...শঙ্খ চৌধুরী ও চিরঞ্জিত ঘোষ
আজ অমাবস্যা । তারওপর জমে থাকা ঘন কুয়াশা যেন জঙ্গলের এই রাতটা কে আরো অন্ধকারময় করে তুলেছে । এই অনন্ত অন্ধকার কে ভেদ করে একটা জিপ গাড়ি জঙ্গলের এবড়ো খেবড়ো বনপ্রান্তর দিয়ে এগিয়ে চলেছে । জঙ্গলের এক জায়গায় এসে গাড়িটা থামল, কারণ এর বেশি গাড়ি আর যাবে না । গাড়ি থেকে চার জন লোক নীরবে নেমে এলো আর গাড়ির পেছন থেকে হেঁচড়ে একটা ভারী কিছু বার করলো । এক জন কে গাড়ির কাছে রেখে বাকি তিন জন সেই ভারী বস্তুটিকে নিয়ে জঙ্গলের আরো গভীরে এগিয়ে চললো । গন্তব্য তাদের জানা, জঙ্গলের শেষে একটা গভীর খাদ আর তাতেই ওই বস্তুটিকে নিক্ষেপ করতে পারলে কার্য সিদ্ধি এবং মোটা পারিশ্রমিক । বাকি কাজটা করে দেবে জঙ্গলের হিংস্র জানোয়ারেরা । মানুষ এর মাংস যে তাদের বিশেষ উপাদেয় । লোকগুলোর মুখে কোন কথা নেই যেন অনেকটা যন্ত্রের মত এগিয়ে চলেছে তারা । কিন্তু হঠাৎ অন্ধকারের নিস্তব্ধতাকে চুরমার করে বজ্রের মত যা গর্জে উঠলো তা হলো এক পাল বুনো হাতির হিংস্র চিৎকার । জায়গাটা যে ‘elephant corridor’ । এ আওয়াজ এমন ভয়ঙ্কর যে, যেকোনো কঠোর অপরাধীর শিরদাঁড়াতেও হিমস্রোত প্রবাহিত করতে পারে । চিৎকার গুলো এত কাছ থেকে এলো যে লোকগুলো প্রথমে কিংকর্তব্ববিমুরের মতো একে অপরের দিকে চেয়ে রইলো আর তার পরক্ষনেই হাতের ভারী বস্তুটিকে ওখানেই ফেলে গাড়ির দিকে ছুটলো । তরাই জঙ্গলের এই বন্য হাতির পালকে যেখানে বড় থেকে বড় আর হিংস্র থেকে হিংস্র জানোয়ারেরাও সমঝে চলে সেখানে মানুষ তো কোন ছাড় । গাড়ির আওয়াজটা সময়ের সাথে সাথে ক্ষীণ হতে থাকলো আর পেছনে পড়ে রইলো শুধু নিস্তব্ধতা, অন্ধকার আর একটা নাম না জানা মানুষের মরদেহ ।
“কাঁচা রক্তের সাথে বেটাডিন মেশানো গন্ধটা বার বার ডাক্তারি করার ইচ্ছেটা বাড়িয়ে দেয়” - এ কথা বলে হিমাংশু একটা সিগারেট ধরালো আর ভালো করে সুখটান দিয়ে সিগারেট টা কাউন্টারের জন্য অর্ঘর দিকে এগিয়ে দিল। অর্ঘও একটা সুখটান দিয়ে বললো “ যা বলেছ ভায়া, কিন্তু সবাইকে কি বাঁচানো সম্ভব ?”, বলতে বলতে অর্ঘর মোবাইলটা বেজে উঠলো । হিমাংশু উঠে একটা কফি নিতে গেল।...অর্ঘ একটু চাপা স্বরে হিমাংশুকে বললো, “আজ রাতে আমার কোয়ার্টারে একটু বসতে হবে” ।
শুনেই হিমাংশু আনন্দে বলে উঠলো “নতুন কেস নাকি?”
অর্ঘ অল্পতে উত্তর দিল, “ইন্সপেক্টর রুদ্র আসছে”...
