মাস্টারমশাই ও অরুন্ধতী
শুভদীপ দত্ত প্রামানিক
স্কুলের মাস্টারমশাই অতুল দত্তের বাড়িতে অনেকটা সময় কাটাতে হয় মাস্টার্সের ছাত্রী অরুন্ধতীকে । অতুল বাবু ছাত্রীকে দিয়ে অনেক বাংলার নোটস লিখিয়ে নেন । বয়সের কারণে নিজে খুব তাড়াতাড়ি লিখতে পারে না , ব্যাঙ্কের কাজ আর টুকটাক লেখা ছাড়া ।
আজ সকালে অরুন্ধতী খবরের কাগজ পড়তে পড়তে দেখে বর্ধমান শহরে গতকাল পুলিশের সঙ্গে শাসক বিরোধী দলের খণ্ডযুদ্ধ হয়েছে । স্যার আসতেই স্যারকে বলতে বলতে কাগজ গুটিয়ে রামায়ণ নিয়ে আলোচনা শুরু করে দেয় ।
রবিবার হাট বসে থানার কাছে । সব্জি থেকে মাছ সবই পাওয়া যায় । থানার পিছনে বটগাছে শাসক দলের একডজন পতাকা টানানো ।
রামায়ণ পাঠ শেষ হলে স্যার জলখাবার খেতে বসে , সঙ্গে অরুন্ধতীও খেয়ে নেয় । দু'দিন হল বাড়িতে কাজের মেয়ে আসছে না , দুপুরের রান্না কি হবে ভাবতে ভাবতে দুটো এটো বাসন আর ঘরটা মুছে নেয় অরু ।
অতুলবাবু মোটা কালো ফ্রেমের চশমা থেকে দেখছেন নারী হয়ে ওঠার দৃশ্য । অতুলবাবুর ছেলে ফ্রান্সে ছবি আঁকে , বৌমা প্রতিবেশী রাষ্ট্রের কলেজে অর্থনীতি পড়ায় ।
অরুন্ধতীর কপালে ঘাম দেখে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির কাছে শান্তি পুরস্কার যে কতখানি খেলো তা মনে মনে ভাবতে থাকে অতুলবাবু !
স্যার হয়ে গেছে বলেই বাড়ি যাবার জন্য তৈরি হয় ছাত্রী । কিন্তু দুপুরে এসে রান্না করে দেবে একথাও বলে যায় অরুন্ধতী ।
স্যার পড়ছেন মার্কিন সাহিত্যের একটি জার্লান । তারপর কাঁপা কাঁপা হাতে লিখলেন : " ভালো কবিতা বলে কিছু হয় না , একটা ব্যর্থ দিন মানুষকে দিয়ে যা ভাবায় তা কখনো আনন্দের কখনো দুঃখের সম্পদ আর ওটাকে লিখে রাখলেই তৈরি কবিতার কাঁচামাল " ।
দুপুর বারোটা পনেরো , অরুন্ধুতী এল সাথে ওর বান্ধবী । বিকালে বঙ্কিমচন্দ্র বিষয়ক বাকি প্রবন্ধটা স্যারকে শেষ করার জন্য বলে অরু । বান্ধবীর হাতে সব্জি আর মাছ ।
দুপুরের খাওয়ার পর অরুন্ধতী মোবাইলে কিছু পুরনো মেল দেখছিল । ওখানেই খুঁজে পেল নিজেরই একটি অণু কবিতা । তারপর বান্ধবীর সাথে কথা বলতে বলতে কখন যে চারটে বেজে গেছে খেয়াল করেনি ।
বান্ধবী বাড়ি চলে যাওয়ার জন্য উঠলে অরুন্ধতী চা অফার করে , সে খাবে না বলে রওনা দেয় ।
অরুন্ধতী ও অতুলবাবু চায়ে চুমুক দিতে দিতে দেখছে একঝাঁক বকের উড়ে চলে যাওয়া । ভাঙা গলায় অতুলবাবু ধরলেন : " মেঘের কোলে কোলে যায় রে চলে বকের পাঁতি । / ওরা ঘর-ছাড়া মোর মনের কথা যায় বুঝি ওই গাঁথি গাঁথি ।। "
স্যারের গলায় রবি ঠাকুরের গান ছোটবেলা থেকেই প্রিয় ছাত্রীর ।
বঙ্কিমচন্দ্র বিষয়ক প্রবন্ধটা শেষ করে অরুন্ধতী বলে এবার বাড়ি ফিরে যাব ।
রাতের খাবার রাখা আছে খেয়ে নিয়েন ।
অতুলবাবু এখন একা , আদ্যিকালের রেডিওটা চালিয়ে দিয়েছে । পাকা দাড়ির ফাঁকে মাটির আঁচল । অতুলবাবু এখন মৃত স্ত্রীর সাথে আপন মনে কথা বলবে ।
পরেরদিন সকালে উঠে বলবে রাধারাণী আমাকে কাল খাইয়ে দিয়েছে অথচ রাতের খাবার যেমনকার তেমনি ঢাকা দেওয়া ।
অরুন্ধতী এসব দেখে আর কাঁদে না ! বলে : ' রাধাফোবিয়া '
বলে : ' ম্যাডাম এখন কোথায় ? '
অতুলবাবু হেসে : ' তোমা...তোমাদের মধ্যে ''।
No comments:
Post a Comment