ঠিকানাঃ- ব্রেকডান্স অ্যাভিনিউ
মানসী গাঙ্গুলী
ছোট থেকেই বাড়িটা আমার কাছে এক রহস্য।
অজানা এক আকর্ষণ বোধ করি বাড়িটার প্রতি। যখনই মামারবাড়ি গেছি ছাদে উঠেছি
বাড়িটাকে দেখার জন্য। হ্যাঁ, বাড়িটা আমার
মামারবাড়ির পাড়ায়। সমস্ত পাড়া থেকে একটু দূরে যেন এক বিচ্ছিন্ন দ্বীপে রয়েছে ওই
পেল্লায় বাড়িখানা। যেন একটা প্রকান্ড পরিত্যক্ত তোরঙ্গের মতো বসানো মাঝখানে।
আশপাশে বাড়িঘর নেই, আছে বাড়িসংলগ্ন
কাঠা কুড়ি জমি। নানারকম ফলের গাছ রয়েছে সে জমিতে। রয়েছে একটা পুকুর, তার শানবাঁধানো ঘাট। প্রয়োজনে সে পুকুর ব্যবহৃত
হয়। মাঝেমাঝে জালও পড়ে সে পুকুরে। তখন বাড়ির পুরুষমানুষেরা তাদের ভাগ বুঝে নিতে
সাতসকালে ভিড় করে পুকুরপাড়ে। পানকৌড়ি ডুব দেয় সে পুকুরে টুপটুপ করে। বাগানের গাছের
ওপর মাছরাঙা বসে তাকিয়ে থাকে পুকুরের দিকে। কোনও মাছ জলের ওপর দিকে উঠলেই ছোঁ মেরে
তুলে নেয় দু'ঠোঁটের মাঝে।
বাগানে রয়েছে আম, কাঁঠাল, নারকেল ইত্যাদি ফলের গাছ। একটা স্বর্ণচাঁপা গাছ
গরমের দিনে ভরে ওঠে ফুলে, তার সৌরভে সুরভিত
করে তোলে বহুদূর পর্যন্ত। নানারকমের পাখি এসে বসে বাগানের গাছে, বাসা বাঁধে, ডিম পাড়ে, তা ফুটে বাচ্চা হয়। গাছগুলোয় ফলন প্রচুর। সেসবও
পারা হয় ছুটির দিনে, ভাগাভাগি হয়।
ফলের সময় পাড়ার দুষ্টু ছেলেরা ভরদুপুরে ঘোরাঘুরি করে বাগানের চারপাশে। টের পেলে
বাড়ির কেউ না কেউ গলা খাঁকারি দিলেই দৌড় মারে। অন্যসময় পাকা রাস্তা পেরিয়ে বিশেষ ও
বাড়িমুখো হয় না ছেলের দল। মামারবাড়ি অবধি রাস্তাটা পাকা, তারপর ওই বাড়িতে পৌঁছাতে রাস্তাটা খোয়া
বিছানো। রিক্সা, সাইকেল, বাইক, আলেকালে কখনও বা গাড়ি ঢুকলে কার্যত ব্রেকডান্স করতে করতে যায়, তাই এদিকের মানুষেরা রসিকতা করে ও বাড়ির
ঠিকানাকে বলে 'ব্রেকডান্স
অ্যাভিনিউ'।
৩০০ বছরের পুরনো বাড়িটায় বাসিন্দারা যেমন
বংশলতায় জড়িয়ে আছে, বাড়িটার গা
দিয়েও বট অশ্বত্থ গাছেরা আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে যথেচ্ছ বেড়ে উঠেছে। বাইরে থেকে দেখে
বোঝার উপায় নেই ঐরকম একটা পোড়োবাড়িতে মানুষের বাস আছে। সংস্কারের অভাবে
জরাজীর্ণ বাড়িটা আজ। আগাছা জঙ্গলে ঢাকা দোতলা বাড়িটার দিকে তাকালে দিনের বেলাতেও
গা-ছমছম করে। রাতের বেলা সব ঘরে আলো না জ্বললে ভূতেরবাড়ি বলে মনে হবে। খসে পড়েছে
দেওয়ালের পলেস্তারা, ভেঙ্গে পড়েছে
পুরনো ইঁটের দেওয়াল। বর্ষায় ছাদ ফেটে জল পড়ে কোনো কোনো ঘরে। দাগরাজি করে কোনোরকমে
বাসের উপযোগী করা হয়। বলাই বাহুল্য, যার ঘরে জল পড়ে সে-ই সেটুকু মেরামত করে নেয়। কোথাও বা ঝুলছে কড়িকাঠ। একটু একটু
করে ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে এককালের বনেদী বাড়িটা। চব্বিশটা ঘরের অতবড় দোতলা
বাড়িটা যিনি করেছিলেন মনে তো হয় তিনি বিত্তবান মানুষ ছিলেন কিন্তু তার বংশের
তৃতীয় কী চতুর্থ পুরুষেরা সব কোনোরকমে দিন গুজরান করে চলেছে এই জীর্ণ, ফাটলধরা বাড়িটিতে।
বাড়িটার এক এক ঘরে এক এক গল্প। কোনও
ঘরের মেয়ে মুসলমান ছেলের হাত ধরে বাড়ি ছেড়েছে। এ বাড়ির দরজা তার জন্য তাই বন্ধ হয়ে
গেছে। কোনো ঘরের কত্তা নিরুদ্দেশ, কোনো ঘরে বা
বেকার ছেলে অবসাদে ভোগে। এ সবই স্বাভাবিক এদের কাছে। এক একটা ঘরে এখন যারা রয়েছে
এখান থেকে বেরিয়ে নিজের মত মাথা গোঁজার ঠাঁই তৈরি করার ক্ষমতা বা যোগ্যতা কোনোটাই
তাদের নেই। তা নিয়ে তাদের মাথাব্যথাও নেই
তেমন। এরই মধ্যে একজন দু'জনের অবস্থার
একটু উন্নতি হওয়ায় নিজের অংশের ঘরটুকুর নবীকরণ করার চেষ্টা করেছে। রঙের পোঁছ
পড়েছে তার অংশের দেওয়ালে বেখাপ্পা রকমভাবে। ময়ূরপুচ্ছধারী কাকের মত দেখাচ্ছে সে
অংশটুকুকে। কেউ আবার আরেকটু উন্নতি করায় নিজের ঘরে তালা দিয়ে বেরিয়ে গেছে বাড়ি
ছেড়ে। কোথায় নাকি একটা ফ্ল্যাটও সে কিনেছে কিন্তু নিজের অংশের দাবি টিঁকিয়ে
রাখতে পেল্লায় এক তালা ঝুলিয়ে গেছে ঘরে। ভুলেও আর এপথ মাড়ায় না সে। তালা ঝুলছে
আরও একটা ঘরে দীর্ঘদিন ধরে। তারা নাকি মুম্বাই চলে গেছে। সেখানে ভালই আছে তারা
কিন্তু নিজের অংশের দাবিটুকু বজায় রাখতে তার ঘরেও ঝুলছে তালা। বাড়িটার ঘরগুলোর
কোলে বারান্দা। সেখানের মোটা মোটা ছালচামড়া ছাড়ানো থামগুলো এককালীন আভিজাত্যের
পরিচায়ক। সেই থামগুলির গা থেকে চাঙড় খসে খসে বিচিত্র ডিজাইন তৈরি করেছে। তাদের
গায়ে পেরেক ঠুকে বাড়ির বাসিন্দারা দড়ি টাঙিয়েছে জামাকাপড় শুকাতে। সে
জামাকাপড়ের অবস্থাও বলে দেয় বাড়ির বাসিন্দাদের অবস্থা কেমন। সবকিছু নিয়েই
বাড়িটায় গিজগিজ করছে দু'পেয়ে, হাত দিয়ে ভাত মেখে খাওয়া প্রাণী সব।
পাঁচশরিকের ভাগাভাগিতে বাড়িটার ঘরে ঘরে বাসিন্দাদের মধ্যে এখন আর আত্মীয়তার
বালাই নেই। লতায়-পাতায় খোঁজ করেও খোঁজ পাওয়া যায় না। কোন ডালে, আবডালে, কে যে কার সঙ্গে জড়িয়েছিল একসময় তার আর
ইয়ত্তা নেই এখন। বাড়িটার চব্বিশটা ঘরে এখন ওরা প্রতিবেশী। অনেকগুলি পরিবারের
পদবী এক, আবার বেশ
কয়েকটির অন্য অন্য। হয়তো বা বাড়ির কোনও মেয়ে সম্পত্তি পেয়ে আস্তানা গেড়েছিল এ
বাড়িতে। সে এখন যারা জীবিত সদস্য ঐ পরিবারের তারা জানেও না। তবু ও বাড়িতে কারও
