1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Saturday, October 21, 2023

ঠাকুর ঘরে লাশ

ছবি : ইন্টারনেট


ঠাকুর ঘরে লাশ 

                                     উত্তম চক্রবর্তী                               

দমদম এয়ারপোর্ট থেকে একটা ট্যাক্সি বুক করে ওদের বাগুইহাটির বাড়িতে যখন জয়ন্ত আর তার স্ত্রী মন্দিরা পৌঁছল তখন বেলা সাড়ে দশটা বেজে গেছে। সিঙ্গাপুর থেকে এয়ার ইন্ডিয়ার ফ্লাইট ছেড়েছিল ঠিক সময়েই। ভারতের তথা কলকাতার মাটিতে ল্যান্ডিং করে সকাল নটার সময়। তারপর ইমিগ্রেশন ও কাস্টমস ক্লিয়ারেন্স করে এয়ারপোর্ট থেকে বেরোতে লেগে যায় আরও একঘণ্টা। জয়ন্ত আর মন্দিরা দুজন একটা টুরিস্ট কোম্পানির প্যাকেজ ট্যুরে পাঁচ দিনের জন্য গেছিল সিঙ্গাপুরের বিখ্যাত স্টার ক্রুজে তিন রাত্রি চার দিনের ট্যুরে। শেষ দিন ওরা সিঙ্গাপুরে এক রাত থেকে সারাদিন শপিং করে আজ সকালেই দেশে ফিরেছে।

জয়ন্তর এটা পৈত্রিক সম্পত্তি। বাবা অশোক সেন ছিলেন কটকে পি ডাবলু ডির ইঞ্জিনিয়ার। রিটায়ার করার তিন বছর আগেই বাগুহাটির দক্ষিণ পাড়ায় জমি কিনে এই এক তলা চার কামড়ার বাড়িটা বানিয়ে ভাড়া দিয়ে রেখেছিলেন। রিটায়ারের পরেই ওঁরা সবাই কলকাতায় এই বাড়িতে চলে আসেন। তখন জয়ন্ত ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে গেছে আর ওর বোন জয়া বি এ পাশ করেছে। জয়ন্তর মা মারা গেছেন যখন জয়ন্তর বোনের সবে বিয়ে হয়েছে এবং জয়ন্ত কলকাতায় ওর দ্বিতীয় চাকরীতে ঢুকেছে। তারপর থেকেই জয়ন্ত আর ওর বাবা এই বাড়িতে একাই থাকত। জয়ন্ত বিয়ে করবার ঠিক দেড় বছর পরেই ওর বাবা এক রাতে হার্ট এটাক করে মারা গেছিলেন।

জয়ন্ত সেন উৎকল ইউনিভার্সিটি থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে কলকাতায় এসেই টাটা কনসালটেন্সিতে চাকরি পেয়ে গেছিল। বোনের বিয়ের পর মা মারা গেলেন, জয়ন্ত ঢুকল এক্সেঞ্চারে। তার ঠিক এক বছর বাদে জয় ওর অফিসের বন্ধুর বোন মন্দিরাকে ভালোবেসে বিয়ে করে ফেলল। বিয়ের পর থেকেই জয়ন্তর প্ল্যান ছিল ওরা দুজন একবার সিঙ্গাপুরের এই স্টার ক্রুজের ট্যুরটা করবে। জয়ের অফিসের এক বন্ধু জানিয়েছিল তাদের হনিমুনে এই ট্যুরটায় গিয়ে ওরা নাকি দারুণ মজা করে ঘুরে এসেছিল সেবার। সেই থেকেই জয়ের প্ল্যান ছিল ওর ইরাকে নিয়ে দুজন একবার অন্তত স্টার ক্রুজে গিয়ে সমুদ্র ভ্রমন করে সিঙ্গাপুর ঘুরে আসবে।

বাড়িতে এসে চাবি দিয়ে জয়ন্ত অনেক্ষণ যাবত চেষ্টা করেও মেইন গেটের লক খুলতে পাড়ল না। লকটা ভিতর থেকে কেউ আটকে দিয়েছে। জয়ন্ত চিন্তায় পড়ে যায় এবং বাড়ির পিছনের ম্যাথরদের যাবার গেটটা খুলতে গিয়ে দেখল সেটাও ভিতর থেকে আটকানো। চোর লকটাকে নষ্ট করেই হয়ত বাড়ির ভিতরে ঢুকেছে। বাড়ির সব দরজা জানলা বন্ধ থাকায় ভিতরের কিছুই বাইরে থেকে দেখা যাচ্ছে না।

জয়ন্ত আর কোন রিস্ক না নিয়ে সোজা বাগুইহাটি থানায় ফোন করে জানাল ঘটনাটা। মিনিট দশেকের মধ্যেই ইন্সপেকটার বিশাল ভরদ্বাজ তার টীম নিয়ে পৌঁছে গেলেন দক্ষিণ পাড়ায় জয়ন্তর বাড়িতে। ইন্সপেকটার বিশাল সব শুনে এবং দেখে জয়ন্তকে বললেন, ‘আপনার ঘরে ঢুকতে গেলে যে কোন একটা দরজা ভেঙ্গে ঢুকতে হবে। আমি বলিকি পিছনের দরজাটা ভেঙ্গে আমরা ভিততে যাই চলুন।’ জয় দখলে এটাই ভাল হবে। সামনের দরজাটায় বেশ কাঠের কারুকার্য করিয়েছিলেন ওর বাবা। ওটা ভাঙতে কষ্ট হয়। দরজাটা নষ্ট হয়ে যাবে।

