1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Saturday, October 21, 2023

অস্তাচলে সূর্যকান্ত

ছবি : ইন্টারনেট 

অস্তাচলে সূর্যকান্ত

স্বপন বিশ্বাস

সূর্যকান্ত বাবুর চোখে কোন ঘুম নেই। রাত পার হয়ে যায়। দিন পার হয়ে যায়। মাস যায়। বছর যায়। তার একটাই অভিযোগ চোখে কোন ঘুম নেই। যদিও অভিযোগ শোনার তেমন কেউ নেই। অন্ধের যষ্ঠি মিনতি। মেইড সারভেন্ট কাম নার্স। যে এই অভিযোগ আমলেই নেয় না। বলে, দাদু বুড়ো বয়সে তোমার ভিমরতি ধরেছে। এই তো শুনলাম নাক ডাকছ। এখন বলছ, ঘুম আসে না। দিন রাততো ঘুমের মধ্যেই আছ। একটা মানুষ ক’ঘন্টা ঘুমায় বলতো! তাই নিয়ে দুজনের কথা কাটাকাটি শুরু হয়। সূর্যকান্ত বলে, চোখটা একটু বন্ধ করে ঘুমের চেষ্টা করছিলাম। নাক ডাকা শুনলি কোথায়? মাঝে মধ্যে তর্ক তুঙ্গে ওঠে। মিনতি মোবাইল ফোনে তুলে রাখা নাক ডাকার ভিডিও দেখায়। ভিডিও দেখে রাগ আরও চড়ে যায়। শয্যাশায়ী সূর্যকান্ত পরাজয় মেনে নিতে পারে না। যুক্তিতে না পেরে মুক্তির অন্য পথ খোঁজে। মিনতিকে কথা শোনার নাম করে কাছে ডাকে। তারপর হাতের নাগালে এলে দু’একটা চড়থাপ্পড় মারে। যখন লাঠি ভর দিয়ে বেড়াত তখন লাঠিটা হাতের কাছে এগিয়ে দেয়ার কথা বলত। তারপর কাছে এলেই লাঠি দিয়ে মিনতিকে দুয়েক ঘাঁ বসিয়ে দিত। এখন লাঠির আর কোন ব্যবহার নেই। চড়থাপ্পড় দেয়ার পর দুজনের মাঝে কপট রাগ অভিমানের পালা চলতে থাকে। মিনতি বাড়ী ছেড়ে চলে যাওয়ার ভয় দেখায়। বলে, চললাম আমি। জীবনে আর এমুখো হচ্ছি না।

যা, যা, যে চুলোয় যাবি যা।

আমি কেন মরতে চুলোয় যাব? তোমার চুলোয় যাওয়ার সময় হয়েছে। তুমি চুলোয় যাও।

মুখপুড়ি, তুই তোর চিন্তা কর। আমি এবার ছেলেমেয়ের কাছে আমেরিকা চলে যাব। সেখানে সব বড় বড় ডাক্তার আছে। চিকিৎসা করলে সব অসুখ ভালো হয়ে যাবে।

যাও না! যাও। এক্ষুনি পেলেনে উঠে ছেলে মেয়ের বাড়ী চলে যাও। তোমায় ঠেকাচ্ছে কে? সবাই তো মুখে নুড়ো জ্বেলে দিয়ে চলে গেছে। কেউ আর ফিরেও তাকাবে না। এই মিনতি ছাড়া তোমার মুখে আগুন দেয়ারও কাউকে পাবে না।

কথাগুলো বলতে বলতে মিনতি তার লম্বা চুলে বিনুনি করে। ঠোঁটে লিপস্টিক লাগায়। চোখে কাজল পরে। কপালে টিপ দেয়। তারপর একটা মুখ ভেঙচি দিয়ে বাড়ী থেকে বেরিয়ে যায়।

