1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Sunday, September 25, 2022

হানা বাড়ি

ছবি : ইন্টারনেট

হানা বাড়ি  

অমিতা ঘোষ 

  ঘটনাকাল আজ থেকে প্রায় বছর ষাটেক আগের, রেলের চাকরি পেয়ে অজিত বাবু একটি গ্ৰামের স্টেশন মাস্টার হয়ে সেখানে যায়। গন্ড গ্ৰাম, চারিদিক ফাঁকা, ইলেকট্রিক তখনও সেই গ্ৰামে পৌঁছোয় নি।

সারাদিন ভালো ভাবে কাটালেও সন্ধ্যাবেলা টা কাটানো খুব ই মুশকিল,  গ্ৰামের শেষপ্রান্তে রেল স্টেশন, সাকুল্যে সেখানে সারাদিনে  দুটো কি তিনটি গাড়ি দাঁড়ায়। বেশিরভাগই মাল গাড়ি কয়লার ইঞ্জিন এ টানে, আর ঐ রেলগাড়ি রাত্রির বেলা তেই বেশি যাতায়াত করে।

 সারাদিন শুনসান থাকে, রেল আসার টাইমে যা একটু ভীড় হয়, নইলে ফাঁকা ই থাকে।  অজিত বাবু রেল স্টেশন এর কোয়ার্টার এই থাকেন, তখন ও বিয়ে থা করেন নি।

 গ্ৰামের একটি ছোকড়া ছেলে কে রেখেছেন সেই দু বেলা রান্নাবান্না করে দিয়ে যায়। ঘর দোর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন সেই ছেলেটিই করে। রাতের বেলায় সে চলে যায়।

 প্রথম দিকে মানিয়ে নিতে অসুবিধা হলেও পরের দিকে অভ্যস্থ হয়ে যান।  খুব ভোরে ওঠেন,  একটু মর্নিং ওয়াক করেন, আর আশপাশের এলাকা থেকে ফুল তুলে নিয়ে আসেন, তিনি ফুল খুব ভালোবাসেন,  ফুল এনে কিছুটা তার টেবিল এ সাজিয়ে রাখেন, আর ঘরে মা কালীর ছবি আছে সেখানে দেন। ফুল তুলতে গিয়ে খেয়াল করেছেন দুরে একটি ভাঙ্গাচোরা একটি বাংলো আছে তার বাগানেই এই সব ফুল ফোটে বেশি। তিনি খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছেন ঐ বাংলো টি অনেক পুরানো, প্রায় শতাব্দী প্রাচীন তো হবেই। শোনা যায় কোনো এক সাহেবের বাড়ি ছিল সেটি। এই টুকুই তিনি শুনেছিলেন তার কাছে আসা ঐ ছোকড়া টির কাছে। গ্ৰাম যেহেতু ভিতরের দিকে তাই আলাপ পরিচয় সেই ভাবে  কারো সাথে গড়ে ওঠেনি।

 কিন্তু অদম্য একটা আকর্ষণ তিনি অনুভব করেন ঐ বাড়িটার প্রতি, যখনই ওখানে ফুল তুলতে যান ওনার মনে হয় বাড়িটার ভিতরে ঢুকতে, বাড়ির সামনের বাগানে কে যে এত যত্ন করে ফুল ফোটায় কে জানে। বাংলোর সদর দরজা ভেজানো থাকে সবসময়, অজিতবাবুর সবসময় মনে হয় দরজায় হাল্কা ঠেলা মারলেই দরজা খুলে যাবে। আর বিশেষ করে পূর্ণিমা র রাতে এই আকর্ষণ খুব তীব্র হয়। মনে হয় কেউ দূরে বাঁশি বাজাচ্ছে,কেউ যেন তাকে ডাকছে। 

  প্রায় মাস ছয়েক তিনি  এইসবে গুরুত্ব দেন নি ভেবেছেন, দূরে কেউ গ্ৰামে বুঝি বাঁশি বাজাচ্ছে, কিন্তু ক্রমশ এই বাঁশির আওয়াজ তাকে এমন আচ্ছন্ন করে ফেলে, যে তিনি এই বাঁশির সুর প্রায় প্রতি রাত্রিরেই শুনতে পান।

একদিন এমন এক কোজাগরী পূর্ণিমা রাত্রে অপেক্ষা করছেন সেই সুরের, চারিদিকে পূর্নিমার আলোয় আলোকিত , জোছনার আলো মায়াময় করে রেখেছে চারিধার, কিন্তু অনেকক্ষণ তিনি শুনতে পাচ্ছেন না সেই সুর, তারপর মনে হলো দূর থেকে ভেসে আসছে সেই সুর।

কিন্তু সেই সুরে আকর্ষণ এ তিনি বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লেন,  কিন্তু সেই সুর ভেসে আসছে সেই হানা বাড়ি র  কাছে থেকে। কিন্তু ঐ বাড়ির কাছে আসতেই দেখলেন একটি গাছের গায়ে ঠেস দিয়ে একটি দেহাতি ছেলে  বাঁশি বাজাচ্ছে আর একটি  কালো সাঁওতালি মেয়ে  একটু দূরে সেই বাশির সুর শুনছে। এরপর তিনি চলে আসেন, এরকম মাঝে মাঝেই হতে লাগলো, তিনি সুর শুনে বেরিয়ে পড়েন, আবার ঐ দুই জনকে দেখে তিনি ফিরে আসেন।

