ছবি : ইন্টারনেট |
ঘুনি
বাপ্পা রুইদাস
বুধো মোটা পলেথিনটা মাথা থেকে হাঁটু পযর্ন্ত পেছন দিকে ঝুলিয়ে, মাথায় একটা সুদলি বাঁধে, কোমরে গামছাটা টান করে বেঁধে পলেথিনটাকে আটকে দেয়। বাইরে সকাল থেকে একভাবে ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে তো, এখনো পর্যন্ত ছাড়ানোর নাম করেনি। সে গোয়াল ঘর থেকে একটা কোদাল, একটা বাঁশের লাঠি ও একটা ঘুনি নিয়ে বেড়িয়ে পড়ে ঘর থেকে।
জমির আলপথ ধরে এগিয়ে যেতে থাকে বুধো। মাঝে মাঝে আল থেকে পা হড়কে জমিতে পড়ছে, তাতে তার কোনো যায় আসে না। মাঝে মাঝে যখন পা হড়কে কুলেখাড়া গাছের উপর পা পড়ছে, কাঁটা বিঁধে যাওয়ার যন্ত্রণায় তখন মুখে দু'চারটে কাঁচা-কাঁচা খিস্তি বেরিয়ে যাচ্ছে। আর সে যদি দু'চারটে খিস্তি করেই থাকে, তাতে কি হয়েছে? এই বাদলের দিনে কেউতো আর শুনতে আসেনি। আর এই ফাঁকা মাঠে সে নিজে ছাড়া আর তো কেউ নেই।
দূরের ওই ঝাপসা গাছগুলো দেখতে পাওয়া যাচ্ছে, ওখানেই সে ঘুনিটা একটা জল যাওয়ার নালায় দিয়ে আসবে। বুধো নিজের মনেই বিড়বিড় করে বলে, সন্ধ্যে হওয়ার আগেই ঘরে ফিরে যেতে হবাক। টর্চটা নিয়ে আসিনি, শালা অন্ধকার হলেই যত সাপের উৎপাত। আবার এদিকে তাড়াতাড়ি না গেলে চোর বাসু আমার জায়গাটা আগুলে নিবাক। শালা আমি পরিস্কার-টরিস্কার করলাম, আর তু কোথাকার কে হে! উড়ে এসে জুড়ে বসলি! শালা দুদিন ধরে ওই চোরটা ঘুনি এঁড়ে দিচ্ছে। আই তু, আজ ঘুনি আঁড়া করাচি!
জৌগোড়ে পেড়িয়ে পির তলায় এসে বুধো দাঁড়িয়ে পড়ল। ছোট একটা ঝোড়ের দিকে তাকিয়ে দেখে ছোট ছোট হাতি ঘোড়া গুলো ডিগবাজি খেয়ে পড়ে আছে। সে তার ডান হাতটা একবার কপালে ঠেকিয়ে প্রণাম করল। আবার হাঁটা শুরু করে, নিজের মনে মনেই বলে, ছোটবেলাই মা বড়মার সঙ্গে এখানে কতবার এসেছি একেন পুজোর সময়। গুড়পাটালির ভোগ হতো। তখন কত যে গুড়পাটালি খেয়েছি, আর এখনকার ছেলেপুলেরা একটা পাটালি খেতেই হিমশিম খেয়ে যায়।
বুধো পিরতলা পেরিয়েই দেখতে পেল চেনোর পুকুরটা। হঠাৎ তার চোখে পড়ল পুকুরের পাড়ে কে যেন বসে রয়েছে। আর একটু পুকুরের কাছাকাছি আসতেই সে দেখতে পেল পুকুর পাড়ে চোর বাসু পায়খানা করছে। সে চোর বাসুকে বলে, শালা তু আর হাগার জায়গা পেলি নাই, শেষে কিনা চেনোর পুকুরে। তুর ওই টাওয়ারে যদি একটা জোঁক ধরে তো বুঝবি, কতো ধানে কতো চাল! তু সারাজীবনেও আর টাওয়ার পাবিনাই শালা।
চোর বাসু বিড়ি টানতে টানতে বলে, উপায় নাইরে ভাই, খুব জোরে পেয়ে গেছে। আর এই পাড়টা ছাড়া তো আর কোথাও ফাঁকা নাই, চারিদিকে জলে জলাময় হয়ে আছে।
বুধো ঘুনি দেওয়ার জায়গাই এসে মনে মনে বলে, শালাকে দু'তিনটে জোঁকে ধরুক!
সে নিজের মনেই বকতে বকতেই ঘুনিটা ভালো ভাবে বসিয়ে বাঁধটা দিতে যাবে, ঠিক এমন সময় চোর বাসু চিৎকার করে বুধোকে ডাকতে থাকে। বুধো মাথা তুলে বলে, কি হল রে বাসু? সাপ টাপ বেরলো নাকি?
পুকুর পাড় থেকে চোর বাসু বলে, আমার কাছকে তাড়াতাড়ি আই?
- ক্যানে রে? কি হল?
- তু আই নারে তাড়াতাড়ি!
বুধো চোর বাসুর কাছে গিয়ে দেখে, তার লুঙ্গিটা কোমরে তোলা। পেছনে দুটো বড় বড় জোঁক ঝুলছে। সে মনে মনে বলে, কেমন জব্দ হয়েচিস বেটা! সে ঠাট্টা করে বলে, কি করেচিস রে দুজনকে, রক্ত খাইয়ে তো অজগর করে দিয়েচিস!
বাসু অধৈর্য্য হয়ে বলে, বক্তব্য পরে মারবি! এখন ওদুটোকে ছাড়ানোর ব্যবস্থা কর।
বুধো মনে মনে বলে, ছাড়াবতো, একটু স্যেঁকটা পা সালা! এবার সে সাভাবিক ভাবে বলে, ছাড়াছিতো, এতো তাড়াহুড়ো করলে চলে? আমার আবার জোঁককে খুব ভয় লাগে!
বুধো আস্তে আস্তে বাঁ হাতে একটা জোঁককে ধরে, জোর টান দিল। টান পেয়ে জোঁকটা আধ হাত লম্বা হয়ে বাসুকে মুক্তি দিল। পরের জোঁকটাও সেই একইভাবে ছিটকে গেল। বাসু একটা ছোট্ট হাসি দিয়ে বলে সালারা আমার আড়াইশো রক্ত খেয়ে নিল।
বুধো হেঁসে বলে, ঠিক করেছে খেয়ে। তু তো কোনদিন কুথাও রক্তদান করিসনি, সেটাই তো তুর খুচরো পাপ।
বাসু তার ঘুনিটা নিয়ে শিয়ালমারার মাঠের দিকে চলে গেল। আর বুধো ঘুনিটা ভালো করে এঁড়ে দিয়ে ঘরের পথ ধরে।
দুই
সারা রাত বৃষ্টি হওয়ার পর ভোরের দিকে থেমেছে। এখনো আকাশে কালো মেঘগুলো ঘুরাঘুরি করছে। তিনদিন ধরে সূর্যের দেখা নেই, আজ হয়তো একটু বেলা করে সূর্যদেবের দেখা পাওয়া যেতে পারে, এমনটাই খবরে বলেছে। নিম্নচাপটা আস্তে আস্তে সরে যাচ্ছে বাংলাদেশের দিকে। বুধোর স্ত্রী অপর্ণা বুধোকে ঘুম থেকে উঠিয়ে সে গরু ছাগল বের করে ঘরে ঝাঁট দিতে শুরু করে। আর বুধো নিমগাছের একটা সরু ডাল ভেঙ্গে দাঁতন করে বেরিয়ে গেল মাঠের দিকে।
অপর্ণা গরু ছাগল গুলোকে খাবার দিয়ে ছোট হাঁড়িতে চা চাপিয়েছে। এমন সময় ওপাড়ার মদন মড়ল এক হাত তামাক নিয়ে দাঁত মাজতে মাজতে তার কাছে এসে বলে, চা হল?
অপর্ণা চমকে ওঠে পেছন ফিরে দেখে মদন মড়ল দাঁড়িয়ে আছে। তার দাঁত মাজাতে দাঁতগুলো চড়চড় করে শব্দ হচ্ছে। সে তাড়াতাড়ি তার পরনের কাপড়টা ভালো করে নিজের শরীরটা ঢাকা দিয়ে বলে, হু, এই চাপাছি। তুমি মুখটা ধোও, দিয়ে চা খাও।
তার দিকে সে কপট দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, বুধো ঘরে আছে?
- না, উ.. মাঠ গেছে ঘুনিটা আনতে।
- পুটি মাছ খেয়ে খেয়ে চেহারাটা তো খাঁসা করেছো।
অপর্ণা তার কাছে চা নিয়ে গিয়ে বলে, এই নাও, চা খাও।
- শুধু চা খাওয়াবে? চায়ের সঙ্গে টা-টা দিবে নাই!
সঙ্গে সঙ্গে মদন মড়ল অর্পণার হাতটা ধরে টানতে থাকে। অপর্ণা হাতে কাঁমোড় দিয়ে এক ঝটকায় ছাড়িয়ে নিয়ে, পাশে পড়ে থাকা ঝাঁটাটা হাতে নিয়ে বলে, বেরো এখান থেকে, নয়লে ঝেটিয়ে তুর বিষ ঝেড়ে দিবো!
মদন মড়ল ভয়ে পেছিয়ে এসে বলে, তুর খুব দেমাক হয়েচে না ঢেমনি। তুর ওই দেমাক যদি না আমি ভেঙ্গেছি তো আমার নাম মদন মড়ল নয়! আর তুর ভাতারটাকে বলেদিবি, কালকের মধ্যে যেন আমার টাকা ফেরত দেয়। তা না হলে....!
শেষের কথাটা আর শেষ না করে দাঁত কড়মড় করতে করতে চলে যায়। অর্পণার হাত পা গুলো কাঁপছে। তার যেন মনে হচ্ছে তার গলার শুকিয়ে গেছে। এখুনি এক বালতি জল খাবে। সে কলতলায় এক ঘটি জল খেয়ে দেখে মদন মড়লকে যে কাপে চা দিয়েছিল, সেই কাপটা ভেঙ্গে পড়ে আছে। ভেঙ্গে যাওয়া টুকরো গুলো সব কুড়িয়ে একটা ঝোপের দিকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে, ঘরে ফিরে এসে দেখে বুধো মাঠ থেকে ঘুনি নিয়ে ফিরে এসেছে। সে বুধোকে বলে, কখন এলে?
বুধো কলতলায় মুখ ধুতে ধুতেই বলে, এইতো এলাম। তোমার চা হয়েগেছে?
অপর্ণা চায়ের কেটলিটা উননে আর একবার গরম করে ঘরকে নিয়ে গিয়ে দু'কাপ চা ঢেলে বলে, ওপাড়ার বিলের বাবা এসেছিল।
বুধো চায়ে চুমুক দিয়ে বলে, কী বলছিল?
- কী আর বলবাক। চা খেতে এসে চায়ের কাপ ভেঙ্গে ঘর গেল। আর বলে গেল যে কালকের মধ্যে ওর টাকা ফেরত চায়।
বুধো হতাশার সুরে বলে, সালা আমার কপালটাই খারাপ! এই আমার ঘরেই শনি, রাহু, কেতু, সবাই একসঙ্গে ঢুকেছে! তা না হলে কী সব বাঁশ একসঙ্গে আসে? কালকে জিতে খুড়ো টাকা চাইছিল। আজকে মাঠের থেকে আসার পথে প্রধানের সঙ্গে দেখা হল, সেও বলছে দশ হাজার টাকা না দিলে ঘর দিব নাই। সালা এমন ভাব দেখাচ্ছে যেন নিজের ঘর থেকে টাকা দিয়ে আমার ঘর করে দিবাক। দাঁড়া ভোট খুঁজতে আসবি, পোন্দেঁ গুড়ালে তাড়াবো!
অপর্ণার চোখ দুটি ভিজে লাল হয়ে গেছে। সে চোখ দুটি মুছতে মুছতে বলে, সব আমার জন্যে হয়েছে। এর থেকে আমার মরে যাওয়ায় ভালো ছিল।
- এতে তুমার কী দোষ? তুমি রোগ থেকে বেঁচে এসেছ, এটাই অনেক। আমার আর কী চায়? আমি বললাম না, আমাদের এখন কপালটাই খারাপ চলছে।
কিছুক্ষণ দুজনে চুপচাপ। বুধো চায়ের শেষ চুমুকটা দিয়ে বলে, বুঝলে অপর্ণা, আমাদের অবস্থাটা এখন এই ঘুনির ভেতরে মাছগুলোর মতো হয়েছে। এই সমস্যা থেকে বেরবার পথটা খুঁজে পাচ্ছি নাই। ওদের মতো মরা ছাড়া উপায় নাই। তবু যতখন বেঁচে আছি, ততখন খুঁজে যাব বেরিয়ে যাওয়ার পথটা।
No comments:
Post a Comment