1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Saturday, October 21, 2023

সুখদুঃখের স্বপ্নকথা

ছবি : ইন্টারনেট


সুখদুঃখের স্বপ্নকথা

সন্দীপ ঘোষ

গ্রাম দেবরাজপুর | বর্ধিষ্ণু এই গ্রামটির একেবারে দক্ষিণে পাশাপাশি বাস করে প্রাণেশ, বিনয়, সুহাসরা | সবার স্বপ্ন একটাই বড় হয়ে সাবলম্বী হবে | বাবা-মায়ের সাধ পূরণ করবে | যাঃ মনে ভাবলেই সবসময় সবার ক্ষেত্রে সেটা হয় নাকি ? আজ এটা উপলব্ধি করেছে প্রাণেশ | মাস ছয়েক হলো সে শিক্ষকতার পদে নিযুক্ত হয়েছে |  শীতের হাড়কাঁপানো ইনিংস শেষের দিকে | জানলা খুলেই বসেছিল | অস্বস্তি শুরু হলো… কারণ পশ্চিমের  জানলা দিয়ে মাঝে মাঝে  ঘরে ঢুকছে শীতল বাতাস | জানলা বন্ধ করে দেয় প্রাণেশ | দুপুরবেলা একলা ঘরে সে | মনে পড়ে যায় ছেলেবেলা-কিশোরবেলার স্মৃতি |  নাড়িয়ে দিয়ে যায় মনকে |

         বন্ধুদের সঙ্গে স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে হৈ-হুল্লোড় মজার আনন্দটা তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করত প্রাণেশ | পড়াশুনা করত খুব ভালোবেসে | শুধু তাই নয় যে কোনো খেলার ক্ষেত্রেও ঐ একইরকম উন্মাদনার শিহরণ অনুভব করত দেহের প্রতিটি কোষে,মনের রেখায় | জীবনে চলার পথে হয়ে উঠেছিল এক ছুটন্ত ঘোড়া | তাই প্রানবন্ত মন নিয়ে বন্ধুদের প্রাণোচ্ছল  সাহচর্য প্রত্যাশাই স্বভাবিক | সত্যি বলতে কি বিনয়- সুহাসদের মধ্যে এই অনুভুতিটা সমমাত্রায় কোনোদিন খুঁজে পায় নি সে | অথচ অর্থনৈতিক সচ্ছলতা কোনো অংশে কম নয় বিনয়-সুহাসদের |

            চাষীবাসী মানুষ প্রানেশের বাবা ও মা খুবই আন্তরিক প্রবণ, স্নেহশীল মনের মানুষ | ছেলের জন্য তাদের সবটুকু নিঃস্বার্থ ভাবে দিয়ে গেছেন | ছেলেও যথেষ্ট শ্রদ্ধাশীল, ভালোবাসা প্রবণ | তাই প্রকৃতির নিয়মের মতই সে আন্তরিকভাবে দায়বদ্ধ তার মা-বাবার প্রতি | নিখাদ ভালোবাসায় পরিপূর্ণ একটি সংসার | সপ্ন দেখেছিল প্রানেশ |

আজ বাস্তবায়িত হয়েছে |

     বিনয়ের মা এসেছিল প্রাণেশদের বাড়িতে | ছেলেকে নিয়ে তার একরাশ ক্ষোভ, মান-অভিমান আর নানান কথা বলে কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে যায় |  বাড়িতে বিনয়ের বাবা অসুস্থ | অনেক পরিশ্রম করে নিজেকে তিলতিল করে গড়ে তোলা মাস ছয়েক আগে নিযুক্ত সরকারী অফিসের আধিকারিক বিনয় কিছুদিন আগে বাড়িতে এসে বাবার চিকিত্সার বন্দোবস্ত করে আবার ফিরে যায় কর্মস্থল মেদিনীপুরে |

        আর খোঁজ নেয় নি বিনয় | এই দায়সারা গোছের মানসিকতা মেনে নিতে পারে না তার মা - বাবা | সত্যিই তো কোন্ বাবা মা নেবে এই আচরণ ? শিক্ষিত ছেলে | এত কষ্ট করে মানুষ করেছে আজকে এই দিন দেখবে বলে ? প্রাণেশ বোঝে এই আচরণের অর্থ | ছোটবেলায় প্রায়ই কাঁদত বিনয় তার কাছে এসে | বলত, মা-বাবা খালি ঝগড়া করে | তার কথা একদম ভাবে না | তার বাবা অফিস থেকে ফিরে নিত্যদিন চিত্কার চেঁচামেচি শুরু করে দিত | খাবার দিতে মিনিট পাঁচেক দেরি হলেই রাগে খাবার খেত না | রান্নার স্বাদ মনের মত না হলে সেই খাবার ছুড়ে ফেলে দিত | তার মায়ের সাথে ভীষণ ঝগড়াঝাটি করত | হাতও তুলত | শিক্ষিত এই মানুষটি কেন করত এসব ছোট্ট বিনয় বুঝত না | তিনটে মানুষ কারো সাথে কারো আন্তরিক বাক্যালাপ ছিল না | বিনয়ের মনের বিকাশের একটা গুরুত্বপূর্ণ সময়ে পারিবারিক তুচ্ছ তাচ্ছিল্য ভরা জীবন কী সাংঘাতিক পর্যায়ে যেতে পারে তা মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ চ্যটার্জ্জীর কাছে জেনেছে প্রাণেশ | তবুও বিনয় অনেক বেটার জায়গায় আছে | প্রাণেশ বোঝায়  বিনয়কে | বিনয় জানায় তার প্রাণরস প্রায় শুকিয়ে কাঠ | অবশিষ্ট যেটুকু আছে চেষ্টা করছে বাবা মা কে ভালো রাখার | নির্লিপ্ত বিনয়  আবার এসে চিকিত্সা করিয়ে ভালো করে তোলে | ভালোবাসার বন্ধনহারা বিনয় | কে বোঝে ? সমাজ কিন্তু আঙ্গুলটা বিনয়ের দিকেই তোলে |

         অন্যদিকে সুহাস বাড়ির খুবই আদুরে ছেলে | তার বাবাও সরকারী কর্মচারী |  এই পরিবারে রয়েছে অহমিকার বাতাবরণ | তাদের প্রত্যেকের মনের গভীরে সুপ্ত অবস্থায় পরষ্পরের প্রতি আন্তরিকতার অভাব রয়েছে |  আগে নিজেরটা বোঝে পরে অন্যের কথা চিন্তা করে | নির্ভেজাল খাঁটি ভালোবাসার জায়গাটার ভীষণ অভাব রয়েছে এই পরিবারে আবিস্কার করে প্রাণেশ | সুহাসের একজন দিদি আছে | নাম সোহিনী | বাবা-মায়ের স্নেহ-আদর-ভালোবাসা ভাগ্যে নেই মেয়ে হওয়ার সুবাদে | সে পড়তে চায় | চায় সাবলম্বী হতে | কিন্তু মেয়ে যে ! শ্বশুরবাড়ি চলে যাবে | কী হবে পড়ে ? যথারীতি তার বিয়েও হয়ে যায় | সুহাস অনেক বড় হবে | বৃদ্ধ বাবা-মাকে দেখবে | এই ভাবনার জগতে সে একটু একটু করে বড় হয়ে আজ সুপ্রতিষ্ঠিত , ব্যাঙ্ক ম্যানেজার পদে কর্মরত | সুহাস আজ প্রতিষ্ঠিত হলেও ইটকাঠ পাথরে পরিণত হয়েছে | মা-বাবার প্রতি যে আবেগ শ্রদ্ধা ভালোবাসার জায়গা সেটা তার শিশু বয়েস থেকে তার মা-বাবা নিঃস্বার্থ-নিখাদ ভালোবাসা ছেলের অন্তরে রোপন করতে পারেনি | বিস্তর একটা ফাঁক থেকে গেছে মনে করে প্রাণেশ | বর্তমানে বিয়ে করে শহরে সেটেলড্ সুহাস | মা-বাবার পরিচর্যা করে তার সেই অবহেলিত দিদি সোহিনী | শ্বশুরবাড়ি থেকে এসে নিয়মিত দেখে যায় |

         প্রাণেশ ভাবে জীবন বড়ই বিচিত্ৰ | কেবলমাত্র সত্যিকারের বা খাঁটি ভালোবাসার অভাব এক একটা পরিবারকে কোথায় নিয়ে গিয়ে দাঁড় করায় ! তাই স্বপ্নগুলো ঘরের চৌকাঠ পেরিয়ে অন্তঃপুরে প্রবেশ করতে পারে না | প্রাণেশ দু'হাত কপালে ঠেকায় ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে | মাতৃ-পিতৃসুখের পরম সুখানুভূতি অনুভব করে | কারণ শ্রেষ্ঠ সম্পদই হলো মা-বাবার ভালোবাসা |

...(সমাপ্ত)...

No comments:

Post a Comment