জন্ম হলে শুভ অশৌচ পালন করে কয়েকঘর, যেমন বরাবর চলে এসেছে। আবার মৃত্যু হলেও অশৌচ পালন করে, সম্পর্কে কে হয় না জেনেই। অথচ বাড়িটা যিনি
তৈরী করেছিলেন কত সাধ করেই হয়তো করেছিলেন সবাইকে নিয়ে একত্রে একসঙ্গে থাকবেন
বলে। তাই সে বাড়িতে নিচের তলায় আছে পেল্লায় এক রান্নাঘর, তার কোণে যজ্ঞিবাড়ির মত বিশাল আকারের এক উনুনের
ভগ্নদশা আজও বিদ্যমান। আর পাশে তেমনই পেল্লায় এক খাবারঘর। তার পাশে অপেক্ষাকৃত
ছোট একটা ভাঁড়ার। সে ঘরে রয়েছে বিশাল সাইজের লোহার কড়া কয়েকটা, পেল্লায় সাইজের হাতা, খুন্তি যেগুলো বলে দেয় একান্নবর্তী পরিবারে
কতগুলো মানুষের পাত পড়ত রোজ। ইঁদুরেরা সংসার পেতেছে আজ সে ভাঁড়ারে। সারা দিনরাত
কিচিরমিচির আওয়াজ সেখানে ঢুকলেই। আর ফাঁকেফোকরে নাদিতে ভর্তি। বাড়ির এক বাসিন্দা
কোনও কাজে গ্রামে গিয়ে সস্তায় একবস্তা চাল নিয়ে এসেছিল একবার। ওই ঘরে গুদাম করে
রেখেছিল। আগামী কয়েকমাসের দায়ে নিশ্চিন্ত। ওই ভাঁড়ারে যে যার নিজের নিজের সবজিও
আলাদা আলাদা ঝুড়িতে করে রেখে দেয়। কত আর ঘরে তুলবে! রান্নার সময় আবার টেনে
নামানো, অনেক ঝকমারি। তো বস্তা
থেকে কৌটোয় ক'দিনের মত চাল বার
করে রেখেছিল বউটি। কৌটোর চাল ফুরালে বস্তা থেকে বার করতে গিয়ে দেখে ধেড়ে ইঁদুরে
বস্তা কেটে বড় বড় গর্ত করে তার ভেতর নাদিতে ভর্তি করে রেখেছে। সে চালের
বেশিরভাগই ফেলা গেল। বাকিটুকু ঢেলে রাখার মতো জায়গাও তার কাছে নেই। কী ভাগ্যি
একটা বাড়তি হাঁড়ি ছিল তার, তাই তার মধ্যে
ঢেলে রাখল। বাকি চাল ফেলতে ফেলতে চোখে জল এসে গেল তার। এরপর তো কর্তার কাছে সেকথা
বলতেই তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন তিনি। "আমি দু'পয়সা সুবিধা হবে বলে সাইকেলে করে সেই কোন
মুলুক থেকে টেনে নিয়ে এলুম আর এমন অলক্ষ্মী মেয়েছেলে তা সামলে রাখতে পারল
না।" মুখ বুজে বৌটি হজম করল, কোনও প্রতিবাদ
করতে পারল না। কেবল হাপুসুটি কাঁদতে লাগল। পাশের ঘরের বউটি তার হয়ে দুটি কথা বলতে
গেলে তাকেও দুটো কথা শুনিয়ে ছাড়ে কর্তা। সে আর ওদের মধ্যে থাকে না, চলে যায় সেখান থেকে। ওই রান্নাঘরে এখন আটটা
উনুন জ্বলে। বিশাল উঠোনে তোলা উনুনে আগুন ধরিয়ে রান্নাঘরে তুলে নিয়ে গিয়ে
রান্না করে তারা। বাকিরা জায়গা না পেয়ে খাবারঘরেই রান্নার ব্যবস্থা করে নিয়েছে। এরা সবাই গ্যাসেই রান্না করে। রান্না
করতে করতে নিজেদের মধ্যে গল্পগুজবও চলে তাদের মধ্যে। এক-আধবাটি তরকারির
আদানপ্রদানও চলে কখনোসখনো। অত মানুষের গিজগিজে ভিড়েও গরমের দিনে কখনও বিছে,
কখনও কেন্নাই ঘুরেফিরে
