1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Sunday, September 25, 2022

মায়ের ডাক

ছবি : ইন্টারনেট

মায়ের ডাক

নীলাঞ্জন চট্টোপাধ্যায়


সময় - দুপুর ।  একটি বিবর্ণ একতলা বাড়ির একটা ঘর। ঘরে আসবাবপত্র বলতে

একটি তক্তাপোশ, দুটি প্লাস্টিকের চেয়ার, একটা আলনা, একটি ছোট স্টিলের আলমারি, আর ছোট

একটি কাঠের টেবিল। জানলা, দরজায়, ঘর আর আসবাবে  পুরানো স্মৃতি যেন মাখামাখি।

ছেলের বয়স বছর চল্লিশ। প্যান্ট ও একটি বিদেশি সার্ট পরে আছে।  সাতাত্তরে পা দেওয়া মা ও ছেলে কথা বলছেন। ছেলে খাচ্ছে, মা বসে পরিবেশন করে খাওয়াচ্ছেন।  ছেলের নাম দীপন।  দীপন সেনগুপ্ত।

মায়ের নাম গীতা। মায়ের পরনে ঘিয়ে রঙের শাড়ি।

চরিত্র --  মা ( গীতা, ছেলে দীপন, মাকে দেখাশোনা করবার মহিলা, বিনতা)


প্রথম দৃশ্য 

-----

 গীতা - বাবা অনেকদিন পর এলি, এই দুটো দিন থেকে যা না আমার কাছে।

       পোস্ত আর কাকরোল পুর আর দুটো দিই, আমি সব কালকে বিনতা কে দিয়ে আনিয়েছি বাজার থেকে

      জানি তুই আজ আসবি, তোর প্রিয় বিউলির ডাল আর পার্সে মাছটাও আনিয়ে নিলাম বিনতাকে দিয়ে।

দীপন- সেই দু বছর আগে তোমার হাতে খেয়েছিলাম, এসব পেলে আর কিছু খেতে ইচ্ছে করেনা মা।

গীতা - নারকেল নাড়ু, আর পাটিসাপটা, গুড়ের পায়েস  করেছি, সবগুলোই তোর প্রিয়, দু টো দিন আমার কাছে থেকে যা না বাবা আমার! কবে যে আবার আসবি কে জানে  !

দীপন - না তা সম্ভব নয় মা,  আমার খুব অসুবিধে হয়, আসলে এভাবে থাকা আমার অনেকদিনের অনভ্যাস।

গীতা - অভ্যাস নেই বলছিস,  তুই ঠান্ডা মেশিনের কথা,বলছিস বাবা।  জানিস তোর বাবাকে দেখতাম কারেন্ট নেই, হাতপাখাও নেই, ঘামছে, অথচ ভ্রুক্ষেপও নেই সবার সাথে হাসি মজায় কাটিয়ে দিচ্ছে। আমি তোকে

  তা বলবো না, তবু যদি দুটো দিন বুড়ী মায়ের কাছে থেকে যাস!

দীপন- হ্যা অভ্যাস তো একটা ব্যাপারই মা,তাছাড়া এ.সি. ছাড়া আমার ঘুম হয়না, সারারাত জেগেই

             কাটিয়ে দিতে হয়,  সকালে উঠে খুব অসুবিধা হয়.. থাক, ওসব বুঝবেনা মা!

গীতা- মনে আছে এই ঘরেই বৈশাখের  দুপুরে স্কুল থেকে এসে তুই খেয়ে দেয়ে শুলে, আমি কেমন

 ঘুম পাড়িয়ে দিতাম, তালপাতার পাখায় হাওয়া করে। আমার কাছে কত গল্প শুনতে শুনতে  ঘুমিয়ে পড়তিস তুই!

দীপন -- মা তুমি যে কি বলো, সে সব দিন তো কবেই চলে গেছে, ওভাবে গরমে শুয়ে আমার তো রাতে

     ঘুমই আসবেনা। ঘুম না এলে সকালে আমার মাথা ধরে যায়, সারাদিন সেই ভার থেকে যায়!

গীতা -- মনে আছে তুই তখন কলেজে পড়ছিস, ইঞ্জিনিয়ার হবি, পুজোর সময় তোর ছোটমাসী, মামাতো

 দাদারা এলো, তুই তো তখন ঘরে না শুয়ে রিনি, মতি, বিট্টু  ওদের সাথে ওই বাইরের বারান্দায় শোবার

জন্য জেদ করলি, পাখা ছিলনা, ঘুম কিন্তু হয়েছিল তোর!

