1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Saturday, October 21, 2023

বন্ধুত্ব

ছবি : ইন্টারনেট 

 বন্ধুত্ব

পায়েল বিশ্বাস

স্কুল পালিয়ে চার্চ লাগোয়া কবরস্থানের ভাঙা পাঁচিলে বসে দুই পা দোলাচ্ছে পাঁচু। কিছুই ভালো লাগছে না আজ তার। একমনে আকাশের দিকে তাকিয়ে কি সব চিন্তা করছে। মুখটা তার বেজায় গম্ভীর।  স্কুলের সবচেয়ে শান্ত, বাধ্য আর মেধাবী ছাত্র সে। সেই ছাত্র কিনা আজ ক্লাস ফাঁকি দিয়ে এই রকম জায়গায় বসে আছে। রাতের  আঁধারে জায়গাটি পুরো ঢেকে আছে। ইতি উতি জোনাকিগুলো মিটমিট করে জ্বলে চারিদিক একটু আলোকিত করার বৃথা চেষ্টা করে যাচ্ছে। একটা ভূতুম প্যাঁচা চোখ গোল গোল করে হুম হুম করে অনেকক্ষণ ধরেই তার অবাঞ্চিত প্রবেশের তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছে। পাঁচু তার দিকে তাকিয়ে দন্তরাশি বিকশিত করতেই প্যাঁচাটি ভয়ে পালিয়ে গেল।

" কি ক্ষতি হবে যদি আমি মাঠে যাই? এমনকি সমস্যা হবে যদি আমি সানি, রহিত,  ইউসুফের সাথে বন্ধুত্ব রাখি?" ঠোঁট ফুলিয়ে নিজের মনেই বলল পাঁচু। তার খুব অভিমান হয়েছে, সবার উপর। শিক্ষক শিক্ষিকা, স্কুলের বন্ধুরা, এমনকি তার বাবা মায়ের উপরও। বন্ধুদের কথা মনে পড়তেই ওর বালবের মতো চোখের সামনে ওদের সাথে পরিচয় হওয়ার দৃশ্য ভেসে উঠল ।

এই মফস্বল শহরের এক প্রান্তে বিশাল মাঠ। নাম তার বিলের মাঠ।  মাঠের শেষ প্রান্তে একটু ঝোপঝাড় শুরু হয়ে তারপর ঘন গাছপালার মধ্য দিয়ে এগিয়ে ভগ্ন প্রায় চার্চের কবরস্থানে শেষ হয়েছে। এই শহরের বেশিরভাগ বাসিন্দা কলকারখানার খেটে খাওয়া মানুষজন। উপরতলার মানুষরা থাকে স্টেশনের ধারের বিশাল বড়ো আবাসনে। বিকেল হলেই এই বিলের মাঠ ভরে যায় কচিকাঁচাদের কলকোলাহলে। অবশ্য বয়স্করাও বাদ যান না। বাকি সারাদিন মাঠটি অবহেলায় একা একা গুমরে মরে। রাত হলে অবশ্য মাঠটা ফাঁকা থাকে না। তবে রাতের আঁধারের বাসিন্দাদের একমাত্র মাঠটিই অনুভব করতে পারে। মাঠের পূর্বদিকের বটগাছের মগডালে বসে সন্ধ্যের ঘনায়মান আঁধারে পাঁচু স্থির দৃষ্টিতে মাঠের দিকে তাকিয়ে থাকত। সানি রোহিত ইউসুফদের খেলতে দেখে ওরও খুব ইচ্ছা করত ওদের সাথে খেলতে। কত রকম খেলে ওরা। ক্রিকেট,  ফুটবল কত কি! পাঁচুরও অনেক বন্ধু আছে। কিন্তু তারা এসব খেলে না। ওদের শুধু ভয় দেখানো খেলা। একঘেয়ে ক্ষতিকারক এক খেলা। পাঁচুর ভালো লাগে না। পাঁচু যে এগিয়ে গিয়ে সানিদের সাথে খেলবে,  তারও তো উপায় নেই। ওকে দেখেই যে সব অক্কা পাবে। একদিন পাঁচুর ইচ্ছা সফল হয়ে গেল। সানিরা সেদিন ক্রিকেট খেলছিল। বলটা ঠিক বটগাছের পাশের ঝোপে এসে পড়েছিল। ওরা এসে খুঁজে পাচ্ছিল না। তখন পাঁচু ওদের বলটা খুঁজে দেয়। কেউ কোথাও নেই, বলটা গড়িয়ে গড়িয়ে নিজে থেকেই ঝোপ থেকে বেরিয়ে এল দেখে ওরা এ ওর মুখের দিকে তাকিয়ে ছুটে পালিয়ে গেছিল। এরপর যতবার ঝোপঝাড়ে বল পড়ত, পাঁচু সাথে সাথে তাদের দিয়ে দিত। এইভাবে বল পেতে দেখে সানিরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করেছিল।

