1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Saturday, October 21, 2023

অপরাধী

ছবি : ইন্টারনেট 

অপরাধী

সংযুক্তা পাল

‘মা আমি পুলকারে যাব না। বড় বড় দিদিগুলো আমাকে চিমটি কাটে’। পাঁচ বছরের হিয়া ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলে।পাপিয়া আশ্বস্ত  করে বলে,'এই রুটে আর একটাও পুলকার চলে না সোনা।তোমাকে এই কারেই যেতে হবে।আমি ওদের খুব বকে দেব।তুমি তো জানো তোমার মাম্মা বাসে করে তোমায় পৌছে দিতে গেলে মাম্মার অফিসে বকুনি খেতে হবে’। হিয়া এবারে ওর পাপার কাছে পাশের ঘরে দৌড়ে গেল। সনৎ ল্যাপটপে অফিসের কাজে ব্যস্ত। হিয়া গা-ঘেঁষাঘেষি করতেই সনৎ বিরক্ত হয়ে হিয়াকে সরিয়ে দিয়ে বলল 'পাপা ব্যস্ত,এখন বিরক্ত কোরোনা'। এ’টুকু কথাও মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বলতে পারল না। চোখটা ল্যাপটপ স্ক্রিনের ওপরেই নিবদ্ধ।

           পাপিয়া মেয়েকে স্নান করানোর সময় টের পেয়েছে গা’টা ছ্যাকছ্যাক করছে। কুসুম কুসুম গরম জলে ওকে স্নান করিয়ে বাইরে নিয়ে এসে স্কুল ইউনিফর্ম পরিয়ে খাওয়াতে বসল। মেয়ে কাশির চোটে কিছু খেতেই পারল না।গতকাল রাতেও মেয়েটা ভাল করে ঘুমোতে পারেনি।ইনহেলার দিয়েছিল পাপিয়া।আজকে পাঠাবার ইচ্ছাই ছিল না ওর। গ্রীণ'ডে সেলিব্রেশন আছে,গতকাল ক্লাস টিচার ফোন করেছিল।পাঠাতেই হবে।ব্যাগে আবার গ্রীণ কালারের ফ্রক দিয়ে দিতে বলেছে।পাপিয়া তাই দিল।মেয়েটা আজ বড় ঘ্যান ঘ্যান করছে স্কুল না যাওয়ার জন্য।পাপিয়া যে কী করে!দোলাচলতায় মনকে কিছুক্ষণ ব্যতিব্যস্ত করে অবশেষে মেয়েকে নিয়ে বের হল পুলকারে তুলে দেওয়ার উদ্দেশ্যে।মনকে বোঝালো ঘন্টা তিনেকের তো ব্যাপার।তারপর মেয়ে ফিরে আসবে।পাপিয়া আর আজ অফিস যাবে না ঠিক করল।পুলকারে ওঠানোর সময় উচু ক্লাসের মেয়ে তিনটেকে একটু মিষ্টি করে ধমক দিয়ে দিল বয়সে ছোট বোনকে নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা করার জন্য। ওদের মধ্যে একজন ‘সরি’ বলল। হিয়াকে কপালে চুমু একে দিয়ে বাই করে দিল পাপিয়া।

            ঘরে এসেও পাপিয়ার মন যেন মেয়ের কাছেই পড়ে রইল। কখন তিন ঘন্টা কাটবে সেই চিন্তায় ঘন ঘন ঘড়ি দেখছিল। সনৎ আজ বাড়ি থেকেই কাজ করবে। অফিস যাবে না।কাজ করতে করতে আড় চোখে পাপিয়াকে দেখছিল।ও বলল, ‘মেয়েকে না পাঠালে কী হত! শরীর ভাল নেই। ক্লাস টিচার বললেই পাঠাতে হবে’! পাপিয়া রেগে বলল,’আগে বলোনি কেন!তুমি বললে আমি পাঠাতাম না’। সনৎ মুখ বেঁকিয়ে বলল,’বাবাহ। তুমি আমার কথা শুনে যেন উল্টে দাও’। পাপিয়া আর তর্কে গেল না।সোফা থেকে উঠে বারান্দাতে গিয়ে দাঁড়াল। সবিতা মাসি কাজে এসে গেছে। দূরের বাচ্চাদের পার্কের দিকে তাকিয়ে ভাবছিল মেয়েটার জন্মের পর থেকেই কাশি হলে শ্বাসকষ্ট হয়। ইনহেলার ওর ব্যাগেই দেওয়া থাকে। স্কুলে বলা আছে। তবু পাপিয়ার উৎকন্ঠা এত বাচ্চার মধ্যে ম্যামদের মনে থাকবে তো!

             দেখতে দেখতে তিনঘন্টা কেটে যায়।পাপিয়া ঘর বার করতে থাকে। মেয়েকে কখন কাছে পাবে এই চিন্তায়। সনৎ ধমক দেয়।বলে, ঠিক চলে আসবে। পাপিয়া সবিতা মাসিকে হিয়াকে আনতে যেতে দেয় না। অন্য দিন উনি হিয়াকে পুল-কার থেকে নামিয়ে আনে,আজ পাপিয়াই বড় রাস্তার পাশে অপেক্ষা করতে থাকে পুল-কারের জন্য।

      এমন সময় পুলকারের ড্রাইভার মইদুর ফোন করে বলে সবাই বেরিয়েছে,হিয়া বের হয়নি। পাপিয়া যেন ক্লাস টিচারকে ফোন করে। পাপিয়া ফোন করতেই ক্লাস টিচার থতমত খায়। বলে,হিয়াকে উনি নাকি স্কুলেই দেখেনি। আর একটু পরেই উনি পাপিয়াকে ফোন করে  জিজ্ঞেস করত,হিয়া কেন আজ স্কুলে আসেনি! কী সুন্দর একটা প্রোগ্রাম হল।পাপিয়া চিৎকার করে উঠল। বলল,’আমার মেয়ে স্কুলে গেছে।পুলকারের ড্রাইভার মইদুরের সাথে কথা বলুন’। পাপিয়া এবার সনৎকে ডাকতে ছুটল।এক্ষুনি উবের বুক করে দু’জনকে স্কুলে যেতে হবে। ভাগ্যিস  সনৎ আজ বাড়িতে ছিল।

       উবের নিয়ে পাপিয়া আর সনৎ স্কুলের দিকে যেতে যেতে কতবার যে স্কুলে ফোন করল তার ইয়ত্তা নেই। ক্লাস-টিচার আর ফোন ধরেনি। মইদুরকে ফোন করা হলে ও বলল, ক্লাস-টিচার আর প্রিন্সিপাল ওর সাথে কথা বলে সেই যে স্কুলের মধ্যে গেছে আর তাদের পাত্তা নেই।এদিকে পুল-কারের অন্য ছাত্র-ছাত্রীরা বাড়ি যাবার জন্য ঘ্যানঘ্যান করছে। তাদের বাড়ি থেকেও মইদুরকে সমানে ফোন করছে। মইদুর জানতে চাইল সে গাড়ি নিয়ে অন্য ছাত্র-ছাত্রীদের পৌঁছে দিয়ে আসবে কি না। পাপিয়ার দু’চোখ দিয়ে সমানে জল গড়াচ্ছে। ও কাঁপা গলায় মইদুরকে বলল,'হ্যা তুমি যাও। আমরা স্কুলে প্রায় পৌঁছে গেছি। হিয়াকে নিয়ে ফিরব'।

         স্কুলে পৌঁছে পাপিয়া হিয়াকে পেয়েছিল ঠিকই। তবে প্রাণহীন,নিস্তেজ। হাত-পা ঠান্ডা। হিয়াকে নাকি বাথরুমের মধ্যে পাওয়া গেছে।সারা স্কুলে না পেয়ে সিকিওরিটি আর ক্লাস টিচার বাথরুমের দিকটা দেখতে গিয়ে হিয়াকে খুঁজে পায়। পাপিয়া আর সনৎ এর মাথা এরপরের কয়েকঘন্টা এবং আগামী আরো কয়েকমাস ঠিকমতো কাজ করেনি। স্কুল থেকে মেয়েকে বের করে নিয়েই ওরা দু’জন কাছের হসপিটালে ছুটেছিল।সাথে ক্লাস-টিচার ছিল। কিন্তু হসপিটালে চেক করেই বলে দেওয়া হয় হিয়া মৃত।

      পাপিয়া ঘটনার একবছর পরেও ধাতস্থ হতে পারেনি। মাথায় একটু গোলমাল দেখা দিয়েছে। সনৎ বাবা মায়ের পরামর্শে স্কুলের বিরুদ্ধে কেস করেছিল। কিন্তু কার গাফিলতি,মেয়ে স্কুলে পৌঁছেই বাথরুমে তিনঘন্টা কী করছিল,আয়া মাসিরা কোথায় ছিল সব কিছু রহস্যেই থেকে গিয়েছিল।সনৎএর উকিল খুব বেশিকিছু প্রমাণ করতে পারেনি,কেসটাও বন্ধ হয়ে গেছিল। ক্লাস টিচার আর সিকিওরিটি হিয়াকে বাথরুমে যেভাবে পেয়েছে সেভাবেই বাইরে বের করে এনেছিল।

বারো বছর পর……..

রোহিনী এক নামী কোম্পানীর সেলস ডিপার্টমেন্টে আছে। কাজের ভীষণ চাপ। বিয়ের পর দেরিতে বাচ্চা নেওয়ার কথা চিন্তা করেছে। কিন্তু এখন ও যতবার কনসিভ করতে যাচ্ছে ততবার মিসক্যারেজ হয়ে যাচ্ছে।কত ডক্টরের সাথে যে কনসাল্ট করল তার ঠিক নেই। বিয়ের সাত বছর পরেও ওর কোল খালি। কানাঘুষোয় শুনেছে অতনু পরকীয়ায় মজেছে। তাই ও আর অতনু এখন সেপারেশনে। এর মধ্যেই আবার টের পায় ওর শরীরের মধ্যে প্রাণের বীজ বপন হয়েছে। রোহিনী জানে এবারেও ‘ও’ থাকবে না। অফিস ছুটি নেয় দু’মাসের জন্য সাধ্য-সাধনা করে। ভাড়ার ফ্ল্যাটে একা থাকে পেটে ছোট্ট ভ্রুণ নিয়ে। রাত এলেই অস্বস্তি। তন্দ্রাচ্ছন্ন ভাবে টের পায় কে যেন মাথার কাছে। ছোট্ট একটা বাচ্চা। মুখটা দেখা যায় না।ঘোর কাটতেই সব উধাও। কে ও!! মনের ভ্রম নাকি ও সন্তানের জন্য পাগলপারা বলে এসব দেখছে! প্রায় প্রতিরাতেই চলতে থাকে। মাকে নিয়ে এসে রাখে। একদিন রোহিনী বাথরুমে যায়। লোডশেডিং হয়ে যায়। রোহিনীর মা বাজারে গেছিল।রোহিনী অন্ধকারের মধ্যেই দেখতে পায় বাথরুমে একটা ছোট্ট বাচ্চা। বাচ্চাটার চারপাশটা অদ্ভুতভাবে উজ্জ্বল বলে ওকে দেখা যাচ্ছে। রোহিনী চিৎকার করে কে তুই!! বাচ্চাটার মুখ স্পষ্ট হয়। রোহিনী আৎকে ওঠে হিয়া……..হিয়াই তো। বারো বছর পরেও চিনতে ভুল হয় না। হিয়া কচি দুটো হাত রোহিনীর দিকে বাড়িয়ে রোহিণীর কোমর  স্পর্শ করে। রোহিনীর কেমন অবশ লাগে। হঠাৎই কারেন্ট চলে আসে। বাথরুমের লাইট অন হতেই রোহিনী এক ঠান্ডা অনুভূতি টের পায়। পা এবং ওর নাইটি চুইয়ে রক্তের ধারা বইছে। রোহিণী বসে পড়ে, শরীর অবশ। ‘ও’ এসেও চলে গেল । হিয়া ওকে প্রতিবারই তবে নিয়ে যায় কি! রোহিনী অজ্ঞান হয়ে যায়।ওর মা আশেপাশের লোকজনের সাহায্যে রোহিণীকে দরজা ভেঙে বাথরুম থেকে বের করে। রোহিণীর চিকিৎসা হয়,কিন্তু ও এখন অর্ধন্মৃত,বদ্ধ পাগল। বাথরুম দেখলেই ভয় পায়।প্রাকৃতিক কর্ম ঘরেই করে ফেলে বাথরুম যাবার ভয়ে। ওকে অ্যাসাইলমে পাঠানো হয়েছে।

হিয়ার মাও তো হিয়ার শোকে পাথর হয়েছিল তাই না!

