1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Saturday, October 21, 2023

পঞ্চপাণ্ডব

ছবি : ইন্টারনেট

পঞ্চপাণ্ডব    

মৌসুমী দেবঘোষ

-“আমাদের এই রকটার পাঁচ বছরপূর্তিটা কিন্তু পালন করা উচিত”

-“অফকোর্স! সেই সঙ্গে আমাদের পঞ্চপাণ্ডবের কর্মহীন জীবনের পাঁচ বছরটাও ,ঠিক কিনা!’ 

-“ঠিক ঠিক!”  

    কথাগুলো যেন কে বলেছিল- নির্ঘাত ঐ অরণিটা ! ওর মাথাতেই  তো যত রাজ্যের উদ্ভট চিন্তা-ভাবনা গিজগিজ করে সবসময়।অরনি আর সন্তুটাই তো আমাদের আড্ডার প্রাণ ,ওরা না থাকলে জমেই না। আজ সব মনে পড়ে যাচ্ছে ,বেশিবেশিই মনে পড়ছে ! 

   লোডশেডিং চলছে বোধহয়, নিমুদার দোকানের টিমটিমে আলোর সাধ্য কি এই অন্ধকার ভেদ করে। সমস্ত রকটাই অন্ধকারে ডুবে আছে। কেবল রাস্তায় দ্রুত অপস্রিয়মাণ বাস –ট্রাকের হেডলাইটের আলোয়ে এক আধবার ঝলসে উঠছে মাত্র।তেমনি এক ছিটকে আসা আলোয় রকের গায়ে কাঠকয়লা দিয়ে লেখা শব্দগুলো আমায় যেন স্ট্যাচু করে দিয়ে গেল।সেই ছোটবেলার গো-স্ট্যাচু খেলার স্ট্যাচু!  

     বুকের মধ্যে কোথায় যেন একটা বিচ্ছেদের যন্ত্রণা চিনচিন করে ওঠে । কে লিখল কথাগুলো ,কবে লিখল –আজই ? এই রকটার সাথে এতদিনের যে একটা নাড়ির টান ছিল , আজ সেই নাড়ি ছেঁড়ার কষ্ট অনুভব করলাম মর্মে মর্মে!  

     ওই অপরিচ্ছন্ন হাতের লেখা শব্দগুলো যেন এক অদৃশ্য ফরমান –“আর আগিয়ো না,তুমি আর আমাদের কেউ নও”। 

    এক বুক স্মৃতি নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম অন্ধকারে স্তব্ধ হয়ে ।যেতে পারলাম না রকটার কাছে ,চলে যেতেও পারলাম না!   

    ********* 

   আজ মনে পড়ছে সত্যিই আমরা একদিন পাঁচবছর পূর্তিটা পালন করেছিলাম নিমুদার দোকা্নে বেশ হই হই করে। মুড়ি –তেলেভাজা আর নিমুদার হাতের গরম গরম চা দিয়েই গ্র্যান্ড ফিস্ট খাবার স্বাদ পেয়েছিলাম সকলে-আমি ,সন্তু ,অরনি,আর তপেস।অবশ্য নিমুদাকেও আমরা আমদের মধ্যেই ধরতাম।

    নিমুদার দোকানের সামনের ওই সিমেন্টের বেদিটাই তো আমাদের ঠেক,যেটাকে আমরা নাম দিয়েছিলাম “পঞ্চপাণ্ডবের সিংহাসন”। শহরের শেষে এই পাঁচমাথার মোড়ে নিমুদার চা দোকান, প্রচুর গাড়ি চলাচল করে, দোকানটাও সারারাতদিনই খোলা। 

      আমাদের আড্ডায় মাঝে মাঝেই আমরা অদ্ভুত অদ্ভুত বিষয় নিয়ে কত না মজা করতাম! যেমন একদিন  আমরা ঠিক করলাম সেদিন যে যার ভবিষ্যৎ নিয়ে পরিকল্পনা জানাবে- অবাধ কল্পনার সুযোগ।