" কি ব্যাপার,  বল তো? বলটা নিজে নিজে কি করে বেরিয়ে আসে?"

রোহিতের প্রশ্নে ইউসুফ বলেছিল, " এ নিশ্চয়ই ভূত বা জীনের কাজ। "

" তাই হবে। তবে যেই হোক আমাদের ক্ষতি চায় না।"

রোহিতকে সমর্থন করে সানি বলেছিল," আমার মনে হয় ও আমাদের সাথে খেলতে চায়। তাই বার বার বল খুঁজে দেয় আমাদের।" 

" চল, একদিন জিজ্ঞেস করি।" ইউসুফের কথায় রাজি হয়ে পরদিন সন্ধ্যেবেলা খেলার শেষে  ওরা বটগাছের তলায় এল। ভয়ে তাদের বুক দুরুদুরু করছে। কিন্তু তাও ওরা সেদিন দেখতে চাইছিল কে ওদের উপকারী বন্ধু যে রোজ বল খুঁজে ওদের দেয়। 

ওদের ডাকাডাকিতে পাঁচু গাছ থেকে নেমে এল। একটা সিড়িঙ্গে আকৃতির ছায়া শরীর ভাঁটার মত আগুনে চোখে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে দেখে ওরা প্রথমে খুব ভয় পেয়েছিল। ওদের ভয় পেতে দেখে পাঁচু পিছন ফিরে গাছে উঠতে যাবে,  তখন সানি অনেক কষ্টে সাহস সঞ্চয় করে বলেছিল, " কে তুমি? কেন আমাদের বল খুঁজে দাও?"

" আমি পাঁচু। তোমাদের সাথে খুব খেলতে ইচ্ছা করে আমার। কিন্তু তোমরা তো আমায় দেখে ভয় পাবে তাই সামনে আসতাম না।" 

রোহিতরা এ ওর মুখের দিকে তাকিয়েছিল। বলে কি এ, আমাদের সাথে খেলবে! যদি খেলার নাম করে ঘাড় মটকে দেয়!

" ভয় পেও না। আমি কাউকে মারব না। প্লিজ আমাকে খেলায় নাও। " ওদের আশংকার কথা বুঝতে পেরে পাঁচু বলল। 

পাঁচুর কাতর অনুরোধে ওরা তারপরের দিন থেকে খেলতে নিত। তবে যখন আঁধার ঘনিয়ে আসত তখনই এক ঘন্টা ওদের সাথে খেলত পাঁচু। এই রকম করেই আনন্দে দিন থুড়ি রাত কাটছিল। কিন্তু যখন পাঁচুর  বাবা, মা জানতে পারল তখন খেলা বন্ধ করতে বলল। পাঁচুর স্কুল থেকেও বারণ করলে পাঁচুকে সানিদের সাথে মিশতে। পাঁচুর খুব কষ্ট হল। সানিরা পাঁচুকে অনেক ডেকেও যখন দেখা পেল না তখন ওদেরও মন খারাপ হয়ে গেল। পাঁচু এই বন্ধু বিচ্ছেদ মেনে নিতে পারল না। তাই রাগের চোটে আজ স্কুলে না গিয়ে এখানে উদাস হয়ে বসে আছে। 

হঠাৎ দূরে 'হুক্কা হুয়া ক্যায়া হুয়া' করে শিয়াল ডেকে উঠল। পূর্ব দিক থেকে শীতল বাতাস পাঁচুর দিকে ধেয়ে এল। একরাশ কালো ধোঁয়ার কুন্ডলী পাক খেতে খেতে তার সামনে এসে থমকে গেল। 

একজন লাল পাড় শাড়ি পরিহিতা লিকলিকে শরীরের মহিলা ভাঁটার মত চোখে নর্দমার জল বের করে মূলার মত দাঁত দেখিয়ে হাউ মাউ করে কাঁদতে কাঁদতে পাঁচুর দিকে এগিয়ে এসে বলল," এই তো আমার পাঁচু, বাপ চল।  মাকে ছেড়ে এভাবে কেউ লুকিয়ে থাকে নাকি? "

" না, আমি যাব না। আগে ব্রহ্মদত্যি স্যারকে আমার দাবী মানতে বলো তারপর আমি যাব।"

" ওরকম করে না পাঁচু। ইউ নো আমরা মানুষের সাথে ফ্রেন্ডশিপ করতে পারি না।" লাল চোখো সাহেবমুখো সূচালো শ্বদন্ত ঝিকমিক করে ড্রাকুলা স্যার বললেন। 

" কেন পারি না? ওরা তো আমাদের কোনো ক্ষতি করছে না। একটু সন্ধ্যেবেলা পার্কে গিয়ে শুধু সানিদের সাথে খেলতাম। "

" ওরা মানুষ।  ওদের ভয় দেখানোই আমাদের কাজ। আর সেই জন্যই তুমি ভূতুড়ে শিক্ষা বিদ্যালয়ের ছাত্র। " 

" আমি মানতে পারলাম না মামদো স্যার। ভূতে নয়, এখন মানুষই মানুষকে সবচেয়ে বেশি ভয় পায়। তাই তারা মানুষের সাথে নয়, পশু পাখি এমকি ভূতের সাথেই বন্ধুত্বে আগ্রহী।" 

" কিন্তু মানুষরা আমাদের অস্তিত্ব টের পেলে ওঝা নিয়ে আসবে। এমনকি ভূত বিজ্ঞানীদেরও খবর দিয়ে আনাবে। আর তারা এখানে এসে পরীক্ষার নামে যা অত্যাচার করবে তাতে আমরা আমাদের বাসস্থান থেকে উৎখাত হব।"

" না, না শাঁকচুন্নী ম্যাম। আমার বন্ধুরা আমার কথা কাউকেই বলেনি। কারণ জানাজানি হলে যে ওরাও আমার সাথে খেলতে পারবে না। ওরা আমায় খুব ভালোবাসে। প্লিজ, আমায় তোমরা আমার বন্ধুদের সাথে খেলতে দাও।" 

এবার ব্রহ্মদত্যিমশাই ধুতির গিঁট তাঁর বিশাল বপুর উপর টাইট করে বললেন," পাঁচু আমাদের স্কুলের গৌরব। ও ঠিকই বলেছে। মানুষই এখন মানুষের শত্রু। আর বাচ্চারা তো কোনো অপরাধ করেনি। তাই তাদের বন্ধুত্বে বাধা দেওয়াও উচিত না। আর আমাদের এই ভূত সমাজে কখনো কোনো কিছু আমরা কারোর উপর চাপিয়ে দিই না। সবার মতামতই এখানে সমান গ্রহণযোগ্য।  তাই অত্যন্ত গোপনীয়ভাবে এবং সতর্কতার সাথে পাঁচু তার মনুষ্য বন্ধুদের সাথে খেলতে পারে।" 

হেড স্যার ব্রহ্মদত্যির কথা শুনে আনন্দে পাঁচু পাঁচিল থেকে নেমে তার হাতের ছোট্ট ছোট্ট হাড়গুলি দিয়ে মায়ের হাতটা শক্ত করে ধরে নাচতে নাচতে বাড়ির পথ ধরল ।

...(সমাপ্ত)...

No comments:

Post a Comment