বেড়ায় ঘরের মেঝে দিয়ে। রান্না করে যে যার রান্না খাবার নিয়ে যায় নিজের নিজের
ভাগের দু'একখানা ঘরে। ঘরের
কোলে চওড়া দালানটা চলাচলের জন্যই ছিল আগে।
সেখানে এখন কারও জুতোর সেল্ফ,কারও বইয়ের র্যাক, কারো বা
জামাকাপড়ের আলমারি স্থান পেয়েছে। একটা ঘরে তো আর সংসার হয় না। ছেলেপুলেরা বড়
হয়, কিছু জিনিসপত্র তো বাড়েই।
চকমিলানো বাড়িটার মাঝে এখনও রয়েছে ভাঙ্গা জরাজীর্ণ ধানের মড়াই যা সেই ৩০০ বছর ধরে
রয়েছে। তার ফোকর দিয়ে বাড়ির বৌ-ঝিয়েরা তাদের মাসিকের নোংরা ন্যাকড়া, ছেঁড়া ন্যাতাকানি, জুতো ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলে। এছাড়া না জানি তার
ভেতরে হয়তো বা সাপখোপেরা বাসা বেঁধে রেখেছে। সন্ধের পর উঠোনে কোনো আলো জ্বলে না।
কোনো ঘর থেকে চিলতে আলো এসে যেটুকু ছিটকে পড়ে তাতে যাতায়াতের সময় কারও চোখে
পড়েছে কখনও, কখনও বা সরসর করে
আওয়াজ শুনেছে কেউ। মোবাইলের টর্চ জ্বেলে সাইকেল নিয়ে তারই মধ্যে দিয়ে সাবধানে
যাতায়াত করেছে তারা। এসব তাদের গা-সওয়া।
ইঁদুরের গন্ধে বিড়ালের আনাগোনা সে
বাড়িতে। তারা ঘুরে বেড়ায় বাড়ির যত্রতত্র। কারও পোষা নয় তবে খেতে দেয় সবাই।
তবু সুযোগ পেলে চুরি করে এরওর ঘরের মাছ খেয়ে নেয়। খাটের তলায় মাঝে মাঝে বাচ্চা
দেয় তিন-চারটে। আবার মুখে করে অন্যত্র নিয়ে যায়। কোথায় যে লুকিয়ে ফেলে! নিজের
দুধের সন্তানকে হুলো-বেড়ালের হাত থেকে বাঁচাতে মা-বেড়ালের এই লুকোচুরি খেলা।
একদিন এক শরিক আবিষ্কার করে তার চৌকির তলায় বাচ্চা চারটে বেড়ালের ধড়, মুন্ডু আলাদা করা। আতঙ্কে চিৎকার করে ওঠে সে
ঘরের বউটি। একেই তার বহুবছর বিয়ে হয়েছে তবু বাচ্চা হয় না। পেটে আসে, নিজে থেকেই খসে যায়, ধরে রাখার ক্ষমতা নেই। আবার যদি বা কখনও ধরে
রাখতে পারে, পুরোমাস কেটে
যাবার পর মরা বাচ্চার জন্ম দেয়। এই নিয়ে খোঁটাও তাকে কম শুনতে হয় না। সে আবার
পোয়াতি হয়েছে। বিড়াল-বাচ্চার ধড়মুন্ডু ছেঁড়া দেখে নিজের পেটেরটার ভবিষ্যৎ দেখে
সে। পেটে হাত বোলায় আর আতঙ্কে ভেউভেউ করে কাঁদতে থাকে।
বাড়ির সদর দরজা সারাদিন খোলা থাকে।
রাতে সবার শেষে যে ফেরে সে তালা লাগায়। নিচের দালানের হুকে টাঙানো থাকে চাবি।
আবার যার সকালে উঠে আগে বেরোবার প্রয়োজন হয় সে ওই তালা খোলে। এভাবেই বাড়ির
বাসিন্দাদের মধ্যে রয়েছে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান। যেহেতু সারাদিন দরজা হাট করে খোলা
থাকে কিছু রাস্তার কুকুরও যখন তখন ঢুকে পড়ে সে বাড়ির উঠোনে। গরমের দিনে তারা ঐ
পরিত্যক্ত মড়াইয়ের নিচে আশ্রয় নেয়। বাড়ির অতগুলো মানুষের পাতের এঁটোকাঁটা পড়ে,
