1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Sunday, September 25, 2022

রাজা ও বিদূষক

ছবি : ইন্টারনেট

রাজা ও বিদূষক

রঞ্জন চক্রবর্ত্তী


এক যে ছিলেন রাজা। তাঁর হাতিশালে হাতি, ঘোড়াশালে ঘোড়া, রাজকোষে অগাধ টাকা। দেশে কোনও অভাব ছিল না। প্রজারা সুখে-শান্তিতে বাস করছিল।

রাজার সর্বক্ষণের সঙ্গী ছিল এক বিদূষক। রাজাকে সে প্রায়ই বলত, “মহারাজ, বিশ্বাস হারাবেন না। জানবেন ঈশ্বর যা করেন সবই আমাদের ভালোর জন্য।” রাজা অবশ্য বিদূষকের কথায় আমল দিতেন না, কিন্তু তার সরল বিশ্বাসে আঘাতও দিতে চাইতেন না। একদিন রাজামশাইয়ের শিকারের শখ হল। সদলবলে তিনি চললেন বনে, বিদূষকও সঙ্গে চলল।

হাতির পিঠে চেপে শিকারে বেরোলেন রাজা। লোকজনের হাঁকডাকে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এল এক বিশাল চেহারার চিতাবাঘ। সরাসরি সে লাফ দিল রাজার দিকেই। তৎক্ষণাৎ গুলি চালালেন রাজা, কিন্তু লক্ষ্যভ্রষ্ট হলেন। বিদূষক রাজার পাশেই ছিল। চিতাবাঘ রাজাকে আক্রমণ করার আগেই তার বন্দুক গর্জে উঠল। চিতাবাঘ ঘায়েল হল ঠিকই, কিন্তু মরার আগে মরীয়া চেষ্টায় থাবা চালাল রাজার মুখের দিকে। রাজা তৎক্ষণাৎ দুই হাত দিয়ে আড়াল করলেন মুখ। তাতে মুখটা বাঁচল বটে, কিন্তু চিতাবাঘের তীক্ষ্ণ নখের আঘাতে তাঁর বাঁ হাতের দুটো আঙুলও জখম হল।

শিকার থেকে ফিরে আসার পর রাজার হাতের আঙুলদুটো ফুলে গেল, সেই সঙ্গে তীব্র যন্ত্রণা। রাজা প্রথমে আমল দেননি. কিন্তু যত সময় গেল যন্ত্রণা উত্তরোত্তর বাড়তে লাগল। রাজবৈদ্য আঘাত পরীক্ষা করে বললেন আঙুলদুটোয় পচন ধরেছে, অস্ত্রোপচার করে বাদ দেওয়া ছাড়া আর কোনও রাস্তা নেই।

একথা শুনে রাজার ভারী মনখারাপ হল। বিদূষককে সামনে পেয়ে তাঁর মাথায় যেন আগুন জ্বলে উঠল। সে যে বাঘটাকে মেরে তাঁর প্রাণ বাঁচিয়েছে সে কথা তিনি বেমালুম ভুলে গেলেন।

রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে তিনি বিদূষককে বললেন, “যখন চিতাটা আমাকে আক্রমণ করেছিল তখন কোথায় ছিলেন তোমার ঈশ্বর? তাঁর সব কাজই যদি ভালোর জন্য হয় তাহলে আমার আঙুল দু’টো এভাবে বাদ পড়ত না।”

বিদূষক মাথা নীচু করে শান্তভাবে  বলল, “তা সত্বেও আমি বলছি মহারাজ, ঈশ্বর যা করেন ভালোর জন্যই করেন।”

একথা শুনে রাজা রাগে একটায় তিনটে হয়ে রক্ষীদের ডেকে হুকুম দিলেন বিদূষককে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে রাজ্য থেকে তাড়িয়ে দিতে। চলে যাবার সময়েও বিদূষক বলে গেল, “মহারাজ, আমার কথা ঠিক না ভুল সময়ই তার উত্তর দেবে।”

ধিন যায়, মাস যায়। একদিন রাজার তীর্থে যাওয়ার ইচ্ছে হল। যথারীতি অনেক লোকজনও তাঁর সঙ্গে চলল। যাত্রাপথে গভীর বনের মধ্যে দিয়ে যাওয়ার সময় একদল জংলী তাঁদের আত্রমণ করে বসল। প্রাণ বাঁচাতে সকলেই রাজাকে ফেলে দৌড়ে পালাল। জংলীদের হাতে রাজা বন্দী হলেন।

জংলীরা বন্দী রাজাকে নিয়ে গেল তাদের পুরোহিতের কাছে। সে বিধান দিল গ্রামদেবতাকে সন্তুষ্ট করার জন্য নরবলি দেওয়া দরকার। তখন জংলীরা রাজাকে পিছমোড়া করে বেঁধে নিয়ে গেল বনের গভীরে, তাদের মন্দিরের সামনে। রাজা বুঝতে পারলেন রক্ষা পাওয়ার কোনও উপায় নেই, আজই তাঁর জীবনের শেষ দিন।

এই সময় জংলীদের পুরোহিত বলল, দেবতাকে সন্তুষ্ট করতে হলে এমন মানুষকে বলি দিতে হবে যার শরীরে কোনও খুঁত নেই। খুঁতযুক্ত মানুষকে বলি দিলে অমঙ্গল হবে।  

পুরোহিতের কথা শুনে জংলীরা রাজার গোটা শরীরটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। তাদের চোখে পড়ল বন্দীর হাতের দুটো আঙুল নেই।  তাই দেখে তাদের পুরোহিত বলল এই লোকটি বলির উপযুক্ত নয়। তখন তারা রাজাকে বনের বাইরে রেখে এল।

রাজপ্রাসাদে ফিরে এসেই রাজামশাই হুকুম দিলেন বিদূষককে খুঁজে এনে তাঁর সামনে যেন হাজির করা হয়। বিদূষককে আনা হলে রাজা তাকে আদর করে নিজের পাশে বসালেন। তারপর বললেন, এতদিনে তোমার কথার তাৎপর্য আমি উপলব্ধি করতে পেরেছি। জংলীদের হাতে আমি প্রায় মরতে বসেছিলাম। কিন্তু আঙুলদুটো না থাকার জন্য আমার প্রাণ বেঁচেছে।

রাজার মুখে একথা শুনে বিদূষক নীরব রইল। রাজামশাই আবার বললেন, “কিন্তু আমার একটা প্রশ্ন আছে। তুমি তো আগাগোড়া ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাসে অবিচল ছিলে। তাহলে তোমাকে এত অপমান সত্য করতে হল কেন?”

তখন বিদূষক শান্তভাবে বলল, “মহারাজ, আপনি যদি রেগে গিয়ে আমায় রাজ্য থেকে তাড়িয়ে না দিতেন তাহলে এবারও আমি তীর্থযাত্রায় আপনার সঙ্গী হতাম। জংলীদের আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য সবাই পালিয়ে গেলেও আমি কিন্তু আপনাকে ফেলে যেতাম না। তাহলে আমাকেও আপনার সঙ্গে জংলীদের হাতে বন্দী হতে হত। আমার শরীরে তো কোনও খুঁত নেই। ফলে বেঘোরে আমার প্রাণটা যেত। তাহলে ভেবে দেখুন মহারাজ, ঈশ্বর যা করেন ভালোর জন্যই করেন।”

...(সমাপ্ত)...



No comments:

Post a Comment