1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Wednesday, October 2, 2024

চাঁদের পাহাড়

চাঁদের পাহাড়

ডাঃ অনির্বাণ আশ

বিভূতিভূষণ বন্দ্যপাধ্যায়। নষ্টের গোড়া যখন তিনিই তাই তাঁর নামটা দিয়েই গল্পটা শুরু করি। ছোট বেলা থেকেই তাঁর লেখার প্রতি বড় ভালো লাগা। শুরু টা সিলাবাসের আরন্যক দিয়ে। তারপর বাধ্যতামূলক ভাবেই চাঁদের পাহাড় পড়া। আবার বাঙালির আদিখ্যেতা পথের পাঁচালি-টাও তাঁর।ছোট বেলায় একবার বইমেলা ঘুরে বেশ কয়েকটা তাঁর লেখা বই কিনে এনেছিলাম।আইডিয়া বিশেষ ছিল না।যেগুলোর মলাট দেখে ভালো লেগেছিল আর পকেট সাথ দিয়েছিল সেগুলোই আমার বই-এর আলমারিতে জায়গা করে নিল। তার একটা ছিল দেবযান।তাই দেখে মায়ের তো কি চিন্তা এইটুকু ছেলে এইসব বই কেন পড়ে।ঠাকুমা ধরে নিয়ে গেল এক নামযাদা ফকিরের কাছে ঝাড়াতে। একটা সাপের ডালার ভেতরে হাত ধুকিয়ে দেওয়া হত।হিমশীতল সেই স্পর্শ। তারপর ঝারফুক করা হত। এতে আমার বিশেষ আপত্তি ছিলনা কেননা সেদিনের বিকালের পড়ার ও ছুটি আর বাড়ি ফিরে এসে একটু বেশি আদর যত্ন পাওয়া যেত।একটা ডুগডুগির মত দেখতে ছোট মাদুলি খালি পরে থাকতে হত।যাই হোক এই আমার ছোট থেকে বিভুতিভূষন ববন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে সম্পর্ক।

ছোট বেলায় পড়া চাঁদের পাহাড় শুধুই রহস্য,রোমাঞ্চ, হীরের খনি আর রুপকথা। এই আধ বুড়ো বয়সে এসে যখন পড়লাম তখন তার প্রভাব অনেক বেশি হল।জীবন দর্শন,অনূভুতি,উপলদ্ধি এখন অনেক পরিণত।

গ্রামের ছেলের শংকরের ছাপোষা  রুটিন মাফিক জীবন থেকে বেরিয়ে পৃথিবীটাকে এক্সপ্লোর করার সাহস। তার গুরু ডিয়েগো আলভারেজের প্রতি তার আনুগত্য এবং শ্রদ্ধা। তার মৃত্যুর পরেও তার প্রাপ্য সম্মান তাকে দিয়ে ইতিহাসের পাতায় তাকে জায়গা করে দেওয়া। নিজের মৃত্যু মুখে পৌঁছে গিয়েও তার প্রাপ্ত কয়েকটা হীরে বেচে সে নিজে স্বচ্ছন্দ জীবন কাটাবে ভাবেনি ভেবেছে এগুলো নিয়ে বেঁচে ফিরলে গ্রামের কত গরীব লোকের উপকার হবে,কতগুলো মেয়ের বিয়ে দেওয়া যাবে।পৃথিবী ঘুরে দেখি পেট রোগা শিঙ্গিমাছের ঝোল খাওয়া বাঙ্গালী রাই ঘোরার নেশায় পাগল।ভাঙা হাঁটু নিয়ে মাফলার আর মাংকি টুপি পড়ে লড়ে যায় এই বাঙালিরাই। এ বাংলার শত খারাপ সত্বেও হৃদয় আছে।বৃষ্টি ভেজা মেঠো রাস্তা আছে, দুপুরের রোদ্দুরে ঠাকুমার আদর আছে,গরমে সন্ধ্যের শাঁখ আর মায়ের আঁচল আছে। এই বাংলার শঙ্কর গরীব হলেও অনেক বিত্তশালী মন তার। কিশোর খ্রিস্টান আত্তিলিও গাত্তির মৃতদেহকে তার সম্মান প্রদর্শন, পর্তুগিজ দিয়েগো আলভারেজের সাথে তার পিতা পুত্রের সম্পর্ক - সবকিছুতেই তার বড় হৃদয়ের পরিচয় পাওয়া যায়। সলসবেরিতে এক মুসলমান মানুষ তাকে সর্বস্বান্ত দেখে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন।ধর্ম বর্ন দেশ ভাষা সবার ওপরে রইল মনুষ্যত্ব। শঙ্কর -ও প্রথম হীরে বেচে কিছু টাকা পেতেই সেই ব্যাবসায়ীকে সে ফেরত দিয়ে আসে। কৃতঘ্ন নয় সে।

আটত্রিশ ছুঁই ছুঁই মনটাকে নাড়া দিয়ে গেল এই জীবন দর্শন। প্রায় 100 বছর আগের প্রেক্ষিতে লেখা একটা কাল্পনিক গল্প কত প্রাসঙ্গিক আজকের এই ইন্টারনেটের সময়েও। রিখটারসভেল্ট পাহাড়, চিমানিমানি পাহাড়, কালাহাড়ি মরুভূমি আর হিরের খনি সত্যি কি আছে? মধ্য আফ্রিকার জঙ্গলের ভেতরে থাকা আগ্নেয়গিরি, শঙ্কর যার নাম দেয় মাউন্ট আলভারেজ আদৌ কি তার অস্তিত্ব আছে?