সূর্যকান্ত বাবু জানে মিনতির দৌড় কতদূর। বাজার করবে। ওষুধের দোকান থেকে ওষুধ নেবে। তারপর মিস্টির দোকানে এসে পাঁচুর সাথে একটু রঙ-তামাশা করবে। পাঁচুর নাকের ডগায় চুলের বিনুনি ঘুরিয়ে একটা ছানার জিলাপি কিংবা ক্ষিরপুরি খাবে। তারপর দুটো গরম রসগোল্লা নিয়ে ফিরে আসবে। যাওয়া আসার পথে ক্লাবের ছেলেগুলো দুয়েক কলি হিন্দি গান গাইবে। সাইকেলের মেকার হারু হাতের কাজ বাদ দিয়ে ফ্যলফ্যল করে তাকিয়ে থাকবে। কিছু বলার সাহস পাবে না।শুধু হাতের ফুলানো টিউব থেকে ফুঁস করে বাতাস বেরিয়ে যাবে। মিনতি তাই দেখে একটু মুখ টিপে হাসবে। তবে দর্জির ঘর থেকে নিলু একটু ঝামেলা করবে। হাঁক ছেড়ে ডাকবে, “ও মিনতি, জামার মাপ দিয়ে যা। একটা নতুন ডিজাইন এসেছে। তোকে হেব্বি লাগবে।” মিনতি কাছে গেলে স্বল্পবসনা কোন মডেলের ছবি দেখিয়ে বলবে, তোর পছন্দ হয়? আমি তোকে গিফ্ট করব। ফ্রী। মিনতি পা থেকে চটি খুলে হাতে নিয়ে বলবে, আমিও তোকে দেবো। ফ্রী। একদম ফ্রী। দর্জির দোকানে আড্ডা দেয়া ছেলেগুলো হো হো করে হেসে উঠবে। তারপর চটি পায়ে দিয়ে গজগজ করতে করতে বেশ কিছুটা হেঁটে আসার পর নিলু পেছন থেকে আবার হাঁক দেবে, তোর দাদু কেমন আছে রে। একদিন দেখতে আসব। মিনতি মুখ না ফিরিয়েই চিৎকার করে জবাব দেবে, “আসিস, মুখে নুড়ো জ্বেলে দেবো”।

মিনতি বাড়ী ফেরার পর যেদিন সূর্যকান্তর মন ভালো থাকে সেদিন উতলা হয়ে জিজ্ঞেস করে, রসগোল্লা এনেছিস?  দে, একটা রসগোল্লা দে। গরম গরম খাই।

মিনতি কোন কথার সোজা উত্তর দেয় না। বলে মিস্টি আনিনি। নিবারণ ডাক্তার বলেছে, নিম পাতা ভাজি আর চিরতা ভেজানো জল খেতে। আজ নিম পাতা আর চিরতা এনেছি।

মন খারাপ থাকলে সূর্যকান্ত কিছু বলে না। মিনতি তখন নিজের থেকেই বুড়োর মান ভাঙায়। এক টুকরো মিস্টি তার মুখে তুলে দিলেই সব মান অভিমান গলে জল হয়ে যায়। বলে, আমার কাছে বসে তুইও একটু মিস্টি খা। আমি শুয়ে শুয়ে দেখি।

আহা! মরন। আমার বলে কত কাজ পড়ে রয়েচে। আর আমি এখন ওনার সামনে বসে মিস্টি খাই। আমি কি তোমার বিয়ে করা বউ?  তুমি শুয়ে শুয়ে আমার মিস্টি খাওয়া দেখবে। বউটা তো মরে বেঁচেছে। আমার হয়েছে যত জ্বালা।

কথাগুলো বলতে বলতে মিস্টির অর্ধেকটা খাওয়ানো হয়ে গেলে বাকিটা মিনতি বসে বসে খায়। সূর্যকান্ত মিস্টি খাওয়া দেখতে দেখতে বলে, ওবেলা নিবারণ ডাক্তার এলে ওকে একটা মিস্টি দিস।

ও বুড়োকে আজ মিস্টি না। কাঁচা মরিচের বড়া খাওয়াবো। একটা ঘুমের ওষুধ দিতে পারে না। শুধু বড় বড় লেকচার দেবে। ডায়বেটিসের রোগী মিস্টি খাওয়া বারণ। কলা খেলে অর্দেক। চিনি ছাড়া চা। রাতে ভাত বন্ধ। অথচ নিজের বেলায় কোন নিয়ম নেই। দোকানে বসে মিস্টি খেতে পারে না। ছেলেরা দেখলে ঠ্যাঙায়। আর এখানে বন্ধুর বাসায় এসে রসিয়ে রসিয়ে মিস্টি খাবে। চায়ে এক চামচ দিলে হবে না। বলবে, মিস্টি মুখে এক চামচে হয় না। দু’চামচ চিনিই দে। 

ডাক্তারের কথাগুলো বলতে বলতে মিনতি একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। বলে, তুমি যদি ওই বুড়োটার মত হেঁটে চলেফিরে বেড়াতে পারতে তবে আমি কবে পালিয়ে যেতাম।

আমার দেখা শোনা করতে তোর বুঝি অনেক কষ্ট?

না, আমার আবার কিসের কষ্ট। তোমার পায়খানা পেচ্ছাব ঘাঁটতে তো আমার খুব আনন্দ হয়।

দেখি কত তাড়াতাড়ি মরতে পারি। মরলে আমিও বাঁচি। তুইও বাঁচিস।

কথাগুলো বলতে বলতে সূর্যকান্ত চোখ বন্ধ করে। চোখের দুপাশ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। মিনতি বলে, তোমাকে মরতে দিলে তো? আমি এতো কষ্ট করছি কী তোমার তাড়াতাড়ি মরার জন্য? তুমি মরলে আমিইবা যাব কোথায়। চারিদিকে তো সব শিয়াল শকুন হা করে আছে। আমার তো একটা ঘুমানোরও জায়গা নেই। তোমার ছেলে মেয়েরাতো সব মুখিয়ে আছে। তুমি মরা মাত্র ছুটে আসবে বাড়ী বিক্রি করার জন্য। এখন কারো টেলিফোন করে খবর নেয়ার সময় হয় না। তখন সবারই সময় হবে।

সূর্যকান্ত চোখ বন্ধ রেখেই মৃদু প্রতিবাদ করে। বলে, তুই জানিস ওরা সব কত বড় বড় চাকরি করে। কত ব্যস্ত।

জানি। জানি। আমি দিদিমার কাছে সব শুনেছি। দিদিমা মারা যাওয়ার আগে টেলিফোন করে ছেলেমেয়ের কাছে কত কান্নাকাটি করেছে। শেষবারের মতো ছেলেমেয়ে নাতি-নাতনির মুখ দেখার জন্য। একজনেরও আসার সময় হয়নি। মারা যাওয়ার পর কেউ তো শ্রাদ্ধ করতে আসেনি। সবাই এসেছিল। বাড়ীঘর জমি-জায়গা আর টাকা-পয়সার ভাগ বাটয়ারা করার জন্য। তুমিও তেমন সব কিছু দিয়ে দিলে। ভাগ্যিস বাড়ীর ভাড়াটা তুলতে পারি। এখন কালেভদ্রে যা দুয়েকদিন ফোন করে। সে ওই বাড়ী ভাড়ার হিসাব নেয়ার জন্য। তুমি মরলে সবাই আমাকে চোর বানিয়ে জেলে দেবে। এ তোমায় বলে রাখলাম।

সূর্যকান্ত চোখ খোলে না। কোন উত্তরও দেয় না। বয়স বাড়লে ভবিষ্যতের কথা আর ভাবতে ইচ্ছা করে না। শুধু পুরাতন স্মৃতিরা এসে মাথায় ভিড় জমায়। সূর্যকান্তর ঠাকুরদা কৃষ্ণকান্ত সূর্য প্রণাম সেরে নাতির নাম রেখেছিল, সূর্যকান্ত। বলেছিল বড় হয়ে সারা পৃথিবীকে আলো দেবে এই ছেলে। সবাই ভেবেছিল কথার কথা। আশির্বাদ করলে বড় করেই করতে হয়। যদি কিঞ্চিত পরিমানও ফলে। কেউ ভাবেনি যে সূর্যকান্ত সত্যি সত্যি আলো জ্বালানোর মত কোন কাজ করতে পারবে। অভাবের সংসার। ছোটবেলায় বাবাকে হারিয়ে লেখাপড়ায় মাঝপথে ইতি টানতে হয়েছে। ইচ্ছা ছিল লেখাপড়া শেষ করে মাস্টারির চাকরি নেবে। সেটাও হয়নি। তবে আলো জ্বালানোর চাকরি একটা পেয়েছে। বিদ্যুৎ অফিসের মিটার রিডারের কাজ। চাকরি পেতে পৈত্রিক জমি জায়গা যা ছিল সব বিক্রি করতে হয়েছে। যদিও অল্পদিনেই সে ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পেরেছে। মিটারের হিসাবে নয়কে ছয় করে সারা জীবনে সে অনেক টাকা কামিয়েছে। শহরে পাঁচতলা বাড়ী বানিয়েছে। গ্রাম জমি কিনেছে। বউয়ের নামে ব্যাংকে মোটা অংকের ব্যাংক ব্যালেন্চ। চার ছেলেমেয়েকে লেখাপড়া শিখিয়েছে। দু’মেয়ে ডাক্তার, দু’ছেলে ইন্জিনীয়ার। তাদেরকে বিদেশে পাঠিয়েছে। অনেকেই তার সাফল্য নিয়ে ঈর্ষা করে। অবৈধ আয় উপার্জন নিয়ে প্রশ্ন তোলে। তা নিয়ে সূর্যকান্তর মনে কোন অপরাধ বোধ কাজ করে না। যস্মিন দেশে যদাচার। বরং তার মনে মনে একটা গর্ব আছে। সে অন্যায় ভাবে কারও চার পয়সা মেরে খায়নি। যা করেছে তা মানুষের উপকারই করেছে। ক্ষতি যা হয়েছে তা সরকারের। তা সরকারের টাকা তো কত ভাবেই নষ্ট হয়। তাছাড়া সে তো একা মেরে খায়নি। কত কত মানুষের বিদ্যুৎ বিল কমিয়ে দিয়েছে। তাতে তো মানুষের উপকারই হয়েছে।

বিকেলের দিকে নিবারণ ডাক্তার আসে। নিবারণ সূর্যকান্তর ছোটবেলার বন্ধু। এখন পারিবারিক ডাক্তার। ডাক্তারের দুটো ছেলে। লেখাপড়াটা ঠিকমত করাতে পারেনি। বড় ছেলের ফার্মেসি ব্যবসা। ছোটটার মুদি দোকান।নিবারণ ডাক্তার এখন আর নিয়ম করে রোগী দেখে না। মাঝেমধ্যে ছেলের ফার্মেসিতে বসে। তবে নিয়ম করে বন্ধুকে দেখতে আসে। দেখতে আসে মানে বন্ধুর সাথে আড্ডা দিতে আসে। আগে দুজন বসে দাবা খেলত। তখন সোমলতা বেঁচে ছিল। মিনতির মা ছিল, বাঁধা কাজের মানুষ। খাওয়া-দাওয়ায় আয়োজনটাও বেশ ভালো ছিল। সাথে ছিল সোমলতার শাসন। চায়ে চিনি খাওয়া যাবে না। বেশি ভাজাপোড়া খাওয়া যাবে না।বেশি রাত অব্দি খেলা যাবে না। দু’বন্ধুতে সোমলতার সব কথা সুবোধ বালকের মতো মেনে চলতো। শুধু একটা কাজ গোপনে করতো। রঙিন তরল পান। সোমলতা যে তা জানতো না তা নয়। না জানার ভান করত। এখন মিনতির মাও নেই, সোমলতাও নেই। এখন মিনতিই এ বাড়ীর কর্তৃ। দুই বুড়োকে বেশ শক্ত শাসনের মধ্যে রাখে। দুই বুড়ো মিলে নাতনি সুলভ রসিকতা করে। বলে, তোকে একটা বুড়ো দেখে বিয়ে দেবো। তিনবেলা ধরে যাতে ঠ্যাঙানি দিতে পারে।

এমন কোন মানুষ কি পৃথিবীতে জন্মেছে যে আমাকে ঠ্যাঙানি দিতে পারে। সামনে আসুক দেখি, ঠ্যাং ভেঙে হাতে ধরিয়ে দেবো।

তাহলে তো তোকে ঠ্যাং ছাড়া একটা নুলো দেখে বিয়ে দিতে হবে। যাতে ঠ্যাং ভাঙতে না পারিস।

আমার পিছনে না লেগে দাদুর জন্য একটা ঘুমের ওষুধ লিখে দাও। তুমি লিখে না দিলে তো তোমার ছেলে আমাকে ওষুধ দেবে না। আর ওই যে পিঠে ঘা হয়েছে তার জন্য ভালো দেখে একটা ওষুধ দেও। কী সব ভেজাল ওষুধ লেখ। ঘা তো সারেই না। শুধু বেড়েই চলেছে।

ওরকম একভাবে শুয়ে থাকলে তো বেডসোর হবেই। বারবার এপাশ ওপাশ ঘুরিয়ে দিবি। আর নিয়ম করে ড্রেসিং করে দিস। বেডসোর ম্যাট্রেসটা কোথায়? ওটার ওপর শোয়ালে তো একটু বাতাস চলাচল করে। বিছনায় শুয়ে থাকলে তো ঘা কমানো যাবে না।

তিনি তো ম্যাট্রেসে শোবেন না। ম্যাট্রেসে শুতে নাকি অনেক কষ্ট। তবু জোর করে শোয়াচ্ছিলাম। সেদিন পায়খানা পেচ্ছাব দিয়ে একাকার করে ফেলেছে। সে কী পরিস্কার করা সোজা কথা। এই মিনতি বলে পারে।

তারপর একটু থেমে মিনতিই আবার হাসতে হাসতে বল, শুনে আমি হাসব না কাঁদব বুঝতে পারি না। তার এখন ফুলের বিছনায় ঘুমানোর সখ হয়েছে। কোন পরী নাকি তাকে পরীর দেশে নিয়ে যাবে। সেখানে তাকে ফুলের বিছনায় ঘুমাতে দেবে। আমি তো শুনে হেসে মরি। বুড়ো বয়সে দাদুর ফুলশয্যার সখ হয়েছে। মিনতি ছাড়া যার এক মূহুর্ত চলে না সে যাবে পরীর দেশে। চোখে ঘুম নেই আবার জেগে জেগে পরীর স্বপ্ন দেখে।

মিনতির কথা শুনে নিবারণ ডাক্তার হাসে। আর সূর্যকান্ত মিনতির দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। তারপর নিবারণ ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে বলে, তোর সেই খোকা মন্ডলের ফুল পাতানোর কথা মনে আছে? আমাদের গ্রামের খোকা মন্ডল। রাতের বেলায় পরী নামাত। তখন তো কোনদিন পরী দেখিনি। শুধু কথা শুনতাম। এখন চোখ বন্ধ করলে মাঝে মধ্যেই সেই পরীটা সামনে এসে দাঁড়ায়। গল্প করে। আমাকে নিয়ে যেতে চায় ওদের দেশে।

নিবারণ ডাক্তার অবাক হয়ে ভুরু কুঁচকে সূর্যকান্তের দিকে তাকায়। সূর্যকান্ত বলে, জানি এসব স্বপ্ন। তবু মনটা কিছু সময়ের জন্য শান্ত হয়। মিথ্যা হলেও সুখ স্বপ্ন। সব সময়ই তো দুঃস্বপ্ন দেখি। আমেরিকা যেতে যেতে প্লেন ভেঙে সমুদ্রের ভেতরে পড়ে যাচ্ছি। ভুমিকম্পে বিল্ডিং ভেঙে পড়েছে। আমি আঁটকা পড়েছি। অথবা ঘরের দেয়ালগুলো সব আমাকে চেপে ধরেছে। আমি দুহাতে ঠেলে দেয়ালগুলোকে সরানোর চেষ্টা করি। দেয়াল একটুও নড়ে না। অনেক কষ্ট হয়। আর আছে পুলিশের স্বপ্ন। সারা জীবনে তো কারো কোন ক্ষতি করিনি। তবু দুমদাম করে পুলিশ এসে ধরে নিয়ে যায়। কত প্রশ্ন। কত অত্যাচার। স্বপ্ন ভেঙে যাওয়ার পরও বুকের ভেতরে কস্ট রয়ে যায়। সে তুলনায় পরীর স্বপ্ন অনেক আরামের।

মিনতি বলে, শুনেছি মানুষের শেষ……

নিবারণ ডাক্তার মিনতির কথাটা শেষ করতে দেয় না। বলে, থাক! তোকে আর পাকামো করতে হবে না। ওষুধগুলো এনে খাইয়ে দিস। ঘুম পাতলা হলে মানুষ এসব দুঃস্বপ্ন দেখে। ভালো ঘুম হলে সব ঠিক হয়ে যাবে।

নিবারণ ডাক্তার বিদায় নেয়ার পর সূর্যকান্ত ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুমের মধ্যে তার খাট ঝাঁকুনি দিয়ে দুলে ওঠে। মনে পড়ে খোকা মন্ডল যে পরী নামাতো সেও এ ভাবে খাটে দোলা দিত। ঘরের চালে ঝাঁকুনি দিত। সবাই বলত পরী এসে গেছে। তখন সূর্যকান্ত মা-ঠাকুমার কোল বসে যা শুনত তাই বিশ্বাস করত। অন্ধকার ঘরের ভেতর থেকে মেয়েলি গলায় কথা বলত। দূর-দূরান্ত থেকে আসা মানুষের সমস্যার সমাধান দিত।সবাই পরীর আনা সন্দেশ খেত। তবে পরীকে কেউ কখনও চোখে দেখেনি। আজ চোখ মেলতেই দেখে পরী। পাখা মেলে দাঁড়িয়ে আছে।সারা ঘর আলোময়। যেন পূর্ণিমার চাঁদটা ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়েছে। পরী বলল, চল সূর্যকান্ত। আমাদের অনেক পথ যেতে হবে। সূর্যকান্ত বলল, আমি কীভাবে যাব? আমি তো উঠে দাঁড়াতেই পারি না। তাছাড়া আমার পিঠ ভর্তি ঘা। সারা শরীরে শুধু ব্যাথা। অনেক কষ্ট।

তোমায় কিচ্ছু করতে হবে না। আমি তোমাকে নিয়ে যাব। পরীর দেশে গেলে দেখবে তোমার সব অসুখ ভালো হয়ে গেছে। তুমি আবার তোমার হারানো যৌবন ফিরে পাবে। পরীর দেশে কোন কষ্ট নেই। অভাব নেই। যেকোন চাহিদার কথা তোমার মনে হওয়ার আগে তুমি পেয়ে যাবে। শুধু নিয়ম মেনে চলতে হবে।

কী নিয়ম আমাকে মানতে হবে?

সে তুমি যখন পরীর দেশে যাবে তখনই জানতে পারবে।

পরী সূর্যকান্তকে পিঠে তুলে নিয়ে উড়ে চলে। মেঘের দেশ, তারার দেশ, চাঁদের দেশ পার হয়ে এক দেশ। তার নাম পরীর দেশ। পরীর দেশ শাসন করে পরীর দেশের রাণী। পরীর দেশে স্বপ্ন দেখা নিষেধ। গাছ থেকে ফুল তোলা নিষেধ। নদীর স্রোত আর বাতাসের বিপরিতে যাওয়া যাবে না। গেলেই সর্বনাশ।

সূর্যকান্ত বলে, স্বপ্ন দেখা কী কোন অপরাধ?

পরির দেশে স্বপ্ন দেখাই সব থেকে বড় অপরাধ। স্বপ্ন থেকেই তো সব অপরাধের জন্ম। ছোট ছোট স্বপ্ন দেখতে দেখতেই তো বড় স্বপ্ন দেখে। এটা রাষ্ট্রদ্রোহের মতো অপরাধ। 

কিন্তু ফুল তুললে কী সমস্যা?

আজ যে ফুল ধরে টান দেবে কাল হয়তো সে একজনের মাথা ধরে টান দেবে।

একজনের মাথা মানে কি রাণীর মাথা?  

একজনের মাথা মানে যে কোন পরীর মাথা। রাণীকে নিয়ে এখানে কোন কটুক্ত করা যাবে না। শুধু প্রশংসা করা যাবে। তোমার কোন চাহিদা তৈরী হওয়ার পূর্বেই যিনি তা পূরণ করার ব্যবস্থা করে রাখেন তার জন্য শুধুই প্রশংসা। তার নামে কোন খারাপ কথা বলা যাবে না। 

বললে কী শাস্তি হবে? জেল হবে নাকি ফাঁসি হবে?

পরীর দেশে জেল, ফাঁসি, শূল কিচ্ছু নেই। এখানে যারা রানীর প্রশংসা করে না তদের যেকোন অপরাধের একটাই শাস্তি। রাণীর পাহারাদার এসে তুলে নিয়ে যাবে। তারপর তাকে হাওয়ায় মিশিয়ে দেয়া হবে।

হাওয়া মানে কী আবার পৃথিবীতে ফেরত পাঠানো হবে?

হয়তো পৃথিবীর হাওয়া। অথবা অন্য কোথাও। তা কেউ কোনদিন জানতেও পারবে না।

এ ভারি অন্যায়। লঘু পাপে গুরু দণ্ড।

আজ যে লঘু পাপ করছে কাল হয়তো সে গুরু পাপ করবে। তাই পরীর দেশে এই নিয়ম। 

সূর্যকান্ত মনে মনে ভাবে এজন্যই হয়তো পৃথিবীর বাতাস যুগ যুগ ধরে শুধু দূষিত হয়ে চলেছে।শুধু কলকারখানার কালোধোঁয়া থেকে বায়ু দূষিত হয় না। অপরাধী মানুষগুলো বাতাসে মিশে গিয়ে বাতাসকে দূষিত করে তোলে, ভারী করে তোলে। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে সূর্যকান্ত পরীর মুখের দিকে তাকায়। অবাক হয়ে লক্ষ্য করে, এ তো মিনতির মুখ। তার শরীরে কামনার শিহরণ জেগে ওঠে। মূহুর্তে পরী এসে তাকে আলিঙ্গন করে। পরীর দেশে এটাই নিয়ম, যে কোন চাহিদা তৈরী হওয়ার সাথে সাথে তা পূরণ হয়ে যায়। সূর্যকান্ত আবার নবযৌবন ফিরে পায়। 

মিনতি সূর্যকান্তর মুখের ওপর ঝুঁকে পড়ে দেখে। অপলক তাকিয়ে থাকা চোখে চোখ রাখে। বুকে মাথা রাখে। বোঝার চেষ্টা করে মানুষটা কি ঘুমিয়ে আছে নাকি জেগে আছে। মনের সন্দেহটা আমলে নিতে চায় না। তবু নিবারণ ডাক্তারকে খবর পাঠায়।

নিবারণ ডাক্তার এসে সূর্যকান্তর হাত ধরে নাড়ি দেখে।গলায় হাত দিয়ে পরীক্ষা করে। তারপর তাকানো চোখের পাতা দুটো নামিয়ে দেয়।

মিনতি মুখে আঁচল চেপে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে।

...(সমাপ্ত)...

No comments:

Post a Comment