1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Monday, July 24, 2023

একটু শান্তির খোঁজে

একটু শান্তির খোঁজে 

মিঠুন মুখার্জী 


                 সমগ্র আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। পেঁজা তুলোর মতো কালো মেঘ আকাশের এক দিক থেকে অন্যদিকে ভেসে বেড়াচ্ছে। সুযোগ পেলেই মেঘের ঘর্ষণে বিদ্যুতের আলো সমস্ত পৃথিবীকে উজ্জ্বল করে তুলছে। ঘন ঘন বজ্রপাত হচ্ছে। এমন প্রলয়ময় পরিবেশে মা দেবকীর গর্ভে বিশ্বময় অধর্ম নাশে এবং ধর্মের প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আবির্ভূত হয়েছিলেন বসুদেব নন্দন বাসুদেব। তাঁর আবির্ভাবে জগৎময় প্রেম ও ভক্তি রসের জাগরণ ঘটেছিল। বন্ধ কারাগার থেকে মায়া শক্তির বলে বাসুদেবের আশ্রয় হয়েছিল মা যশোদার ঘরে। কংস বধের পূর্ব ইঙ্গিত মতো দেবকীর অষ্টম গর্ভের সন্তানের আবির্ভাবের খবর মা মহামায়া কংসকে জানিয়ে দেন। তারপর কি হয়েছিল দাদু। বলো না, বলো না আমাদের। আমার কাছে ছোট্ট বলাই জিজ্ঞাসা করেছিলো। আমি ওদের শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাবের কাহিনীটা শোনাচ্ছিলাম। আমার বয়স এখন তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকেছে। আমি আবার ওদের শ্রী কৃষ্ণের বৃন্দাবনে বেড়ে ওঠার কাহিনী শোনালাম। তারপর দেখতে দেখতে সন্ধ্যা নেমে এলো। গল্প বলা সেদিনকার মতো শেষ করে বলাইদের বললাম -- "তোর আবার কালকে বিকেলে আসিস। এরপর কি হয়েছিল তোদের শোনাবো।" আমার কথা মত যে যার বাড়ির পথে যাত্রা করে।

                বলাই আমার পাশের বাড়ির এক অনাথ শিশু। দাদু নিরঞ্জনের কাছে ছোট থেকেই মানুষ। আমার বাল্যবন্ধু। দুজনে একসঙ্গে বড় হয়েছি, পড়াশোনা করেছি, এমনকি এক গাঁয়ের মেয়েও  বিয়ে করেছিলাম। কিন্তু ভাগ্যের বিরম্বনায় দুজনেই আজ পত্নীহীন। আমার এক মেয়ে, বিয়ে দিয়েছি দূর দেশে। বছরে দুই একবার আসে। পেনশনের টাকায় কোনমতে সংসার চলে। নিজে দুটো রান্না করে নি কষ্ট করে। যেদিন পারিনা, সেদিন পাশের বাড়ির নিমাইয়ের বউ ভাত দিয়ে যায়। নিরঞ্জনের ছোট মেয়ের বিয়ে হয়নি, যে কারণে আমার মতো সমস্যায় পড়তে হয় না ওকে। সংসারের সব কিছুই ওই পুটিই সামলায়।

              প্রচণ্ড গরমে রাতে ভালো করে ঘুম হলো না। সারারাত হাতপাখা নাড়তে নাড়তে হাতের ডানা দুটি একেবারে ব্যথা হয়ে গেছে। ভোর রাতে হঠাৎই আকাশ প্রচন্ড মেঘলা করে বিদ্যুৎ চমকানো সহ মুষলধারায় বৃষ্টি নামল। তখন ভোর পাঁচটা। আমার ঘুম আর হলো না। আমি বৃষ্টি দেখতে খুব ভালোবাসি। বর্ষা ঋতু আমার  ও রাধার খুব ভালো লাগতো। রাধার বিয়ে হওয়ার পর আমি একেবারে একাকীত্ব অনুভব করি। তাই বিকেল বেলা পাড়ার ছোট ছোট নাতি-নাতনিগুলো এলে আমার একাকীত্ব দূর হয়ে যায়। এখন ওরাই আমার আনন্দেরদূত। জানালার কাছে বসে বসে বৃষ্টি দেখছিলাম আর প্রকৃতির অপরূপ শোভাকে উপভোগ করছিলাম‌। এরকম বৃষ্টি হলে আমার মানসপটে ভেসে ওঠে ময়ূরের পেখম মেলে বৃষ্টিতে ভেজার দৃশ্য, শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে অভিসারিকা রাধার দেখা করতে যাওয়ার সেই বর্ষা অভিসারের দৃশ্য‌। আর মনে পড়তো রাধার মার কথা। সেও বৃষ্টি ভারি পছন্দ করত। বৃষ্টিতে ভিজত আর চিৎকার করে বলতো-- " আমার ভারী ভালোলাগে বৃষ্টিতে ভিজতে। তুমি এসো, দেখবে তোমারও খুব ভালো লাগবে। অসহ্য গরমের ক্লান্তি একেবারে ভুলে যাবে।" কিন্তু সেই বৃষ্টিতে ভিজেই ওকে চলে যেতে হবে আমি এখনও ভাবতে পারিনা। নিউমোনিয়ায় মারা যায় রাধার মা সুন্দরী বউ‌।

           টানা  দুঘন্টা মুষলধারায় বৃষ্টি হওয়ার পর বৃষ্টি একেবারে থেমে যায়। আকাশে তখনও মেঘ ছিল। পরে আবার বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বাজারে যাবো বলে বেরিয়ে দেখি রাস্তাঘাট কাদায় কাদা। কিছু কিছু জায়গায় জল দাঁড়িয়ে গেছে। বাজারে যাওয়ার সময় দেখি, পাড়ার ছেলেরা মাঠে ফুটবল খেলছে। ছোট্ট বলাই মাঠের একপাশে দাঁড়িয়ে খেলা দেখছে। আমাকে দেখে দৌড়ে চলে আসে। জিজ্ঞাসা করে-- 'দাদু বাজারে যাচ্ছ?' আমি বলি-- "হ্যাঁ রে। বিকেলে আসিস কিন্তু।" বলাই মাথা নেড়ে আবার মাঠে গিয়ে দাঁড়িয়ে খেলা দেখতে লাগলো ‌।

         বাজার থেকে ফিরে এসে নিজের মত হাঁড়িতে চাল ও আলু চড়িয়ে দিয়ে 'শ্রীমদ্ভাগবতগীতা' খুলে একাদশ অধ্যায় "বিশ্বরূপ দর্শন যোগ" পাঠ করছি -- অর্জুনকে শ্রীকৃষ্ণের দিব্যদৃষ্টিদান ও বিশ্বরূপ দর্শন এবং ভক্তি রসের সঞ্চার সম্পূর্ণ কয়েকটি শ্লোক পাঠ করে নিয়ে ভাত নামিয়ে রাখি। তারপর এগারো নম্বর অধ্যায়টি শেষ করে হাত মুখ ধুয়ে দুপুরের খাবার খেতে বসি। খাওয়া শেষ করে একটু বিশ্রামের জন্য খাটে গিয়ে বসি। বাজার থেকে ফেরার পরপরই পুনরায় টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছিল। যখন দুপুরবেলা একটু বিশ্রাম নিতে যাচ্ছি তখনও ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে। ঠান্ডা ঠান্ডা আবহাওয়ায় কখন যে খাটে শরীর ঠেকিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছি নিজেই তা জানি না।

ঘুমের জগতে রাধার মাকে দেখলাম, যে একটা আম বাগানের মধ্যে দাঁড়িয়ে হাসছে আর আমাকে দেখে  বলছে -- " ও রাধার বাবা, তোমার জন্য বহুদিন ধরে অপেক্ষা করে আছি। কই, তুমি তো এখনো এলেনা। জন্ম-জন্মান্তরে একসঙ্গে থাকার কথা দিয়েছিলে। তোমার মনে নেই !!" তারপর দেখলাম যমরাজ এসে জোর করে সুন্দরীর হাত ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সে যেতে চাইছে না। যমরাজকে শুধু বলছে-- " জন্ম-জন্মান্তরে ও একসাথে থাকার কথা দিয়েছিল আমাকে।" সুন্দরীর কথার প্রত্যুত্তরে যমরাজ জানান--- "এখনো সময় হয়নি ওর। সময় হলে ওকেও নিয়ে আসব।" তারপর দেখলাম, একটা চাবুক মারতে মারতে সুন্দরীকে নিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ আমার ঘুম ভেঙে গেল‌। আমি চমকে উঠে দেখি সমস্ত গা বেয়ে ভয়েতে দরদর করে ঘাম ঝরছে। বাইরে তখন বৃষ্টি পড়ছে। সুন্দরীকে স্বপ্নে দেখে আমার মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে উঠলো। ভাবলাম, আজকে আর বাচ্চাদের কিছু বলবো না। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণের দয়ায় তা পারলাম না।

বিকেল পাঁচটার সময় বলাই, রতন, রিমি, আরাধ্যা, পাখি আরো অনেক শিশুরা গল্প শুনতে এলো বৃষ্টি মাথায় করে। ওদের ফিরিয়ে দিতে মন চাইল না। সেদিন বালক কৃষ্ণের কালিয়া দমন কাহিনী শোনালাম শিশুদের। বালক কানাই তাঁর বন্ধুদের নিয়ে মাঠে খেলা করছিলেন। খেলতে খেলতে বল নদীতে পড়ে যায়। সকলে যখন আফসোস করছিল যে, আজকে আর তারা খেলতে পারবেনা, তখন  কানাই জলের মধ্যে ডুব দিলেন। বলের খোঁজে একেবারে নদীর নিচে গিয়ে দেখেন, সেখানে কালিয়া নামের পাঁচ মাথা বিশিষ্ট একটি সাপের রাজ্য। সে কৃষ্ণকে বল দিতে চাইল না। বালক কানাইয়ের সাথে এরপর প্রচন্ড লড়াই হল কালিয়ার। অবশেষে কালিয়া পরাজয় স্বীকার করলেন এবং তার পঞ্চ ফনার উপর নৃত্য করতে করতে বালক কানাই জল থেকে উঠে এলেন। পাঁচ মাথা বিশিষ্ট কালিয়া নাগ-এর কথা শুনে সকলে ভয়ে শিউরে উঠলো। আরাধ্যা ও পাখি আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিল -- "দাদু কানাইয়ের সাথে কালিয়া পারল না কেন? ওর কী প্রচণ্ড শক্তি?" বলাই বলল -- " দাদু, কালিয়ার বিষ ছিল না ?" ওদের প্রত্যেকের প্রশ্নের যথাযথ উত্তর দিতে দিতে সন্ধ্যা গড়িয়ে এলো। তুলশী তলায় ও ঘরে লক্ষীর বেদীতে প্রদীপ দেখাতে হবে তাই ওদের সেই দিনের মত ছুটি দিয়ে দিলাম। শিশুদের কৌতুহলী মনের প্রশ্ন আমার খুব ভালো লাগতো। তাই আমি রাগ না করে সহজ-সরল ভাবে উত্তর দিতাম।

অকালে রাধার মা চলে যাবার পর থেকে আমি একেবারে একা। রাধা ছেলে-মেয়েদের সামলে অতদুর থেকে আসতে পারে না। একটু শান্তি পাওয়ার জন্য মনের মধ্যে জমে থাকা মেঘ কারো সামনে প্রকাশ করি না। একা একা সেই মেঘ বৃষ্টি হয়ে দুচোখ থেকে ঝরে পড়ে একান্ত নিভৃতে। আজ সন্ধ্যা প্রদীপ ধরিয়ে কোনমতে কৃষ্ণ নাম করে ঘরে আসি। শরীরটা খুব একটা ভালো লাগে না। প্রিয়জনদের কথা চিন্তা করে মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। জগতে আমরা সকলেই দুঃখকে চেপে রেখে সুখের অনুসন্ধান করে চলেছি। শিশুদের সংস্পর্শ আমি তাই করে চলেছি। আনন্দ পাই তাদের নিষ্পাপ সংস্পর্শে‌। তবে মনের মধ্যে জমে থাকা দুঃখ-কষ্টের কথা প্রকাশ করার লোকের খুবই অভাব।

দীর্ঘদিন নিরঞ্জন আমার বাড়ির ছায়া মাড়ায় নি। কিন্তু সেদিন রাতে হঠাৎ নিরঞ্জনের আগমন আমাকে অবাক করেছিল। নিরঞ্জনের চোখে জল দেখে আমিও কেঁদে ফেলেছিলাম। নিরাঞ্জন আমার কাছে চোখের জল নিয়ে এসে বলেছিল -- " গোবিন্দ তুই আমাকে ক্ষমা করে দিস বন্ধু। সত্যি সত্যি আমি এতদিন ধরে তোকে ভুল বুঝেছিলাম। আমি বুঝতে পেরেছি বিরাজ বৌ-এর মৃত্যুর জন্য তুই দায়ী নস, দায়ী আমার কপাল। তার নিয়তি তার মৃত্যুর কারণ।" নিরঞ্জনের এই কথা শোনার পর আমি জড়িয়ে ধরেছিলাম তাকে। কান্নায় দুজনে ভেসে গিয়েছিলাম।

সেদিনটি ছিল পয়লা বৈশাখ‌। আমি গ্রামের হাটে বাজার করতে গিয়েছিলাম। বিরাজ বৌও সেদিন বাজারে গিয়েছিল। বাজার সেরে গ্রামে ফেরার সময় দুজন একসাথে ফিরছিলাম। হঠাৎ প্রবল বেগে ঝড়-বৃষ্টি নামে। দুজনেই ভিজে ভিজে বাড়ি ফিরেছিলাম। বাড়ি ফিরে কলের জলে স্নান করে নিলে জ্বর আসবে না -- এই কথা আমি বিরাজ বৌকে বলেছিলাম। কিন্তু পরদিন থেকে জ্বরে পড়েছিল বিরাজ বৌ। নিউমোনিয়ায় সেও অকালে সুন্দরী বৌয়ের মতো চলে যায়। নিরঞ্জন সেই থেকে আমাকে ভুল বুঝেছিল যে, আমার বলাতেই বিরাজবৌ সেদিন বৃষ্টিতে ভিজে বাড়ী ফিরে ছিল। যার পরিনতি তার মৃত্যু। আজ সময়ের সাথে সাথে সে তার ভুল বুঝতে পেরেছে। তাই নিজের বাল্যবন্ধু, প্রাণপ্রিয় বন্ধুর কাছে ক্ষমা চাইতে এসেছে। নিজেদের ভুল বোঝাবুঝি দূর হওয়ার পর সেদিন রাত্রে আমরা দুই বন্ধু প্রায় দু-ঘন্টা ধরে নিজেদের অতীতে ফেলে আসা দিনগুলোর কথা স্মৃতি রোমন্থন করি।

রাত্রি দশটা নাগাদ নিরঞ্জন বাড়ি চলে গেলে আমার ভিতরটা অনেকটা হালকা হালকা বোধ হয়। এতদিনের একটা ভুল-বোঝাবুঝি ঘুচে যাওয়ায় কিছুটা শান্তি আমি পেয়েছিলাম। বাসুদেব শ্রী কৃষ্ণের কাছে বলেছিলাম -- " হে প্রভু জীবনের শেষ কয়েকটা বছর যেন এভাবেই আমি কাটিয়ে দিতে পারি-- আপনি আমাকে আশীর্বাদ করুন। মানবজীবন বড় দুঃখের। এ জীবনে শান্তির বড়ই অভাব। আমরা সকলেই অর্থের জন্য দৌড়ে চলেছি। প্রকৃত শান্তি কারো ঘরে নেই। ব্যক্তিস্বার্থ বড় হয়ে উঠেছে। নিজের মানুষরাই নিজেদেরকে দেখে না। এ বড় দুঃখের বিষয়। একটু শান্তির খোঁজে আমরা সকলেই।  কিন্তু শান্তি কোথায়?"

...(সমাপ্ত)...

No comments:

Post a Comment