তা-ই কুকুর-বেড়ালে
ভাগাভাগি করে খায়। তা তাদের মন্দ হয় না তাতে। একটা পাড়ায় যতগুলো লোক থাকে,
এই একটা বাড়িতেই বোধহয়
তার থেকে বেশি মানুষ। বিকালবেলা আবার ঐ উঠোন বাড়ির বাচ্চাদের কলকাকলীতে মুখর হয়ে
ওঠে। নিচের তলার ঘরের আনাচে-কানাচে কুনোব্যাঙ গ্যাঙরগ্যাঙ করে তাদের অস্তিত্ব
জানান দেয়। ইঁদুর, বেড়াল, কুকুর, সাপ, ব্যাঙ, আরশোলা, মাকড়সা, টিকটিকি নিয়ে যেন একটা মিনি চিড়িয়াখানা এ
বাড়িতে।
এ বাড়িতে কোনো কলিংবেল নেই। যদিও
বাইরের মানুষের আনাগোনা কম, তবু কেউ কখনও এলে
সোজা ভেতরে ঢুকে পড়ে। উঠোন থেকে অমুকদা, তমুকদা বলে নাম ধরে ডাকে। সেই তমুকদা বাড়ি না থাকলে তার পরিবারের কেউ উপরের বারান্দা থেকে গলা বাড়িয়ে, বা নিচের ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বলে দেয়,
"বাড়ি নেই, কী নাম বলুন, এলে বলব তাহলে।"এভাবেই চলছে। ছাদের ওপরের
একদার ঠাকুর ঘরখানা এখন ভগ্নপ্রায়। সেখানে আর কেউ প্রবেশ করে না। ভূতপ্রেত থাকলেও
থাকতে পারে। প্রত্যেকে নিজের নিজের ঘরের কোণে বা সেলফে এখন ঠাকুরের আসন পেতে
নিয়েছে। সন্ধেয় সেখানে সস্তার ধূপকাঠি জ্বলে। তুলসীমঞ্চ একটা আছে উঠোনে, পুবমুখো। নিচের ঘরের কেউ কেউ সেখানে সন্ধেয়
প্রদীপ দেয়।
এইরকম একটা বাড়িতে বাস করার জন্য
বাসিন্দাদের মনে কোনো অশান্তি বা অভিযোগ আছে বলে মনে হয় না। গতানুগতিক জীবন বেশ
তো চলে যাচ্ছে, তাই এ নিয়ে
মাথাব্যাথার কোনও কারণ তাদের নেই। কিন্তু মাথাব্যথা রয়েছে কারো কারো। ও বাড়ির যে
শরিক ঘরে তালা ঝুলিয়ে বেরিয়ে গেছে, ফ্ল্যাট কিনে রয়েছে কিছুদূরে, সে একটি দু'কামরার ফ্ল্যাট কিনেছিল তখন। বড়ছেলে চাকরি
পাওয়ায় তার বিয়ের কথা ভাবছে সে। তার একটি তিন-কামরার ফ্ল্যাটের প্রয়োজন
হচ্ছে। ভাবল পৈতৃক বাড়িতে ঘরটি শুধু
শুধুই তালাবদ্ধ অবস্থায় পড়ে, ওই মান্ধাতার
আমলের বাড়িটা ও তার সংলগ্ন কুড়িকাঠা জমি মিলে কলকাতা শহরে দাম মন্দ হবে না।
অনেকগুলো ভাগ হলেও তার ভাগেও নেহাত মন্দ টাকা আসবে না। তাই একদিন সে বাড়িতে গিয়ে
কয়েকজনের কাছে প্রস্তাব রাখে বাড়িটা প্রোমোটারের হাতে দেবার জন্য। প্রস্তাব
ছড়িয়ে পড়ে ঘরে ঘরে। কেউ খুশি কেউ অখুশি। যারা অখুশি তারা বাধ সেধেছিল। কিন্তু
প্রকৃতি তাদের এ সিদ্ধান্ত মানতে বাধ্য করল। অল্পদিনের মধ্যেই প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে
বাড়ির একাংশ ভেঙে পড়ল। ঝড়ের তান্ডবে আগেভাগেই ঘর থেকে বেরিয়ে পড়েছিল সেই অংশের
বাসিন্দারা। হতাহত কেউ হয়নি। গৃহহীন হয়ে নিচের দালানে উদ্বাস্তুর মত বসবাস করছে
তারা। বিপদের দিনে বাড়ির সকলে এক পরিবার হয়ে তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। সকলেই এখন বাড়ি
প্রমোটারের হাতে তুলে দিতে প্রস্তুত। প্রমোটারের সঙ্গে মিটিংয়ে বসার আগে জানার
দরকার কে কতটা অংশের হকদার। নবতিপর বিনয়বাবু ঐ পরিবারের একমাত্র জীবিত বয়োঃজ্যেষ্ঠ
সদস্য। তিনি এখনও শক্তসমর্থ, মানসিকভাবেও যথেষ্ঠ
সুস্থ। মুম্বাইতে চলে গিয়েছেন বহুবছর আগে। তাঁর একটি ঘরও ঐ বাড়িতে তালাবন্ধ
অবস্থায় পড়ে রয়েছে। মুম্বাইতে ফ্ল্যাট কিনে সুখে ঘর করছেন তিনি পরিবার নিয়ে কিন্তু
এবাড়ির দাবিও তিনি ছাড়েননি। তাই মিটিংয়ের আগে তাঁকে সব জানিয়ে আসার জন্য অনুরোধ
করা হল। তিনি কলকাতা এলেন তাঁর একমাত্র নাতিকে নিয়ে। উঠলেন হোটেলে। বাড়িটা ধূলিসাৎ
হয়ে যাবার আগে এলেন একবার শেষ দেখা দেখতে, নাতিকে দেখাতে। নাতি এবাড়ির গল্প শুনেছে দাদুর কাছে, দেখেনি কখনও।
ঘুরে ঘুরে দেখলেন বিনয়বাবু, নাতিকে দেখালেন।
ভগ্নপ্রায় বাড়িটার প্রতিটি কোণায় পুরনো জিনিসেরা নিথর দাঁড়িয়ে আছে, এতটুকু নড়চড় হয়নি তাঁর এবাড়ি থেকে চলে যাবার
এতদিন পরেও। তাঁর মনে হল বাড়িটা যেন রাজ্যের পুরনো জিনিসের একটা মিউজিয়াম। দেওয়ালে
টাঙানো বিশাল পেন্ডুলাম ঘড়িটার খোঁজ নিলে জানতে পারলেন অনেকদিন আগেই সেটি এক ঝড়ের
দাপটে দেওয়াল থেকে পড়ে দেহ রেখেছে। তার টুকরোটাকরা আশ্রয় পেয়েছে ছাদের ঠাকুরঘরে।
তবে নিচের দালানের দেওয়ালে টাঙানো রঙচটা তৈলচিত্রটা এখনও সেভাবেই রয়ে গেছে। কার
ছবি বোঝা দায়, তবু আছে
প্রাচীনত্বের দাবি নিয়ে। স্মৃতিরা সব উঁকি দিতে লাগল মনের মাঝে। কাগজ কলম চেয়ে
বাড়ির সবার সাহায্যে তিনি এঁকে দিলেন ফ্যামিলি-ট্রি,
যা থেকে বোঝা যাবে কে
কতটা অংশের হকদার। বাসিন্দারাও জানতে পারবে কার সঙ্গে কতটা সম্পর্ক তাদের। এরপর
প্রমোটারের সঙ্গে মিটিংয়ে যোগ দিলেন তিনি। চলতে থাকল কথা। "প্রয়োজনে আবার
আসব", কথা দিয়ে তিনি
ফিরে গেলেন। অতগুলো মানুষের থাকার ব্যবস্থা করার দায় প্রমোটারের। চলছে ব্যস্ততা।
বিশাল বাড়িটা একদিন ধূলোয় মিশিয়ে গেল। খাঁ খাঁ শূন্যতা। 'ব্রেকডান্স অ্যাভিনিউ'য়ের প্রাচীন বাড়িটিতে এখন নিত্য মালবোঝাই
গাড়ির আনাগোনা ব্রেকডান্স করতে করতে। ক্রমে উঠল ঝাঁ চকচকে বহুতল। রাস্তা হল পাকা।
নিত্য গাড়ির আনাগোনা। গাড়ি ঢোকে সাঁ করে। এখন মামারবাড়ির ছাদে উঠে সেদিকে তাকিয়ে
বুকের ভেতরটা হুহু করে ওঠে। সেই মায়াজড়ানো রহস্যময় বাড়িটা আর নেই, কোত্থাও নেই।
...(সমাপ্ত)...
No comments:
Post a Comment