আফ্রিকা আর জঙ্গল বলতেই ভেতো বাঙালি বোঝে মাসাইমারা।

একবার গুগলে সার্চ মারতেই আর নিস্তার নেই।ফেসবুক খুললেই মাসাইমারার এডভার্টাইসমেন্ট। এমনিই OCD-এর রুগী।মন কে নিয়ন্ত্রণে রাখা আর জীবন কে ঘড়ির কাঁটার রুটিনে বেঁধে রাখা বড় কঠিন।তাও মনকে বোঝাচ্ছি অনেক টাকা খরচ,ওই টাকায় ফ্ল্যাটের কিছু কাজ হয়ে যাবে।কিন্তু পড়তে তো আর খরচ নেই।জানার আনন্দ-ও তো কম নয়।আর এখন ইন্টারনেটে সব কিছু পড়ে জানা অনেক সহজ।

এইবার ভূগোল নিয়ে বসতে হল।আমরা চাঁদের পাহাড় বলতে বুঝি মাউন্ট কিলিমাঞ্জারো।সেই নিয়ে অনেক তর্ক আছে আসলে চাঁদের পাহাড় কোনটা? বহুজনের মতে এটা একটা পর্বত শ্রেণী যার গোড়া থেকে নীলনদ বেরিয়েছে৷ তবে কিলিমাঞ্জেরো কেনিয়ার আম্বোসেলি থেকে মাঝে মধ্যে, দেখা গেলেও নিশ্চয়তা একদমি নেই।বরং তাঞ্জানিয়া থেকে দেখতে পাবার সম্ভবনা বেশি। আর রিখটারসভেল্ট পাহাড় আসলে অবস্থিত সাউথ আফ্রিকায়। শঙ্কর যে রেল কোম্পানিতে কাজ নিয়েছিল সেটা ছিল উগাণ্ডায়। চাঁদের পাহাড়ের গল্পে বর্নিত কালাহারি আসলে অবস্থিত বোতসোয়ানায়। তবে ভূপ্রকৃতি আর বন্যপ্রানের সিমিলারিটি প্রচুর এই জায়গা গুলোর মধ্যে। আফ্রিকা কে মোটামুটি পাঁচ ভাগে ভাগ করা যায়।উত্তরে ইজিপ্ট,লিবিয়া,মরক্কো; পূর্বে সেশিলস,কেনিয়া, মরিশাস, মাদাগাস্কার,তানজানিয়া, সোমালিয়া, ইথিওপিয়া, সুদান, উগান্ডা; পশ্চিমে ঘানা সেনেগাল আইভরি কোস্ট,নাইজিরিয়া; সেন্ট্রালে ক্যামেরুন,কঙ্গো, আর দক্ষিণে সাউথ আফ্রিকা, জিম্বাবুয়ে,জাম্বিয়া, বোতসোয়ানা, মোজাম্বেক।তাই মোটামুটি চাঁদের পাহাড়ের গল্পে পূর্ব-মধ্য-পশ্চিম আফ্রিকার ভূমিরুপ আর বন্যাপ্রাণের কথা আমরা জানতে পারি। আফ্রিকার দেশগুলোর মধ্যে নাইজিরিয়া, ইজিপ্ট আর সাউথ আফ্রিকার অর্থনৈতিক অবস্থা বেশ ভাল। এগুলোর মধ্যে কেনিয়ার মাসাইমারা, তাঞ্জানিয়ার সেরেঙ্গিটি, সাউথ আফ্রিকার ক্রুগার জঙ্গল সাফারির জন্য বেশি পপুলার।এর মধ্যে আবার কেনিয়ার মাসাইমারা বেশি পপুলার কারন এখানে বন্য পশুর ঘনত্ব বেশি তাই বিগ ফাইভ বা বিগ নাইন চট করে দেখে ফেলা যায়। বিগ ফাইভ হল সিংহ, হাতি,লেপার্ড,কালো গন্ডার আর আফ্রিকান বাফেলো।আর বিগ নাইনে এদের সাথে জায়গা পেয়েছে জিরাফ,চিতা,যেব্রা আর জলহস্তী। সেরেঙ্গিটি জঙ্গল মাসাইমারার তিনগুন বড় তাই অনেক বেশি খুঁজতে হয়।খরচ মাসাইমারা যেতে তুলনামূলক কম, জার্নি কম করতে হয়, ট্যুরিস্ম উন্নত তাই অপশন অনেক বেশি।কিন্তু মজার ব্যাপার আফ্রিকা বলতে আমরা যে জঙ্গলের রাজা সিংহ কে বুঝি, সেই সিংহ পৃথিবীতে সব থেকে বেশি সংখ্যায় আছে আমাদের এই পোড়া দেশেই, প্রায় 3000  আর আফ্রিকায় কিন্তু বাঘ পাওয়া যায় না। যাইহোক মাথায় এখন আফ্রিকা ঢুকেছে। পড়াশোনা চলুক।আমরাও তুল্যমূল্য আলোচনা করে ঠিক করলাম শুরুটা হোক মাসাইমারা দিয়েই।অনেকের মতে মাইগ্রেশন পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য। জুলাই থেকে অক্টোবর দ্য গ্রেট মাইগ্রেশনের সময় সাবানা ঘাস শেষ হওয়ায় মারা রিভার পার করে জীবন বাজি রেখে লক্ষ লক্ষ ওয়াইল্ড বিস্ট,গ্যাজেল আর যেব্রা  তাঞ্জানিয়া থেকে মারা পার হয়ে মাসাই চলে যায় খাবারের জন্য। নদী পার হতে গিয়ে কুমির বা জলহস্তির হাতে প্রান যায় অনেকেরি। ডিসকভারি তে সেই "survival of fittest" - এর ভিডিও আমরা সবাই দেখেছি।আবার এরা কেনিয়া থেকে তানজানিয়া ফিরে আসে নভেম্বর থেকে যা রিভার্স মাইগ্রেশন নামে বিখ্যাত। এক দেশে খাবার শেষ হয়ে গেলে প্রতি বছর খাবার জোগানোর তাগিদে এই জীবন সংগ্রামের সাক্ষী হতে হাজারো ট্যুরিস্ট হাজির হন কেনিয়ায়, তাঞ্জানিয়ায়। বহু আগে এটা একটাই ভূমি ছিল।কিন্তু ভূগর্ভস্থ প্লেট সঞ্চালনের ফলে মাঝখানের জায়গা ঢুকে গিয়ে তৈরি হয় ক্ষত সেখানে তৈরি হয় মারা নদী আর তার দুদিকে দুই দেশ ভাগ হয়ে যায়।একদিকে কেনিয়া আর একদিকে তাঞ্জানিয়া । কেনিয়া মূলত দুটো ভাগে বিভক্ত, একটি রিফ্ট ভ্যালী যেটা আগ্নেয়গিরি, লেক দিয়ে ঘেরা। এই অঞ্চল ফ্লেমিঙ্গো, হিপো-র জন্য বিখ্যাত। নাকুরু, নাইভাসা, বগোরিয়া, এলিমেন্টেইটা এই নিয়েই রিফ্ট ভ্যালী। আর অন্যভাগটি হলো বন্যপ্রাণে ঠাসা। মাসাইমারা, অলপ্যাজেটা, সাভো, অ্যাম্বোসেলী ন্যাশনাল পার্ক - এই ভাগে অবস্থিত, যেখানে বিগ ফাইভের দেখা পাওয়া খুব কঠিন কিছু না। অলপ্যাজেটা ন্যাশনাল পার্ক শিম্পাঞ্জির জন্য বিখ্যাত। 

