে কাঁধে ব্যাগ রয়েছে । যদিও চোখে চশমা রয়েছে, তবে তিনি দেখছেন চশমার ওপর দিয়ে। তিনি ইন্দ্রকে হটাৎ জিজ্ঞাসা করলেন - 

তোমার নাম কী ? 

ইন্দ্র এক্কেবারে অপ্রস্তুত হয়ে উত্তর দিলো - 

আমার নাম ইন্দ্র, ইন্দ্র বিশ্বাস। 

ভদ্রলোক আবার বললেন - 

তুমি স্কুলে যাওনি ? তুমি তো স্কুলের জামা-প্যান্ট পরে আছো দেখছি, পিঠে স্কুলের ব্যাগ... 

বড় গম্ভীর ভাষায় এমন প্রশ্ন শুনে সে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেল। সে উত্তর দিলো - 

আমি মাঝে মাঝে স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে এখানে এসে চকলেট, ছোলাভাজা, মটরভাজা বিক্রি করি। আপনি নেবেন ? সকালেই প্যাকেটে ভরেছি। 

ভদ্রলোক বললেন - ঠিক আছে, দাও। প্রতি প্যাকেট কতটাকা ? 

ইন্দ্র বলল - পাঁচ টাকা। 

ভদ্রলোক এক প্যাকেট চকলেট কিনে নিলেন।

তিনি বললেন - তুমি এখা থেকে কখন বাড়ি ফিরে যাও? পড়াশুনা কখন কর ? 

সে উত্তর দিলো - দিনে আড়াইশো টাকার জিনিস বিক্রি হয়ে গেলেই আমি বাড়ি ফিরে যাই, কোন কোন দিন সন্ধ্যে হয়ে যায়। 

ভদ্রলোক এবার তাকে বিনম্রভাবে বললেন - তোমার কাছে এখন যতগুলো প্যাকেট আছে আমাকে সব দিয়ে দাও, আমি এখনই তোমাকে সব প্যাকেটগুলোর দাম দিয়ে দিচ্ছি। 

সে রাজি হয়ে গেল এবং সবগুলো প্যাকেট দিয়ে দিলো আর জিজ্ঞেস করল - আপনি সবগুলো প্যাকেট নিয়ে কী করবেন? 

তিনি বললেন - আমার অবশ্যই প্রয়োজন আছে, না হলে আমি নিতে যাব কেন? 

দূর থেকে ট্রেন আসার শব্দ শোনা যাচ্ছে, ভদ্রলোক নিজের ঘড়ির দিকে চটকরে তাকিয়ে নিলেন আর তারপর সব প্যাকেটগুলো নিজের ব্যাগের মধ্যে ভরে নিয়ে ট্রেনে ওঠার জন্য দ্রুতপায়ে এগিয়ে গেলেন,ট্রেন প্ল্যাটফর্মে এসো থামলো, যাত্রীরা গন্তব্যে যাওয়ার জন্য ট্রেন থেকে নেমে পড়লেন। তারপর ভদ্রলোক ট্রেনের কামরায় ওঠার আগে একবার ইন্দ্রর দিকে তাকিয়ে হাসলেন আর তারপর ট্রেনে উঠে পড়লেন।  কয়েক সেকেন্ড পর ট্রেন - এর বাঁশি বাজলো, ট্রেন স্টেশন থেকে রওনা দিলো। 

                   আজ ইন্দ্র বড় খুশি, সে মনে মনে ভাবছে, আজ তার কোন পরিশ্রম ছাড়াই সব প্যাকেটগুলো বিক্রি হয়ে গেছে। স্টেশনের কোলাহল ছাপিয়ে আজ তাকে চিৎকার করতে হয়নি, আজ তার প্ল্যাটফর্মে ঘুরে ঘুরে শরীর থেকে ঘাম ঝরানোর প্রয়োজন পড়ে নি, এইসব ভাবতে ভাবতে সে যাত্রী প্রতীক্ষালয়ের জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখলো ; বৃষ্টি থেমে গেছে। বইয়ের ব্যাগের মধ্যে সে তার অন্য ব্যাগটাকে ঢুকিয়ে নিলো, তারপর বইয়ের ব্যাগটা কাঁধে তুলে নিয়ে বাড়ির দিকে এগোতে শুরু করলো। বাড়ি পৌঁছতেই মাসি রান্নাঘর থেকে জিজ্ঞেস করলেন - ইন্দ্র... তুই এসেছিস বাবা....? আজ তাড়াতাড়ি চলে এসেছিস কেন ? 