জয় ঘাড় নেড়ে সম্মতি দিল পর পুলিশ পিছনের দরজাটার তালা ভেঙ্গে দেয় আর তারপর সবাই মিলে জয়ন্তদের কমন বাথরুম দিয়ে বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করে। কিন্তু ঘরে ঢুকেই জয়ন্ত এবং পুলিশ অফিসার দেখলেন ঘরের জিনিসপত্র সব লণ্ড ভণ্ড করা। বোঝা যাচ্ছে বাড়িতে চোর ঢুকেছিল, বসবার ঘরের জিনিষ, টেবিলের জিনিস, ড্রয়ারের সব নিচে ফেলে সে এক চূড়ান্ত ছড়ানো ছেটানো বিচ্ছিরি দৃশ্য দেখতে পেল ওরা। জয় ওদের বেড রুমে গিয়ে দেখে দেয়াল আলমারি খোলা, জামা কাপড় সব ঘেঁটে দেখবার লক্ষন চারিদিকে। ডাইনিং টেবিলে একটা খালি মদের বোতল গ্লাস প্লেট রাখা।

ইন্সপেকটার বিশাল এসে দাঁড়িয়ে পড়েন ওদের ঠাকুর ঘরের সামনে। বন্ধ দরজাটা টেনে দেখলেন অটো লক ভিতর থেকে আটকানো। ইন্সপেকটার বিশাল জয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এই ঘরের তালার চাবি নিয়ে আসুন। ভিতরে কী আছে দেখতে হবে।’ ইরা গিয়ে শোবার ঘরের ড্রয়ার খুলে তালার চাবি নিয়ে আসে আর তারপর দরজা খুলেই সবার চক্ষু চড়ক গাছ হয়ে যায়। ভিতরে সিলিং ফ্যানের সাথে ঝুলছে টি সার্ট ও ফুল প্যান্ট পরা একজন যুবকের মৃতদেহ। ইন্সপেকটার বিশাল সেই দেখে অবাক হয়ে উপর দিকে তাকিয়েই জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এ বাবা ! এ আবার কী ? কে এই লোকটা ? চেনেন নাকি আপনি, নাকি এই ব্যাটাই চুরি করতে এসেছিল ?’

জয়ন্তর পিছনে এসে দাঁড়ানো মন্দিরা ভয়ে চিৎকার করে উঠে বলে উঠল, ‘ও মাগো, একী কাণ্ড গো ? কে এই লোকটা? ইস মরবার আর কোন যায়গা পেলিনা তুই? এসে একেবারে আমাদের ঠাকুর ঘরেই মরলি ? কী হবে এখন ?’

ইন্সপেকটার বিশালের দিকে তাকিয়ে স্তম্ভিত জয়ন্ত বলে, ‘আমরা একে চিনব কোত্থেকে ? এই লোকটাই বোধ হয় পিছনের তালা কোনমতে খুলে ভিতরে ঢুকে চুরি করতে এসেছিল, এই বাড়ি খালি দেখে। কিন্তু লোকটা এভাবে ঠাকুর ঘরে ঢুকে আত্মহত্যা করতে গেল কেন সেটাই তো মাথায় ঢুকছে না স্যর !’

ইন্সপেকটার বাগুইহাটি থানায় ফোন করে দেন। একটু বাদেই এ্যাম্বুলেন্স এবং সাথে পুলিশের ফটোগ্রাফার ও সাথে ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ চলে আসে। জয়ন্তদের বাড়ির সামনের ভিড় জমে গেছিল, দুজন কনস্টেবল সামাল দিচ্ছিল তখন। ইতিমধ্যে ইন্সপেকটার বিশাল প্রথমে ঠাকুর ঘর এবং তারপর একে একে সবকটা ঘর খুব ভালো করে চেক করতে থাকেন যদি কোন ক্লু পাওয়া যায়। ইন্সপেকটার এরপর জয়ন্ত এবং ইরার স্টেটমেন্ট রেকর্ড করে নিলেন। বোঝা গেল কেউই এই লোকটাকে চেনে না এবং সাড়া বাড়িতে জিনিসপত্র তছনছ করে এই লোকটা কিছু একটা খুঁজে না পেয়ে হতাশ হয়ে গেছিল আর তারপর হয় এ আত্মহত্যা করেছে অথবা কেউ একে খুন করে ঝুলিয়ে দিয়ে ঠাকুর ঘরের তালার লক ভিতর থেকে টেনে বাইরে থেকে লক করে দিয়েছিল।     

পুলিশের টিম মৃতদেহের ফটো তুলে, ডেড বডি নিচে নামিয়ে ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞ চেক করবার পর এ্যাম্বুলেন্সে করে মরদেহ নিয়ে চলে গেল আর জি কর হাসপাতালের উদ্দেশে। বিশাল জয়ন্ত এবং মন্দিরাকে শহর ছেড়ে কোথাও না যেতে বলে দিয়ে বিদায় নিয়ে চলে আসেন থানায়। কিন্তু বিশালের মনে খচ খচ করতে থাকে কে এই লোকটা এবং জয়ন্তদের বন্ধ ঠাকুর ঘরে ওর ডেড বডি এলোই বা কী ভাবে ? লোকটা যদি আত্মহত্যাই করে থাকে তবে সেটা বাইরে অন্য কোথাও না করে জয়ন্তর বাড়িতে গিয়ে করল কেন ? জয়ন্তদের সাথে এর কি কোন রকম সম্পর্ক ছিল যেটা জয়ন্ত চেপে যাচ্ছে ? মরবার আগে ওই বাড়িতে এসে ছেলেটা তন্ন তন্ন করে কী খুঁজছিল ? তবে জয়ন্ত আর মন্দিরা বিদেশে গিয়েছিল। হয়ত তারা এই ঘটনার সাথে কোন রকমেই জড়িত না।