এছাড়াও কেনিয়ায় রয়েছে জগৎ বিখ্যাত সমুদ্রতট মোমবাসা।অনেক পড়াশুনা হল।আমার পাপের ভাগিদার এখন প্রত্যয়।বিকাশ,শুদ্ধ আর সুপ্রিম এবারে যেতে পারবে না। প্রত্যয়-ও বলল অনেক খরচ এবার ছেড়ে দে 2023-এ দেখা যাবে। আমিও মনকে বুঝিয়ে নিলাম। কিন্তু কদিন পরেই প্রত্যয়ের ফোন বুঝলি অনেক পড়াশুনা করে যা বুঝলাম মাসাইমারাটা যেতেই হবে।ভাবগতিক ভালো না তাই সকালের দিকে প্রত্যয়ের ফোন এলে রিসিভ করা বন্ধ করলাম। কিন্ত ফেসবুক-গুগল খোঁচা দিয়েই যাচ্ছে। ইতিমধ্যে tripadvisor আর  ফেসবুকের মাধ্যমে একগাদা কেনিয়ান গাইড, ট্যুর অপারেটর, ফোটোগ্রাফার- এর সাথে আলাপ হয়ে গেছে।কদিন কোথায় থাকা যায়,কোথায় কোথায় যাওয়া যায়,দূরত্ব কত এইসব কথা চলছে।কেনিয়ান কয়েকজন বন্ধুও জুটে গেল।কিন্তু মেন মুশকিল যেটা মাইগ্রেশানের টাইমে হোটেল ভাড়া আগুন।রুম ভাড়া প্রায় কম করেও 20-25 হাজার টাকা দুজনের এক রাত্রে থাকা খাওয়া নিয়ে। প্রতিরাতে খরচ একলাখ - দেড় লাখ টাকা; এরকম ক্যাম্প ছড়াছড়ি। আসলে ফরেনার দের কাছে ডলার-পাউন্ড দিয়ে ভাগ করলে ওদের কাছে সেরকম কিছু না। কিন্তু আমাদের টাকার হিসাবে অঙ্কটা আকাশছোঁয়া। তাই আপাতত যা বোঝা গেল কোন সিন নেই।ফেসবুকের এক গ্রুপ থেকেই একজনের কনট্যাক্ট পেলাম নাম রাজা দা।বহু বছর উনি আফ্রিকা ট্যুর করছেন।লাগাও ফোন।বাত করনে সে বাত বনতা হ্যায়।রাজা দার একটা ট্যুর কম্পানি আছে - "home away tours and treks". আমাদের গল্পের দিয়েগো আলভারেজ এই ট্যুর অপারেটর-ই। বারাসাতে ভদ্রলোকের বাড়ি সেখানেই তিনতলায় তার অফিস। সেই দিন থেকে যাবার দিন সকাল অবধি রাজা দার মাথা খেয়ে নিয়েছি আমি আর প্রত্যয়। মাঝেমধ্যে রাজা দাও হাল ছেড়ে দিয়েছে তখন ওনার বিসনেস পার্টনার রাখি দি আমাদের আবদার গুলো সহ্য করেছেন।  রাজা দার সাথে কথা বলে ভালো লাগল।বিজনেস করতে এসেছেন বিজনেস করবেন লাভ করবেন সেগুলো ন্যাচারাল সবাই করেন কিন্তু ওনার মাসাইমারার বন্যাপ্রানের জন্য ওখানকার লোকের জন্য একটা মায়া আছে। যাব কি যাব না ঠিক নেই কিন্তু অনেক ইনফরমেশন উনি দিলেন।যতই বই পড়া হোক নেট ঘাটা হোক যিনি নিজে গেছেন তার কাছ থেকে অনেক ক্লিয়ার আইডিয়া পাওয়া যায়।রাজা দা বললেন আমার সাথেই যেতে হবে এরকম কোন মানে নেই আপনি 6জন যোগাড় করুন নিজেরাই চলে যান আমি সব বলে দেব। ভালো লাগল কথাটা।একটু ইমোশনাল মানুষ। আফ্রিকার জঙ্গলের কথা উঠলে খুব আবেগপ্রবণ হয়ে পরেন।তারপর আসল কথায় এলাম আমরা।আমরা ফাইনাল ট্যুর প্ল্যান করলাম এরকম

Day 0 (07/08/2022)

প্লেন কোলকাতা থেকে 8.15পম ছেড়ে  দিল্লী পৌঁছাবে 10.35pm

Day 1 (08/08/2022)