সব প্যাকেটগুলো বিক্রি হয়ে গেছে? ব্যাগটা দেখতে পাচ্ছি না তো! 

ইন্দ্র উত্তর দিলো - হ্যাঁ মাসি, সব প্যাকেট বিক্রি হয়ে গেছে। 

নিজের কাছে দশ টাকার একটা নোট রেখে মাসির হাতে বাকি টাকা তুলে দিয়ে সে চুপচাপ নিজের ঘরে চলে গেল, স্টেশনের ঘটনা সে কিছুই বলল না। তার নিজস্ব সঞ্চয় বলতে মাটির তৈরি একটি লক্ষীর ভাঁড়, সে সেটা খাটের নীচ থেকে বার করে তাতে দশ টাকার নোটটা ভাঁজ করে ঢুকিয়ে রাখলো। দুপুরের খাওয়ার কিছুক্ষণ আগেই তার মেসো ক্ষেত থেকে বাড়ি ফিরলেন। সবাই একসঙ্গে দুপুরের খাবার খেলেন, তারপর  ইন্দ্র বেশ কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে পড়লো। ঘুম থেকে উঠে সে দেখলো যে, মাসি আগামীকালের জন্য সবকিছু প্যাকেটে ভরে রেখে দিয়েছেন। 

                               সন্ধ্যায় নিজের পড়াশুনা শেষ করেছে ইন্দ্র, এখন ঘড়িতে প্রায় রাত ন'টা। রাতের খাওয়া শেষ করে সে বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবছে, আগামীকাল রবিবার, কাকভোরে উঠেই বাকি প্যাকেটগুলো ব্যাগে ভরেই বেরিয়ে পড়তে হবে। ভোর হতেই ইন্দ্র যেমনটা ভেবে রেখেছিল ঠিক তেমন ভাবেই কাজ করতে শুরু করলো;  দু' মুঠো শুকনো মুড়ি খেয়েই স্টেশনের উদ্দেশ্য সে বেরিয়ে পড়লো। আজ স্টেশনে বড় কোলাহল, রবিবার ছুটির দিন তাই  সচরাচর এমন হয় না। সে বরাবরের মতোই খদ্দের আকৃষ্ট করার জন্য সেই কোলাহল ছাপিয়ে হাঁক দিতে লাগলো। তার স্টেশনে আসার পর প্রায় ঘন্টাখানেক সময় অতিবাহিত হয়েছে, এখন সে বড় ক্লান্তি বোধ করছে, খানিকটা জিরিয়ে নেওয়ার জন্য সে একটি বেঞ্চের ওপর বসে পড়েছে, সে হিসেব করে দেখলো যে এখনও পর্যন্ত নব্বই টাকার প্যাকেট বিক্রি হয়েছে । হটাৎ করে তার পেছন দিক থেকে কে যেন তার কাঁধে হাত রাখলো, ইন্দ্র পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখলো সেই ভদ্র লোকটি, যিনি আগের দিন তার কাছ থেকে চকলেক, ভাজাছোলা আর ভাজা মটরের সব প্যাকেটগুলো কিনে নিয়েছিলেন।

তিনি ইন্দ্রকে বললেন - এই কাজ আর কর না, এই সব ছেড়ে দিয়ে পড়াশুনা কর। তোমার তাতে ভালো হবে। 

ইন্দ্র উত্তর দিলো - এই কাজ আমি ছেড়ে দেব কেন ? অমি কী কোন অন্যায় কাজ করেছি? আমি নিয়মিত স্কুলে যাই, পড়াশুনা করি, আমার ইংরেজি আর ভূগোল পড়তে খুব ভালো লাগে। 

তিনি বললেল - তোমার পরিবারে কে কে আছেন? 

সে বলল - আমার মাসি আর মেসো আছেন, আমি তাদের সাথে থাকি। 

তিনি বললেন - আচ্ছা, তুমি কী আজ সারাদিন এখানে থাকবে ? তুমি আর কিছুক্ষণ এখানে থাকো, আমি তাড়াতাড়ি ফিরে আসছি। 

ইন্দ্র উত্তর দিলো - ঠিক আছে আমি থাকব, তবে দুপর হলে আমি চলে যাব। 

                       ঘন্টা চারেক সময় অতিবাহিত হয়েছে, ভদ্রলোকটি তাকে অপেক্ষা করতে বলে দিয়ে গেছেন কিন্তু এখনও আসেননি। দুপুর আসন্ন, তার সব প্যাকেটগুলো বিক্রি হয়ে গেছে। ইন্দ্র এবার প্ল্যাটফর্ম থেকে নেমে বাড়ির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, তার কানে এলো কে যেন তার নাম ধরে ডাকছে - ইন্দ্র.... দাঁড়াও... ইন্দ্র....  

ইন্দ্র পেছন ফিরে দেখলো সেই ভদ্রলোক এসেছেন, তার ডানহাতে একটি সাদা রঙের খাম রয়েছে । ইন্দ্র স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো, তিনি তার দিকে এগিয়ে এলেন এবং ইন্দ্রর হাতে খাম-টা দিয়ে বললেন - তুমি এটা নিয়ে যাও, বাড়িতে গিয়ে খুলে দেখবে। ইন্দ্র খামটা নিয়ে জামার পকেটে রাখলো এবং তারপর প্রত্যুত্তরে বললো - ধন্যবাদ, আমাকে বড় খিদে পাচ্ছে, আমি আসছি। ভদ্রলোক উত্তর দিলেন - ঠিক আছে, এসো। 

                        ইন্দ্র বাড়িতে এসে এই ব্যাপারে কাউকে কিছু জানালো না। সে স্নান করে দুপুরের খাওয়ার খেয়ে খাম-টা জামার পকেট থেকে বার করলো এবং হাতে নিয়ে তা খুলে দেখেই স্তব্দ হয়ে গেল। খামের ভেতরে রয়েছে

 দু'হাজার টাকার একটি নোট আর একটি ভাঁজকরা সাদা কাগজ, সে ভাঁজকরা কাগজটা খুলে দেখলো কাগজে কিছু লেখা রয়েছে। সে এবার সেই লেখাটি পড়তে শুরু করলো -


প্রিয় ইন্দ্র,


             আমি সৈকত ভট্টাচার্য্য, একটি ইনসিওরেন্স কোম্পানিতে চাকরি করি। তোমার অবস্থা দেখে আমি বড় কষ্ট পেলাম। স্টেশনের পাশেই যে তিনতলা সাদা রঙের বড় ঘরটা আছে ঠিক তার পেছনেই আমার অফিস। তুমি চাইলে রবিবার বাদ দিয়ে যেকোন দিন সকাল দশটা থেকে বিকেল চারটের মধ্যে আমার অফিসে আসতে পারো, তোমার সাথে কিছু কথা আছে। এই টাকা দিয়ে তুমি অবশ্যই তোমার পড়শুনার বইপত্র, খাতা-কলম ইত্যাদি কিনবে। আমি তোমার অপেক্ষায় রইলাম। 

                                ভালোবাসা ও শুভেচ্ছাসহ,

                                        সৈকত ভট্টাচার্য্য


লেখাটা পড়ে ইন্দ্রর দু'চোখে জল চলে এলো, সে তার জামার একধার হাতে টেনে নিয়ে চোখের জল মুছে ফেলছে। ঘরের জানালা দিয়ে সে আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলো - আকাশে মেঘ উঠেছে, মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, তার ডানহাতে ধরা আছে সৈকতবাবুর দেওয়া দু' হাজার টাকা আর সেই চিঠিটা। 

...(সমাপ্ত)...


No comments:

Post a Comment