    আমাদের মধ্যে সন্তুর অবস্থাই সবথেকে খারাপ। ভাইবোনদের মধ্যে ওই সবার বড়,ওর নিচে আরো দুটো ভাইবোন,ছোট ভাইটা জন্মের পরই নাকি ওর বাবা নিরুদ্দেশ। পাড়ার বয়স্করা বলেন ওর বাবা নাকি সন্ন্যাসী হয়ে গেছে। 

   ওরা থাকে কাকার কাছে,বাজারে কাকার একটা ছোট মুদি দোকান আছে, লোকটা খারাপ কিছু না। বিয়ে-থা করেনি,দাদার সংসারটাই টেনে গেল।তাই নিয়েও নিন্দুকেরা নানা কথা বলে ।এমনও বলে দাদার নিরুদ্দেশের পিছনে নাকি ওনারই হাত আছে। 

    কে জানে সত্যি কি! মানুষের জীবনের কটা সত্যি বা জানা যায় !

   তবে সন্তু ওর কাকাকে যত না  ভয় পায় ,তার দ্বিগুণ ভয় করে নিজের মাকে। ওর মা-মহিলাটি ডেঞ্জারাস ,সবসময় যেন ভিসুভিয়াস হয়ে আছেন ! উঠতে বসতে সন্তুকে কথা শোনায়।তাঁর ইচ্ছা ও কাকার দোকানটাতেই বসুক,সন্তুর মোটেই তা ইচ্ছা নয়। এইচ এস দিয়ে তো ও আর পড়লই না। এদিক-ওদিক কাজের চেষ্টা করে বেড়ায়, এই বাজারে কে আর এইচ এস পাশ ছেলেকে কাজ দেবে! অগত্যা আমাদের ঠেকে বসে কল্পনার রঙিন ফানুশ ওড়ানোই কাজ !   

     আসলে সন্তুর খুব ইচ্ছা, ছিল ষ্টেশন এলাকায় নতুন যে মার্কেটিং কমপ্লেক্সটা গড়ে উঠেছে সেখানে একটা বইএর দোকান করার। কদিন খুব ছুটোছুটি –একেতাকে ধরাধরিও করেছিল। কিন্তু সেলামির অঙ্কের পরিমান শুনেই পিছিয়ে এসেছে,এক  লাখ টাকা! অতো টাকা ওর কাছে ছিলই না, তাছাড়া যোগাযোগ করতে গিয়ে জানতে পারে দোকানঘরগুলো ভেতরে ভেতরে বিলি হয়েই গেছে। বাইরে একটা লোকদেখানো বণ্টননামা হবে শুধু। 

     মনে আছে ,সন্তু রকে বসে অক্ষম রাগে সেদিন বলেছিল-“শালা, এক লাখ টাকাই যদি সেলামিতেই চলে যায় তবে ব্যাবসাটা করব কি দিয়ে ,হাওয়ায় ?শালা এদেশে ব্যাবসা হয়!”কথায় কথায় “শালা” বলা ওর একটা মুদ্রাদোষ। 

    সেই সন্তুও সেদিন বিনা দ্বিধায় বলেছিল ,ও নাকি একটা লটারির টিকিট কেটেছে,তাতে ওর ফার্স্ট প্রাইজটাই লেগে গেছে!অনে-ক টাকা, ও একটা বিরাট বইএর দোকান দেবে শহরের একদম মাঝখানে। একটা প্রেসও করবে,তাতে নতুন লেখকদের বই ছাপাবে ইত্যাদি ইত্যাদি---আরো কত কি !   

 *******

     এরপর ছিল তপেশের পালা। তপেশ কমার্স গ্রাজুয়েট ,সি এ পড়ার ইচ্ছা ছিল ,হয়নি। মেসে থাকে,টিউশানি করে,আর একটার পর একটা চাকরীর পরীক্ষা দিয়ে যায়। 

   ও বলেছিল – একদিন হঠাৎ ও নাকি পরীক্ষায় পাশ করে একটা নামকরা বড় ব‍্যাঙ্কে চাকরী পেয়ে যাবে ,তারপর একটা মস্ত বড় বাড়ি করবে ,বড় বাইক কিনবে ---ইত্যাদি ইত্যাদি।