এইটুকু বলে কফিতে চুমুক দিতে লাগলো ।
অর্ঘ মানে ডা:অর্ঘ চৌধুরী আর হিমাংশু মানে ডা:হিমাংশু ঘোষ কর্মসুত্রে কয়েক বছর হল উত্তরবঙ্গের এই ডিস্ট্রিক্ট হসপিটালে কর্মরত।ডা:হিমাংশু পেশায় শল্য চিকিৎসক আর ডা:অর্ঘ পেশায় ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ যে এই হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগ ও পুলিস মর্গের দায়িত্বে আছে।এই অল্প বয়েসেই অর্ঘ ফরেনসিক মেডিসিনের অনেক দেশি ও বিদেশী নামী জার্নালে তার বেশ কয়েকটা পেপার পাবলিশ করে সাড়া ফেলেছে । হিমাংশুর বাড়ি হাওড়ার বালি শহরে । ডাক্তারি ছাড়াও তার খেলাধুলা আর সাহিত্য চর্চায় বিশেষ ঝোঁক । আর অর্ঘর বাড়ি মেদিনীপুর । তার আবার শরীর চর্চায় বিশেষ ন্যাক । কিন্তু দুজনেরই যাকে বলে ভয়ংকর অ্যাডভেঞ্চার প্রীতি ও ট্রেকিং এর শখ এবং এই অ্যাডভেঞ্চারের নেশা থেকেই শখের সত্যান্বেষণ। তাই যদিও পেশায় এরা ডাক্তার কিন্তু এরা দুজনেই শখের ডিটেকটিভ । আর ভাগ্যটাও এমন যে বিগত তিন বছরে এই দুই অ্যামেচার ডিটেকটিভ নিজেদের বুদ্ধির বলে বেশ কতক জটিল খুন এবং রাহাজানি কেসের সুরাহা করে পুলিশকেও তাক লাগিয়ে দিয়েছে।
জায়গাটা এমনিতেই জঙ্গল এলাকা, তার ওপর শীতের সন্ধ্যে, অনবরত ঝিঝির ডাক আর মাঝে মাঝে শিয়ালের হুক্কা হুয়া পরিবেশটাকে আরো বেশি ভয়ঙ্কর করে তুলেছে । হিমাংশু আর অর্ঘর কোয়ার্টারের দুরত্ব বেশি নয়, তাও আধ মাইল মতো । কোয়ার্টার বলতে একতলা বাড়ি, জঙ্গলের সান্নিধ্যে । কোয়ার্টারের পিছন দিক দিয়ে বয়ে চলেছে হলং নদীর কোনো এক উপশাখা । অর্ঘর সঙ্গে থাকে একজন কেয়ার টেকার কাম বাবুর্চি কাম চাকর শম্ভু । অর্ঘকে অনেক বার বলা হয়েছে সে যেন হাসপাতালের মেইন কাম্পাস কোয়ার্টারে এসে থাকে কিন্তু ওই ওর এক গোঁ, “একা আলাদা থাকবো”, তাতে ওর পড়াশোনা ও চিন্তা করতে সুবিধা । আসলে সবাই আড়ালে বলে - মরা পচার সাথে সারাদিন থাকতে থাকতে নিজেই মরা হয়ে গেছে।এই সব ভাবতে ভাবতে হিমাংশু অর্ঘর কোয়ার্টারের দরজায় এসে কলিংবেল টিপলো , দুবার বেল বাজানোর পর অর্ঘর চাকর শম্ভু এসে দরজা খুলল, বৈঠকখানায় ঢুকে হিমাংশু দেখে অর্ঘ ইজি চেয়ারে শুয়ে একটা ফরেনসিক জার্নাল পড়ছে । সামনে টিভিতে ক্রিকেট খেলা চলছে । ওর পিছনে বইয়ের থাকে সারি দিয়ে সাজানো দেশি বিদেশী ডিটেক্টিভ ম্যাগাজিন ও মেডিক্যাল বই । সামনে টেবিলে তিনটে গ্লাস ও সিঙ্গেল মল্ট হুইস্কি রাখা ।
হিমাংশুকে দেখে অর্ঘ একটা গ্লাসে কিছুটা পানীয় ঢেলে বললো – “বস শুরু করো”।
... “না না , আগে বল কি কেস ? তারপর হুইস্কি” হিমাংশু বললো।“আগে ইন্সপেক্টর
রুদ্রকেতো আসতে দাও”। অর্ঘ বললো ।বলতে না বলতে একটা জিপ গাড়ির আওয়াজ কোয়ার্টারের দরজায় এসে থামলো।কিছু বিরতির পর দরজাতে কলিংবেলের আওয়াজ। শম্ভু দরজা খুলতে ইন্সপেক্টার রুদ্রর প্রবেশ। প্রায় ৬ ফুটের ওপরে উচ্চতা, সুঠাম শরীর ও বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা, একটু শ্যামলা গায়ের রং ,বয়স অর্ঘ -হিমাংশুর মতন । লোকাল থানাতে পোস্টিং এই বছর দুয়েক ,কয়েকটা কেসের সান্নিধ্যে যতটুকু জানা কোন গুরুত্তপূর্ণ কেস ছাড়া ইন্সপেক্টর রুদ্র ডিসেম্বরের এই ঠান্ডার সন্ধ্যে বেলা এই চালচুলোহীন ব্যাচেলার্স ডেনে আসবে না।
