1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Saturday, October 21, 2023

উদ্বাস্তু

ছবি : ইন্টারনেট


উদ্বাস্তু

জগদীশ গাঙ্গুলি

"ওরে দাশু, দাশু রে শুনলাম নাকি আমাদের এই ভিটে মাটি ছেড়ে কলকিতা না কি যেনো নাম ওহ মনে পরসে আন্দিয়া না কি ঐখানে যাইতে হইবো"! শীতের অলস সকাল, দুইধারে বেগুন আর মুলোর ক্ষেত যতদূর চোখ যায় সবুজ আর সবুজ, বাংলাদেশের কুয়াকাটা গ্রাম, সময়টা উন্নিশো ছেচল্লিশ সালের ডিসেম্বর এর একটা শীতের সকাল, প্রশ্নকর্তা কালিদাসীর বড় সন্তান হচ্ছে দাশু যার ভালো নাম জ্যোতি গাঙ্গুলি, কলিদাসীর তিন মেয়ে আর দুই ছেলের মধ্যে এই দাশু হচ্ছে সবচেয়ে বড়, তারপর পরপর তিন মেয়ের পর ছোটো পুত্র ননী বা ননী মাধব গাঙ্গুলি। দাশু এখন দশম ক্লাস এর ছাত্র, পড়াশুনায় বরাবর মেধাবী। কালী দাসীর স্বামী, দাসুর বাবা যজমানি করতেন বছর খানেক হলো মারা গেছেন, কিছু চাষবাসের জমিজমা করে গেছেন, কালী দাসী শক্ত হাতে হাল ধরে গ্রামের রফিক কে দিয়ে সেই জমিতে চাষবাস করান যার একটা ভাগ রফিক পায়। চাষবাস থেকে হাটে গিয়ে ফসল বিক্রি সবই রফিক করে থাকে। এইভাবেই কষ্টে সৃষ্টে কালী দাসী পাঁচ ছেলে মেয়েকে নিয়ে বেঁচে আছেন। মার কথা শুনে দাশু কিছুক্ষন চুপ করে থাকলো তারপর আস্তে আস্তে বললো - " মুসলিম লীগ আর হিন্দু মহাসভা চাইছে সাহেব দের সরিয়ে দেশ কে দুটো ভাগে ভাগ করতে যার দুটো টুকরো হবে ভারত আর পাকিস্থান। কালীদাসী কিছু বুঝলেন কিনা দাশু বুঝতে পারলনা শুধু দুই হাত কপালে ঠেকিয়ে বলে উঠলো - " দুগ্গা, দুগ্গা"!

দুদিন পর রফিক মিয়া সকালে বাড়িতে এসেছিলো, কালীদাসী চা আর মুড়ি খেতে দিলেন, রফিক মুড়ি চিবোতে চিবোতে বললো - "বউঠান আমাগো এখনকার ভাবগতিক ঠিক ঠেকতেচেনা, কাল রাইতে আমাগো ছোটো মসজিদ এ মিটিং ছিলো ওখানে আমাগো গ্রামের মাত্তবর গফুর মিয়া কইতেছিল - "এই দেশখান আমাগো এইবার দেশ ভাগ হইলে এই হিন্দু দের এওখানে থাকবার কোনো অধিকার নাই এদের এইবার তারণ দিতে হইবো"! কালীদাসী গালে হাত দিয়ে রফিকের কথা শুনছিল, বললো "ও রফিক আমাগোর বাপ ঠাকুরদার জন্ম কম্য তো সব হাইখানে, আমরা তবে জামুটা কই!"  এর উত্তর রফিকের কাছে নেই, সে চুপ করে মাথা নিচু করে বসে থাকলো।

