1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Wednesday, October 2, 2024

পিন্টু চা-ওয়ালা


ছবি : অর্কজ্যোতি চক্রবর্ত্তী

পিন্টু চা-ওয়ালা

অর্কজ্যোতি চক্রবর্ত্তী

পুরুলিয়ার রঘুনাথপুরের আগারওয়াল ইন্স্টিটিউশনের (এ.আই.) অনতিদূরে বন্ধ হয়ে যাওয়া একটি চায়ের দোকানের সামনে কালো একটা বি.এম.ডব্লিউ. গাড়ী এসে দাঁড়াল। গাড়ীটার ড্রাইভিং সীট্ থেকে নামল বছর সাতাশ-আঠাশের এক যুবক, নাম কৃষ্ণেন্দু। সে চায়ের দোকানটার দিকে তাকিয়ে খানিক আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ল। এই দোকানটা আসলে তার বাবার। কৃষ্ণেন্দু ওরফে পিন্টু আশৈশব তার বাবাকে প্রতিদিন সকাল সাড়ে ছটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত দোকান চালাতে দেখে আসছে। সেখানে সমাগম ঘটতো সমাজের সব স্তরের মানুষের। তাদের চায়ের আড্ডায় যে চর্চা চলতো, তা ছোট্ট পিন্টুর কানে আসতো, আর সে সেটা তার মনের মণিকোঠায় ধরে রাখতে পারত। বলা বাহুল্য, এই সমস্ত কাহিনী মনে করতে করতেই সে আজ বড় হয়ে উঠেছে। কৃষ্ণেন্দুর বাবা তারিণী মাঝিকে আমি জ্যাঠামশাই মানতাম।

     চায়ের দোকানটা অনেকদিন হ’ল বন্ধ। আর দোকানের মালিকের ছেলে আজ বি. এম. ডব্লিউ. গাড়ি চেপে বেড়ায়। আন্দাজ করা যায় যে,কিছু একটা ম্যাজিক ঘটে গিয়ে থাকতে পারে। কিন্তু কী এমন ঘটল যে একজন সামান্য চা-ওয়ালার ছেলে আজ কয়েক কোটি টাকার মালিক? লটারির চক্কর আবার কি! তবে এটা যে সে লটারি নয়, বাংলার সুপারষ্টার অভিনেতা বিক্রমজিৎ দেববর্মনের কে হবে বাংলার কোটিপতি?’ -ক্যুইজ শোতে জিতেছে পিন্টু, এই মাস দু-এক আগের ঘটনা। তাহলে এতো বিস্ময়কর আর অবিশ্বাস্য বললে কম বলা হবে। কারণ একটা প্রথাগত লেখাপড়া না শেখা ছেলে কিভাবে এরকম একটা হাই-প্রোফাইল শোতে এসে বাজিমাৎ করল সেটাই হল আশ্চর্য্যের।

     আসলে সহজাত প্রতিভায় পিন্টু যে এক এবং অদ্বিতীয়, তা অবিশ্যি দু’দিনের টিভি শোতেই দিনের আলোর মতো বোঝা গিয়েছিল। দুর্লভ স্মৃতিশক্তি সত্ত্বেও ছোটবেলায় অভাবের কারণে স্কুলে পড়ার সুযোগ সে পায়নি, কিন্তু তা বলে শুনে এবং দেখে শেখার তার যে বিশেষ ক্ষমতা, তা বয়সের সঙ্গে আরো বাড়তে থাকে। সে নিজে থেকেই বাংলা, ইংরেজী, অঙ্ক, বিজ্ঞানের অনেক কিছু রপ্ত করে নেয়। তাদের ছোট্ট দোকানে যখন বিভিন্ন পেশার মানুষ চা খেতে আসত, তাদের সেই বিভিন্ন রকমের আলাপ-আলোচনা শুনে ছোট্ট পিন্টু তার মনের কম্পিউটারটিতে জমা রাখত। সামনের এ.আই. কলেজের স্যারেরা সেখানে এলেই, প্রথমে পিন্টুর নামে হাঁক পড়ত: এই পিন্টু, তিন পাত্র চা দে! তারপর শুভাশিস স্যার তাঁর গণিতের ক্লাসের ছাত্রদের অপারদৰ্শিতা ও অকর্মন্যতা নিয়ে গল্প জুড়ে দিতেন,হা হা! বুঝলে ভাই আশিস, এই অনার্সের ফার্স্ট-ইয়ারের ছেলেগুলো একেবারেই ঝুল। ইন্টিগ্রেশনটাই জানে না। ইন্টিগ্রেশন যে ডিফারেন্সসিএসনের উল্টো একটা মেথড, সেটাই ওদের মাথায় ঢোকে না।আশিস স্যার হেসে বলে উঠলেন, “হ্যাঁ! এরপর যদি ওদেরকে আবার ৯৫ এর স্কোয়ারের মান কত হবে জিজ্ঞাসা করেন, তাহলে তো কথাই নেই।বাংলার স্যার অমিয়বাবু খানিক ঢোঁক গিলে বললেন, “ধুর্ এগুলো আবার ক্যালকুলেটর ছাড়া বলা যায় নাকি?” আশিস স্যার তখন স্বমহিমায় প্রতিভাত হলেন, “আরে পাঁচের স্কোয়ার যদি পঁচিশ হয়, তাহলে সেটা শেষে বসাও, তারপর পঁচানব্বই এর নয়, আর নয়-যুক্ত-এক মানে দশের সঙ্গে নয় গুণ করে দিলে হল নব্বই। তাহলে পঁচানব্বই স্কোয়ার মানে হলো ৯০২৫। হা হা হা হা!সবাই কিছুটা হলেও বিস্মিত হয়ে শুনল। পিন্টুর বাপ তারিণী জ্যাঠা মাথা নাড়িয়ে বলে উঠলেন, এসব অঙ্ক-টঙ্ক আমার মাথায় ঢোকে না বাপু। পিন্টু কিন্তু সব শুনে তার দুর্লভ স্মৃতিশক্তিতে সেটা তক্ষুনি ছেপে নিল। এতো গেল একদিনের ঘটনা। এরকম আরো অজস্র দিনের আলোচোনা-আড্ডা সবই পিন্টুর মনের ক্যানভাসে আঁকা ছিল, কিছুই খোয়া যায়নি। তার পাড়ার দাদা ডাবলু তাকে একদিন বলল, “এই পিন্টে! তোকে আজ আমি একটা নতুন জিনিস শেখাব, সেটা হলো গুগল্। তুই তারিণী জ্যাঠাকে বলে ফোনে নেট্ ভরিয়ে নিস্। তাহলে পৃথিবীর যাবতীয় খবরাখবর তুই গুগলেই পেয়ে যাবি।

কিছুদিন হল তারিণী জ্যাঠামশাই একটা কম-দামে স্মার্টফোন কিনেছেন। তিনি সেটা চালাতে পারেন না বলে পিন্টুকেই সেটার জিম্মা দিয়েছেন। পিন্টু সারাদিন চায়ের দোকানে বসে বসে এ. আই.-এর স্যারেদের-ছাত্রদের আর বাকীদের আড্ডা-আলোচনা শোনে, আর গুগলে সার্চ করে প্রাসঙ্গিক বিষয়গুলো পড়তে থাকে। গুগল হয়ে ওঠে তার একান্ত সহচর। তারপর একদিন একদল ছাত্র এসে ভিড় করল তারিণী জ্যাঠার চায়ের দোকানে। তারা আলোচনা করছিল বিক্রমজিতের টি.ভি. শো কে হবে বাংলার কোটিপতি? নিয়ে। একজন চেঁচিয়ে বলল, শো-এ চান্স পাওয়া তো দূরের কথা, সামান্য কোয়ালিফায়িং রাউন্ড ক্লিয়ার করাই সম্ভব নয়। একজন লোকের পক্ষে সবকিছু জানা কি সম্ভব! যাইহোক, এটা কর্ণগোচর হওয়া মাত্র পিন্টুর মাথায় বিদ্যুৎ খেলে যায়; তার পেটের ভেতর একটা চাপা উত্তেজনা লাফিয়ে লাফিয়ে ধাক্কা দিতে লাগল। সে তার বাবাকে না জানিয়েই স্মার্টফোনে ‘কে হবে বাংলার কোটিপতি?’ প্রতিযোগিতায় নিজের নাম রেজিস্ট্রেশন করল। প্রতিযোগিতার নিয়মানুযায়ী তার স্মার্টফোনের স্ক্রিনে ভেসে উঠল একটা বহুনির্বাচনী প্রশ্ন, যেটা তাকে ১০ সেকেণ্ডের মধ্যে উত্তর দিতে হবে। প্রশ্নটা হল: “নিম্নলিখিত কোন শব্দটি ভারতীয় কনস্টিটিউশন-এ নথিভুক্ত নেই? দেওয়া হল চারটি বিকল্প।” পিন্টু কয়েক সেকেন্ড এর মধ্যেই 'সলিডারিটি' বিকল্পটায় তালা লাগাল। কিছুদিন আগে গুগল-এ ভারতীয় কনস্টিটিউশনের ছবি সে দেখেছিল। সেখানে ঐ শব্দটি নিশ্চিতভাবে ছিল না। হ্যাঁ, তার উত্তর একেবারে ঠিক; তবে এরকম ঠিক উত্তর দশ সেকেন্ডর মধ্যে আরো প্রায় দশ হাজার প্রতিযোগী দিয়েছে। তাই এর ফয়সালা হবে লটারীর মাধ্যমে, যার ফল ঘোষণা হবে পরের এপিসোড রেকর্ডিং-এর দুদিন আগে। পিন্টু উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করতে লাগল।

অবশেষে সেই বহুকাঙ্ক্ষিত বাংলার সুপারস্টার বিক্রমজিৎ দেববর্মনের ফোনটা সে পেল। বিক্রমজিৎ বললেন, “হ্যালো! আমি বিক্রমজিৎ দেববর্মন বলছি কে হবে বাংলার কোটিপতি (কে.এইচ.বি.সি.) থেকে। পিন্টু কাঁপা-কাঁপা গলায় বলে উঠল, হ্যাঁ বলুন!" বিক্রমজিতের মহীয়সী কণ্ঠস্বর গমগম করে উঠল, "কৃষ্ণেন্দু আপনাকে আমাদের শো-এর নেক্সট্ এপিসোডে আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে। পিন্টু আনন্দ-উত্তেজনায় ফুকরে উঠল, আচ্ছা, অনেক ধন্যবাদ।

এরপর পিন্টু তার বাবাকে ব্যাপারটা জানালে তিনি বেশ ধন্দের মধ্যে পড়লেন। পাড়ার লোকেদের উৎসাহে আমল তাকে দিতেই হল। কে.এইচ.বি.সি.-তে যোগদানে তিনি আর বাধা দিলেন না। তিনি ডাবলুকে আমতা আমতা করে বললেন, "ওই মা-মরা ছেলেটা লেখাপড়া শেখেনি, ও কি করে ঐসব কঠিন প্রশ্নের উত্তর দেবে রে?" ডাবলু আত্মবিশ্বাসী কন্ঠে উত্তর দিল, “হ্যাঁ জ্যাঠা!দেখবেন, ও ঠিক পারবে।

তারপর সেইদিনের কথা। পিন্টু ও ডাবলু হাজির হল কে.এইচ.বি.সির সেটে। দেখল তার মত আরো নয়জন প্রতিযোগী প্রাথমিক পর্যায়ে অংশগ্রহণের জন্য উপস্থিত। শুরু হলো শো আর প্রথমেই পিন্টু প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের সঙ্গে স্ক্রীনিং-এ বাকি নয়জনকে পিছনে ফেলে হটসিটে বসার অনুমতি পেয়ে গেল। হটসিটে বসার পর হোস্ট বিক্রমজিৎ তাঁর চিরাচরিত ঢঙে কৃষ্ণেন্দু ওরফে পিন্টুকে জিজ্ঞাসা করলেন, “কৃষ্ণেন্দুবাবু আপনি কি করেন?” পিন্টু বলল, আমার বাবা একজন চা-বিক্রেতা, আমি দোকানে থেকে তাঁকে সাহায্য করি। গোটা দর্শকাসন থেকে করতালি উঠল। বিক্রমজিৎ তাঁর জোরাল কণ্ঠস্বরে বললেন, আপনি যে আজ আমাদের সঙ্গে হটসিটে বসে খেলবেন, সেজন্য আমি আমার শো-এর তরফ থেকে আপনাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আশা রাখি আপনি এখান থেকে অনেক টাকা জিতবেন এবং আপনার বাবার ছোট্ট ব্যবসায় সাহায্য করতে পারবেন। তারপর ক্যুইজ শো-এর নিয়মাবলী বিক্রমজিৎ একে একে পিন্টুকে অবহিত করালেন। খেলা শুরু হল। পিন্টু মাথা ঠান্ডা করে ভাবল, তিনটে লাইফলাইন তাকে ভেবে-চিন্তে ব্যবহার করতে হবে।

প্রথম প্রশ্ন তার সামনের কম্পিউটার স্ক্রিনটিতে ভেসে উঠলো: ভারতের প্রথম মহিলা মুখ্যমন্ত্রীর নাম কি? সরোজিনী নাইডু, নন্দিনী সৎপথী, সুচেতা কৃপালানি, এবং শশীকলা কাকোদকার। পিন্টু চোখ বন্ধ করল, মুহূর্তের মধ্যে ভেসে উঠল কোনো এক দিনের চায়ের দোকানের কয়েকজনের মধ্যে আড্ডার ছবি। সুচেতা কৃপালানির নামটা তার মনে এল। এক স্বনামধন্যা বাঙালি ভদ্রমহিলা এবং স্বাধীনতাসংগ্রামী। সে চোখ খুলে হাস্যমুখে বিক্রমজিতের দিকে তাকিয়ে বলল, "অপশন সি, সুচেতা কৃপালানি।" বিক্রমজিৎ পিন্টুর আত্মবিশ্বাসে খুশি হলেন, -হ্যাঁ, একদম সঠিক উত্তর! দর্শকদের করতালিতে গর্জে উঠল গোটা অডিটরিয়াম আরো একবার, এবং পিন্টু পৌঁছে গেল দশহাজার টাকার স্তম্ভে। পরের প্রশ্ন: পুষ্কর লেক ভারতের কোথায় রয়েছে? এই উত্তরটা পিন্টুর আয়ত্তের বাইরে। সে বলল, স্যার, আমি অডিয়েন্স পোল নিতে চাই। বিক্রমজিৎ সম্মতি জানিয়ে বললেন, তবে তাই হোক। অডিয়েন্স পোল নেওয়া হলো: রাজস্থান ৫০%, গুজরাট ৩০%। পিন্টু আবার চোখ বন্ধ করল, তার মনে পড়ল তার দোকানে দুই তীর্থযাত্রীর কথোপকথন। তাঁরা রাজস্থান থেকেই ফিরেছিলেন সেদিন; আর পুষ্কর লেকের কথাটাও মনে পড়ে গেল। পিন্টু বলল, অপশন বি: রাজস্থান! বিক্রমজিৎ খানিক চিন্তাশীল মুখে বললেন, আর ইউ সিওর? পিন্টু সম্মতি জানিয়ে মাথা নাড়ল। হ্যাঁ, এটাও সঠিক উত্তর; সে এবার পৌঁছে গেলো পঁচিশ হাজার টাকার স্তম্ভে। পরের প্রশ্ন পঞ্চাশ হাজার টাকার জন্য তার কম্পিউটার স্ক্রিনে ভেসে এল: ২০২২-এর ফুটবল বিশ্বকাপের ফাইনালে আর্জেন্টিনার হয়ে প্রথম গোল করেন এঞ্জেল দি মারিয়া, সেই গোল এর জন্য যে মুভ্ হয়েছিল, তার প্রথম পাসটি কে করেন? দর্শকাসনে বসা প্রতিটি মানুষ শিহরণ অনুভব করল। প্রশ্নগুলো যে এবার রীতিমত শক্ত হতে শুরু করেছে। পিন্টু আবার তার চোখ বন্ধ করল। তার মনে পড়ে গেল সেই একদল ছাত্রের কথা। তারা সেদিন চায়ের দোকানে এই গোলটা নিয়ে আলোচনায় মেতে ছিল। শেষপর্যন্ত সিদ্ধান্ত হয় প্রথম পাসটা করেন ক্রিস্টিয়ান রোমেরো। সে অবিচলিত কণ্ঠে জবাব দিল, “অপশন্ ডি: ক্রিস্টিয়ান রোমেরো। বিক্রমজিৎ এবার মুখে একটা নকল হাসি দিয়ে বললেন, হ্যাঁ এবারেও ঠিক বলেছেন কৃষ্ণেন্দু। তারপর একবার পিছনে ঘুরে শো-এর সঞ্চালকদের দিকে তাকিয়ে কিরকম একটা কঠোর দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। মনে হল, কোথাও একটা কিছু গোলমাল হতে চলেছে। যাইহোক, পিন্টু এবার পঞ্চাশ হাজার টাকা জিতে বসে আছে হটসীটে; পরের প্রশ্ন এক লাখ টাকার জন্য! এত টাকা পাবার কথা হয়ত তার বা তার বাবার স্বপ্নেও ছিল না। বিক্রমজিৎ পিন্টুকে জিজ্ঞাসা করলেন, "কৃষ্ণেন্দু আপনি চাইলে এখন খেলা ছেড়ে দিয়ে ৫০০০০ টাকা নিয়ে বাড়ি যেতে পারেন!" পিন্টু উত্তর দিল, না স্যার, আমি আরও খেলতে চাই।

পরের প্রশ্ন এল একলাখ টাকার জন্য। “‘প্রব্লেমস অফ দ্য ইস্ট বইটির রচয়িতা কে? লর্ড বেন্টিংক, রবার্ট ক্লাইভ, লর্ড কার্জন, উইনস্টন চার্চিল। নাহ্! পিন্টু বোধহয় এটার উত্তর দিতে পারবে না। কিন্তু এ কি! সে খেলা না ছেড়ে বলল, সে ফিফ্টি-ফিফ্টি লাইফলাইনটা নিতে চায়। বিক্রমজিতের মুখের হাসি এখন অনেকটাই ম্লান, তিনি গম্ভীরভাবে বললেন, কম্পিউটার মহাশয় যেকোন দুটো ভুল বিকল্প সরিয়ে নিন। রইল লর্ড কার্জন আর উইনস্টন চার্চিল। পিন্টুর দ্বিধা বাড়ল বই কমল না। তার মাথায় যে রবার্ট ক্লাইভের নাম ঘোরাঘুরি করছিল। সে আবার চোখ বন্ধ করল। হ্যাঁ, এবার তার মনে এল ইতিহাসের স্যার সৌমেন্দুবাবুর চায়ের দোকানে সেই একদিনের লম্বা লেকচারের কথা। পরীক্ষার খাতায় ছেলেদের কারিকুরির কথা বলতে গিয়ে, তিনি ঐ বইটির ও তার রচয়িতার নাম উল্লেখ করেছিলেন। বিক্রমজিৎ তড়িঘড়ি শো থেকে পিন্টুকে বিদেয় করতে গেলে পিন্টু উত্তর বাতলে দিল, স্যার, অপশন্ সি: লর্ড কার্জন। আরেব্বাস্! এটাও সঠিক উত্তর! দর্শকদের করতালির ধ্বনিতে গোটা অডিটরিয়ামের দেওয়ালগুলো যেন কেঁপে উঠল। সেদিনের এপিসোডের সময় সমাপ্ত হল। পিন্টু রইল এক লাখের স্তম্ভে আর বিক্রমজিৎ শো সমাপ্তির ঘোষণা করে বললেন, বাকি খেলাটা পরের এপিসোডে হবে। সবাই ভাল থাকুন, শুভরাত্রি।

     সেদিন সন্ধ্যা বেলায় শো-এর পর দর্শকদের হাজারো শুভেচ্ছা কুড়িয়ে যখন পিন্টু ডাবলুকে সঙ্গে নিয়ে তপনদার মেসের দিকে হাঁটা দিয়েছে, তখন ঘটল এক অঘটন। একটা জনমানবশূন্য রাস্তায় কালো জীপে করে কতগুলো ষণ্ডামার্কা লোক নেমে পিন্টুর চোখ-মুখ চেপে গাড়িতে তুলে নিল, ধস্তাধস্তিতে ডাবলু কোথায় ছিটকে গেল।

ছবি : অর্কজ্যোতি চক্রবর্ত্তী

তারপর যখন পিন্টুর চোখ থেকে কালো কাপড় সরান হল, তার হাত-পা বাঁধা; সে দেখল তার সামনে দন্ডায়মান শো-এর সঞ্চালক তথা সুপারস্টার খোদ বিক্রমজিৎ। পিন্টু ভয়ে কেঁপে উঠল, তার গলা শুকিয়ে গেল। খুক-খুক করে কাশতে লাগল। বিক্রমজিৎ তখন জলের গ্লাসটা পিন্টুর দিকে এগিয়ে ধমক দিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, তারপর কৃষ্ণেন্দু, না না পিন্টুবাবু, বল তোমার কারসাজিটা কী? কীভাবে তুমি লেখাপড়া না শিখে অবলীলায় এসব উত্তর দিয়ে দিচ্ছ? জান তুমি একটা বড় জালিয়াত….চোর। তোমার জন্য আমি আমার শো-এর টাকা এভাবে ওড়াতে পারব না। তুমি কালকে এপিসোডের শুরুতে বলবে তুমি আর খেলবে না; আর পঞ্চাশ হাজার টাকা নিয়ে চুপচাপ বাড়ি যাবে। বুঝলে সোনা। পিন্টু একটা কথাও বললো না, সে নির্ভীকভাবে বিক্রমজিৎ- এর চোখে চোখ রাখল। এতে বিক্রমজিৎ আরো ক্ষেপে গিয়ে সপাটে তাকে একটা চড় মারলেন। তাঁর সহকারী তক্ষুনি তাঁকে শান্ত করে বলল, আপনি ছাড়ুন স্যার, কথা বার করার অনেক উপায় আমার জানা আছে। ও নিশ্চিত চোখ বন্ধ করে শো চলাকালীন কাউকে ঈশারা করছিল...তোর জালিয়াতির আমি শেষ দেখে নেব শয়তান। তারপর বিক্রমজিতের সাঁকরেদরা পিন্টুকে বেধড়ক মারতে লাগল, তার মুখে-চোখে-শরীরে আঘাতের চিহ্ন ফুটে উঠল। তাকে সারাদিন একটা ঘুপটি ঘরে হাত-মুখ বেঁধে বন্ধ করে রাখা হল।

   কিন্তু পরদিন সকালে ঘটে গেল এক অভাবনীয় ঘটনা। ডাবলু কোথা থেকে খবর নিয়ে এসে পৌঁছে গেল বিক্রমজিতের গোপন ডেরায়, সঙ্গে হিউমান রাইটস কমিশনের কর্মী বাদল বোস। সেই ব্যক্তি নিজের পরিচয় দিয়ে বিক্রমজিৎকে সরাসরি আক্রমণের সুরে বললেন, তুমি এক্ষুণি ছেলেটাকে যেতে দাও, নইলে তোমার শো-এর কালোবাজারির কথা সবার সামনে ফাঁস করব, আর বাংলার সুপারস্টার বিক্রমজিৎ দেববর্মন একদিনের মধ্যে পথের ‘ভিকিরি’ হয়ে যাবে। তুমি যে শুধু নিজের লোকেদের কোটিপতি করার খেলা খেলছ, সেটা গোটা বাংলার মানুষ জানতে পারবে। বিক্রমজিৎ এবার বাদলবাবুর দিকে তেড়ে আসতে তাঁর সহকারী তৎক্ষণাৎ তাঁর হাত চেপে ধরে বলল, স্যার এ কি করছেন! এনার অনেক নেটওয়ার্ক আছে, প্রব্লেম হয়ে যাবে। বিক্রমজিৎ তৎক্ষণাৎ নিজেকে সামলে নিয়ে এককোণে একটা চেয়ারে মাথা নিচু করে বসে পড়লেন। বাদলবাবু পিন্টু আর ডাবলুকে সঙ্গে নিয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে এলেন।

সেদিন সন্ধে বেলায় আবার শুরু হল কে.এইচ.বি.সি.র পরের এপিসোডের রেকর্ডিং। বিক্রমজিৎ অনিচ্ছা সত্ত্বেও প্রবল চাপে পড়ে পিন্টুকে হটসিটে বসিয়ে শো শুরু করতে বাধ্য হলেন। কম্পিউটার স্ক্রিনে ভেসে উঠল পরের প্রশ্ন, পঁচিশ লক্ষ টাকার জন্য: গাড়ির ইঞ্জিন-এর কিউবিক ক্যাপাসিটি কোন ইউনিট-এর মাধ্যমে মাপা হয়? জুল,সি সি, পাসক্যাল, হর্সপাওয়ার। পিন্টু চিরাচরিত ভঙ্গিমায় আবার চোখ বন্ধ করল, তার মনে পড়ে গেলো সেদিনের কথা। দেবপ্রিয় স্যার সেদিন গাড়ির সিলিন্ডারে বায়ু ও জ্বালানির ঠেলাঠেলির বিষয়টা নিয়ে বলেছিলেন। পিন্টু ভয়ংকর আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলে উঠল, লক অপশন বি: সিসি। হ্যাঁ, এটাও সঠিক উত্তর। বিক্রমজিতের কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না। একটা সামান্য চায়ের দোকানে কাজ করা ছেলে এতোসব জটিল প্রশ্নর উত্তর কিভাবে দিতে পারে? যাইহোক, পিন্টু এবার পঁচিশ লক্ষ টাকার স্তম্ভে উঠে গেল। বিক্রমজিৎ প্রবল অনিচ্ছা সত্ত্বেও খেলা চালিয়ে যেতে থাকলেন- পরের প্রশ্ন পঞ্চাশ লক্ষ টাকার। খুবই শক্ত প্রশ্ন। বিজ্ঞানী না হলে এর উত্তর দেওয়া সম্ভব নয়। কোন রশ্মির সহায়তায় অণুর রাসায়নিক বন্ধন-দৈর্ঘ্য মাপা যায়? এর উত্তর পিন্টুর জানা নেই। তাই সে খেলার নিয়মানুযায়ী লাইফ-লাইন নিতে বাধ্য হল-‘ফোন-এ-ফ্রেন্ড’। সে ফোন করল তার একজন প্রিয় ব্যক্তিকে; এ. আই. কলেজের কেমিস্ট্রির টিচার পরিমল স্যারকে। পরিমল স্যার পিন্টুকে খুব স্নেহ করতেন এবং মাঝে-সাঝে ভালোবেসে তাকে দশ-বিশ টাকা বকশিসও দিতেন। পরিমল স্যারের রসায়নে জ্ঞান যেকোন বড় মাপের বিজ্ঞানীর সমতুল।

   পরিমল স্যার অবলীলায় বলে দিলেন উত্তরটা এক্স-রে হবে। সুতরাং পিন্টু পৌঁছে গেলো পঞ্চাশ লক্ষ টাকায়। আর একটি প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলেই সে হয়ে যাবে ‘ক্রোড়পতি’। সে কি পারবে? সেটে উপস্থিত জনতার মধ্যে তখন তুমুল উত্তেজনা। তাদের সুপারস্টার এখন পিন্টু। বিক্রমজিতের জৌলুস বরঞ্চ ফিকে হয়ে আসছে। তার বাবা এবং টিভির অডিয়েন্স অবশ্য এই খেলার ফলাফল জানবে পরে, যখন প্রোগ্রামটি টিভিতে সম্প্রচারিত হবে কয়েক ঘন্টা পর। পিন্টুর পাড়ার লোকজনও জানতে পারবে তখন। প্লাবন ঘটে যাবে। কিন্তু পিন্টু সেসব কিছুই ভাবছে না এখন, তার মন শান্ত, ধীর। ছোটবেলার মায়ের মুখটা তার মনে পড়ে কখনো-কখনো, তিনিও তো এরকমই ছিলেন শান্ত-ধীর। যাইহোক, এবার বিক্রমজিতের কণ্ঠে ভেসে উঠল খেলার শেষ প্রশ্ন। পিন্টু বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রইল কম্পিউটার স্ক্রিনটির দিকে। সে আর কোনকিছুতে ডরায় না। প্রশ্নটা এল খুব কঠিন; গণিত-বিষয়ক। বিশ সেকেন্ডে পারবে কি পিন্টু অসাধ্য সাধন করতে?

   প্রশ্নটি ছিল: ৯৯৯৯৯৯৫ এর বর্গ কত হবে? ক্যালকুলেটরই এর উত্তর দিতে পারবে। পিন্টু আবার চোখ বন্ধ করল: তার কি এবার কিছু মনে পড়বে, নাকি উচ্চাশার চাপে তার অনবদ্য স্মৃতিশক্তি তাকে ধোঁকা দেবে শেষপর্যন্ত। পিন্টু বিড়বিড় করতে করতে বলল, “অপশন ডি : ৯৯৯৯৯৯০০০০০০২৫। এ কি করে সম্ভব? পিন্টু এটা কিভাবে করল! হুঁ, আশিস স্যারের ফর্মুলাটা বোধয় পাঠকের মনে আছে। সেটারই প্রয়োগ করেছে পিন্টু। বিক্রমজিৎ কোনক্রমে মুখে একটা ফ্যাকাসে হাসি ফুটিয়ে অভিনয় করে বললেন, অবিশ্বাস্য, আমি মোহিত। একেবারে সঠিক উত্তর। আর কৃষ্ণেন্দুবাবু জিতে গেলেন এক কোটি টাকা। অনেক অভিনন্দন। দর্শকাসন থেকে গগনবিদারী করতালির মধ্যে ডাবলু দৌড়ে এসে পিন্টুকে জড়িয়ে ধরল। পিন্টুর চোখে জল, ডাবলু বলল, "তারিণী জ্যাঠাকে এক্ষুণি ফোন করে বলছি, না জানি উনি খুশিতে কি না কি করবেন। আর ঘন্টাখানেক পর যখন টিভিতে দেখাবে তখন গোটা বাংলার লোক এটা দেখবে। ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিচ্ছে রে পিন্টু। ডাবলুকে থামান গেলনা, সে যেন এক উৎসবে মেতে উঠেছে। অন্যদিকে বিক্রমজিৎ পিন্টুর সঙ্গে হ্যান্ডশেক করে সেট্ থেকে বেরিয়ে গেলেন বটে, তবে মেক-আপ রুমে ঢুকে তার রাগের রেশ সেখানকার আসবাবপত্রের ও উপস্থিত অনুচরদের উপর গিয়ে পড়ল। তিনি বোধহয় স্বপ্নেও ভাবেননি, যে তাঁর পছন্দের লোক ছাড়া কেউ তাঁর নাকের ডগা দিয়ে কোটি টাকা জিতে এভাবে বেরিয়ে যাবে, তাও আবার একজন সাতাশ-আঠাশ বছরের সামান্য চা-বিক্রেতা।

   এইভাবে পিন্টু চা-ওয়ালা হয়ে গেলো ক্রোড়পতি। তার বাবার আর চায়ের দোকান চালাবার দরকার রইল না। পিন্টুর কাছে আজ সব আছে-বাড়ি-গাড়ি-টাকা, কোনো অভাব নেই তার। কিন্তু তবুও মাঝে মাঝে রঘুনাথপুরের সেই চা এর দোকান আর সেখানকার নিত্য অভ্যাগতদের ভিড়ের ছবি এখনো তার মাথায় ঘোরে। সে যে এক সুখস্মৃতি ছাড়া আর কিছুই নয়,  তা কি আরবলবার অপেক্ষা রাখে।

...(সমাপ্ত)...

No comments:

Post a Comment