খাওয়ার টেবিলে সাজিয়ে রাখা বুনো মুরগির ঝোল,ফুলকপির তরকারী আর ডাল সহযোগে গরম- গরম ভাত দিয়ে নৈশ ভোজ সেরে ওরা আবার ফিরে এলো অর্ঘর বৈঠকখানায় , হাতে সিঙ্গেল মল্ট আর ঠোঁটে সিগারেট নিয়ে । প্রাথমিক কিছু আলাপ-চারিতার পর ইন্সপেক্টর রুদ্র তার স্বভাব মত এ হেন আগমনের কারণ বলা শুরু করলো । প্রথমে ও ওর ব্লেজারের পকেট থেকে একটি খবরের কাগজের কাটিং টেবিলের ওপর রাখলো, হিমাংশু আর অর্ঘ দুজনেই ঝুঁকে পড়ে পেপার কাটিংটা পড়তে লাগলো , যা কিছুটা এই প্রকারের- ‘ কলকাতা শহরের বিশিষ্ট হীরক ব্যাবসায়ী পরিবার, সরকার এন্ড সন্স ,এর জৈষ্ঠ পুত্রের আকস্মিক অন্তর্ধান,এবং রহস্যজনক মৃত্যু ' খবরটি দিনপাঁচেক আগে প্রকাশিত হয়েছে বলে রুদ্রর থেকে জানাগেল । সিগারেটে একটা লম্বা টান আর সিঙ্গেল মল্ট এ একটা ছোট্ট চুমুক দিয়ে ইন্সপেক্টর রুদ্র আসল ঘটনাবলী বলতে আরম্ভ করলো-
“ মাস দুয়েক আগের কথা”, রুদ্র বলে চললো , "আমি তখন কালিঙপং এ একটি অন্য কেস নিয়ে ব্যস্ত । খবর পেলাম চিলাপাতার জঙ্গলে কিছু কাঠকুরুনি একটা ক্ষতবিক্ষত লাশ দেখেছে।খবর পেয়ে আমি দুজন কনস্টেবল নিয়ে অকুস্থলে যাই । জঙ্গলের একটি আপেক্ষিক গভীর জায়গায়ে বছর চল্লিশের এক পুরুষের লাশ । পরনের বেশ-ভূসা ও চেহারা দেখে অবস্থাপন্ন মনে হলো। লাশের সর্বাঙ্গে অজস্র খোবলানোর দাগ দেখে বুঝতে অসুবিধা হলনা যে এগুলি জঙ্গলের হিংস্র জন্তুদের কাজ। লাশের থেকে বেরোনো পচা গন্ধ আর ক্ষতস্থানে থাকা ম্যাগট দেখে লোকটির মৃত্যু আনুমানিক দিন চার পাঁচেক আগে হয়েছে বলে মনে হলো । এও বুঝলাম যে লোকটিকে অন্য কোথাও মেরে লাশ এখানে ফেলা হয়েছে কারণ জায়গাটিতে ভালোভাবে খুঁজেও স্ট্রাগেলের বা ধস্তাধস্তির কোন চিহ্ন পেলাম না । এটাও বুঝলাম চুরি বা ডাকাতি এ খুনের প্রধান উদ্দেশ্য নয় কারণ খুন করে লাশ এভাবে গুম না করে ঘটনাস্থল থেকে কেটে পরাটাই চোর বা ডাকাতের স্বভাব । লোকটি আত্মহত্যা করেছে বা তার এক্সিডেন্ট হয়েছে এটা ভাবাও নিছক পাগলামি বলে বোধ করলাম। নিয়ম মেনে লাশটিকে নর্থ-বেঙ্গল মেডিকেল কলেজের পুলিস মর্গে পোস্ট-মর্টেমের জন্য পাঠালাম।
দিন দুয়েক পর পাওয়া পোস্ট-মর্টেম রিপোর্টে আশ্চর্যজনক ভাবে মৃত্যুর সঠিক কারণ জানা গেলনা । রিপোর্টএ মৃতুর কারণ হার্টএটাক বলা হলো । শরীরে থাকা ক্ষতচিন্হ্ন গুলোও পোস্ট- মর্টেম ইনজুরি অর্থাৎ মৃত্যুর পরে বলে জানা গেল। স্থানীয় খবরের কাগজে লাশের ছবি দিয়ে সনাক্তকরণের বিজ্ঞাপন দেওয়া হলো যার কোন ফল পাওয়া গেলনা । যা আমাদের দেশে হয়ে থাকে - প্রমান, লোকবল আর চেষ্টার অভাবে নেগেটিভ অটোপসি আর আনক্লেমড লাশ বলে কেস ক্লোজ করে লাশ সৎকার করে দেওয়া হলো।
এই ঘটনার আরো দিন দশেক পর হঠাৎ একদিন বাড়িতে বসে খবরের কাগজ পড়তে গিয়ে একটি সন্ধান চাই বিজ্ঞাপনে দেওয়া ছবি আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করলো । বিজ্ঞাপনটি দিয়েছেন কলকাতা শহরের এই নামী হীরক ব্যাবসায়ী ‘সরকার এন্ড সন্স’ পরিবার। ছবিটির সাথে দিন দশেক আগে দাহ করা সেই আনক্লেমড লাশের খুব মিল মনে হতে আমি থানাতে গিয়ে বিজ্ঞাপনে দেয়া ছবিটির সাথে কেস ফাইলে রাখা মৃতকের ছবি মিলিয়ে দেখলাম।সাথে সাথে কলকাতায় সরকার এন্ড সন্স-এ ফোন।পরে ওদের কিছু পরিবারের লোক থানায় এসে মৃতকের জিনিসপত্র দেখে তাদের জৈষ্ঠ পুত্র শান্তনু সরকার বলে সনাক্ত করলো। হঠাৎ এদেরমধ্যে থেকে একজন বলে উঠলেন - " কিন্তু দাদার আংটি কই ?"। জানলাম যে মৃতকের অনামিকাতে একটি বহুমুল্য হীরার আংটি ছিল । আমিও লক্ষ করে ছিলাম যে লাশের ডান হাতের আঙ্গুলে একটি অনেকদিন পরে থাকা আংটির সাদা দাগ । তাহলে কি এটা লুটের কেস ? কিন্তু লজিক মানলোনা ।
আসল মুশকিল শুরু হলো এর দুদিন পর। কলকাতার এহেন ধনী পরিবারের ছেলের
এইরকমপরিনতি না মেনে নিতে পেরে পরিবারের লোকজনেরা মন্ত্রী-সন্ত্রী এবং পুলিসের বড় কর্তাদের বড়ই বিড়ম্বনাতে ফেললেন।যার একটি বড় অংশীদার ফার্ষ্ট ইনভেসটিগেটিং অফিসার হওয়ার দরুন এখন আমাকেও পোহাতে হচ্ছে” । এই বলে রুদ্র একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার শুরু করলো “এবার বুঝলে অর্ঘদা, লাশ নাই, প্রমান নাই,পোস্ট -মর্টেম রিপোর্টের নির্দিষ্ট কোন পরিনাম নাই, আর তার ওপর উপর মহলের চাপ।এই কেসটিতে তোমরাই আমার শেষ ভরসা "।
একে ওদের এত ঘনিষ্ঠ, তার ওপর পূর্বের বহু কেসে ওর থেকে পাওয়া প্রচুর সাহায্যের কথা ভেবেই হয়ত অর্ঘ আর হিমাংশু কেসটা হাতে নেব বলে রুদ্রকে আশ্বাস দিল। আস্বস্ত্য হয়ে রুদ্র সে রাতের মত তার জিপ নিয়ে ফিরে গেল আর রাস্তায় হিমাংশুকে ওর কোয়ার্টারে নামিয়ে দিল।
কোয়ার্টারে ফিরে হিমাংশু ওর আগামীকাল রাখা দুটি বড় অপারেশনের কথা চিন্তা করার ফাঁকে হঠাৎ ভাবতে লাগলো যে গত তিন বছরে অর্জন করা ক্রাইম সলভিং অভিজ্ঞতাগুলো কি এই জটিল ও হাইপ্রোফাইল হোমিসাইড কেসের জট ছাড়াতে পারবে!?...(ক্রমশ)
sankha.chowdhury799@gmail.com/
chiranjit.dr@gmail.com
কলকাতা
Awsome story.
ReplyDeleteThank you.
DeleteExcellent story
ReplyDeleteThank you.
Deleteখুব ভালো হয়েছে,পরবর্তী সংখ্যার জন্য অপেক্ষায় রইলাম।
ReplyDeleteঅসংখ্য ধন্যবাদ।
DeleteInteresting
ReplyDeleteঅসংখ্য ধন্যবাদ।
DeleteKhub sunddor....porer sonkhar appekhe roilam
ReplyDeleteঅসংখ্য ধন্যবাদ।
Deleteগোয়েন্দা গল্পের শুরুটা একেবারে যথাযথ। পরের পর্বের জন্য অপেক্ষায় রইলাম।
ReplyDeleteঅসংখ্য ধন্যবাদ।
Deleteখুব সুন্দর হয়েছে স্যার .... পরের গল্পের জন্য অপেক্ষায় থাকলাম
ReplyDeleteKhub vlo hye6e sir... Nice
ReplyDelete