1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Wednesday, January 1, 2020

স্বস্তিকা ও হিটলার

                                                           ...চিরঞ্জিত ঘোষ


        আধুনিক বিশ্ব  ইতিহাসে সবচেয়ে পরিচিত চিহ্ন হিসেবে ধরা হয় স্বস্তিকাকে। প্রাচীনকাল থেকেই চিহ্নকে সৌভাগ্যের প্রতীক হিসেবে ভাবা হয়। যদিও এই চিহ্ন যুগে যুগে  
নৃশংসতা ও স্বৈরাচারীতার দখলদারিত্ব আর রক্তপাতের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে।  
হিন্দু ও নাৎসি স্বস্তিকা

   স্বস্তিকা একটি সংস্কৃত শব্দ যার অর্থ কল্যাণ বা মঙ্গল বা ‘সৌভাগ্য’, ‘ভালো থাকা’।সনাতন, বৌদ্ধ,জৈন ধর্মালম্বীদের কাছে স্বস্তিকা অত্যন্ত পবিত্র।স্বস্তিকার ইতিহাস বহু প্রাচীন। স্বস্তিকা উল্লেখযোগ্য ব্যবহার ভারতে দেখা যায়, যেখানে স্বস্তিকা হিন্দু, বৌদ্ধ ও জৈনবাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক। স্বস্তিকাকে ব্রহ্মা ও সূর্যের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়। চতুর্মস্তকধারী ব্রহ্মা ও সূর্য যেহেতু জীবন, সৃষ্টি এবং সৌভাগ্যের প্রতীক এছাড়া  স্বস্তিকা চারটি বাহু সাধারণত চতুর্মস্তকধারী ব্রহ্মাকে চিহ্নিত করে। মাঝখানের  যোগ চিহ্ন থেকে বোঝায় যে এভাবেই পরমাত্মার সঙ্গে জীবাত্মার মিলন হয়ে থাকে। 

স্বস্তিকের প্রতীকী অর্থ

অন্যদিকে জৈনধর্মে স্বস্তিকা তীর্থঙ্কর পার্শ্বনাথকে বুঝাতে ব্যবহৃত হয়। আগেই বলা হয়েছে শব্দটির অর্থ মঙ্গল। আর জৈনধর্মের মঙ্গলময়তার ধারণা মূলত চক্রাকার পুনর্জন্ম-কেন্দ্রিক। আবার জৈনধর্ম মতে  স্বস্তিকার চারটি বাহু একটি আত্নার সম্ভাব্য চারটি স্থান নির্দেশ করে, স্বর্গ, নরক, মনুষ্য ও তীরঞ্চ। মোক্ষলাভের আগ পর্যন্ত এই চক্র চলতে থাকে। মোক্ষলাভ হলেই পরমাত্মার সঙ্গে জীবাত্মার মিলন হয় । বৌদ্ধধর্মে স্বস্তিকার অর্থ সৌভাগ্য এবং নির্বাণ। বুদ্ধের বুকে, হাতে কিংবা পায়ে হামেশাই মেলে এই চিহ্নের সাক্ষাৎ। স্বস্তিকাকে মনে করা হয়, বুদ্ধের হৃদয়। এইখানেই শেষ না। তিব্বতে দালাই লামার সিংহাসন চারটি স্বস্তিকা দ্বারা সজ্জিত। চীনে ওয়ান এবং জাপানে মান নামে পরিচিত প্রতীকটি। বিশ্বাস করা হয়-
১. নীল স্বস্তিকার মানে অনন্ত মহাজাগতিক গুণসমূহ,
২. লাল স্বস্তিকা বুদ্ধের হৃদয়ের পবিত্রতম গুণাবলি,
৩. হলুদ স্বস্তিকা অনন্ত সমৃদ্ধি, এবং
৪. সবুজ স্বস্তিকা কৃষির শুদ্ধ স্বচ্ছলতা।