দীপন - মা সে সব দিনের কথা আলাদা, তখন আমার গড়িয়াহাটে আর লন্ডনে ফ্ল্যাট ছিলনা,

   গাড়ি ছিলনা, সবই অভ্যেস মা, অভ্যেস।

গীতা - বছর দুই আগে একটা রাত তোকে দিদিভাই আর বৌমাকে নিয়ে পাশের ঘরটাতে

 থাকতে বলেছিলাম, তুই হোটেলে থাকলি ওদের নিয়ে, আমাকে বললি ফুটো ছাদের তলায়,

 ড্যাম্প ঘরে থাকো কি করে - আমি বলেছিলাম ভালোবাসার আর মায়ার জোরে থেকে যাইরে সোনা।

দীপ - উঃ মা, তুমি যে  , যাক অনেকদিন পর আলু পোস্ত, বিউলির ডাল খেলাম, আর কি সুন্দর

  পার্সে মাছের ঝাল, বার্গার, স্যান্ডউইচ খেতে খেতে.

 গীতা - কালকে তোকে পুকুরের শাপলার সেই চচ্চড়ি আর কই তেল করে খাওয়াবো, মনে আছে

এই দুটো জিনিস পেলে সব ভাতটাই ওই দিয়ে খেয়ে নিতিস বাবা।

দীপন - টুসি বলে দিয়েছে, রাতেই ফিরে যেতে, মেয়েটাকে আমি কাঁদাতে চাইনা, একদিন আমায় যদি

   না দেখে!

গীতা - দিদিভাই কে  হোটেলে না রেখে, নিয়ে এলিনা কেন? কতদিন দেখিনি, ক্লাস সেভেন হলোতো!

দীপন - হ্যা, ওরা আসতে চাইল না, আমিও জোর করলাম না, ফিরে যাব বলে।

বিনতা - এই তো দাদাবাবু!  পার্সে মাছটা ভাল ছিল তো, আমি বাজার থেকে এনেছি জানিনা কেমন!

দীপন -এসে গেছো বাহ, ভালই বাজার করেছো।  আর রান্নাটাও দারুন, সবগুলোই..।

বিনতা - জানেন, সবগুলোই মা করেছে, আমি শুধু বেটে, কেটে, ধুয়ে দিয়েছি

দীপন - কি বলছো বিনতা দি , কই মা কিছু বললো না তো! উঃ এত খেয়েছি উঠতেই কষ্ট হচ্ছে এখন

(উঠে পড়ে দীপেন)

বিনতা - আপনি খেয়ে যে  খুশি, এতেই মায়ের বুক ভরে গেছে, নিজের কথা তাই হয়তো বলতে চাননি।

(দীপনের মুখে হাসি, মায়ের চোখে জল, হাসি আর কান্না মিলেমিশে একাকার।)

গীতা - বিনতা তোর দাদাবাবু আজ থাকবেনা রে বিকেলেই  চলে যাবে!

বিনতা - কি বলছো মা, দাদাবাবু এই দু বচ্ছর পর এলেন, মায়ের কাছে দুটো দিন থাকবেনা

দীপন - না বিনতাদি, আজ আমাকে যেতেই হবে ( ফোন বাজবে, ফোন টা দেখে নিয়ে)

বিনতা - দাদাবাবু যদি কিছু মনে না করেন, একটা কথা বলবো! 

দীপন- বলো ।

বিনতা - আপনার যেমন টুসি  দিদিভাইয়ের জন্য মন কাঁদে,  মায়ের তো আপনার জন্য মন কেমন করে, বুক ফেটে যায়..  দু বছর, তিন বছর পর আপনাকে দেখে একটু হাল্কা হয়, তাই বলছিলাম, যদি থেকে যান.

 মায়ের পাশে সেই ছোটবেলার মতো শোবেন, গল্প করেন।

(হঠাৎ কেঁদে ওঠেন দীপন)


দ্বিতীয় দৃশ্য

-------

---দীপন- সেই সাতাশ বছর বয়স থেকে দৌঁড়ে বেড়ালাম, কিন্তু কি পেলাম! হ্যাঁ পেয়েছি, অনেক, অনেক টাকা

কিন্তু হারিয়েছি অনেক বেশি।

বিনতা - কি হারাবার কথা বলছেন দাদাবাবু?

দীপন - না, তুমি আমার  চোখ খুলে  দিয়েছো, বিনতা দি।  আমি যে সবথেকে দামী বস্তুটাই হারিয়ে ফেলছিলাম, মায়ের স্নেহ, ভালবাসা, আর অনেক অনেক আদর।

বিনতা -- হারায়নি কিছুই দাদাবাবু, সব আছে

দীপন- তুমি বলছো বিনতা দি, সব আছে, হারায়নি কিছু।  (শিশুর মতো হেসে ওঠে)

বিনতা- মা, ছেলের সম্পর্ককি নষ্ট হবার  হারিয়ে যাবার!  সব আছে, মাকে একবার ঠিক আগের মতো

মা বলে জড়িয়ে ধরুন না!

দীপন- মা বলে জড়িয়ে ধরে ( দু চোখ জলে ভরে যায়)

...(সমাপ্ত)...

No comments:

Post a Comment