বিভ্রান্ত ইন্সপেকটার বিশাল লাল বাজারে ওর বন্ধু ইন্সপেকটার সুজন বিশ্বাসকে ফোনে সমস্ত ঘটনা জানিয়ে মৃত লোকটার পরিচয় পেতে ওর ফিঙ্গার প্রিন্টের সাথে আধার কার্ডের ডেটা চেক করে আজই সমস্ত কিছু বিশালকে জানাতে অনুরোধ করলেন। বিকেলে লাল বাজার থেকে খবর আসে মৃত ছেলেটার নাম চন্দন মোহান্তি, বাবার নাম বিরেন মোহান্তি,কটকের লোক। মৃতের বয়স আঠাশ বছর এক মাস। ইন্সপেকটার ঠিক করলেন কটকে গিয়ে এই কেসটার ব্যাপারে আরও ছানবিন করতে হবে। সেদিনই রাতের ট্রেনের টিকিট বুক করে নিলেন।

******


বিরেন মোহান্তি ছিলেন নামকরা একজন তান্ত্রিক মানুষ। কটকে মহানদীর পাশে ধনবালেশ্বর নামের এক টুরিস্ট স্পটে ফাঁসি ঠাকুরানীর মন্দিরে ছিল তার আস্তানা। সেখানে ইংরাজদের আমলে ভারতীয় বিপ্লবীদের বড় বড় উঁচু গাছে ঝুলিয়ে ফাঁসি দেওয়া হত। সেই থেকেই এই ঘাটের মা কালী মন্দিরের নাম হয়ে যায় ফাঁসি ঠাকুরানীর মন্দির। স্থানীয়দের কাছে ভীষণ জাগ্রত মন্দির এটা। বিরেন মোহান্তি এই মন্দিরেই পূজা আচ্চা করে তন্ত্র মন্ত্রের সাধনা করে যথেষ্ট নাম অর্জন করেছিলেন। বিরেন তার স্ত্রী, মেয়ে তাপসী আর ছেলে চন্দনকে নিয়ে কাছেই বন জঙ্গলে ঘেরা এক ছোট্ট বহু পুরানো পৈত্রিক বাড়িতে বসবাস করতেন। 

বিরেনের ঠাকুরদা ধিরেন মোহান্তি ছিলেন বিপ্লবী মানুষ। কটকে ইংরাজদের উপর বোমাবাজি করতে গিয়ে ধরা পড়ে জেলে গেছিলেন। তখন বিরেনের ঠাকুমা ছিলেন অন্তঃসত্বা। জেলে ওঁর বিনা বিচারে দুই বছর কেটে যায়। তারপরে সেই বন জঙ্গলে ঘেরা ফাঁসি ঠাকুরানী মন্দিরের কাছেই এক নির্জন জায়গায় আরও সাতজন স্বদেশী বিপ্লবির সাথে ধিরেন মোহান্তিকেও ফাঁসি দেওয়া হয়। ইতিমধ্যে বিরেন মোহান্তির বাবা নবীন মোহান্তি জন্মেছিলেন এবং তখন তার বয়স ছিল মাত্র দেড় বছর। অনেক পরে মায়ের মুখে এই সব ঘটনার কথা জানতে পেড়েছিলেন বিরেন মোহান্তি। বিরেনের স্কুল শিক্ষক বাবা নবীন মোহান্তি বিরেনের মা নন্দিনীকে বিয়ে করে বেশ সুখেই জীবন কাটিয়ে ছিলেন।

নবীন মোহান্তির মৃত্যুর পর তার বিধবা মা খুব কষ্টে বড় করে তোলেন একমাত্র ছেলেকে। ওঁর বাপের বাড়ি কটকেই। দাদাদের আর্থিক সাহায্যে এবং বাড়িতে বসে ব্লাউজ সায়া পাজামা ইত্যাদি সেলাই করে কোনোমতে বিরেনকে মানুষ করে তোলেন নন্দিনী। ভাগ্যিস মাথার ওপর ছাঁত ছিল। কিন্তু ছোট থেকেই বিরেন পাশের কালী মন্দিরের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন এবং সেখানে আসা সাধু সন্যাসিদের সাথে মেলামেশা করে একজন তন্ত্র মন্ত্রের সাধক হয়ে ওঠেন। ওঁর গুরু সাধু লোলিত মহাজন ওঁকে অনেক আশ্চর্য তন্ত্র মন্ত্রে দীক্ষিত করে তুলেছিলেন। সেই সময় গুরুজির মৃত্যুর পর কাছেই ঝোপ জঙ্গলের মাঝে এক ফেলে যাওয়া বহু পূরানো ইংরাজের পোড়ো বাড়িতে নির্জনে বসে সাধনা করতে গিয়ে বাড়িটার গুপ্ত এক ঘরে বিরেন এক সোনা দানায় ভরা একটা গুপ্তধনের বাক্সের সন্ধান পেয়ে গেছিলেন। তান্ত্রিক হবার সুবাদে উনি এরপর সেই ধন সম্পদের রাক্ষা করবার জন্য সেই বাড়ির ভিতরেই তার সাধন স্থল গড়ে তোলেন। দিনে দিনে তার ভক্তের সংখ্যা বাড়তে থাকে। ওর বিধবা মা এসবের কিছুই জানেন না, কোনোমতে সংসার চালাতেন।

চন্দনের মা রূপসী সাহু বালেশ্বরের মেয়ে। বিরেন এক ভক্তের বাড়িতে তার বড় মেয়ের পাঁচ বছরের পুত্রের রোগ সারাবার জন্য ডাক পেয়ে বালেশ্বরে গিয়ে সেই বাড়ির ছোট মেয়ে রুপসীর দেখা পান এবং মন্ত্র বলে রূপসীর মনোহরন করে একেবারে তাকে বিয়ে করে ঘরে এনে তুলেছিলেন। যদিও নতুন স্ত্রীকে নিয়ে বিরেন মোহান্তি তার পৈত্রিক বাড়িতেই তুলেছিলেন, কিন্তু সকাল আর রাতে মন্দিরে গিয়ে পূজা দিয়ে তারপর সারাদিন এবং সারা সন্ধ্যা তিনি সেই ইংরাজের পোড়ো বাড়ির সাধনাস্থলেই থাকতেন। তার গোপন উদ্দেশ্য ছিল বাড়ির সেই গোপন জায়গায় আবিস্কার করা প্রচুর পরিমানে সোনা গয়নার বাক্সটাকে নজরে নজরে রাখা আর তাকে পাহারা দেওয়া।

রূপসীও এসবের কিছুই জানতো না। দুই বছর বাদে চন্দন জন্মাবার কয়েকমাস পর বিরেনের মা মারা গেলেন পরে রূপসী একদিন স্বামীর কাছেই জানতে পাড়ল যে বিরেন মোহান্তি এক বিরাট বড় সম্পদের খোঁজ পেয়েছে এবং গত পাঁচ বছর যাবত নাকি সেই পোড়ো বাড়িতে থাকা সম্পদকে বুক দিয়ে আগলে রেখেছেন। বিরেনের ধারনা ইংরেজ সাহেব স্থানীয় অধিবাসীদের কাছ থেকে লুঠ তরাজ করে এই সম্পদ জমা করেছিলেন কিন্তু শেষে বিপ্লবীদের হাতে তিনি ও তার পরিবার মারা যান আর এই বাড়ি তখন থেকেই এক পোড়ো বাড়িতে পরিণত হয়। ভূতের ভয়ে ওদিকে বহুদিন কোন মানুষের যাতায়াত ছিলোনা। ইদানীং তান্ত্রিক বাবা বিরেনের দেখা পেতেই কিছু লোকজন জঙ্গলের মাঝে ওই বাড়িতে যাতায়ত করা শুরু করেছিল।

কিন্তু বিরেন এখন সেই সম্পদ রক্ষার চিন্তায় অস্থির হয়ে পড়েছেন। স্ত্রীকে সব জানিয়ে বিরেন তার সাথে আলোচনা করে ঠিক করেছিলেন যে সুযোগ বুঝে সেই সম্পদ তুলে এনে নিজের বাড়িতেই লুকিয়ে রাখবেন। যেই কথা সেই কাজ। আরও বছর খানেক বাদেই একদিন গভীর রাতে বিরেন সেই গহনা শুদ্ধ লোহার বাক্স এনে ইতিমধ্যেই নিজের বাড়ির রান্না ঘরে মাটির নিচে তৈরি করা এক গোপন জায়গায় সেগুলি লুকিয়ে রাখলেন। এরপরেই বিরেনের মেয়ে তাপসী জন্মায়। একদিকে ছেলে চন্দন বড় হতে থাকে আরেকদিকে মেয়ে স্কুলে যাওয়া শুরু করে দিয়েছে। বিরেন ভাবলেন এখান থেকে একটু একটু সোনা বের করে ওঁর চেনা জানা দোকানে বেঁচে ছেলেকে উচ্চ শিক্ষিত করে তুলবেন, মেয়েকে ভাল ঘরে বিয়ে দেবেন।

বিরেন চন্দনকে কটকের খুব ভাল ইংরাজি মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি করিয়েছিলেন। চন্দন ওই গোপন সম্পদের কথা কিছুই জানত না। তবে চন্দন কিন্তু পড়া শুনায় মন দেওয়ার বদলে খারাপ ছেলেদের সঙ্গ পেয়ে একেবারে উচ্ছন্নে চলে গেল। বয়সের সাথে এসব বেড়ে যায় এবং ক্লাস ফাঁকি দিয়ে বন্ধুদের সাথে সিনেমা দেখা, সিগারেট মদ ইত্যাদির নেশা করা, মেয়দের সাথে ফষ্টিনষ্টি  করত। শেষে কোনোমতে বি কম পাশ করে বেরিয়ে একটা কেরানির চাকরি জুটিয়ে নেয়।

এদিকে ওর তিন বছরের ছোট বোন তাপসী দিনে দিনে পড়াশুনায় ভাল খুব বুদ্ধিমতী ও সুন্দরী যুবতী হয়ে ওঠে। কটকের নামকরা সিটি ওমেন্স কলেজে বি এ পড়বার সময়ে তাপসী ওর বাঙ্গালি বন্ধু জয়ার দাদা জয়ন্ত সেনের প্রেমে পড়ে যায়। জয়ন্ত তখন ইঞ্জিনিয়ারিঙে ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র। তাপসী ওর মাকে জয়ন্তর কথা জানালে রূপসী ওকে একদিন বাড়িতে নিয়ে আসতে বলে দেন। চন্দনকেও জানালেন বোনের কথা। চন্দন বোনের সাথে একটা ইঞ্জিনিয়ারের প্রেম চলছে জেনে খুশি হয়। কিন্তু বিরেন মোহান্তি এসবের কিছুই জানতে পাড়লেন না।

বিরেনের সাথেও জয়ন্তর আলাপ পরিচয় হয়। জয়ন্ত এরপর প্রায়ই সময়ে অসময়ে তাপসীদের বাড়িতে যাতায়াত করতে থাকে। একদিন সন্ধ্যা বেলা জয়ন্ত এসে দাঁড়ায় তাপসীদের বাড়ির দরজায়। আর তখনই লোড শেডিঙ হয়ে যায়। বাড়িতে তখন চন্দন বা তাপসী কেউই ছিল না। জয়ন্ত দরজার কলিং বেলে হাত দিতে গিয়েছিল সবে, কিন্তু অন্ধকার হয়ে যাওয়ায় দাঁড়িয়ে পড়ে। তখনই জয়ন্ত শুনতে পায় ভিতরে বিরেন বাবু তার স্ত্রীর সাথে রান্না ঘরের মেঝেতে লুকনো গুপ্তধনের থেকে আরও কিছু গয়না বের করবার ব্যাপারে আলোচনা করছেন। জয়ন্ত কান পেতে সব শুনে চুপটি মেরে সেখান থেকে সরে পড়েছিল সেই সন্ধ্যায়। কিন্তু ওর মনে এক বিরাট কৌতুহলের জন্ম নেয় সেদিন। জয়ন্ত ভাবতে থাকে কীভাবে এই সম্পত্তি হাতানো যায়। জয়ন্তর ভাগ্যে এসে গেল সেই সুযোগ। কয়েকদিন বাদে বিরেন মোহান্তি তার স্ত্রী ও কন্যাকে নিয়ে বালেশ্বরে গেলেন শ্বশুর মশাইয়ের শ্রাদ্ধে। বাড়িতে থেকে গেল শুধু চন্দন।   

তাপসী জানিয়েছিল ওরা দুই দিনের জন্য বালেশ্বর যাবে, দাদা থাকবে বাড়িতে। সেদিনই সন্ধ্যায় প্রচণ্ড ঝর বৃষ্টি নামে আর তার মধ্যেই জয় এসে দাঁড়ায় তাপসীর বাড়িতে। এসে চন্দনকে বলে কাছেই একটা কাজে এসেছিল, ঝড় বৃষ্টি দেখে ওদের বাড়িতে এসেছে। চন্দন সেই রাতে জয়কে ওদের বাড়িতেই থেকে যেতে বলেছিল। জয় ওর বাড়িতে ফোন করে জানিয়ে দেয় যে ও বন্ধুর বাড়িতে আটকে গেছে, আজ আর ফিরবেনা। এরপর রাতে খাবারের সময় এক সুযোগে সাথে নিয়ে আসা ঘুমের ওষুধ চন্দনের খাবারে মিশিয়ে দেয় জয় আর একটু বাদেই চন্দন গভীর ঘুমে ঢলে পড়ে।

চন্দন যখন ওর বিছানায় গভীর নিদ্রায় জয়ন্ত ঢুকে যায় ওদের রান্না ঘরে। রান্না ঘরের লাল রঙের সিমেন্টের চারিদিকে কালো বর্ডার দেওয়া ছিল। এক পাশে রান্না করবার জন্য উঁচু লম্বা বেদি করা আরেক দিকে আলমারিতে রাখা রান্নার সামগ্রি ও টুকি টাকি প্রয়োজনীয় জিনিষ। খুব সন্তর্পণে আলো জ্বালিয়ে পুরো রান্না ঘর তন্ন তন্ন করে খুঁজতে থাকে জয়ন্ত। বাইরে তখন বেশ জোরে ঝড় বৃষ্টি চলছে। কিছুক্ষণ খোঁজার পরেই আলমারির নিচের দিকে এক জায়গায় মেঝেতে একটা লম্বা দাগ দেখেই জয়ন্তর সন্দেহ হয়। একপাশে রাখা হাত দাও দিয়ে সেটা চাড় মারতেই সেটা সরতে থাকে। জয়ন্ত তাড়াতাড়ি কাঠের আলমারিটা একপাশে সরিয়ে দিয়ে সেই জায়াগায় আবারো দাও দিয়ে চাপ দিতে থাকে এবং একটা বড় সিমেন্টের স্ল্যাব সরে গিয়ে সেখানে একটা গর্ত উঁকি মারে, ভিতরে সেই লোহার বাক্স রাখা।

জয়ন্ত লোহার বাক্স তুলে নিয়ে সেটা খুলে দেখে অনেক গুলি সোনার হার, বালা, কানের দুল, কঙ্গন, ব্রেসলেট ইত্যাদিতে ভরা এক বিশাল বড় সম্পত্তি লুকনো সেখানে। জয়ন্ত একটা ব্যাগ সাথে এনেছিল। সমস্ত গহনা সেই ব্যাগে ভরে নিয়ে খালি বাক্সটা ঢুকিয়ে রেখে সিমেন্টের স্ল্যাব জায়গা মত সরিয়ে রেখে ব্যাগ হাতে রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। এরপর জয়ন্ত সেই ব্যাগ গেটের দিকে যাবার পথে এক জায়গায় লুকিয়ে রেখে আবার গিয়ে চন্দনের পাশে শুয়ে পড়ে। সকালে চন্দন উঠে বাথরুম গেলে পর জয় ওকে জানিয়েই শোবার ঘর থেকে বেরিয়ে সেই ব্যাগটা হাতে নিয়ে বাড়ির উদ্দেশে রওনা দেয়। চন্দন এতো বড় ঘটনার কিছুই জানতে পারলনা। এমনকি বেশ কয়েক মাস এই ঘটনা বিরেন মোহান্তিরও নজরে আসেনা। এরপর একদিন সোনার গহনা বের করতে গিয়েই বিরেন জানতে পারেন যে তার সর্বনাশ হয়ে গেছে।

ইতিমধ্যে জয়ন্তর বাবা রিটায়ার করেছেন। সবাই মিলে কটকের পাট চুকিয়ে কটকের সরকারী ফ্ল্যাট খালি করে কলকাতায় চলে যান। কিন্তু জয়ন্ত যাবার আগে বা পরে আর কোনদিনই ওর ফিয়াসে তাপসীকে কোন খবরও দেয়নি বা ফোনও করেনি। তাপসীর ফোনও তুলত না। অনেক দিন বাদে জয়ন্তরা কটক ছেড়ে কোথাও চলে গেছে জানবার পর তাপসী দুঃখে অপমানে মহানদীতে ঝাপ দিয়ে আত্মহত্যা করতে চেষ্টা করে, কিন্তু পারেনা। জনতা ওকে বাড়িতে ফিরিয়ে দিয়ে যায়। কিন্তু তারপর থেকেই তাপসী একদম গুম মেরে যায়। তখনই একদিন কথায় কথায় চন্দন জানায় যে জয়ন্ত ওর বাবা মা আর বোন যখন বালেশ্বর গেছিল তখন এক ঝড় বৃষ্টির রাতে ওদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল।

বিরেন মোহান্তি এবার বুঝতে পেড়ে যান ওঁর গুপ্তধন কে চুরি করেছে এবং কবে করেছে। বিরেন মোহান্তি ভীষণ খুব্ধ হয়ে ওঁর তন্ত্র মন্ত্রের সাহায্যে  জয়ন্তর খোঁজ পাবার চেষ্টা করতে থাকেন, কিন্তু বিফল হন। এদিকে চন্দন নিজেও বোনের আত্মহত্যা করার চেষ্টার জন্য দায়ী জয়ন্তের খোঁজ করতে থাকে। বছর খানেক বাদে দুশ্চিন্তায় এবং পারিবারিক ভাবে আর্থিক ভাবে চাপে পড়ে বিরেন মোহান্তি একরাতে হার্ট এটাক করে মারা গেলেন। কিন্তু মৃত্যুর পূর্বে পুত্র চন্দনকে ওঁর খুঁজে পাওয়া গুপ্তধনের সব কথা সব জানিয়ে গেলেন এবং বললেন ওই জয়ন্তই সেই রাতে ওদের সেই বিপুল সম্পত্তি চুরি করেছিল। চন্দন যেন ওকে কোনদিন ক্ষমা না করে এবং পারলে সেই সম্পত্তি উদ্ধার করে আনে। সেই থেকেই চন্দন জয়ন্তের খোঁজে আরও উঠে পড়ে লেগে গেছিল। বোনের এই দুরবস্থা আর বাবার শোকে কষ্টে এইভাবে মৃত্যু হওয়া চন্দনকে ভীষণ ভাবে নাড়িয়ে দিয়ে যায়।

বিধবা মায়ের কাছে চন্দন জানতে পারে কীভাবে ওর বাবা কষ্ট করে ইংরাজদের পোড়ো বাড়িতে পাওয়া সোনার গয়না বেঁচে বেঁচে ওদের দুই ভাই বোনকে মানুষ করে তুলেছেন। এই সোনা পাবার আগে কীভাবে বাবার সামান্য রোজগারে এই সংসার চলত। এই গুপ্তধন যেন ছিল ওদের জন্যই রক্ষিত। এই সম্পত্তি পাবার পরেই ওদের সংসারে একটু স্বাচ্ছন্দ এসেছিল। কিন্তু শয়তান জয়ন্তর জন্য সেই আবার ওরা অভাবের মধ্যে পড়ে গেল। চন্দনের সামান্য মায়নায় চন্দন নিজেও আর বিয়ে করবার কথা ভাবতে পারে না। শুধু মনে মনে ভাবতে থাকে কীভাবে জয়ন্তকে খুঁজে পাবে।

দুই বছর কেটে গেছে ওর বাবা মারা গেছেন। চন্দন একদিন গিয়ে হাজির হল পি ডাবলু ডির কটক অফিসে। খোঁজ করে জানতে পাড়ল জয়ন্তর বাবা অবসরের পর কলকাতায় নিজের বাড়িতে চলে গেছেন। কিন্তু অফিস থেকে তার সেই কলকাতার বাড়ির ঠিকানা পেল না চন্দন। হঠাৎ ওর মাথায় বুদ্ধি খেলে যায় এবং চন্দন প্রভিডেণ্ড ফান্ডের অফিসে গিয়ে ওর এক চেনা জানা লোকের সাহায্যে অশোক সেনের কলকাতা বাড়ির ঠিকানা জোগাড় করে ফেলল। পি এফ অফিস থেকে ওদের পেনসন ব্যাঙ্কে জমা পড়লেও রেকর্ডে কলকাতার বাড়ির এই ঠিকানাই দেওয়া আছে।