    আমরা সমস্বরে যোগ করেছিলাম “আর তোর কল্পনা? “ 

    তপেশ একটু লাল হয়েছিল ,লজ্জা লজ্জা পাওয়া গলায় বলেছিল -"ওঃ , সে কল্পনা তো থাকবেই”।

     তপেশের মেসের সামনের বাড়িতে একটি মেয়ে থাকে, বেচারি তার নজরে পড়ার কত চেষ্টাই না করে গেছে ,মেয়েটা চেয়েও দেখেনি! তার নাম “কল্পনা”কিনা আমরা তা জানিও না ,এই নাম আমাদেরই দেওয়া । 

  এবার অরনির বলার পালা। ওরা নাকি কোন এক সময়ে জমিদার ছিল।এখন ঐ কি বলে না নামেই পদ্মপুকুর আসলে ঘটি ডোবে না, সেই অবস্থা আর কি !হাজারটা শরিকের সাথে একটা পলেস্তারা খসা বিশাল বাড়িতে থাকে। বাবা চাকরি করতেন ,এখন রিটায়ার্ড পার্সন,দাদা রেলে চাকরি করে ।কিন্তু বৌদি মেয়েটি মোটেই সুবিধার নয়। নিত্যদিন সংসারেঅশান্তি লেগেই আছে। অরনি কিন্তু চাকরীর চেষ্টাই করে না। ওর নাকি এসব পোষায় না ,ও চায় নতুন কিছু করতে স্বাধীন ভাবে ।চাকরি ও করবে না,চাকরি দেবে লোককে! 

    অরনি পায়ের উপর পা তুলে জমিদারী চালে বলেছিল, -“ওসব ছেঁদো পথে আমি যাচ্ছি না , আমি বাপু কয়েক লাখ নিয়ে নেমে পড়বো, সিনেমা বানাবো বুঝলি। বিরাট নাম হবে, প্রচুর পয়সা হবে,কাগজের প্রথম পাতায় বড়ো করে আমার ছবি বেরাবে,এয়ারকন্ডিশন গাড়ি হবে,আজ বম্বে,কাল লন্ডন ঘুরে বেড়াবো ।এমন একটা সিনেমা করবো--- ফাটাফাটি ব্যাপার হবে,আর সিনেমার গল্পটা লিখবে ও”।অরনি এমন ভাবে আমার দিকে আঙ্গুল তুলে দেখিয়েছিল যেন পরের দিনই ও শুটিং শুরু করবে আর আমাকে সেদিনই গল্পটা লিখে দিতে হবে!

   আমাদের চা দিতে এসে নিমুদা ফুট কেটেছিল- “ভাই রে দাদাটার কথা ভুলো না যেন ,শুটিঙে অন্তত আমার চা দোকানের একটা সিন রেখো , বলা তো যায় না অস্কার-টস্কার পেয়ে গেলে হয়তো !” 

    সেদিন কি হাসাই না হেসেছিলাম সবাই!! 

******      

    বলতে নেই এদের মধ্যে আমার অবস্থাটাই একটু ভালো।মধ্যবিত্ত ফ্যামিলি, বাবা এখনো চাকরীতে আছেন, তাই সংসারের চাপটা এখনো ঘাড়ে এসে পড়েনি।যদিও সে সুখ আর বছর দুয়েকের।তিন ভাইবোনের মধ্যে আমিই বড়।বাড়ির চাপে গ্রাজুয়েশন শেষ করে এম এ-তে ভর্তি হয়েছি বটে ,ক্লাস খুব একটা করা হয় না।তার সাথে অধিকাংশ ছেলেরা যা করে আমিও তাই করছি চাকরীর ফর্ম ফিলাপ করা, পরীক্ষা দেওয়া, আর নিয়ম করে দুবেলা আড্ডা মারা। 

     বাবা পার্টি করেন ,মিটিং-মিছিলে যান। তবে বাবা উপরতলায় পাত্তা না পাওয়া সেই বিরল প্রজাতির  একজন ঘোরতর আদর্শবাদী মানুষ।যিনি নিজের সম্পর্কিত কারো সমন্ধে কোন সুযোগসুবিধা নিতে নারাজ(যদিও আমার মনে হয় সে ক্ষমতা ওনার নেইও) ।ওনার কথা হল নিজের যোগ্যতা দিয়ে আদায় করো,আমি একটু- আধটু সাহায্য করতে পারি এই পর্যন্ত। রোজ এই নিয়ে বাড়িতে মায়ের সাথে ঝগড়া!ঝগড়াটা অবশ্য একতরফাই হয়, কারন বাবা বেশিরভাগ সময়েই চুপ থাকেন। মাকে প্রায়ই বলতে শুনি-“ তুমি বসে বসে শুধু আদর্শের বুলিই আওড়াও আর ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াও,আর অন্যরা নিজের আখের গোছাক , তাদের ছেলেরা চাকরী পাচ্ছে,একতলা বাড়ি দোতলা হচ্ছে, শুধু তোমারই কিছু হয় না!”    

     ঘরে থাকলেই মায়ের এই গজগজানি শুনতে হয়। উপলক্ষ‍্য আমি, তাই যতদূর সম্ভব বাইরেই থাকি,সেটাই নিরাপদ। আজকাল সন্তুরাও বলে-“ শালা তুই এখানে আর কতকাল বসে থাকবি রে! তোর বাবাও তো পার্টি –ফারটি করে,তোর কেন একটা হিল্লে হয় না বুঝি না ! অবশ্য কি করেই বা হবে বল ,তোর বাবা তো চুনোপুঁটি। উপরে যে সব রুই-কাতলারা আছে তারা কিছু ছাড়লে তবে না---শালা!” 

      মনে আছে ,সেই সন্ধ্যায় আমি বলেছিলাম –“ধর আমি একটা  চাকরী সত্যিই পেয়ে গেলাম।তখন সন্তুর প্রেসে আমার গল্পের বই ছাপাবো, তপেশ পুশ সেল করবে,আর অরনি তো বলেই দিয়েছে ও গল্পটা নিয়ে সিনেমা বানাবে ,ভালো হবে না!”ওরা সকলেই সমস্বরে টেবিল চাপড়ে আমাকে সমর্থন করেছিল।

   আমাদের চিৎকারে নিমুদার দোকানের অন্য খদ্দেররা রেগে যেত ,দুএকটা বিরক্তিসূচক মন্তব্যও করতো কখনো। 

   সেকথা শুনে সন্তুকে থামাতে গেলে খেপে যেতো, জামার হাতা গোটাতে গোটাতে বলতো –‘কোন শালা কি বলেছে চল দেখি!”ওর মাথায় বুদ্ধি থাক না থাক, গায়ে জোর ছিল খুব,রোজ মুগুর ভাঁজত যে!

*********

  আমাদের আড্ডাটা রোজই বসত ,কেবল বৃষ্টিবাদলার দিনে আড্ডাটা নিমুদার দোকানের একটা টেবিল জুড়ে বসত। নিমুদা এই চারটে ভ্যাগাবন্ডকে কোনোদিন তাড়ায় নি। ওখানে আমাদের অবাধ বিচরন,কত যে চা-পান-সিগারেট উড়ে যেত ,সব দিন পয়সাও দেওয়া হত না,থাকতই না ।নিমুদাও চাইত না ,লিখে রেখে দিত। আমরা যে যখন পারতাম শোধ করে দিতাম । খদ্দের না থাকলে অনেক সময়ে নিমুদাও এসে যোগ দিতো আমাদের সাথে, বয়েসের তফাৎ কোনোদিন আমাদের আড্ডায় বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় নি। বরং নিমুদার একটা বিশেষ গুন ছিল- সারাদিন কাজের ফাঁকে যেসব মজার মজার খবর যোগাড় করত খদ্দেরদের কাছ থেকে,বেশ রসিয়ে রসিয়ে বলত সেগুলো! 

      আমাদের আড্ডায় কত কিছুই যে আলোচনা হতো ! হিট সিনেমার নায়ক-নায়িকা থেকে রাজনীতি, খেলাধুলা,প্রেম কিছু পড়তে পেত না।

     আড্ডাতে বসেই যেমন খবর পেলাম তপেশের মেসের সামনের বাড়ির সেই কল্পনার নাকি বিয়ে,ছাদে প্যান্ডেল হচ্ছে।বেচারাতো একেবারে মুষড়ে পড়ল। কদিন পরেই দেখি তপেশ হাসিমুখে এসে জানালো- খবরটা ভুল ছিল, বিয়ে হচ্ছিল ওর কোন মামাতো দিদির।

   একদিন শুনলাম পাশের পাড়ার গোবিন্দবাবুর ছেলে নাকি স্কুলে চাকরি পেয়েছে,কাকে নাকি কত লাখ টাকা নাকি ঘুষ দিয়ে। সবাই মিলে সেদিন গোবিন্দবাবু আর তার অপগন্ডো ছেলের মুন্ডুপাত করে নিজেদের গায়ের ঝাল মিটিয়েছিলাম।

*******

       আমাদের দিনগুলো এরকমভাবেই কেটে যাচ্ছিল, সেই থোড় বড়ি খাঁড়া, আর খাঁড়া বড়ি থোড় করে। আমাদের সবার বয়েস বেড়ে যাচ্ছিল শুধু, কারোরই কিছু জুটছিল না।

   এর  মধ্যেই এমন একটা ঘটনা ঘটল, সব কিছু কেমন যেন উলটপালট হয়ে গেল! একটা যেন ঘূর্ণিঝড়-সাইক্লোন তছনছ করে দিল সব! 

       আমি  একদিন সত্যিই একটা চাকরী পেয়ে গেলাম-ক্ল্যারিকাল পোষ্টে ,তবু তো চাকরী ! চাকরীটার জন্য পরীক্ষা দিয়েছিলাম ঠিকই, কিন্তু সবটাই আমার কেরামতিতে হয়েছে বললে ডাহা মিথ্যে বলা হবে। 

  মায়ের কাছে নিত্যদিন কথা শুনতে শুনতে বাবাও বোধহয় আর চুপ করে থাকতে পারেননি। কিছুদিন ধরেই বাবাকে এর-ওর কাছে ছুটতে দেখেছি,আর কি কি তিনি করেছিলেন জানি না।শুধু একদিন সকালে দেখি রেজিস্ট্রি করে একটা চিঠি  এল আমার হাতে-চাকরির অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার ! 

   সারা বাড়িতে যেন খুশির ঝড় বয়ে গেল,বহুদিন পর মাকে দেখলাম হাসতে। সেই ছোটবেলার মতো প্রাণখোলা হাসি। ছোট ভাইবোনগুলোরও আর আনন্দ ধরে না। আমিই কেবল অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারটা হাতে নিয়ে বসেছিলাম চুপ করে -বুঝতে পারছিলাম না কি করা উচিত এখন ।আমার কি আনন্দে অন্যদের মত মেতে ওঠা উচিত-নাকি-----।

   বুকের মধ্যে একটা অজানা রিনরিনে ঢেউ- এই একটা চিঠি আমায় কতদুরই না নিয়ে যাবে ! চোখের সামনে এক এক করে ভেসে উঠছিল বন্ধুদের মুখগুলো। তপেশ সবসময় বলত-নিজের উপার্জন নিজে খরচ করার ক্ষমতাটাই স্বাধীনতা । অরনির মতে-চাকরীটা আসলে একটা দাসত্ব। সন্তু বলত-চাকরীই হোক কি ব্যাবসা- শালা টাকাটাই আসল জীবনে ইয়ার!

    আমি জানি না কে ঠিক ওদের মধ্যে,আমি দাসত্ব করতে যাচ্ছি,না স্বাধীনতা পেতে !  শুরু এটুকু বুঝতে পারছিলাম,এই একটা চিঠিই আমার জীবন বদলে দিতে যাচ্ছে!

           মা একগাদা সিঁদুর মাখানো সন্দেশ কপালে ছুঁইয়ে মুখে গুঁজে দিল।কতদিন যে মাকে এত কাছ থেকে দেখিনি।ঠিক কোন বয়েসের পর মায়ের গায়ের গন্ধ এমনি করে নাকে লাগেনি কে জানে! মায়ের পরনে গরদের লাল পাড়ের শাড়ি, পিঠে খোলা ভিজে চুল ,কপালের সিঁদুরের ধেবড়ে যাওয়া টিপ –বোঝাই যাচ্ছে মা মন্দির থেকে ফিরেছে।মায়ের ঘামে ভেজা মুখ থেকে চুইয়ে পড়ছে আনন্দটা ।ভারি ভালো লাগে দেখতে! অনেকক্ষণ তাকিয়ে আছি দেখে মা বোধহয় লজ্জা পেলেন ,বললেন –“ কি রে অমন করে কি দেখছিস ?”

   -“না ,ও কিছু না” বহুদিন পরে মায়ের সাথে হালকা ভাবে কথা বললাম আমি।ভাল লাগার এই রেশটুকু অনিবার্য ভাবে সংক্রামিত করেছিল আমাকেও!   

*****

    একটু পরেই বেরিয়ে পড়লাম ,এত বড় একটা খবর ,বন্ধুদের না দেওয়া পর্যন্ত তর সইছিল না । কে জানে এত বেলা হয়ে গেল ,ওরা চলে গেল কিনা! 

     বাড়ির গলি ছেড়ে বড় রাস্তায় উঠতেই দেখা হয়ে গেল তপেশের সাথে। ঠেক থেকেই ফিরছে,আমাকে দেখেই সাইকেল থামালো –“কিরে বড় ডুব দিলি যে আজ!কি ব্যাপার?” 

    কথাটা কিভাবে শুরু করব বুঝতে পারছিনা।তবু বলতে তো হবেই,কিছুটা হেঁয়ালির ঢঙে বলি-“এবার থেকে আর বোধহয় ঠিক সময়ে রকে আসতে পারব না রে।”  

    -“কেন?” তপেশ স্বভাবতই অবাক হয়। 

     -‘না মানে…মানে তোদের বলেছিলাম না ,সেই যে ইন্টারভিউটা দিতে গেলাম ,আমার চাকরীটা হয়ে গেছে জানিস ।’ কথাটা শেষ করতে পেরে বাঁচি আমি। 

     তপেশ নির্নিমেষ তাকিয়ে ছিল আমার দিকে, ওর দৃষ্টিতে জিজ্ঞাসা-ঈর্ষা-বিস্ময়ের মাখামাখি।খবরটা শুনে যা ভেবে ছিলাম, ও কিন্তু মোটেই আনন্দে ফেটে পড়ল না। বরং অন্য দিকে তাকিয়ে হেসেছিল ,হাসিটা শানিত ছুরির মতো। 

   কেটে কেটে বলেছিল-“যাক!শেষপর্যন্ত তোরও তাহলে একটা হিল্লে হয়ে গেল।ভালো … ভালো,কদিন আর রকে বসে কাটাবি বল,তোদের সুযোগ আছে,এতদিন যে কেন বসেছিলি সেটাই আশ্চর্যের ! যাক কংগ্রাচুলেসন ভাই! চলি রে।”  

     তপেশ দ্রুত সাইকেল চালিয়ে চলে গেছিল। বুঝতে পারি ও মোটেই খুশি হয়েনি,বরং আমার চাকরীর পেছনে যে বাবার হাত আছে সেটাই ঘুরিয়ে বলে গেল।

    আসলে অনেকদিন আগে ওর কোন একটা কাজের ব্যাপারে বাবাকে ধরেছিল, বাবা কাজটা করতে চান নি। সেই রাগটাই ঝালিয়ে নিল।    

     মনটা ভীষণ দমে গেল।যেন আমি এই চাকরীর জন্য কোন চেষ্টাই করি নি,যেন চাকরী পাওয়াটা অপরাধ! আজকাল ধরাধরি ছাড়া কিছু হয়?বাবা যদি ছেলের জন্য এটুকু করেই থাকেন ,তাকি খুব দোষের! 

     মনের মধ্যে একটা খচখচানি চলতেই থাকে। সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে কখন যে নিমুদার দোকানের সামনে এসে গেছি বুঝতেই পারিনি।নিজের নামটা কানে যেতে সম্বিৎ ফেরে,দেখি সন্তু-অরনি তখনো বসে আছে। খদ্দের নেই বলে নিমুদাও আড্ডা দিচ্ছে ওদের সঙ্গে। 

   সন্তুই চেঁচিয়ে ওঠে স্বভাবসিদ্ধ কণ্ঠে-‘কি গুরু সকালটা তো মা-বাবার বাধ্য ছেলে হয়েই কাটালে,ব্যাপার কি !’

    হেসে ওদের পাশে বসি,খবরটা কিভাবে বলব ,ভাবছি।এরাও যদি তপেশের মত-----! চুপ করে আছি দেখে নিমুদা বলে-‘তোমার কি কিছু হয়েছে ?চা খাবে ?’ 

   -‘ঘরে আজ নির্ঘাত ঝাড় খেয়েছে ব্যাটা, ঠিক কিনা?’ সন্তু টিপ্পনী কাটে। 

    মনের মধ্যে আনন্দের ঢেউ ,অথচ কিছু বলতে ভরসা পাচ্ছি না। শেষপর্যন্ত সঙ্কোচ কাটিয়ে বলতেই হয়-‘একটা ভালো খবর আছে নিমুদা---‘ 

   -‘ভালো খবর! বলো বলো ‘ নিমুদা বলে।

   -‘ওতো গাইছো কেন গুরু! ঝেড়ে কাশো দেখি,ব্যাপারটা কি ?সন্তুর তর সয় না। 

   -‘না ,মানে সেই যে আমি একটা ইন্টারর্ভিউ দিতে গেলাম না----আমার চাকরীটা হয়ে গেছে।‘

     সন্তু-অরনি-নিমুদা হা করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে,আমি ঠাট্টা করছি কিনা বুঝতে। সবার চোখেই বিস্ময় আর অবিশ্বাস ,বাধ্য হয়ে পকেট থেকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারটা বের করতেই হয়। 

     চিলের মতো ছোঁ মেরে চিঠিটা নেয় সন্তু,ভালো করে উল্টেপাল্টে দেখে পরক্ষণেই টেবিল চাপড়ে চিৎকার করে ওঠে-‘ও নিমুদা ,সত্যিই তো গুরু মার দিয়া কেল্লা! শালা এতক্ষণ কত পাঁয়তারাই না করছিল! তা মুখটা অমন করে আছিস কেন? না খাওয়ালে আর ছাড়াছাড়ি নেই বুঝেছ বাছাধন!গ্রান্ড ফিস্ট চাইইইই ।‘ 

      চিঠিটা ততক্ষণে অরনির হাতে।  

    -‘আরে বাবা খাওয়াব নিশ্চয়ই’-আমি বলি।  

   -‘এবার কিন্তু শুধু চা- টোস্টে হবে না বলে দিচ্ছি।’ নিমুদা চা দিতে দিতে বলে।

   -‘কি যে বল তুমি নিমুদা,চা- টোস্ট কি গো ,এবার মাংস- ভাত চাই,বিরিয়ানি-চিলি চিকেন চাই, শালাকে ছাড়বো ভেবেছো !’

    -‘সে তো বটেই ,ওকে তো একটা ফেয়ারওয়েল দিতে হবে নাকি ,ওর বেকার জীবন শেষ!’  

    -‘ঠিক ঠিক !’সন্তু উচ্ছসিত।

   আমি প্রতিবাদ করি-‘ ফেয়ারওয়েল আবার কি? আমাকে তোমরা তাড়িয়ে দিচ্ছো নাকি !অফিস তো দশটা –পাঁচটা, তারপর আমি ঠিক আসবো দেখে নিও।‘  

     -‘আসবি মানে! ঘাড় ধরে আনবো তোকে, এবার থেকে আমাদের সব টি এ বিলগুলো তো তোকেই দিতে হবে ,কি নিমুদা ঠিক বলি নি?’ নিমুদাও মাথা নেড়ে সমর্থন জানায়। 

     এতক্ষণ অরনি একটাও কথা বলে নি, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে চিঠিটাই পড়ছিল।পড়া শেষ করে আমার হাতে চিঠিটা ফেরত দিয়ে বলল- ‘এখানের কথা আর কি মনে থাকবে ওর!চলি রে—ফিস্ট হলে যেন বাদ না পড়ি!’ 

     অরনি চলে যায়,তপেশের মতো স্পষ্ট ভাবে না হলেও ,কোথায় যেন ওর কথাতেও একটা কাঁটা লুকিয়ে ছিল।  

     কিন্তু সন্তু আর নিমুদা খুব খুশি, নিঃস্বার্থ ভাবেই খুশি!বাকি দুজনকে মনে মনে ক্ষমা করে দিয়েছিলাম আমি। ওদের কষ্টটা আমি বুঝি! 

*********

      তারপরের কয়েকটা দিন কেটে গেল কেমন ঘোরের মধ্যে। জয়েন করতে যাবার আগের দিন সারারাত ঘুমই হল না আমার। কেবলই মনে হচ্ছিল, এটা সত্যি তো,নাকি স্বপ্ন!আমাদের রকের আড্ডায় বসে দেখা স্বপ্ন নয়তো ! কাল সকাল হলেই এই স্বপ্নটা ভেঙে যাবে নাতো!

  না যায়নি, মানুষের জীবনের কোন কোন স্বপ্ন সত্যিই হয়,এটা তেমনই। পরদিন আমি জয়েন করলাম। নতুন অফিস,নতুন মানুষের সাথে পরিচয় হল।বেশ লাগছিল ।প্রথম কয়েকটা দিন কাজ বুঝে উঠতেই চলে গেল আমার। 

       দিনগুলো যেন ঝড়ের বেগে কেটে যেতে লাগল। সকালে উঠে যাহোক করে তৈরি হয়ে ,নাকেমুখে দুটি গুঁজেই দৌড় ।ফিরতে ফিরতে কোন কোন দিন তো রাত আঁটটাও হয়ে যায়।অরনির কথাই ঠিক হলো, ঠেকের দিকে যাবার সময়ই হচ্ছে না। যাতায়াতের পথেই মাঝে মাঝে ওদের সাথে দেখা হয়েছে,কথা বলার সুযোগ পাই নি,দূর থেকে হাত নেড়েই ছুটেছি বাস ধরতে। 

      আজকাল ছুটির দিনেও ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়।তবু একদিন ঠেকে এলাম ,ততক্ষণে বেলা হয়ে ছগেছে বেশ।

    সন্তু আর নিমুদা ছাড়া কেউ ছিল না । আমাকে দেখে দুজনেই খুব খুশি,নতুন অফিসের গল্প হলো কিছুক্ষণ। সেদিনই ঠিক হল আগামী রোববারেই আমাদের ফিস্ট হবে,মেনু ওরাই ঠিক করবে।নিমুদাই সব দায়িত্ব নিলেন হাসিমুখে।বাকিদের বলার ভার সন্তুর। 

       আজ এসেছিলাম অফিস ফেরত,নিমুদাকে টাকাটা দিয়ে যাবো বলে। রাত হয়ে গেছে , তার উপর লোডশেডিং। অন্ধকারে হাটতে হাটতে, কত পুরানো কথাই মনে ভিড় করে আসছিল! হঠাৎ পাশ দিয়ে চলে যাওয়া গাড়ির আলোয় ঠেকটা আলোকিত হয়ে উঠতে নজর আটকে গেল লেখাটার দিকে।

     বুকের মধ্যে কোথায় যেন একটা জোর ধাক্কা লাগল । স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম ,কে যেন আমার পাদুটো গেথে দিয়েছে মাটিতে!এগাতেই পারছি না!নিজেকে বড্ড একা মনে হচ্ছিল ।

    চোখের কোনটা নিজের অজান্তেই করকর করে উঠল। দেখলাম ঠেকের দেয়ালে কে যেন কাঠকয়লা দিয়ে ঘষে ঘষে -‘পঞ্চ’ শব্দটা মুছে লিখে দিয়েছে-‘চারপাণ্ডব’!   

...(সমাপ্ত)...

No comments:

Post a Comment