পারমিতার বাড়ি থেকে তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দেয় ও গুন্ডা রমেশের সাথে প্রেম করছিল বলে। ওর বর পুলিশ। বিয়ের বছর ঘুরতেই ওর এক অসুস্থ বাচ্চা জন্ম নেয়। ফুসফুসে সমস্যা রয়েছে। খালি কাশে। ডক্টর ইনহেলার নিতে বলেছে। একটু বড় হলে অপারেশন হবে। কাশিটা পারমিতার খুব চেনা লাগে। মনে করার চেষ্টা করেও ও কাজের চাপে ভুলে যায়।পুলিশ বর অসুস্থ বাচ্চা জন্ম দেওয়ার ‘অপরাধে’ ওকে পেটায়। রাতে বাচ্চার কাশির আওয়াজে বরের ঘুম ভেঙে যায়, ইনহেলারেও কাজ হয় না। তিনমাসের বাচ্চা কাশতে থাকে আর পারমিতার ধীরে ধীরে সব মনে পড়ে একদিন। হিয়া…য়া …..য়া……।ও ওর বাচ্চাকে দেখে ভয় পায়,হিয়া কী তবে ফিরে এসেছে! ভয়ে নিজের বাচ্চাকেই চৌবাচ্চার মধ্যে চেপে ধরে। শিশু নিষ্প্রাণ হয়ে আসে। পারমিতার বর টের পেয়ে ছুটে আসে। ওকে থানায় নিয়ে যায়।পুলিশ বর মনে মনে নিশ্চিন্ত হয়,বৌ বাচ্চার থেকে নিষ্কৃতি পেল বলে।কিছুদিন পর জেলে পারমিতা আত্মহত্যা করে।

  রাকা কলেজে পড়ার সময় বাথরুমে পা পিছলে পড়েছিল। কোমরের হাড় জোড়া লাগেনি।পঙ্গু হয়ে বেঁচে আছে একপ্রকার। হুইলচেয়ারে জীবন বয়ে বেড়াতে বেড়াতে চল্লিশে এসে সে তার ডায়েরীর পাতায় লিখে যায় এক নিষ্ঠুর সত্য।তার মৃত্যুকালীন জবানবন্দি।

এক পাপের গল্প যা বারো বছর আগে সে আর তার দুই বান্ধবী মিলে করেছিল। ছোট্ট ফুলের মত শিশুটাকে ওদের কাঁদাতে,বিরক্ত করতে খুব ভাল লাগত পুলকারে। সেদিনটা ছিল ওদের গ্রীণ ডে। বাচ্চাটা বেশ অসুস্থ আর নিষ্প্রভ দেখতে লাগছিল। বাড়াবাড়ি করার ভুত চেপে গেল রাকার মাথায়,সাথ দিল রোহিণী আর পারমিতা।ওরা প্ল্যান করে পুচকেটাকে নিয়ে গিয়ে বাথরুমে আটকে দিল। বেচারী। সবাই সেদিন গ্রীণ ডে নিয়ে ব্যস্ত। বাথরুমের দিকেও কেও খুব বেশি যায়নি। তবে ওরা ভাবতে পারেনি হিয়া এই ঘটনায় মারা যাবে। অসুস্থ ছিল, ভয় পেয়ে শ্বাসকষ্টে হয়তো মারা গেছে। হিয়াদের ক্লাস-টিচার সেদিন প্রিন্সিপালের নির্দেশে কাওকে বলেনি যে হিয়াকে বাথরুম থেকে উদ্ধার করা হয় তা লক করা ছিল বাইরে থেকে। উনি যদি একবার সত্যিটা বলতেন তবে হিয়ার মৃত্যুর বিচার এতদিনে হয়ে যেত। জবানবন্দী লিখে রেখে রাকা অ্যাসিড খায়। মানসিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি,পঙ্গুত্বের থেকে মুক্তি,পাপী জীবন থেকে মুক্তি।

         কেসটা আবার রি-ওপেন হয়। ক্লাস টিচার সাক্ষ্য দেন বারো বছর আগের ঘটনার। পাপড়ি আর সনৎ হতবাক। পাপড়ি অনাথ আশ্রমের সাথে যুক্ত হয়েছে শিশুগুলোর মধ্যে হিয়াকে খুঁজে পেতে।

ঘরে হিয়ার ফটোর দিকে তাকালে পাপড়ির মনে হয়  হিয়া হাসছে,আগে বিষাদ প্রতিমা ছিল।মনের ভুল কি!

...(সমাপ্ত)...

No comments:

Post a Comment