চন্দন যেদিন কলকাতায় এলো তার ঠিক দুদিন আগেই জয়ন্ত আর মন্দিরা সিঙ্গাপুরের উদ্দেশে রওনা দিয়েছিল। চন্দন জয়দের বাড়ির দরজায় কলিং বেল বাজিয়ে কোন জবাব না পেয়ে বাড়ির পিছন দিয়ে ঘুরে এসে আবার কলিং বেল বাজায়। কিন্তু বুঝতে পাড়ল এটা অটো লক, নির্দিষ্ট নম্বরের চাবি ছাড়া খুলবে না এবং বাড়িতে এখন কেউই নেই। চন্দন আরও দুইবার দিনের বেলায় এসে কলিং বেল টিপে চেষ্টা করেও বাড়িতে কাউকেই পেলনা। তৃতীয় দিন চন্দন বেশি রাতে আবার আসে জয়ন্তদের বাড়িতে। রাত তখন সাড়ে দশটা বাজে।

চন্দন সাথে একটা বড় স্ক্রু ড্রাইভার নিয়ে এসেছিল। সেটা দিয়েই অনেক কষ্টে পিছনের ম্যাথর যাবার দরজাটা খুলে বাড়ির ভিতর প্রবেশ করে ভিতর থেকেই সব দরজা আটকে দেয়। সমস্ত বাড়ি তছ নছ করে খুঁজতে থাকে ওর বাবার সেই চুরি হয়ে যাওয়া সোনার গহনার সম্পত্তি। আলমারি, খাটের ভিতরের বক্সে, বুক শেলফের ফাঁকে, রান্না ঘরের কৌটোয় কোথাও চন্দন কিছুই দেখতে পায়না। চন্দন যেটা জানতো না যে কলকাতায় আসবার আগেই ওই সমস্ত গহনা কটকেই এক সোনার দোকানে প্রায় কুড়ি লাখ টাকায় বেঁচে দিয়েছিল জয়ন্ত। সেই টাকার মধ্যেই প্রায় পনের লাখ টাকায় বিয়ের পর মন্দিরাকে নতুন গহনা গড়িয়ে দিয়ে বাকি টাকা খরচ করে বেড়াত। সিঙ্গাপুরে যাওয়াও ছিল তারই অঙ্গ।

সাড়া রাত তন্ন তন্ন করেও জয়ন্তর কোন গয়নাই খুঁজে পায়না চন্দন। পাবে কোত্থেকে, জয়ন্ত তো সব গয়নাই ব্যাঙ্কের লকারে জমা করে রেখেছে। বাড়িতে এতো গয়না গাটি আজকাল কেউ রাখে নাকি ? জয়ন্তদের পারিবারিক এবং ওর নিজের কেনা গয়না মিলে প্রায় চব্বিশ পঁচিশ লাখ টাকার সোনার গয়না সবই রাখা ছিল ব্যাঙ্কের লকারে। চন্দন হতাশ হয়ে রান্নাঘর থেকে স্ন্যাক্স বের করে খায় এবং সাথে ফ্রিজে রাখা মদের বোতল বের করে বেশ কয়েক পেগ মদ খেয়ে চুড় হয়ে গিয়ে ঘরে বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। তখন ও কোথায় আছে তার কোন হুসই ছিলোনা। পরদিন সকালে চন্দনের মৃতদেহ পাওয়া যায় জয়ন্তদের ঠাকুর ঘরে গলায় ফাঁস দিয়ে ঝুলন্ত অবস্থায়।       

******


ইন্সপেকটার বিশাল কটকে গিয়ে চন্দন মোহান্তির মার সাথে দেখা করে সমস্ত ঘটনা জানতে পেড়ে তাকে ওঁর ছেলের জয়ন্ত সেনের বাড়িতে গিয়ে আত্মহত্যার কথা জানিয়ে দিলেন। রূপসী মোহান্তি কাঁদতে কাঁদতেই জানালেন যে তাদের পরিবারের সমস্ত গহনা চুরি করে পালায় ঐ জয়ন্ত সেন এবং তার মেয়েকে ধোঁকা দেওয়ায় সেই তরতাজা মেয়েটিও আত্মহত্যার চেষ্টা করে না করতে পেড়ে এখন কেমন যেন হয়ে গেছে। ওদের বাবা এই শোক সহ্য করতে না পেড়ে দিনে দিনে দুর্বল হয়ে দুবছর আগে মারা গেছেন। চন্দন তিনদিন যাবত কোথায় গেছে কিছুই ওঁকে জানায়নি। ইন্সপেকটার কটকের কয়েকটা সোনার দোকানে গিয়ে আরও কিছু তথ্য জোগাড় করে কলকাতার উদ্দেশে রওনা দেন।  