দিল্লী থেকে ভোর 6.15am প্লেন,আমেদাবাদে এক ঘন্টা দাঁড়াবে আমদের নামতে হবে না,তারপর নাইরোবি পৌঁছাবে ওখানকার দুপুর 12.25pmএয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে গাড়িতে লেক এলিমেন্টেইটা যাওয়া।

150কিমি রাস্তা সময় লাগবে সাড়ে তিন ঘন্টা মত। সেদিন রেস্ট।লেকে পেলিকান পাওয়া যায়।

Day 2 (09/08/2022)

হোটেল থেকে 45মিনিট দূরে নাকুরু ন্যাশনাল পার্ক সেখানে সারাদিন গেম ড্রাইভ।এখানে মেন দেখার হোয়াইট রাইনো আর লাখ লাখ ফ্লেমিংগো। তবে কপাল ভালো থাকলে বিগ ফাইভ এখানে পাওয়া যায়। বিকেলে ফিরে লেক এলিমেন্টেইটার ধারে হোটেলেই নাইট স্টে।

Day 3 (10/08/2022)

সকালে বেরিয়ে 45মিনিট দূরে লেক নাইভাসাতে এক ঘন্টা বোটিং। মেন দেখার জলহস্তী।তারপর ওখান থেকে সোজা মাসাইমারা।দূরত্ব 250কিমি। সময় লাগবে 5ঘন্টা।

Day 4 (11/08/2022)

মাসাইমারা সারাদিন গেম ড্রাইভ

6am-6pm

Day 5 (12/08/2022)  মাসাইমারা সারাদিন গেম ড্রাইভ

6am-6pm

Day 6 (13/08/2022)

সকালে মাসাই ভিলেজ যাওয়া।ওখানে 2ঘন্টা কাটিয়ে সোজা নাইরোবি। 6ঘন্টার রাস্তা।

রাতে নাইরোবি হোটেলে থাকা।

Day 7 (14/08/2022)

নাইরোবি থেকে 1.55pm প্লেন, দিল্লী পৌঁছাবে 2.10am ভারতীয় সময়ে।

Day 8 (15/08/2022)

দিল্লী থেকে  6.50 আম প্লেন কোলাকাতা পৌঁছাবে 9am.

**আম্বোসেলি গিয়ে লাভ বিশেষ নেই আর ট্যুর এর দিন আর বাজেট বেড়ে যাওয়ায় আমরা আম্বোসেলি যাবোনা ঠিক করি।**

**গেম ড্রাইভের জন্য অনেকরকম গাড়ি পাওয়া যায় কিন্তু অবশ্যই ল্যান্ড ক্রুজার নেবেন এটা নিয়ে কোন কম্প্রোমাইজ করবেন না।

গাড়ীর মাথা সবার খোলা কিন্তু জানলা পুরো ওপেন কিনা জেনে নেবেন। ওয়াইল্ড লাইফ ফোটোগ্রাফিতে পশুর ছবি আই লেভেলে ভালো আসে তাই জানলা দিয়ে ছবি তোলা খুব জরুরি।**

রাজা দা জানালেন আমাদের এই প্ল্যানের খরচ মোটামুটি হবে 1.35লাখ মত প্রতিজনের।এতে ভিসা টিপস এন্ট্রি ফি সব ধরা।ওখানে আর একটাকাও লাগবেনা। প্লেন ভাড়া আরো 65হাজার।মানে যা দাড়াল ওই 2 লাখ টাকার মত।SIP আর সেভিংস ভাঙ্গিয়ে টেনেটুনে হয়ে যাবে।কিন্ত হাত পুরো খালি হয়ে যাবে। মনকে বোঝাচ্ছি।কিন্তু প্রত্যয় ফিলোজফিকাল জিনিষ বোঝাচ্ছে একটাই জীবন কবে আছি কবে নেই আর মাসাইমারাটা না গেলে হবে না বুঝলি।আমি হোয়াটসঅ্যাপে ওকে মিউট রেখেছি আর ফোনে আমার এমনি এলার্জি ওর ফোন তো আরোই ধরব না পুজো অবদি।যতই যাই বোঝাক আমি আর ফাদে পা দেব না।একদম "কন্ট্রোল উদয় ভাই কন্ট্রোল" মোডে চলে গেছি।টাকা জমাতে হবে ফ্ল্যাট এর রেজিষ্ট্রেশন হয়নি এখনো, তারপর কখন কি ইমার্জেন্সি আসে।ওদিকে মাঝে মাঝে শুদ্ধ-ও ওর সেরেঙ্গিটির গল্প   শোনাচ্ছে আর চাগাচ্ছে আফ্রিকার জঙ্গল টা যেতেই হবে; মাইগ্রেশন টা দেখতেই হবে জীবনে। জঙ্গল গেলে শুদ্ধর D500 আর 70-200 2.8 লেন্সটা আমি নিয়ে যাই। সাথে আমার D750 আর ট্যামরনের 150-600থাকে। যারা ছবি তুলতে চায় তাদের জন্য বলার এখানে পশু খুব কাছে থাকে তাই 200-300 ফোকাল লেংথে অনেক ছবি পাওয়া যায়। তবে টেলি লেন্স ও লাগবে। এখানে পশু সাধারণত অনেক সময় দেয়।আমাদের এখানের মত ঝোপঝাড় কম বেশিরভাগ টাই প্লেন ল্যান্ড তাই অনেক দূর অবদি পশুকে ট্র‍্যাক করা যায়।মোটামুটি সব গাইড জানে কিভাবে কোন এঙ্গেলে ছবি ভালো হবে। পদ্ম, সুপ্রিম, শুদ্ধ, মৈনাক, কৃশানু,প্রত্যূষ সবার থেকে ক্যামেরা, লেন্স, ফোটোগ্রাফি - নিয়ে অনেক পরামর্শ নিচ্ছি। শ্যামল স্যার তো আছেন সবসময় আমার মাথার ওপর ছবির জন্য। আমাদের ফোটোগ্রাফি ক্লাব এর অভিজিৎ দা, রত্নজিত দা -ও সবসময় এনকারেজ করে। এবারে  বৃন্দাবনের বারসানায় গিয়ে আলাপ হল কল্যান দা,ভেঙ্কি আর উদয়ন দার সাথে- তাদের থেকে অনেক ছবির ব্যাপারে জানতে পারি শিখতে পারি। রোজ রাতে ঘুমনোর আগে পেশেন্ট দের মেসেজের উত্তর দেওয়ার পাশাপাশি ইউটিউবে ফোটোগ্রাফি শেখার ভিডিও দেখা একটা রুটিন হয়ে গেছে। স্টিভ পেরির ভিডিও গুলো মেনলি দেখি।