এর মধ্যে কালিদাসী আশেপাশের আর কয়েক ঘর যে হিন্দু পরিবার আছে তাদের সাথে কথা বলে বাস্তবিক পরিস্থতিটা কি বোঝার চেষ্টা করেও কিছু বুঝে উঠতে পারলনা সমসময় এখন একটা ভয় ভীত পরিবেশ, যে সব মুসলমান ভাই বোনেরা এতদিন ধরে এই হিন্দু পরিবার গুলোর সুখ দুঃখের সাথী ছিলো তারাও আজকাল কেমন যেনো এদের সন্দেহের চোখে দেখা শুরু করলো, কথাবার্তাও খুব একটা দরকার না হলে আর বলতনা, এর মধ্যে রফিক এসে একদিন কালিদাসী কে বললো -"মা ঠাকুরণ আর বোধ হয় আপনাগো কাজ আমি করতে পারুম না আমার গেতি গুষ্ঠি আমারে না করতাছে হিন্দু বাড়ি কাজের জন্যে"। কালীদাসী চুপ করে থাকলেন চোখের কোন দুটি ঝাপসা হয়ে আসলো, রফিকেরও কি তা হলনা!নাহলে রফিক কোনো রকমে মুখটা পিছন করে দৌড়ে পালাবে কেনো!

গ্রামে মুসলিম লীগ বলে নাকি এক নতুন পার্টি এসেছে,এরা জায়গায় জায়গায় সভা করছে আর বলে বেড়াচ্ছে হিন্দুদের এসব স্থানে কোনো জায়গা নেই, তাদের এই ভিটে মাটি ছেড়ে চলে যেতে হবে, অনেক হিন্দু বনেদি পরিবার যাদের সামর্থ্য আছে তারা জলের দরে ভিটে মাটি মুসলমান দের  বিক্রি করে কলিকাতা না এমনি একটা কোনো জায়গায় চলে যাচ্ছে, যাওয়ার সময় বাড়ির মহিলাদের সে কি কান্না! কতো স্মৃতি, মূহুর্ত, ভালোলাগা, ভালোবাসা,পুকুর ভরা মাছ, নিজেদের হাতে লাগানো চারা পেয়ারা, আম, জাম, কাঠাল,তাল যেগুলো আজ মহীরুহতে পরিণত হয়েছে, গোলা ভরা ধান, গোয়ালের গরু বাছুর, হাস,পায়রা সব ছেড়ে আজ চলে যেতে হচ্ছে, যেখানে যাবে অপরিচিত জায়গা, অপিরিচিত পরিবেশ, নতুন লোকজন পারবেতো সব কিছু মানিয়ে আবার নতুন ভাবে সব শুরু করতে! তাও এরা যেতে পারছে আর যারা পারছেনা, সামর্থ্য নেই তারা মনে মনে ক্ষ্মীন একটা আশা জিয়ে রেখেছে আগামী দিনে আবার সব আগের মত ঠিক হয়ে যাবে! আবার তারা এখানে নিশ্চিন্তে থাকতে পারবে! কিন্তু হায়রে মানুষ ভাবে এক আর হয় আরেক!

