1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Sunday, September 25, 2022

চলচ্চিত্র সমালোচনা : দ্য প্ল্যাটফর্ম


চলচ্চিত্র সমালোচনা : অভিষেক ঘোষ

দ্য প্ল্যাটফর্ম
The Platform(২০১৯)

সময় ৯৪ মিনিট

পরিচালক Galder Gaztelu-Urrutia.

চরিত্রায়ন Iván Massagué, Zorion Eguileor, Antonia San Juan, Alexandra Masangkay.

ভাষা -স্পেনীয়

মুক্তি- ২০২০ , নেটফলিক্স 

       আজ আমরা প্রত্যেকেই নিজের নিজের ঘরে বসে মুঠোফোনে সিনেমা বা ওয়েব সিরিজ দেখতে পছন্দ করি, সিনেমাহলে যাওয়াটা আর অভ্যাস নয়, পরিণত হচ্ছে বিলাসিতায় । তা কখনও কখনও প্রোডাক্ট যথাযথ হলে, আপনার স্মার্ট-ফোনও সিনেম্যাটিক অভিজ্ঞতা দিতে পারে বই কি ! নেটফ্লিক্স নিবেদিত, ‘দ্য প্ল্যাটফর্ম’ তেমনই একটি নির্মাণ এবং সেই সঙ্গে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক ছবি । এই ছবি বার্তা দেয়, ভয়াবহ অভিজ্ঞতা দিয়ে যায়, ভয় দেখায় আর বিভীষিকার ভ্রূকুটির মধ্যেও মনে করিয়ে দেয় সুমনের গানের সেই অনুভব, —

“কতটা অপচয়ের পর মানুষ চেনা যায় ?

প্রশ্নগুলো সহজ, আর উত্তরও তো জানা !”

    হ্যাঁ । জানা বই কী ! সেইজন্যই তো ছেলেবেলার বিজ্ঞান বইতে আঁকা পৌষ্টিক তন্ত্রের ছবিটা মনে পড়ে যায় সিনেমাটা দেখতে দেখতে । পৌষ্টিক তন্ত্রের ছবিটা ছেলেবেলায় বিশ্রী লাগতো, ঐ নাড়িভুঁড়ি, ঐ ক্ষুদ্রান্ত্র-বৃহদন্ত্রের জটিল প্যাঁচালো সহাবস্থান, বিশ্রী লাগতো । মনে হতো এই দেহের চমৎকার আবরণের ভিতরটা কতটা কুৎসিত ! ভোগসর্বস্বতাও ঠিক অমনই কুৎসিত । Denis Villeneuve পরিচালিত ছোটো ছবি ‘Next Floor’ অনেক আগেই সেই বীভৎসতা ধরেছিল ক্যামেরায় । আপনার মনে পড়তে পারে, হুমায়ূন আহমেদের 'কুটু মিয়া'-র কথাও । এবার তা জীবন্ত হয়ে উঠল Galder Gaztelu-Urrutia পরিচালিত এই স্প্যানিস্ থ্রিলারে । টরন্টো থেকে পুরস্কার জিতে আসা এই ছবি আজকের এই থমকে যাওয়া, করোনাক্রান্ত্র পৃথিবী-তে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয় । তাই কৌশিক (Q) পরিচালিত ‘তারানাথ তান্ত্রিক’-এর রিভ্যিউ লিখবো ভেবেও, তা লিখতে পারলাম না । কারণ ঐ অখাদ্য পিছনপাকা লোকটার আবর্জনা নিয়ে যত কম কথা বলা যায় ততই মঙ্গল । ভদ্রলোক (!) বাংলা সাহিত্য নিয়ে কাজ করছেন, বিশ্বযুদ্ধের সময়-কে ধরছেন, অথচ জানেন না যে, মেয়েরা যখন দাওয়ায় বা, উঠোনে বসে কাঠের জ্বালানি-তে মাটির উনুনে ভাত রান্না করে, তখন হাঁটু দুটো বুকের কাছে জড়ো করে উবু হয়ে বসে । তাতেই কাজের সুবিধা হয় । কিউ-এর ওয়েব সিরিজে মেয়েরা ওইসময় বাবু হয়ে বসে । সম্ভ্রান্ত বাড়িতে যে মেয়ের পাকা-দেখার ব্যবস্থা হয়েছে, পাত্রের বাবার সামনে তার কাঁচুলি দেখলে মনে হবে ভিক্টোরিয়াস্ সিক্রেট ফ্যাশন চলছে ! এই জ্বলজ্যান্ত করোনা-গুলো থাকতে আর ভাবনা কী ! তার চেয়ে স্প্যানিস্ থ্রিলারের চর্চা করাই ভালো ।

    গল্পটা এক অনাগত ভবিষ্যতের । ‘দ্য হোল’—নামে পরিচিত, এক নলাকৃতি সুবিশাল জেলখানায় স্বেচ্ছায় নির্বাসনে যায় আমাদের গল্পের নায়ক Goreng (Ivan Massagué) । তার ঘুম ভাঙে আটচল্লিশ নম্বর কক্ষে । সে অবসরের সঙ্গী হিসেবে চেয়ে নিয়েছিল, ‘দন ক্যিহোতে’ বইখানা । ঐ কক্ষে আরেকজন ছিল, Trimagasi (অনবদ্য অভিনয়ে Antonia San Juan), তার নিত্য সঙ্গী ছিল একটি তীক্ষ্ণ-ধার ছুরি । বুড়োটার মুক্তি আসন্ন — সে অনেক দেখেছে আর জেনেছে যে, কাড়াকাড়ি করে কেড়ে খাওয়াই সত্য, আর সব মিথ্যা । কিন্তু গোরেঞ যে বোঝে না — সে যে সাম্যবাদে বিশ্বাস করে ! কিন্তু পারে কি ! না পারে না । নৈতিক চেতনা ও আদর্শবাদে আস্থা এই ভঙ্গুর সমাজতন্ত্রে ততোধিক ভঙ্গুর । ধনতন্ত্র আর বাজার অর্থনীতি আমাদের সকলকে নিয়মিত গিলে চলেছে । আমরা একটা অজগরের পেটের মধ্যে আছি । আমরা ইতিমধ্যেই ভোগবাদের খাদ্যে পরিণত — আমাদের খাদ্য আজ অদৃশ্য শ্রেণি-সোপানে বন্টিত । একদম উপরের ধাপে থাকেন দুনিয়ার মাথারা, প্রভুরা, অভিজাতরা । তাঁরা খান, ছড়ান, দরকারে মুতে বা হেগেও দেন ওই খাবারে । তারপর খাবারের প্লেটগুলো নিয়ে প্ল্যাটফর্ম নামে নীচের ধাপগুলোয় । নীচের স্তরের মানুষরা ঐ এঁটোকাটা খেয়ে পেট চালায় । কারো বা ‘নুন নেই ঠান্ডা ভাতে’ । তাই মারপিট চলে — খাবারের জন্য চলে রক্তারক্তি । চলে পানীয়র জন্য ভয়াবহ হত্যালীলা । বিশ্বাস হচ্ছে না ! ডকু ছবির বাস্তব সহ্য না হলে ‘Mad Max’-এর লাস্ট পার্ট-টা দেখে নিন । খাবারের জন্য (নাকি টাকা !) আজকাল কীরকম কাড়াকাড়ি হচ্ছে, টিভি খুললেই দেখতে পাবেন । তবে সাবধান, গরীবের বেশি কাছে যাবেন না — করোনার জীবাণু না থাক, ওদের গায়ে বড্ড গন্ধ (শীর্ষেন্দুর ভূতের মতো) ! আপনার সভ্যতা দুর্গন্ধময় হয়ে যাবে । আর এর মধ্যেই সুপ্ত থাকে, ‘Allegory of the long spoons’ । বাইরে থেকে ভোগবাদকে ঠিক বোঝা যায় না বোধহয়, বোঝা যায় 'স্কুইড গেম'-এর মতো তার ভিতরে ঢুকলে । মজার ব্যাপার, সেই ঘৃণ্য ভোগবাদই আবার আমাদের চোখে ঝিলিমিলি লাগিয়ে দেয় আর বাজার থেকে কোটি টাকা মুনাফা তোলে !

        তো এই রূপকের মধ্যে দিয়েই ‘দ্য প্ল্যাটফর্ম’ একটা ভীতিপ্রদ অবস্থাকে দেখায় । দ্য হোল-এর মানুষগুলো যেন কোয়ারান্টিন বা, আইসোলেশনে আছে । কেউ চাইলেও তার শিক্ষা ও সভ্যতাকে এই পরিবেশে বাঁচিয়ে রাখতে পারবে না — এটাই সবচেয়ে ভয়াবহ । কারণ, ২০২-নং কক্ষটিতে যখন প্ল্যাটফর্ম পৌঁছায়, ততক্ষণে সব খাবার শেষ । কারণ পরিমিত আহার যে আমাদের স্বভাবে নেই । প্রয়োজনের অতিরিক্ত আমরা গ্রহণ করি । অথচ পৃথিবীতে সমস্ত প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম বাজার-চলতি সম্পদ সীমাবদ্ধ — বুঝে খেলে খাবার সবার — হয়তো বেঁচেও যায় — কিন্তু দরকারের বেশি দখল করলে অনেকেই অভুক্ত থাকে । তাই হয় ২০২-তে । ত্রিমাগাসি তাই বেঁধে রেখে বোঝায় গোরেঞ-কে, আমি তোমার গা থেকে অল্প অল্প মাংস কেটে খাবো — উপায় নেই যে — তোমায় বেশি কষ্ট দেবো না — আমায় মাফ কোরো । কিন্তু হায় ! গোরেঞ প্রথম সুযোগেই বৃদ্ধ ত্রিমাগাসি-কে পেড়ে ফেলে, ছুড়ি বসাতে থাকে নির্মম ভাবে । তখনই বোঝা যায় এই শিক্ষার ঝুটো অহং আর সভ্যতার দর্প আসলে অধিকার ফলিয়ে চলা মানুষের মুখোশ । ঐ মুখোশের ঠিক নীচেই রয়েছে প্রায় অদৃশ্য বৈষম্য আর ভেদবুদ্ধির বীভৎস পৌষ্টিক তন্ত্র, যা মানবতা-কে নিয়মিত গিলে খাচ্ছে । ঐ ভয়াবহতার মধ্যেই আবার স্বপ্ন আসে এক ক্যানসার-আক্রান্ত মানবী-র মাধ্যমে । ভিতরটা পচ ধরে তার সাম্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গি উপরে উঠে আসে ও প্রকাশিত হয়, যা ত্রিমাগাসি-র হত্যাকারী গোরেঞ-কে প্রভাবিত করে । ঐ মানবী আত্মহত্যা করে ও গোরেঞ-এর জন্য রেখে যায় নিজের শরীরের যাবতীয় মাংস । ভয়াবহ তাই না ! কিন্তু এই তো নিয়ম । বাপ-ঠাকুরদা আমৃত্যু খেটে টাকা-জমিজমা রেখে না গেলে, এই বাঙালির হতো কী বলুন দেখি ! পারতো পুজোয় কোটি টাকা নষ্ট করতে । যে রাজ্যে এত অভাব — এত লোক বেকার — এত নয়ছয় — হাসপাতালে বেড নেই — সেখানে এই অপচয় ! হ্যাঁ । অপচয়েই মানুষ চেনা যায় ।

    গল্পে অভিনব মোড় আসে তখন, যখন জানা যায় অন্য বন্দি-দের কুপিয়ে মারা এক নারী, সন্তানসম্ভবা হয়ে ঢুকে পড়েচিল ঐ ‘দ্য হোল’-এ । প্ল্যাটফর্ম-এ চেপে সে উপর থেকে নীচে যাতায়াত করে, মেয়েকে খুঁজতে নয় । বরং ঐ হোল-এর নরকে জন্মানো তার মেয়ের স্বাস্থ্য বজায় রাখতে খাদ্য সংগ্রহ করতে । ঐ জননী-কে একমাত্র গোরেঞ-ই বিশ্বাস করেছিলো, গোরেঞ-ই পরে মেয়ে-টির পিতৃত্বের দায় তুলে নেয় । তাকে মসিহা বলে ব্যঙ্গ করে কেউ কেউ । ঐ নরকে এক কালো মানুষ দড়ি বেয়ে উপরে উঠতে চায় । তার মুখে হেগে দেয় উপরের সাদা চামড়ারা — দেখতে খারাপ লাগে ? রবি ঠাকুরের ‘আফ্রিকা’ কবিতা-খানা আরেকবার ঝালিয়ে নিন । এই তো হয়ে আসছে — মানবাত্মার ক্রন্দনে পরিপূর্ণ সমুদ্র জমাট বেঁধেই তো তৈরি হয় সভ্যতার তৈল খনি — তাতেই তো প্রদীপ জ্বলে সভ্যতার — নীচে পিলসুজ তো আছেই । তারপর সেই সাজানো প্ল্যাটফর্মে গোরেঞ আর তার মেয়ে — অপরাজেয় মনুষ্যত্ব — চেপে বসে । প্ল্যাটফর্মের ওঠানামা চলতেই থাকে — আমরা কোথায় গিয়ে থামবো ? — মার্ক্সের ইউটোপিয়ান স্বর্গে না-কি ভোগবাদের ডিসটোপিয়ান নরকে ? আজকের দিনে চারিদিকে হতমান মানুষের হাহাকারে তাই এই সব প্রশ্নের উদ্রেক করা সিনেমা-ই প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয় । রোম্যান্সের স্বর্গরাজ্য নয়, কবিতা নয় — গদ্য । পাহাড়ের মতো খাড়াই, পৈশাচিক ধনতন্ত্রের প্রতি সমালোচনামূলক, প্রতিক্রিয়াশীল প্রবন্ধ এই ছবি, শিল্প নিয়ে আদিখ্যেতা নয় । কে বলে অনলাইন প্ল্যাটফর্মে ভালো কাজ হয় না ? — কাজ করলেই কাজ হয় ।

...(সমাপ্ত)...

1 comment: