1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Sunday, September 25, 2022

লুকানো কাঁটা

ছবি : ইন্টারনেট

লুকানো  কাঁটা

ঋভু চট্টোপাধ্যায়

১ 

ফোনটা আসতেই ঋষি একটু বিরক্ত হয়।কি অদ্ভুত লোক রে বাবা, এই নিয়ে একদিনে চারবার ফোন করলেন।তাও আবার বিকাল থেকে সন্ধের মধ্যেই তিনবার।প্রতিবার ফোন করে ঐ এক কথা,‘সঞ্জীবকে একটু বলবে কবিতা উৎসবটাতে যেন ডাকে।’

এই লোকগুলোর এই এক সমস্যা।কবিতা উৎসবের কিছু শুনলেই হল, এক্কেবারে হাত ধুয়ে পিছনে পড়ে থাকবে।এর আগেও কয়েকজনের সাথে আলাপ হয়েছিল, কবিতা উৎসবের কথা শুনেই সবার কেমন যেন জিব বেরিয়ে যায়।আরে বাবা সেই তো দেবে একটা টিন কাটা আর একটা পচা মিষ্টির প্যাকেট।ফাণ্ড এলে দুপুরে একটা খ্যাটন।তার জন্যে আসার যে খরচ তাতে তো আর পরতা হবে না।কালিদাস মিত্র বাবু অবশ্য আরো অন্য রকমের মানুষ।পাশের জেলার লোক।তবে এখন কলকাতাতে থাকেন।সরকারি ব্যাঙ্কে চাকরি করতেন, কয়েক বছর ধরে রিটায়ার্ড ম্যান।ভদ্রলোকের স্ত্রীও বেশ কিছু বছর হল গত হয়েছেন।তাঁর নামেই একটা পুরস্কার দেন।‘কাকে দেয় জানো, ওর বাড়িতে একটা বেশি টাকার বিলেতি নিয়ে যেতে হবে।দু থেকে তিন বার যা, মাসের একটা রবিবার পছন্দের লেখক ও লেখিকাদের ডেকে খিচুড়ির সাথে খাসির মাংস খাওয়ায়, তাতে তুই স্পনসর কর।দেখবি সেই বছর ওর পত্রিকার পুরস্কার তুই পাচ্ছিস।’

কথাগুলো মোহন কাকু একবার একশ্বাসে বলে কিছু সময়ের জন্যে চুপ করে গেছিলেন।তারপর ঋষির দিকে তাকিয়ে বলেন,‘এই রে কোন ভুল বলে দিলাম মনে হচ্ছে।তোর সাথে কেমন সম্পর্ক সেটা তো জানি না।এখন তুই বলে দিলেই সব গেল।’

ঋষি কোন জবাব না দিয়ে মুচকি হেসেছিল।কালিদাস বাবুর সাথে তাঁর সে রকম কোন সম্পর্ক নেই।একটা ঘরোয়া সাহিত্য পাঠের অনুষ্ঠানে একবার মাত্র দেখা হয়েছিল।সেখানে ঋষি আমন্ত্রিত হয়ে একটা ছোট গল্প পাঠ করে।কালিদাস বাবু খুব প্রশংসা করে গল্পটি এক রকম ছো মেরে নিয়ে নেন।নিজে বেশ কয়েকবার গল্পটা পড়ে ঋষির দিকে তাকিয়ে বলে ওঠেন, ‘তোমার বয়স তো বেশি নয়, এই বয়সে এই রকম ম্যাচিওর গল্প লিখলে কিভাবে?’

পাশে সেদিন জয়ন্তদা বসে ছিলেন।কালিদাস বাবুর কথাগুলো শুনেই উত্তরে বলেন,‘ও এখন আমাদের শহরের গর্ব।দারুণ লিখছে।এখানকার সব লিটিল ম্যাগাজিনের কথা তো ছেড়েই দিন, কলকাতার বড় বড় হাউসে ওর নিয়মিত লেখা প্রকাশিত হচ্ছে।গল্পের হাতটি চমৎকার।’

সেই শুরু।কালিদাস বাবু নিজের থেকেই ঋষির ফোন নম্বর নেন।দু দিন পরে ফোনও করেন।যেদিন শুনলেন ঋষিরা তাদের শহরে একটা বেশ বড় করে কবিতা উৎসবের আয়োজন করছে তার পর থেকে প্রতিদিনের ফোনের সংখ্যাও বেড়ে যায়।প্রথমে জিজ্ঞেস করলেন,বড় কবিদের কে কে আসছেন? কি গিফ্ট দিচ্ছ, কোথায় থাকতে দিচ্ছ তারপর সরাসরি,‘আমার নামটা কিন্তু রেখো, ভুলে যেও না।’

এই একটা সমস্যা।ঋষি যত বোঝানোর চেষ্টা করে,‘আপনার নাম আমি বলব, কিন্তু ফাইনাল লিস্টের ব্যাপারে আমি কিন্তু কিছুই বলতে পারবো না।’

–আরে না না, তুমি হলে ওখানকার একজন ভালো লেখক, তোমার কথা সবাই শোনে।আমার নামের কথাটা বললে সবাই শুনবে।

ঋষি কোন উত্তর না দিলেও নিজের মনেই বলে ওঠে,‘এখানে ভালো লেখাটাই সব সময় সব কিছু হয় না।অনেক ছক, সমীকরণ ভাঙতে ও গড়তে হয়।কাছে থাকতে হয়, যোগাযোগ করতে হয়, তবেই সঠিক সম্মান পাওয়া যেতে পারে, না হলে কচু পোড়া। কালিদাস বাবুকে তার শহরের সবাই পছন্দ করে না।’

ঋষির আবার এই সবকিছু থেকে একটু দূরে থাকতেই পছন্দ করে, তাতে কে ডাকল, আর কে ডাকল না তাতে কিছু এসে যায় না।কিন্তু এই সব কথা তো আর সবার সাথে আলোচনা করা যায় না।ঋষি তাও সুশান্তকে বলে।সুশান্ত ঋষির বয়সি।দুজনে কবিতা গল্প বিষয়ে আলোচনা করে।কালিদাস বাবুর কথা শুনেই উত্তর দেয়,‘দূর, লোকটা কিচ্ছু লিখতে পারে না।একজন লেখকের প্রথম ও প্রধান কাজ হল পড়াশোনা করা, সেসব না করে যদি আজ এই সভা কাল ঐ সভা করে বেড়ায় তাহলে পত্রিকা করতে পারলেও নিজে কিছুতেই লিখতে পারবে না।কালিদাস বাবুর পত্রিকাটা দেখেছি, খুব ভালো পত্রিকা, কিন্তু ওখানে কালিদাস বাবুর নিজের লেখাটাই সব থেকে খারাপ।এই সব লোককে আমাদের কবিতা উৎসবে আনলে লোকজন গাল দেবে।’

সুশান্ত এরপর কোয়ান্টিটি কোয়ালিটি এই সব সম্পর্কে অনেক কিছু বললেও ঋষি কোন কথায় শোনে নি।এর মাঝে বেশ কয়েকবার মিটিং হলেও কবিতা উৎসবটা আর হয় নি।যে কম্পানি পুরো উৎসবটাকে স্পনসর করবার কথা বলেছিল শেষ মুহূর্তে তাদের কোন একটা সমস্যার জন্যে স্পনসর করতে পারে নি।বাকি টাকা বাজার থেকে তোলার মত কারোর সামর্থ নেই।ওদিকে শহরে ঠিক এক বছর আগে একটি কবিতা উৎসবের নামে টাকা তোলাকে কেন্দ্র করে ঝগড়া ঝামেলাও হয়। কয়েকজনের বিরুদ্ধে টাকা পয়সা নয়ছয় করবার কথাও শোনা যায়।ঋষি সব কিছু শুনতে পেলেও প্রথম থেকেই এইসব উৎসবের কমিটি থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখে।প্রাইভেট স্কুলে পড়ায়, সেই সঙ্গে কিছু টিউসন আর এই টুকটাক লেখালেখি। বাজে নষ্ট করবার মত টাকা ও সময় কোনটাই তার নেই।

এই কবিতা উৎসবেও প্রথম থেকে সেই একটাই শর্ত চাপিয়ে রেখেছিল,‘আমি কিন্তু সে ভাবে এক টাকাও দিতে পারবো না। তাতে আমাকে এই কমিটিতে রাখতে হলে রেখো, না হলে সরিয়ে দাও।’

কালিদাস বাবুকে কথাগুলো বললে উনি বিশ্বাস তো করেনই না, উল্টে বলেন,‘তাই হয় নাকি, তোমাদের শহরে তুমি ছাড়াও আরো অনেকের সাথেই তো কথা বলি, সবার একটাই কথা, এখন কম বয়সি যারা লিখছে তাদের মধ্যে তুমিই সেরা, তোমার কথার একটা ওয়েট আছে।’ এই সব কথার মাঝে ঋষি যতবার কালিদাস বাবুকে তার নিজের লেখা গল্পটার কথা জিজ্ঞেস করেছে ততবার উনি উত্তর দিয়েছেন,‘তোমার গল্পটা সামনের ইস্যুতেই রাখবো।লিটিল ম্যাগাজিন হলেও তোমার নাম কভারে রাখবার কথা ভাবছি।সবাই তোমাদের মত নতুন লেখকদের লেখা না পড়লে আর কি পড়বে?’

ঋষির কথাগুলো শুনতে বেশ ভালোই লাগে।

কলকাতার  লিটিল ম্যাগাজিন মেলায় ঋষি এই প্রথমবার কবিতা পড়বার জন্যে ডাক পেল।একটু দোনোমোনোই করছিল। গতমাসে দুটো টিউসন চলে গেছে।একজনের বাবা ট্রান্সফার হয়ে যায়, আরেকজনের হয়ত পড়ানোটা পছন্দ হয় নি। স্টুডেন্টরাও পড়তে এসে অন্য স্যার ম্যামদের কামাইএর কথা বলে।ঋষির আগের সপ্তাহে তিনদিন কামাই হয়ে গেছে।আবার কামাই হলে গার্জেনদের রেগে যাওয়া স্বাভাবিক।সুশান্ত শেষ পর্যন্ত একটু জোর দিয়ে বলে ওঠে, ‘চলো তো, পরে মেকআপ করে দেবে।’

মেলাতে এসে সবাইকে দেখে, আলাপ করতে বেশ ভালো লাগে।সব থেকে বড় কথা ঐ রকম একটা সরকারি অনুষ্ঠানের মঞ্চে একটা কবিতা বলতে পারা তো কম গর্বের বিষয় নয়।বেশ কিছু পত্রিকাও হাতে পেল।এই সব পত্রিকাগুলোতে লেখা প্রকাশিত হলেও বিভিন্ন কারণে ঋষির হাতে পৌঁছায় নি।ঘুরতে ঘুরতে ঋষি কালিদাস বাবুর পত্রিকার টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ায়।সুশান্ত তখন অন্য আরেকদিকের টেবিলে কিছু পত্রিকা দেখছিল।ঋষি কালিদাস বাবুর সামনে এসে দাঁড়ালেও উনি প্রথমে চিনতেই পারেন নি।ঋষিও নিজের পরিচয় না দিয়ে ওনার টেবিলের পত্রিকারগুলো উল্টেপাল্টে দেখতে আরম্ভ করতেই কালিদাস বাবু বলে উঠলেন,‘এটা মেলা উপলক্ষ্যেই প্রকাশিত, দেখতে পারেন।’

ঋষি তার সামনে যতগুলো ইস্যু ছিল সবগুলো ভালো করে দেখে নিজের লেখা খুঁজতে থাকে।কি আশ্চর্য, কালিদাস বাবুর সাথে প্রায় এক বছর ধরে নিয়মিত কথা হচ্ছে।এই পত্রিকা সহ আরো অনেক পত্রিকা ও তাদের লেখা সম্পর্কেও কথা হয়েছে।প্রতিবারেই বলেছেন,‘তোমার ঐ গল্প তো থাকছেই।পারলে আরো কয়েকটা গল্প পাঠিও।এখন ভালো গল্প লেখকের খুব অভাব।’

এত সবের পরেও তার গল্পটা নেই!এক সপ্তাহ আগেও যেখানে, উনি বললেন...

ঋষির মাথাটা জ্বলতে আরম্ভ করল।ঘাড় ঘুরিয়ে ডানদিকে সুশান্তকে দেখতে পেল।একবার ভাবল যাকগে, যা করেছে বেশ করেছে।অন্য কোন পত্রিকাতে গল্পটা পাঠিয়ে দেবে।ওদের পছন্দ হলে প্রকাশ করবে, না হলে করবে না।এই সব কথা মনে করে একপা এগিয়ে যেতেই মনে হল,‘কিছু না বললে অপরাধ হয়ে যাবে।লোকটা আবার অন্য কোন লেখা নিয়ে একই রকম ভাবে এইসব করবে।’

তারপরেই মনে মনে কালিদাস বাবুর টেবিলের সামনে এসে বলে,‘চিনতে পারছেন না তো? আমি ঋষি।কল লিস্টটা দেখাবো?’ কালিদাস বাবু হেসে বলে উঠলেন,‘ও ঋষি, বল, ভালো আছো?’

–গল্পটা প্রকাশ করেন নি তো?

–না আসলে প্রকাশ করা হয় নি, তুমি গল্পটা অন্য কোথাও দিয়ে দিতে পারো।

–কুকুর পেয়েছেন নাকি, গল্পটা আমি আপনার হাতে পায়ে ধরে ছাপানোর জন্যে বলেছিলাম, নাকি আপনি নিজে নিয়েছিলেন।  মনে পড়েছে কত কিছু বলেছিলেন। এখন খ্যাপা সাজছেন।

 ঋষি নিজের ভিতরেই কালিদাসবাবুর সাথে ঝগড়া করে নিলেও মুখে কিছু বলে না। এমনকি নিজের পরিচয়টাও না দিয়ে আস্তে আস্তে ঐ টেবিল থেকে সরে অন্য টেবিলে চলে যায়। সুশান্তের সাথে পুরো মেলাটা ঘুরে বেড়ায় কবিতাও পাঠ করে। কিন্তু মনের ভিতর একটা কাঁটা সব সময় খোঁচা দিয়ে যেতে থাকে।কোন সম্পাদক বা কোন মানুষ যে এতটা অমানুষ হতে পারে সেটা নিজের স্বপ্নেও কোন দিন ভাবতে পারেনা। খুব কষ্ট হয়, কিন্তু জানে কোন খারাপ কথা বললেই এক্ষুণি চারদিকে রাষ্ট্র হয়ে যাবে ঋষির ব্যবহার খারাপ।

সুশান্তকে কথাগুলো বলে।সুশান্ত সব শুনে উত্তর দেয়,‘এক কাজ কর, তোমাকে তো চিনতে পারেন নি।তুমি এই খান থেকে একটা ফোন কর। কি বলে বুঝতে পারবে।তারপর সামনা সামনি দেখা করে পরিচয় দাও।’

ঋষি সঙ্গে সঙ্গে একটু নিরিবিলিতে গিয়ে কালিদাসবাবুকে ফোন করতেই ওপাশ থেকে সেই আগের মত দরদ মাখা গলার আওয়াজ শুনতে পায়, ‘হ্যাঁ বল, কেমন আছো? মেলায় একবার এসো।তোমার সাথে তো আর দেখাই হল না।’

ঋষি তার গল্পের কথাটাও জিজ্ঞেস করতে উত্তর শোনে, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, তোমার গল্পটা প্রকাশিত হয়ে গেছে।তুমি আসবে, না হলে আমি কাউকে দিয়ে পাঠিয়ে দেব।’

এবার ঋষির সারাটা শরীর রি রি করতে থাকে।সুশান্তকে সব কথা বলে উত্তর দিল, ‘কি জাত ঢ্যামনা লোকরে বাবা।এই রকম ভাবে কেউ মিথ্যা বলতে পারে?’

কথাগুলো শেষ করেই দু’জন আবার কালিদাস বাবুর টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ায়।আবার পত্রিকাগুলো নাড়াচাড়া করতে করতে ওখান থেকে কয়েকপা পিছিয়ে কালিদাস বাবুকে আবার ফোন করে।ফোন ধরে আবার আগের মত কথা বলা আরম্ভ করতেই ঋষি বলে ওঠে,‘কালিদাস বাবু, আমি আপনার টেবিলের সামনেই দাঁড়িয়ে আছি।একটু আগে আপনার টেবিলে এসে পত্রিকার সব সংখ্যাগুলোয় দেখে এসেছি।’

 কালিদাস এবার ফোনটা কেটে দেন।উল্টো দিকে দাঁড়িয়ে থাকা দুজন মানুষ আর মাঝখানের টেবিলের উপরকার শূন্যতা দেখিয়ে দেয় সব অঙ্ক জোর করে মেলানো যায় না।

...(সমাপ্ত)...

No comments:

Post a Comment