 একদিন  এই রকম পূর্ণিমা র দিনে তিনি ওখানে গিয়ে দেখেন, ঐ মেয়েটি কাঁদছে, মেয়েটি কে অজিতবাবু জিজ্ঞাসা করে সে কাঁদছে কেন, মেয়েটি বলে,  বাড়ির ভিতরে গিয়ে দেখ, এক অদ্ভুত কৌতূহলে তিনি এ বাড়িতে প্রবেশ করেন, একটু ঠেলা দিতেই দরজা খুলে যায়, কিন্তু একি এই বাড়িটি তো তেমন পুরানো নয় , কি সুন্দর সাহেবি কায়দায় সাজানো,  চারিদিকে ঝলমলে আলো

 একটি ঘরে কিসের আওয়াজ, তিনি ফাঁক দিয়ে দেখেন। একটি সাহেব সেই দেহাতি ছেলেটিকে চাবুক দিয়ে মারছে,  অজিতবাবু ঘরে ঢুকে যেই বলতে  যাবে সাহেব কেন মারছে, তখনই চারিদিক অন্ধকার হয়ে যায়, মনে হয় কেউ যেন তার গলা চেপে ধরেছে , তিনি শ্বাস নিতে পারছেন না, এক অসহ্য কষ্ট তাকে পেয়ে বসেছে।

 তিনি ছাড়াতে চাইছেন কিন্তু সেই বিভৎস ভারি হাত তিনি  কিছুতেই ছাড়াতে পারছেন না। দরদর করে ঘেমে যাচ্ছেন, কতক্ষন  এরকম অবস্থায় তিনি ছিলেন তার মনে নেই। হুস ফিরতেই দেখেন সেই ছোকড়া ছেলে টিকে আর কিছু গ্ৰামের লোকজন কে।চোখেমুখে জল দিয়ে একটু ধাতস্থ হতেই ও গ্ৰামে র একজন বৃদ্ধ তাকে জিজ্ঞাসা করে কি হয়েছিল, অজিতবাবু গত রাতের সেই ঘটনার কথা বলতেই চমকে ওঠেন তিনি। তারপর  যা বলেন তাতে শিউরে ওঠেন তিনি।

বৃদ্ধ টি তখন বলেন,

" এখন যে হানা বাড়িটি আপনি দেখছেন, এটি একসময়ের এক সাহেবের বাংলো ছিলো।  তার কাছে কাজে আসতো একটি আদিবাসী সাঁওতাল মেয়ে, মেয়েটি এই বাংলোর ঝাড় পোছ সব করতো, আর তার গরন ছিল দেখার মতো, তার ছিল এক প্রেমিক, সে বাঁশি বাজাতো, বাঁশি র সুর শুনে  মেয়েটি সব কাজ ফেলে ওর প্রেমিকের কাছে ছুটে যেতো। এই অবধি ঠিক ছিল, সাহেবের এইবার কুনজর পড়লো ঐ মেয়েটির প্রতি, সাহেব জানতো ঐ যুবকের কথা তাই তাকে দূরে কোথাও পাঠিয়ে দিতে চাইলো,  কিন্তু ঐ যুবক একরোখা সেও যাবে না, তখন সাহেবি যুগ, একদিন সাহেব ও যুবক টি কে চাবুক দিয়ে খুব মারলো,  ঐ যুবক আদিবাসী সম্প্রদায় এর সর্দার এর ছেলে ছিল, তারা তো মানবে না, তাদের ছেলের গায়ে হাত, তারা ক্ষেপে  গেলো, একদিন রাতে সাহেব যখন ঘুমায় তখন তারা অতর্কিতে আক্রমণ করে, সাহেবের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়।

সাহেব তো মরে গেলো, কিন্তু ঐ মেয়েটিকে ওদের সমাজ মেনে নিল না, মেয়েটি দুঃখে আত্মহত্যা করলো, আর ঐ যুবকটি পাগল হয়ে গেলো, খালি সে বাশি বাজায় আর মেয়েটিকে খোঁজে। 

 আর এই সাহেব বাড়ি পরিত্যাক্ত হয়ে গেল।

 কিন্তু সাহেব রয়ে গেলো এই বাড়িতে ভুত হয়ে, তাই এখানে কেই আসে না, আর পূর্ণিমা র রাতে শোনা যায় সেই বাঁশির সুর। আর এই বাড়িটি হানা বাড়ি বলে পরিচিত হয়ে গেল।

 অজিত বাবু ভাবলেন মা কালী ই বোধহয় তাঁকে রক্ষা করেছেন। প্রত্যেকদিন মা কে তিনি ফুল দেন পুজো করেন। এর কিছুদিন পরে তিনি বদলী নিয়ে অন্যত্র চলে যান।

...(সমাপ্ত)...

No comments:

Post a Comment