যাক রোজাকার রুটিন চলছে, ভেতরের শঙ্কর কে বুঝিয়ে শান্ত করে রেখেছি।কপালের নাম গোপাল বলে,আমার ফুটো কপালের নাম প্রত্যয়। চেম্বার চলাকালীন আমি ফোন ধরি না বা মেসেজ দেখিনা। মাঝে দুপুরে খাবার সময় ফোনটা খুলে দেখি পিয়াঞ্জনার একটা মেসেজ - প্রত্যয় তোকে ফোনে পাচ্ছে না ফোন করতে বলেছে আরজেন্ট আছে। শুনেই বুকের মধ্যে ধরাস ধরাস। বিপদের গন্ধ। না ফোন করা মানেই খাল কেটে কুমির  ডাকা কিন্তু যদি অন্য কোন অসুবিধায় পরে থাকে একটা মেসেজ করি আগে।সেই ভেবে চ্যাট বক্সটায় টাইপ করতে গিয়ে খুলে দেখি 2টো PDF ফাইল এসেছে। ডাউনলোড করে চক্ষু চরকগাছ। আমার আর পিয়াঞ্জনার দুজনের প্লেনের টিকিট CCU-DEL, DEL- NRB.

ঠিক কি এক্সপ্রেশন দেব ভেবে পাচ্ছি না।এই প্রত্যয়ের বড় দোষ মানে ভাবনা চিন্তার কোন ব্যাপার নেই ওর ডিক্সনারিতে। অগত্যা ফোন করলাম কেস টা বোঝার জন্য। হেলো বলার আগেই ওদিক থেকে উত্তর শোন এই মানসিক চাপ নেওয়া যায় না। রোজ মাইগ্রেশনের স্বপ্ন দেখছি। তুই গাছে তুলে এখন মই কেড়ে নিলে তো হবে না। পিয়াঞ্জনাও একমত প্রত্যয়ের দোষ নেই তুই সবাইকে চাগিয়ে দিয়ে পালিয়ে গেলে তো হবে না।আমিইই দেখি এখন কালপ্রিট। কেস টা যেটা হয়েছে রাজা দা ফোনে করেছিলেন আমি ধরি নি প্রত্যয়ের সাথে কথা হয়েছে এই মুহুর্তে প্লেন ভাড়াটা কম যাচ্ছে। তাই প্রত্যয় পিয়াঞ্জনার থেকে পাসপোর্ট কপি নিয়ে রাজা দাকে বলে প্লেনের টিকিট কেটে ফেলেছে। আমি বললাম টাকা কে দিল।রাজা দা এখন দিয়ে দিয়েছে আমরা পরে দিয়ে দেব। কপালে মাসাইমারা আছে আর যাব কোথায়।

হাতে আড়াই মাস সময় বাকি। তার মধ্যে টাকা এরেঞ্জ করতে হবে।আর কেনিয়া যেতে গেলে ইয়েলো ফিভার আর পোলিও ভ্যাক্সিন নিতে হয়। কোলকাতা এয়ারপোর্টে মেল করতে হয় ওনারা ডেট দেন সেইদিন গিয়ে নিতে হয়,ভীষণ স্লো কাজ হয় ওখানে সারাদিন ধরে 50জনের ভ্যাক্সিন দেওয়া হয়।একজন মেডিকেল পার্সন হয়ে সময়ের এইরকম অপব্যবহার দেখে বেশ রাগ হচ্ছিল।ভ্যাক্সিন এর জন্য  300টাকা নেয়।কিন্তু সারাটা দিন নষ্ট।এখন শুনছি R.G.Kar Medical college -এ দেওয়া হচ্ছে। ভিসা রাজা দা করে দিয়েছেন।কেনিয়া আসতে গেলে গ্লোবাল হেভেন পোর্টালে গিয়ে কোভিড ডিক্লেয়ারেশন দিতে হয়, কেনিয়া গভর্নমেন্টের সাইটে গিয়ে হেলথ ডিক্লেয়ারেশন দিতে হয় আর ফেরার জন্য ভারতীয় গভর্নমেন্টের এয়ার সুবিধা ফিল-আপ করতে হয়।এগুলো আমাদের রাখি দি করে দিয়েছেন বলে আমাদের ঝক্কি নিতে হয় নি।কোভিড সার্টিফিকেট আর ইয়েলো ফিভার সার্টিফিকেট টা জরুরি।