দাশুর মনমেজাজ খুব খারাপ ও বুঝতে পারছে একটা ঝড় এগিয়ে আসছে যা সব লন্ডভন্ড করে দেবে, ছোটো ছোটো অবুঝ  ভাইবোনগুলোকে ,মাকে নিয়ে কি করবে সে বুঝতে পারছেনা! এর মধ্যে কানা ঘুষয় শুনলো একজন ব্রিটিশ বিচারপতি স্যার সেরিল রেডক্লিফ নাকি নাম তাকে দায়িত্ব দাওয়া হয়েছে বাংলা বিভক্ত করার বাউন্ডারি কমিশনের, যার ম্যাপ করার কোনো প্রতিষ্ঠানিক বিদ্যা নেই, যে  না বাংলা ভাষা বোঝে,  না বাংলার সংস্কৃতি বোঝে, বাঙালির মনন বোঝে, বাংলার আনন্দ বেদনা যে কিছুই বোঝেনা, এর হাতে কোটি কোটি বাঙালির ভবিষ্যত ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। কোটি কোটি বাঙালির জীবন যার হাতে অনিশ্চিত! মুর্শিদাবাদ, সিলেটের মানুষ আজ বিভ্রান্ত, ১৯৪৭এর এপ্রিল মাসেও বোঝা যায়নি দেশ ভাগ হবে কিন্তু এই স্যার সেরীল এর কাজকর্মে এবার দেশ ভাগের ছবিটা একটু একটু করে পরিষ্কার হতে শুরু করে। রাতের অন্ধকার চিরে শত শত মুসলিম এবার পথে নেমে আল্লাহ আকবর হুঙ্কার দিয়ে হিন্দুদের ঘর বাড়িতে আগুন লাগানো শুরু করে, বহুদিনের চেনা জানা জাহাঙ্গীর, আবুল, লতিফ,আসিফ,মকবুলরা চোখের সামনে কেমন পাল্টে যায়, শয়ে শয়ে হিন্দু প্রাণ বাঁচাতে ভিটে মাটি ছেড়ে প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে রাস্তায় নেমে দিকবিদিক জ্ঞান শূন্য হয়ে একটু আশ্রয়ের জন্যে দৌড়া দৌড়ি শুরু করে, এর মধ্যে কারোর মাথায় লাঠির আঘাত পরে, সারা শরীর রক্তে ভেসে যায় তার মধ্যেও তারা দৌড়ায়, কেউ মাটিতে লুটিয়ে পড়ে স্থির হয়ে যায়, কেউ কোনো ঝোপ ঝাড় দেখে তার মধ্যে ঢুকে ভয়ে কাঁপতে থাকে, চোখের সামনে কতজন তাদের মা, বোন দের নির্মম ভাবে ধর্ষণ হতে দেখে। দাশু তার চার বোন,ছোটো ভাই আর মাকে নিয়ে রফিক চাচার বাড়িতে আশ্রয় নেয়, চোখের সামনে তাদের সাধের ভিটে, তুলসিতলা,সামনের উঠোন টা ধূলিসাৎ হতে দেখে,একদলা কান্নার মত কিছু একটা গোঙানির মতো গলা দিয়ে বেড়াতে চায়, রফিক চাচা বলে - " দাশু এক কাম কর সবাইরে লইয়া তুই বেড়াতে পারবিনা, তোরে, ননী আর মা ঠাকুরন কে যেমন কইরা হোক আমি রাতের অন্ধকারে গোয়ালন্দ ঘাট অব্দি লইয়া যামু তারপর ওপারে রানাঘাট এ শুনছি হিন্দুদের থাকার জন্যে একটা ক্যাম্প করা হইছে ওই অব্দি আমি তোদের ছাইড়া আসুম আর এই মাইয়া কডা এই গরীব চাচার ভিটায় আমার জিম্মায় থাক পরিস্থিতি একটু সাবভিক হইলে তারপর এগুলারে লইয়া ছাইড়া আসুম"! রফিক চাচার কথায় দাশু কোনো উত্তর দিলনা,দাশু শুধু ভাবছে এরপর কাল থেকে কি হবে!কি খাবে, কোথায় থাকবে! ভাইবোন গুলোর কি হবে! সন্ধ্যার পর দাশু, ননী আর কালীদাসী তৈরী হলো, কালিদাসী একটা পুঁটলিতে যতটা হয় চিরে মুড়ি আর গুর নিয়ে নেন, রফিক কালী দাসীর হাতে পঞ্চাশ টা টাকা জোর করে গুঁজে দেন, কালীদাসীর চোখ ভিজে ওঠে, রফিক কে প্রাণভরে আশীর্বাদ করেন। রফিক বলে ওঠে - " মা ঠাকুরন আর দেরী করা সমচিন হইবনা এবার চলেন"। রফিক হাতে একটা দা নিয়ে দরজা খোলে, বাইরে নিকষ কালো অন্ধকার, একটু আগে বৃষ্টি হয়েছে, কালীদাসী কে রফিক একটা বোরখা পড়িয়ে দেয়। দত্তদের মাঠের পাশ দিয়ে, সোনা দীঘি কে পিছনে রেখে দাশুর স্কুল এর পাশ দিয়ে পশ্চিম দিকে তারা এগোতে থাকে, দাশু শেষ বারের মত স্কুলটা দেখে নেয়।l বুকের ভেতরে একটা মোচড় দিয়ে ওঠে। পথে

রফিক মিয়া ছিলো বলে কেউ কোনো সন্দেহ করেনি। যেতে যেতে দাশু পথের দুধারে হিন্দুদের বাড়িঘর দেখে শিউরে ওঠে। রাতের অন্ধকারে প্রতিটি বাড়ি যেনো এক একটা মৃত্যুপুরী।কোনো বাড়ি ঠিকঠাক অক্ষত নেই, একটা ঝড় যেনো সব লন্ডভন্ড করে গিয়েছে।

কুয়াকাটা গ্রামের সীমানা ছাড়িয়ে মেন রাস্তায় দাশুরা যখন উঠলো দেখলো কাতারে কাতারে লোক গোয়ালন্দ ফেরি ঘাটের দিকে বিধ্বস্ত শ্রান্ত হয়ে দেহটাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে, কোথায় যাবে, কি তাদের ঠিকানা কেউ জানেনা, ননীর ছোটো শরীর এর মধ্যই ক্লান্ত হয়ে পড়েছে, পথের একপাশে বসে সবাই একটু চিরে গুর খেয়ে নেয়, জল খায়, রফিক মিয়া ননিকে কাঁধে উঠিয়ে নেয়। আবার চলা শুরু। ভোরের আকাশ যখন ধীরে ধীরে লাল বর্ণ ধারণ করছে সেই সময় তারা গোয়ালন্দ ফেরি ঘাটে পৌঁছায়, চারদিকে শুধু মাথা আর মাথা। রফিক মিয়া তাদের ঘাটে বসিয়ে চারটে টিকিট কেটে আনে, দাশু শোনে তাদের ফেরিতে করে ওপারে যেতে হবে, তারপর ট্রেন ধরে রানাঘাট বলে একটা জায়গায় নামতে হবে, সেখান থেকে আরো  সবার সাথে উদ্বাস্তু ক্যাম্প এ গিয়ে উঠতে হবে, তাদের ওখানে পৌঁছে রফিক মিয়া ফিরে আসবে। কালীদাসী অস্ফুটে শুধু একবার বলে ওঠে " রফিক রে এবার আর মনসা পুজোটা করা হইলো নারে"! রফিক মিয়ার মুখে স্বজন হারাবার বিষাদের ছায়া। ফেরিতে গাদাগাদি করে উঠে ওপার পারে নেমে দাশুরা শেষবারের মতন ওপারটা দেখে নেয়, এই হয়তো তাদের শেষবার নিজের দেশটাকে দেখে নেওয়া। রফিক কালীদাসী কে আশ্বস্ত করে তার প্রাণ থাকতে কালীদাসীর মেয়েদের চিন্তা করতে হবেনা। তারা একটু থিতু হলে রফিক নিজে তাদের এপারে দিয়ে যাবে। দাশু ভেবে পায়না ওপারে কিভাবে তারা থিতু হবে! ফেরি থেকে নেমে ভোরের আলোয় তারা স্টেশন এর দিকে হাটা দেয়, আজ থেকে তাদের নতুন পরিচয় "উদ্বাস্তু"। পথে আসতে আসতে কানে আসছিল  পনেরো আগস্ট ইন্ডিয়া পাকিস্তান নামে দুটো স্বাধীন দেশ জন্ম নেবে আর তাদের ভিটে মাটি সব থাকা সত্বেও সব হারিয়ে তারা উদ্বাস্তুর তকমা ধারণ করে এই অভিশপ্ত জীবন বয়ে বেড়াবে, তাদের জন্যে কারোর কোনো চিন্তা নেই, কারোর কোনো ভাবনা নেই, কেউ জানেনা এই অভিশপ্ত জীবনের শেষ কোথায়!

...(সমাপ্ত)...

No comments:

Post a Comment