সিন্ধু সভ্যতার স্বস্তিকা সীল
 ব্রিটিশ যাদুঘরে সংরক্ষিত

হিন্দু ধর্মের মতো বৌদ্ধধর্মেও স্বস্তিকার অভিমুখ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ঘড়ির কাঁটা অভিমুখী স্বস্তিকার অর্থ অহিংসা। বিপরীত দিকটা কিন্তু গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। স্বস্তিকার চারটি হাত চারটি দিক অর্থাৎ উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিমকে বুঝিয়ে থাকে। আবার বেদব্যাসের চারটি বিভাজন ঋক, সাম, যজু ও অথর্বকেও ধরা হয়। এছাড়াও ধর্ম, অর্থ, কাম, ও মুক্তিও প্রকাশ পায় স্বস্তিকার চারটি হাতের মাধ্যমে। এই চিহ্নের উৎপত্তি নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো শক্ত প্রমাণ দেখাতে পারেননি বিজ্ঞানীরা। তাহলে কবে, কখন, কোথায়, কার মাধ্যমে এই চিহ্নের উৎপত্তি? হালে কিছু গবেষক দাবি করেছেন, প্রাচীনকালের কোনো ধূমকেতু দেখে এই চিহ্নের উৎপত্তি হয়। কেননা অনেকদিন ধরেই বিজ্ঞানীরা ধারণা করে আসছেন, প্রাচীনকালে সূর্যের গতিবিধি বোঝাতে প্রথম স্বস্তিকা চিহ্নের ব্যবহার শুরু হয়েছিল। আবার স্বস্তিকের বাহুগুলো ঘড়ির কাঁটা অভিমুখে (ক্লকওয়াইজ) থাকলে, এটি সূর্যের পাশাপাশি বিষ্ণুকেও নির্দেশ করে। একে বলা হয় ‘ধনাত্মক স্বস্তিকা’। আবার উল্টো অবস্থায় (অ্যান্টি-ক্লকওয়াইজ) থাকলে এটি বোঝায় কালী এবং অলৌকিককে। একে বলা হয় ‘ঋণাত্মক স্বস্তিকা’।

Comet Encke

মজার ব্যাপার হল, এঙ্কে (Comet Encke) নামে একটি ধূমকেতু কিন্তু সত্যি আছে। যাকে দূর থেকে স্বস্তিকা চিহ্নের মতোই দেখতে পাওয়া যায়। এটি পৃথিবীর হিসেবে প্রতি সাড়ে ৩ বছর পর পর সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে। মৌর্য শাসনকালের সময় বৌদ্ধ ধর্মের প্রসারের সাথে সাথে মধ্য এশিয়ায় ছড়িয়ে যায় স্বস্তিকা। চীন, জাপান, মংগোলিয়া থেকে তিব্বতে , প্রাচীন নিদর্শনের মাঝে স্বস্তিকার ছাপ পাওয়াযায় । প্রাচীন গ্রিসে স্বস্তিকার নকশা ব্যবহার করা হয়েছে কাপড়ে ও  মুদ্রায়। একই রকম ব্যবহার আমরা দেখতে পাই গথিক, রোমানেস্কু কিংবা গ্রেকো রোমান শিল্পকলায়। গ্রীক ধর্মযাজকরা স্বস্তিকার ট্যাটু ব্যবহার করতেন শরীরে। পম্পেই নগরীর  অট্টালিকার মেঝেতেও আমরা স্বস্তিকার নকশা দেখাযায় । খ্রিস্টপূর্ব ৭০০ সালের গ্রিসের বাসনপত্র এবং অন্যান্য বেশ কিছু সামগ্রীতে পাওয়া গেছে স্বস্তিক চিহ্ন। গ্রিক দার্শনিক পিথাগোরাস এই চিহ্নকে অভিহিত করেছিলেন আকাশ এবং মাটির সংযোগের চিহ্ন হিসেবে। ফিনল্যান্ডের বাসিন্দারা আবার এই চিহ্নকে মানতেন সূর্যের প্রতীক হিসেবে। সেখানকার ধর্মযাজকদেরই শুধু এই চিহ্ন ব্যবহার করার অনুমতি ছিল। গ্রিস এবং ফিনল্যান্ডের সঙ্গে ব্যবসায়িক যোগাযোগ ছিল লিডীয়, হিব্রু এবং মিশরীয়দের। সেই পথেই এই দেশগুলোতেও ছড়িয়ে পড়েছিল এই চিহ্ন। সম্প্রতি আবিষ্কৃত দ্বাদশ শতকের এক স্লাভ রাজকন্যার পোশাকে দেখা গেছে স্বস্তিক চিহ্ন। তবে এই পোশাক ছাড়া মাটির পাত্র সহ বিভিন্ন বস্তুতে ব্যবহৃত হয়েছে এই চিহ্ন। ইতিহাসবিদদের অনুমান, এই চিহ্নের ব্যবহারের কারণ কখনও নান্দনিকতা এবং কখনও ধর্মীয় আবেগ। পূর্ব ইউরোপ এবং রাশিয়ার সভ্যতায় অবশ্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বহু আগেই নিহিত ছিল স্বস্তিক চিহ্ন। এই চিহ্নের প্রভাব সবথেকে বেশি লক্ষণীয় ছিল পশ্চিম ইউরোপ এবং ইংল্যান্ডে। ইয়র্কশায়রে প্রাপ্ত ২০০০ খ্রিষ্টপূর্বে নির্মিত এই শিল্পকর্মই সেটার প্রমাণ।

প্রাচীনকালে  স্বস্তিকার ব্যবহার 

স্নোলডেলেভ স্টোন (নবম শতক) -এ একটি স্বস্তিকার চিত্র 
৮ম শতাব্দীর প্রাচীন গ্রিক স্বর্ণ চাকতীতে
স্বস্তিকা প্রতীক


পাখির একটি ছোট্ট আইভরি মূর্তি রয়েছে।
 ম্যামথের দাঁত  থেকে তৈরি,
এটি 1908 সালে রাশিয়ান সীমান্তে পাওয়া যায়  

(ইস্রায়েল) খননকৃত বাইজেন্টাইন
 গির্জার মোজাইক স্বস্তিকা
                     



ক্রীট থেকে একটি মিনোয়ান মৃত্শিল্প
টুকরার উপর প্রাচীন স্বস্তিকা প্রতীক
৫ম থেকে ৬ষ্ঠ শতাব্দীর অ্যাংলো-স্যাক্সন
শবভস্মে পাত্রে  স্বস্তিকা খোদাই করা














প্রাচীন মুদ্রা 
দ্বাদশ শতাব্দীর রাজকন্যার কলার





উত্তর ইরানের গিলান প্রদেশের মার্লিক থেকে খনন
করা 3,200 বছরের পুরানো স্বস্তিকা নেকলেস


জ্যোতিষ পুঁথি, রেশমের কালি,
খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দী, হান,চীন 















পেট্রোগ্লাইফ সহ স্বস্তিকা,
গেঘাম পর্বত, আর্মেনিয়া

ইয়র্কশায়রে প্রাপ্ত ২০০০ খ্রিষ্টপূর্বে নির্মিত এই শিল্পকর্মই

খ্রিস্টপূর্ব 6th ষ্ঠ শতাব্দীর করিন্থের
গ্রীক রৌপ্য স্টেটারের মুদ্রায় স্বস্তিকা

জৈন প্রতীক  স্বস্তিক সমন্বিত









বৌদ্ধধর্ম

বিভিন্ন ধর্মে স্বস্তিকা


হিটলারও ব্যবহার করেছিলেন স্বস্তিকা চিহ্ন




1920 ই আগস্ট, 1920, সালজবার্গ কংগ্রেসে, একটি সাদা বৃত্ত এবং কালো স্বস্তিকা সহ লাল পতাকাটি নাৎসি পার্টির আনুষ্ঠানিক প্রতীক হয়ে ওঠে।
1920 সালে হিটলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে নাৎসি পার্টির নিজস্ব ইন্সিনিয়া এবং পতাকা দরকার। হিটলারের পক্ষে, নতুন পতাকাটি "আমাদের নিজস্ব সংগ্রামের প্রতীক" পাশাপাশি "পোস্টার হিসাবে অত্যন্ত কার্যকর" হতে হয়েছিল। (মেইন কাম্পেফ, পৃষ্ঠা 495)
নাৎসি পার্টি কেবল জার্মানিতে স্বস্তিকা ব্যবহারের পক্ষ ছিল না। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে, বহু ডানপন্থী জাতীয়তাবাদী আন্দোলন স্বস্তিককে গ্রহণ করেছিল। প্রতীক হিসাবে, এটি একটি বর্ণগত "খাঁটি" রাষ্ট্রের ধারণার সাথে যুক্ত হয়েছিল। নাৎসিরা জার্মানির নিয়ন্ত্রণ লাভ করার সাথে সাথে স্বস্তিকার অভিব্যক্তি চিরতরে পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছিল।


 নৃশংসতা ও স্বৈরাচারীতার প্রতীক বলতে যার নাম সবার প্রথমে মাথায় আসে, সেই  হিটলারও ব্যবহার করেছিলেন স্বস্তিকা চিহ্ন। ইতিহাসের পাতা উল্টালে দেখা যায়, বিভিন্ন ঐতিহাসিক, গবেষক আর্য জাতিকে দুর্ধর্ষ ও উন্নত জাতি হিসেবে তুলে ধরেছেন। আর বর্ন বৈষম্যের মাস্টারমাইন্ড হিটলার নিজের জাতির শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে এই তত্ত্বকে কাজে লাগিয়েছে। তারাই যে আসলে আর্য তা নিজ জাতিকে বোঝাতে স্বস্তিকা চিহ্নের ব্যবহার করেন। উনিশ শতকের দিকে জার্মান পণ্ডিতদের মাঝে ভারত নিয়ে আগ্রহ তুঙ্গে ওঠে। এক্ষেত্রে ম্যাক্স মুলারের নামটি না নিলে আসলে অন্যায় হবে। জার্মানিতে জন্ম নেওয়া এই ভদ্রলোক জ্ঞানের স্বতন্ত্র শাখা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে যান ভারতপাঠ এবং ধর্ম। সেইক্রেড বুকস্‌ অব দ্য ইস্ট নামে ৫০ খণ্ডে অনূদিত ভারতীয় সংকলন তারই তত্ত্বাবধানে সৃষ্ট।

অজস্র জার্মান পণ্ডিতের হাতে বেশুমার প্রাচীন ভারতীয় বই অনূদিত হতে থাকে। নিজেদের ভাষা ও ভারতীয় সংস্কৃত ভাষার মধ্যে তারা খুঁজে পায় বিস্ময়কর মিল। ভারত ও জার্মানির একটি নৃতাত্ত্বিক শেকড় হিসেবে উঠে আসে আর্য জাতির কথা। জার্মান জাতীয়তাবাদীরা এই ধারণাকে ব্যাপকভাবে গ্রহণ করলো। শুধু গ্রহণ না, প্রচণ্ড জাত্যাভিমানে নিজেদের পুরোনো ঐতিহ্য প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সচেষ্ট হলো। নিজেদের প্রতীক হিসেবে পতাকায় স্থাপন করলো স্বস্তিকা। তাদের এই উপলব্ধিতে বেকায়দায় পড়লো অনার্য সেমেটিক ইহুদিরা। 
হিটলারের ব্যবহৃত স্বস্তিকা ছিল ঘড়ির কাঁটার বিপরীতমুখী।
 বুদ্ধের অহিংসা স্বস্তিকার ঠিক বিপরীত।





“In red we see the social idea of the movement, in white the Nationalist idea, and in the swastika the vision of’ the struggle for the victory of the Aryan man.” - Adolf Hitler



                                                                                 
সনাতন ধর্মে তাৎপর্যপূর্ণ এই স্বস্তিকা চিহ্নকে হিটলারও ব্যবহার করেছেন। তিনিও এই চিহ্নকে আশির্বাদ হিসেবেই ব্যবহার করতেন। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তার পরাজয় ও মৃত্যুর পর ইতিহাসের পাতায় ঘৃণার দৃষ্টিতে লেখা হয় তার সবকিছু। তাই বর্তমান ইতিহাসে জার্মানির নাৎসি বাহিনীর মতো স্বস্তিকা চিহ্ন’ও নেতিবাচক দৃষ্টিতে বিবেচিত হয়ে আসছে।



We will always remember what the swastika was like in our life - a symbol of pure evil "





Freddie Knoller,
 (হলোকস্ট উত্তরজীবী )




পশ্চিমা বিশ্বে স্বস্তিকা প্রতীক

স্পেনর বায়ু সেনের পতাকা


কোকাকোলা কোম্পানি বাবহৃত স্বস্তিকা
স্বস্তিকা ডাকটিকিট







সূত্র: বিভিন্ন ওয়েবসাইট এবং ইন্টারনেট





chiranjit@mail.com

2 comments: