1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Saturday, October 21, 2023

কৃতজ্ঞতা

ছবি : ইন্টারনেট

 কৃতজ্ঞতা

মিলন কুমার মুখার্জি

শনিবারের ছুটিটা আজ একটু অন্যভাবে কাটাবে বিমল l জানুয়ারিতে মুম্বই থেকে নতুন চাকরির অফারটা এল আর সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেল l কী আনন্দ! এইবার দত্ত সায়েবের মুখের ওপর জবাবটা দেওয়া যাবে l শুধু খিঁচ খিঁচ করা আর ভয় দেখিয়ে কাজ আদায় করা l শেষের দিকে ছুটি পর্যন্ত নিতে দিচ্ছিল না l  কলকাতা ছেড়ে দু' মাসের মধ্যে সপরিবারে চলে এল এই নতুন শহরে l

পেল্লায় শহর l পিলপিল করছে লোক! সারাদিনই শোরগোল l উঁচু উঁচু অট্টালিকাও আছে, আবার বিরাট বিরাট বস্তিও আছে l এখানে বস্তি বলে না, বলে 'চল', 'ঝোপড়পট্টি' বা 'ওয়াড়ি' - রকমফের অনুযায়ী l দামি দামি গাড়ির পাশে অটো-ট্যাক্সির সংখ্যাও কিছু কম নয় l তবে আসল গাড়ি হল ট্রেন - লোকাল ট্রেন l তিনটে লাইন - ওয়েস্টার্ন, সেন্ট্রাল আর হার্বার l এই তিনটেই হল মুম্বইয়ের প্রধান ধমনি l দশ-পনের মিনিট বাদ বাদ ট্রেন l তবুও অফিসটাইমে ভীড় অসম্ভব! পদ্মফুলের পাঁপড়ির মতো লোক ঝোলে কামরাগুলোর গেটে l কিন্তু ওই ট্রেনই জনসাধারণের যানও বটে, আবার জানও বটে! 

প্রথম দিন নতুন অফিসে পৌঁছনোর কথা এগারোটায় l বিমল খোঁজ নিয়ে দেখেছিল ওদের বাড়ির কাছের দহিসর স্টেশন থেকে চার্চগেট স্টেশন ট্রেনে প্রায় চল্লিশ মিনিট l তাই দেড় ঘন্টা আগে স্টেশনে চলে এসেছিল l কিন্তু যে ট্রেনই আসে, সেটা ভয়ংকর ভীড় l গেট থেকে অসংখ্য মানুষ ঝুলছে l পা রাখার কোন জায়গাই নেই! ফলে, একের পর এক চারটে ট্রেন ছেড়ে দিতে হল l শেষে বিমল দুশ্চিন্তায় ঘামতে শুরু করে দিয়েছিল l নতুন চাকরিতে প্রথম দিনই এত দেরী করলে চাকরি কি আর থাকবে? ছেলে-বউ নিয়ে এই নতুন জায়গায় পথে না বসতে হয়! টেনশনে প্ল্যাটফর্মের এদিক থেকে ওদিক হাঁটাহাঁটি শুরু করে দিল বিমল l এখানে ট্রেনে অনেক ধরনের কামরা - প্রথম শ্রেণী, দ্বিতীয় শ্রেণী, মহিলা, ভেন্ডার, বৃদ্ধ আর অসুস্থদের ইত্যাদি l বিমল দ্বিতীয় শ্রেণীর টিকিট কেটেছিল l অন্য শ্রেণীর কামরায় উঠে ধরা পড়লে ফাইন এবং হাজতবাস! সেদিকেও খেয়াল রেখে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়াতে হবে l

এমন সময়ে পঞ্চম ট্রেনটা ঢুকল l একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতেই যাচ্ছিল, কিন্তু ট্রেন ছাড়ার আগের মুহূর্তে একটা লোক গেটের থেকে হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে প্ল্যাটফর্মে পড়ে গেল l হয়তো শরীর খারাপ হয়ে থাকবে l কিছু লোক হই হই করে উঠল l কিন্তু বিমলের সেদিকে নজর ছিল না l লোকটা পড়ে যাওয়ায় যেটুকু জায়গা হয়েছিল, বিমল নিজের দেহটা সেই শূন্যস্থানটায় ছুঁড়ে দিল l হাত দিয়ে যে কী ধরেছিল আজ আর খেয়াল নেই l

ট্রেন চলতে শুরু করল l পেছনের লোকের চাপে আস্তে আস্তে ভেতরে ঢুকে যেতে থাকল বিমল l  চাপ চাপ ভীড় আর প্রচণ্ড গরমে নিশ্বাস যেন বন্ধ হয়ে আসতে লাগল l এরকম অবস্থায় কখনো পড়তে হয়নি l বনগাঁর ট্রেনেও বার দুয়েক চড়েছে, কিন্তু সে অভিজ্ঞতাও এমন মারাত্মক নয় l তার মধ্যে বীভৎস ঘামের গন্ধে পরিস্থিতি আরো খারাপ করে তুলেছিল l  বিমলের মনে পড়ল, পুরোন অফিসের তপুদা বলেছিল,'বুঝলি বিমল, বোম্বে গেলে বুঝবি জলই জীবন! জলের কষ্ট কাকে বলে! তখন মনে হবে, জীবনটা বুঝি জলেই গেল!' ঘামের গন্ধ তো জলের অভাবের সমানুপাতিক হবেই! সকাল থেকেই কপালটা অসহযোগিতা করছিল l ঘটনাচক্রে সাড়ে পাঁচ ফুটের বিমলের সামনের তিন চার জনই ছিল প্রায় ছ' - সওয়া ছ' ফুটের l ফলে, তাদের ঘামে ভেজা পিঠ এবং বগল ছাড়া আর কিছুই বিমলের নাকের নাগালে আসছিল না l

এই শোচনীয় এবং অসহনীয় অবস্থায় কিছুক্ষণ কাটতেই বিমলের চারপাশের আলো যেন কমে যেতে লাগল l কেমন যেন হালকা লাগতে লাগল l চারপাশের কয়েকজন হই হই করে উঠল l কাছের জানলার পাশে একটা গুণ্ডামার্কা লোক বসেছিল, মুখের ডানদিকে বড় জরুল l সে নিজে উঠে ওকে বসার জায়গা করে দিল l লোকটা নিজের বোতল থেকে জল দিল l অনেকেই আশ্বাস দিচ্ছিল - এরকম মাঝেমধ্যেই হয়, কিন্তু বড় কিছু হয় না! আশ্বাসবাক্য অতটা তৃপ্তিদায়ক লাগছিল না l লোকটা দু-তিন বার ঝুঁকে পড়ে জিজ্ঞেস করেছিল - শরীর কেমন লাগছে l লোকটাকে খুব ভাল লেগেছিল বিমলের - ও না সিট দিলে ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়েই আজ কিছু হয়ে যেত! ছেলে-বউ হয়তো খবরই পেত না! বিমল বাকী রাস্তা জানলার ধারে চোখ বন্ধ করে ঝিম মেরে বসেছিল l

দাদর স্টেশন থেকে ট্রেনের ভীড় বেশ কমতে লাগল আর মুম্বই সেন্ট্রালে একদম ফাঁকা হয়ে গেল গাড়ি l গোটা কামরায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে জনা আটেক যাত্রী l বিমলের বেশ ভাল বোধ হচ্ছিল l কিন্তু তখনই আরেকটা ঝটকা লাগল - মাস খানেক আগে পনেরো হাজারে কেনা মোবাইলটা নিরুদ্দেশ! পকেট খালি l ফাঁকা কামরায় এদিক ওদিক বৃথাই খুঁজল l মনটা ভেঙে গেল! চোখে জল এসে গেল! মোবাইলটায় প্রথম থেকেই শনি লেগেছিল! কেনার দিন দশকের মধ্যেই হাত থেকে পড়ে গিয়ে নীচের ডান কোণে একটা চির খেয়ে গেল l তাও সাবধানে চালাচ্ছিল বিমল, কিন্তু আজ তাও গেল!

এ ক'মাস অফিস আর বাড়ির কাজের চাপে নাস্তানাবুদ ছিল বিমল l নতুন অফিসের নতুন কাজ! নতুন বস, নতুন পরিবেশ l নতুন কালচার l আবার বাড়িতে গ্যাস, ছেলের স্কুল, টিউশন, মিসেসের ডাক্তার - এই সব ঠিক করতে করতে সময় ঝড়ের মতো কেটে যাচ্ছিল l একঘেয়ে কাজ আর কাজ! আজ একটু সমুদ্রের ধারে কয়েক ঘন্টা কাটিয়ে আসার পরিকল্পনা করল l ছেলের স্কুলে প্রজেক্ট তাই বউ-ছেলে এল না l

অক্সা বিচের এই দিকটায় ভীড় একটু কম l বেশ নিরিবিলি l হালকা ঢেউ l দূরে দূরে জনা দশ-বারো লোক ঘুরে বেড়াচ্ছে বা বসে আছে l একটা নীল প্লাস্টিক গোটা চারেক বাঁশের সঙ্গে বাঁধা, বোধহয় অন্য সময়ে এখানে কেউ দোকান লাগায় l এখন খালি l এখানেই বসে পড়ল সে l আহাহা, কি ভাল লাগছে! সামনে অনন্ত বিস্তৃত সমুদ্রে গোটা দুই নৌকো দেখা যাচ্ছে l মেঘে ঢাকা আকাশ দিগন্তে সমুদ্রের জলের সঙ্গে মিলেমিশে এক হয়ে গেছে l কিছু পাখি উড়ে বেড়াচ্ছে l মৃদুমন্দ হাওয়া দিচ্ছে l  এমন একটা ছবি মোবাইলবন্দী না করলেই নয়!

কিন্তু পকেটে হাত দিয়ে দেখল মোবাইলের কোন চিহ্নমাত্র নেই! ভয়ঙ্কর চমকে গেল বিমল! আবার চুরি? চারপাশে ঘুরে ঘুরে দেখল, কোত্থাও নেই! আগের মোবাইলটা চুরি হওয়ার তিন দিনের মধ্যে বারো হাজার দিয়ে কিনেছিল এটা l কারোর থেকে মোবাইল চেয়ে ওই নম্বরটায় এক্ষুনি একটা কল করা দরকার l কিছুটা দূরে দুটো লম্বা-চওড়া লোক গল্প করতে করতে হাঁটছে l বিমল দৌড়ে গিয়ে বলল,'দাদা, আমার মোবাইলটা পাচ্ছি না, আপনার মোবাইল থেকে একটা কল করতে দেবেন?' ওদের একজন পকেট থেকে নিজের মোবাইলটা এগিয়ে দিল l রিং হচ্ছে l তারপরেই বউয়ের গলা ভেসে এল,'হ্যালো...'l যাক্ ঘরেই ফেলে এসেছে! ভদ্রলোককে ধন্যবাদ দিয়ে মোবাইলটা ফেরৎ দিতে গিয়েই নজরে পড়ল - মোবাইলটার নীচের ডান কোণে একটা চির, খুব পরিচিত এ চিরটা! অবশ্য এরকম চির তো অন্য মোবাইলেও থাকতে পারে - ভাবল বিমল l কিন্ত ভদ্রলোক মুখ ফিরিয়ে ওকে প্রতি-ধন্যবাদ জানানোর  সময়েই ওনার মুখের ডানদিকের বড় জরুলটা চোখে পড়ে গেল বিমলের l চমকে উঠে কি যেন বলে উঠতে গিয়েও বলতে পারল না বিমল l ট্রেনে জানলার ধারের সিটে প্রায়-অজ্ঞান হয়ে বসে পড়ার দৃশ্যটা চোখে ভাসতে লাগল l

...(সমাপ্ত)...

No comments:

Post a Comment