ইন্সপেকটার বিশাল ভীষণ ধন্দে পড়ে গেছিলেন। কলকাতায় ফিরবার পথে গভীর ভাবে ভেবে দেখলেন এটা মোটেই আত্মহত্যার কেস নয়। যদিও সেভাবেই কেসটাকে সাজানো হয়েছে। এয়ারলাইন্স  অফিস, চন্দনের অফিস, ওর ব্যাঙ্ক একাউন্ট সমস্ত চেক করে তিনদিন বাদে জয়ন্তকে জানালেন বিকেল পাঁচটায় বাড়ি থাকতে, উনি আসবেন ওদের দক্ষিণ পাড়ার বাড়িতে চন্দন মোহান্তির মৃত্যুর ব্যাপারে কথা বলতে।

শনিবার বিকেলে ঠিক পাঁচটার সময় ইন্সপেকটার বিশাল ভরদ্বাজ এসে হাজির হলেন জয়ন্তদের বাড়িতে। বৈঠকখানা ঘরে তখন জয়ন্তর বোন বোনের জামাই, মন্দিরা সবাই বসা। জয়া ওর ছেলে ও স্বামীকে নিয়ে সেদিনই সকালে দিল্লি থেকে এসেছে কলকাতার বাড়িতে কয়েকদিন থাকতে। এসে বাড়িতে এতো বড় একটা ঘটনা ঘটেছে শুনে অবাক হয়ে গিয়েছিল সবাই। বিশাল সোফায় বসলেন, সাথে আসা এক কনস্টেবল হাতে একটা স্টিলের তৈরি হাতকরা নিয়ে ওঁর পিছনে দাঁড়িয়ে রইল। সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল বিশাল কী বলে শুনবার জন্য।

বিশাল প্রথমেই বললেন, ‘ দেখুন আমি সোজা কথার মানুষ। আজ আমরা আপনাদের এরেস্ট করতে এলাম জয়ন্ত সেন ও মদিরা সেন। আমি সম্পূর্ণ রূপে তদন্ত করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি যে কটকের ছেলে চন্দন মোহান্তিকে আপনি এবং আপনার স্ত্রী দুজনে মিলে খুন করে ঠাকুর ঘরে আত্মহতার কেস সাজানোর জন্য ঝুলিয়ে রেখে দিয়েছিলেন।’

জয়ন্ত মুচকি হেসে বলে উঠল, ‘আমরা সেদিনই সিঙ্গাপুর থেকে ফিরে দরজা না খোলায় আপনাকেই ফোন করেছিলাম স্যর, সেটা বোধহয় ভুলে গেলেন আপনি। আমরা সিঙ্গাপুরে বসে তো আর এই ভাবে খুন করতে পারিনা, তাই না ?’

বিশাল ভরদ্বাজ একটুও বিচলিত না হয়ে সবাইকে অবাক করে দিয়ে বললেন, ‘আপনারা ওই দিন সিঙ্গাপুর থেকে ফেরেন নি, ফিরেছিলেন তার আগের দিন শেষ রাতে। আপনার মোবাইলে সি সি টি ভি ফুটেজে বাড়িতে কেউ ঢুকেছে দেখেই আপনারা এয়ারপোর্ট থেকে ট্যাক্সি নিয়ে বাড়ি ফিরে এসে পিছনের দরজা দিয়ে বাড়িতে ঢুকে দেখেন তাপসীর ভাই চন্দন আপনার শোবার ঘরে শুয়ে অঘোরে ঘুমোচ্ছে। আপনার স্ত্রী সবই জানতেন। আপনারা দুজন মিলে তখন ওকে গলায় ফাঁস দিয়ে হত্যা করে ঠাকুর ঘরে ঝুলিয়ে ভিতরের লক আটকে বাইরে থেকে টেনে দেন। তারপর আপনারা আবার ফিরে যান এয়ারপোর্টে এবং সকালে অন্য সিঙ্গাপুর ফ্লাইটের সময় ক্যালকুলেশন করে বাড়িতে ফিরবার অভিনয় করেন।’

‘কিন্তু আমাদের মোটিভ কী যে আমরা একটা নিরীহ লোককে মেরে ঝুলিয়ে রাখব ?’ জয়ন্ত ডিফেণ্ড করার চেষ্টা করে।

‘বিরেন বাবুর পরিবারের কুড়ি লক্ষ টাকার সোনা চুরি করে সেটা বিক্রি করে কী কী করেছেন তার সব খবর আমরা পেয়ে গেছি। আপনার ব্যাঙ্কের লকার আমরা সিল করে দিয়েছি মিস্টার সেন। এবার আপনাকে জেলে ভরে সেই লকারের সব সোনা আমরা চন্দনের মাকে ফিরিয়ে দেব। আপনি যেমন রাস্তার সিকিউরিটি ক্যামেরা হ্যাক করে চন্দনের এখানে এন্ট্রির ছবি দেখেছিলেন, সেরকম আমরাও আপনার দুইবার বাড়িতে ঢুকবার দুটো সি সি ফুটেজই পেয়ে গেছি এবং এয়ারলাইন্স থেকেও খবর নিয়েছি। আপনি একজন চোর থেকে শেষ পর্যন্ত খুনিতে পরিণত হয়েছেন। এবার চলুন থানায়, বাকি সাক্ষ্য প্রমান কোর্টেই জমা দেব। আপনার আর কোন ভাবেই পালাবার জায়গা নেই। চন্দন আত্মহত্যা করেনি, আপনাদের হাতে খুন হয়েছে।’ 

কনস্টেবল দুজনের হাতে হাতকড়া পড়িয়ে দেয়। জয়া কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে।

...(সমাপ্ত)...

No comments:

Post a Comment