আচ্ছা আরেকজনের কথা না বললেই নয় সে হল দিব্যেন্দু দা।ফিজিওথেরাপি করে  স্লিপ ডিস্কের ব্যাথা টা মোটামুটি বাগে এনে দিয়েছে। আমি তো ফাকিবাজ কিন্তু দিব্যেন্দু দা নিয়মিত সকাল বেলায় বাড়ি এসে আমাকে আমার 12কেজির ক্যামেরা ব্যাগ টাকে কাধে নেওয়ার মত কোমর শক্ত করে দিয়েছে।দেখতে দেখতে দিন উপস্থিত। টুক টুক করে এক সপ্তাহ ধরে ব্যাগটা গোছানো ছিল তাই বেশি হেডেক হয়নি এবারে।যাবার দিন সকালে ব্যাগ টা ফাইনালি গুছিয়ে নিলাম।ক্যামেরা ব্যাগ টা গোছাতেই সময় যায় বেশি।বেরতে বিকেল 4.45 হয়ে গেল।রাস্তায় যেতে যেতে ওয়েব চেক ইন টা সেরে নিলাম। রাত 8.15 তে প্লেন। এই কোভিড পরবর্তী সময়ে বিদেশ ভ্রমন বেশ ঝক্কির।এয়ারপোর্টে পৌঁছে অনেক কাজ।পাসপোর্ট, ভিসা, গ্লোবাল হেভেন, ইয়েলো ফিভার টিকার কাগজ, কোভিড সার্টিফিকেট, পোলিও সার্টিফিকেট,কেনিয়া গভর্নমেন্ট থেকে দেওয়া হেলথ ক্লিয়ারেন্স এর লিংক।নাজেহাল কান্ড।ভালোয় ভালোয় সব মিটল।আমাদের প্লেন কোলকাতা থেকে দিল্লি যাবে। সেখানে 6ঘন্টা এয়ারপোর্টে থাকা। ভোর বেলা 5.30টায় প্লেন এখান থেকে যাবে আমেদাবাদ ওখানে এক ঘন্টা দাঁড়াবে ফুয়েল ভরতে আর কিছু প্যাসেঞ্জার-ও উঠবেন। একটা বড় সুবিধা হল লাগেজ একেবারে নাইরোবি পৌঁছে যাবে।তাই দিল্লি এয়ারপোর্টে লাগেজ টানাটানির ঝামেলা টা রইল না।ঝারা হাত পা। মাথা পিছু 23কেজি নেওয়া যায়।আমাদের দুজনের 46কেজি বরাদ্দ।অনেক এয়ারলাইনস দুজনের লাগেজের টোটাল ওজন দেখে আবার অনেকে ব্যাগ হিসাবে ওজন করে। তাই ঝামেলায় না গিয়ে একটা ব্যাগে 46কেজি না করে দুটো আলাদা 23 কেজি নেওয়াই ভাল। দিল্লি পৌঁছাতে 10.30টা বাজল।আমাদের পুরটাই এয়ার ইন্ডিয়া তে। এমনিও আমরা এয়ার ইন্ডিয়া তে যেতে পছন্দ করি খাবার টা ভাল দেয়।এখন টাটা নেবার পর এয়ার ইন্ডিয়াতে আমাদের প্রথম যাত্রা, খাবার বেশ ভাল।নন ভেজ এ বিরিয়ানির টেস্ট আউধ কে টেক্কা দেবে।

11.45 --এ প্লেন নামলো নাইরোবি।  নির্ধারিত  সময়ের প্রায় 40 মিনিট আগেই।এয়ারপোর্টে 100 ডলার ভাঙ্গিয়ে 11600 কেনিয়ান সিলিং নিয়ে নিলাম।ওদের দেড় টাকা আমাদের এক টাকার সমান।মানে কোন জিনিষের দাম 150 সিলিং হলে আমাদের টাকায় তার দাম 100 টাকা।ইমিগ্রেশন চেক করে বেরতে 1 টা বাজল,যা ভেবেছিলাম তার থেকে অনেক তাড়াতাড়ি কাজ হয়ে গেল। এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়েই সিমটা নিয়ে নিলাম।বিদেশ বিভূঁইয়ে ইন্টারনেট খুব জরুরি।সিম নিল 12 ডলার।তাতে 7 দিনের জন্য  5জিবি ডাটা থাকবে।আমরা 2টায় এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে পরলাম। আমাদের ড্রাইভার কাম গাইড মাইকেল।আমাদের রিসিভ করতে এসেছিলেন মার্সি।অনেক ট্যুরিস্ট এলে রাজা দা আর রাখি দি সাথে আসেন।কম জন এলে কেনিয়ায় ওনাদের হয়ে মার্সি সব দায়িত্ব পালন করেন। গাড়িটা 9 সিটার,আমাদের জন্য একদম আরামদায়ক।এখানে মেনলি দেখলাম টয়োটা আর নিসান এর গাড়ি চলে। তবে মহিন্দ্রা, বাটা-র মত ইন্ডিয়ান কোম্পানি এখানে ভাল বিজনেস করে। ভারতীয়রাই নাকি তাদের বিজনেস সিখিয়েছে।জানলা খুলতেই একরাশ তাজা ঠান্ডা হাওয়া মুখে এসে লাগল।রাস্তার চারদিকে সবুজ।একটু এগোতেই রাস্তার ধারে ঘাস খাচ্ছে এক দল জেব্রা আর গ্যাজেল। রাস্তার ধারে মাঝেমাঝেই বাস স্টপ আসছে।সেখানে একটু ভিড়। এখন এখানে ইলেকশন চলছে তাই রেসাল্ট বেরলে ঝামেলা হবার চান্স আছে বলে রাস্তায় গাড়ি কম আর ট্যুরিস্ট-ও কম।যাতে কোন ঝামেলায় না পড়তে হয় আমরাও শহরের ভেতরে না ঢুকে বাইপাস ধরে বাইরে দিয়ে যাচ্ছি।একদিকে সুবিধাই হল, তাড়াতাড়ি সব জায়গায় পৌঁছানো-ও যাবে আবার বেশি ভীড়-ও কোথাও পেতে হবে না।এখানে এখন শীতকাল।রাস্তার দু ধারে যতদূর চোখ যায় সবুজ আর সবুজ।চারদিকে ঘিরে আছে নীলাভ পাহাড়।রাস্তাতেই কিছু ভলক্যানো পরল।এখানে এখনো এক্টিভ ভলক্যানো আছে।রাস্তার দু ধারে ছোট বড় বাড়ি।তবে বাড়ির তলাগুলো একটু নীচু।রাস্তার দুধারে বাচ্চারা খেলা করছে।বেলা গড়াচ্ছে।তিনটে বাজল।প্লেনে অনেক খাইয়েছে তাই খিদে বেশি পায়নি। রাস্তায় যেতে যেতে সাথে নিয়ে আসা কিছু ড্রাই ফুড খেয়ে নিলাম।এয়ারপোর্ট থেকে সরাসরি চলে আসলাম লেক এলিমেন্টেইটাতে। এয়ারপোর্ট থেকে রাস্তা প্রায় 150কিমি।সময় লাগল প্রায় 4ঘন্টা। মাঝে একটা জায়গায় আমরা দাঁড়িয়ে কফি খেলাম।বেশ মনোরম ওয়েদার।15 ডিগ্রি মত তাপমাত্রা। বাইরে বেশ হাওয়া।গাড়ির কাচ তোলা থাকলে কিছু সেরকম ঠান্ডা মনে হচ্ছে না। মোবাইলে টাইম জোনটা নাইরোবি কেনিয়া করে নিয়েছি। আমাদের থেকে এরা 2.30ঘন্টা পেছনে।এদের 5pm মানে ভারতে 7.30pmহোটেলে ওয়াইফাই আছে তাই অসুবিধা নেই।বাড়িতে হোয়াটসঅ্যাপ করে জানিয়ে দিলাম। দুই বাড়ির বাবা মাই বয়স্ক,বাইরে গেলে ওটাই টেনশন হয়। এখানে বেশির ভাগ মানুষ কৃষিজিবী।টমেটো, ভুট্টা, পালংশাক, আলু এগুলো বেশি চাষ করে। আমাদের দেশ ক্রিকেটে বেশ কবার এদের কাছে হেরে মরলেও এদের একদমি ক্রিকেট নিয়ে ইন্টারেস্ট দেখলাম না। 5টায় পৌঁছে গেলাম আমরা। লেক এলিমেন্টেইটা। এখানে আমাদের ঠিকানা সেন্টিরিম রেসর্ট।পুরো লেক এর পার জুড়ে বিশাল এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে রেসর্টের 84 টা ঘর।মাঝে মাঝে ডাইনিং হল,সুইমিংপুল, বার, বাচ্চাদের পার্ক, বসার জায়গা।রেসর্ট বেশ ভালোই ভর্তি কিন্তু জায়গা এতই বড় যে ফাকা ফাকাই লাগছে। আমাদের টোটাল 3টে রুম। দুটো এক তলায় আর একটা দোতলায়। সব রুম এর বারান্দা থেকেই দেখা যাচ্ছে লেক এলিমেন্টেইটা আর তাতে চরে বেরাচ্ছে এক দল পেলিক্যান।মাঝে মাঝে মাথার ওপর দিয়ে উরে যাচ্ছে ফ্লেমিংগো।ঘরে ঢোকার কথা মনেই নেই।মনের সুখে পেলিকান গুলোর ছবি তুলতে সন্ধে নেমে এল।প্রায় 7টা বাজে। ঘরে ঢুকে এক কাপ কফিতে চুমুক দিতেই প্রত্যয় এসে জানাল ডিনার শুরু হয়ে গেছে। ডিনার টাইম 7pm-8.30pm. খিদে খিদে পাচ্ছিলো তাই আর দেরি না করে চলে এলাম ডাইনিং হল এ।বুফে তে মেনু বিভিন্ন স্যুপ, স্যালাড,চিকেন,রুটি,ভাত,বিফ,পর্ক,ফল, প্যাস্ট্রি। এমনি আমি চিকেন মাটন ছাড়া কিছু খাইনা জেনেশুনে। কলেজ লাইফে বিকাশ আর তার পরে চাকরি লাইফে সত্যর পাল্লায় পরে এদিক সেদিক খেলেও মন থেকে সায় বিশেষ ছিল না।কিন্তু এখন পরিস্থিতি আলাদা। এখন আমি বিভূতিভূষণের শঙ্কর এর উত্তরসূরি।যে কিনা শকুন হায়না বেবুন সব কিছুই খেয়েছে জীবন রক্ষার  তাগিদে। সেখানে ওমন রোস্ট করা হানি পর্ক না খেলে মুখ দেখানো যাবে না।এরপর এমনিও উট পাখির ডিম,জেব্রার মাংস কিনা কি খেতে হবে তাই একটু পেট টাকে অভ্যস্ত করে নেওয়া। ঘরে ফিরে একটু ক্যামেরা গোপ্রো গুলো ঠিকঠাক আছে কিনা ল্যাপটপে ফেলে দেখে নিলাম।ক্যামেরাটে স্টিল ছবি তোলা আমার দায়িত্ব আর গোপ্রোতে ভিডিও করা পিয়াঞ্জনার দায়িত্ব। তারপর রেডি হয়ে শুতে 11টা বেজেই গেল।হোটেলের ওয়াই ফাই তে কিছু রুগির রিপোর্টের উত্তর দেওয়াও হয়ে গেল।

আজ দ্বিতীয় দিন

Day 2

আজকে গন্তব্য নাকুরু লেক ঘিরে থাকা নাকুরু ন্যাশনাল পার্ক।

আমাদের হোটেল থেকে পৌঁছাতে লাগল 45মিনিট।গাড়িতে ওঠার মুখেই মাইকেল পাসপোর্টের কথা মনে করিয়ে দিয়েছিল ভাগ্যিস আমরা নিতে ভুলে গেছিলাম।নাকুরু তে ঢুকতে পাসপোর্ট লাগবে।আমরা ভেবেছিলাম নাকুরু তে শুধুই একটা লেক আছে তাই ওখানে কিছুক্ষন কাটিয়ে আমরা বগোরিয়া যাব ফ্লেমিংগো দেখতে। কিন্তু এখনো ফ্লেমিংগো গুলো নাকুরু তেই আছে অন্ন বছর এতক্ষনে চলে যায় তাই আমাদের র বগোরিয়া যাবার দরকার নেই।হাতে অনেক সময় আগে হোটেল ফিরেও করার কিছু নেই।তাই আমরা ঠিক করলাম প্যাকড লাঞ্চ নিয়েই বেরোবো, যততা সময় নাকুরু তে থাকা যায় থাকব, ধীরে সুস্থে ঘুরব ভালো করে ছবি তুলব। আমাদের ডিশিসন একদম ঠিক ছিল।পুরোটা ঘুরে দেখতে সকাল 8টা থেকে বিকেল 4টে বেজে গেল।

লাখ লাখ ফ্লেমিংগো।গ্রেটার ফ্লেমিংগো একটু গোলাপি হয় আর স্মল ফ্লেমিংগো সাদা হয়।গোটা নাকুরু লেকের নীল জলে গোলাপি রেখা চলে গেছে।এখানে স্পেশাল হল হোয়াইট রাইনো। গোটা পৃথিবীতে একমাত্র এখানেই এটা পাওয়া যায়।যদিও এ বিগ ফাইভ-এ জায়গা পাইনি তবুও এর বিশ্ব জোড়া কদর। অনেক রাইনো তাদের বাচ্চা নিয়ে মনের সুখে শান্তিতে ঘুরে বেরাচ্ছে। একটা জিরাফ হাটু ভাজ করে জল খেল।লম্বা হবার কি জ্বালা। এতটা কোমর নিচু করে জল খাওয়া। ওর দুঃখ আমার থেকে ভাল আর কে বুঝবে।এখানে ওই একটা দুটো পশু দেখা যায় না।সব পাল পাল। ইম্পালা,যেব্রা,অলিভ বেবুন,ওয়াটার বাক, আফ্রিকান বাফেলো,জলহস্তী,ঈগল দেখলাম। একটা সেক্রেটারি বার্ড দেখলাম বেশ বিগ্গ বিগ্গ হাটা। দুপুরে একটা জায়গায় আমরা লাঞ্চ করতে দাড়ালাম।এখানে জঙ্গলে খাবার সময় নামা যায়। টয়লেট-ও আছে।মাসাইমারা তে কিন্তু টয়লেট নেই ভেতরে তাই প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে ঝোপেঝাড়ে যেতে হবে।এখানে অদ্ভুত রকম সাদা কালো লোমওলা হনুমান দেখলাম।এর নাম হলোবাস। খেয়ে আবার গাড়িতে উঠে পরলাম আমরা।এবারে একটা অস্ট্রিচ এর দেখা।ছেলে অস্ট্রিচ কালো হয়, মেয়েরা ধুসর রং-এর হয়।মেয়েরা আকারে বড় হয়।আর পুরুষরা ডিম দেয়।এরাই সব থেকে বড় পাখি।এরা কিন্তু উড়তে পারে। সারাদিনে ইজিপশিয়ান গুস, হাডেডা আইবিস, ব্ল্যাক হেডেড হেরন, মারাবৌ স্টর্ক, সাউথার্ন গ্রাউন্ড হর্নবিল,আফ্রিকান স্পুনবিল দেখলাম। চারদিকে ছোট বড় হাজার হাজার পাখি উড়ে বেরাচ্ছে। পৌনে পাঁচটা নাগাদ হোটেল ফিরে এলাম।এখানে বিদেশি দের খুব ভীড়।ভারতীয় চোখে পরল না বিশেষ। সূর্য ডুবুডুবু।চারদিকে স্টারলিং, ডাভ, আইবিশ,লাভ বার্ড ঘুরে বেরাচ্ছে।একটা লাভ বার্ড আমাদের ঘরের ছাদে একা বসে লেকের দিকে তাকিয়ে রয়েছে।হয়ত সন্ধ্যের নির্জনতায় ওর-ও কারো জন্য আজকে মন খারাও। আমার ম্যাডামের ইন্সটার জন্যা একটা ফোটোশেসন করলাম, এটা এতদূর টেনে নিয়ে আসার ঘুষ।সময় কিকরে যেন এগিয়ে যাচ্ছে মুহুর্তে। পড়ন্ত সূর্যের রক্তিম আভা মেখে অপরুপ এলিমেন্টেইটা। অন্ধকার নেমে এল।ঘরে ঢুকে প্রথম কাজ ক্যামেরার ব্যটারি চার্জ করা। তাড়াতাড়ি ডিনার করে নিলাম। আজকে ভেজ খেলাম।এদের চিকেন গুলোর টেস্ট ঠিক আমাদের মত নয়।

ঘরে এসে প্রতি দিনের ছবি ল্যাপটপ আর এক্সটার্নাল হার্ডডিস্ক-এ ট্রান্সফার করে নি। ছবি গুলোই তো সম্পদ।

এইসব করতে বেশ কিছু টাইম কাটল। 10টা নাগাদ শুয়ে পড়লাম।লেপ মুড়ি দিতেই কখন ঘুমিয়ে পরেছি খেয়াল নেই।

আজ তৃতীয় দিন।

রাতে এখানে ঘুমটা বড় ভালো হয়।তাড়াতাড়ি শোওয়া হয় তাই সকালে ঘুম তাড়াতাড়ি ভেঙ্গে যায়।ফ্রেশ লাগে।সকালে 6.15তে উঠে পড়লাম।দাঁত মেজে আগে ব্রেকফাস্ট করতে চলে গেলাম। ঘরে তাপমাত্রা খুব কমফর্টবল হলেও বাইরে বেরলে ভিষণ হাওয়া।লোভে পরে আজ আর সকালে নন ভেজ খাইনি।পাউরুটি জুস অমলেট কেক খেয়ে ঘরে ফিরে আমরা রেডী হয়ে নিলাম 8টার ভেতর। কিন্তু বেরতে গিয়ে বিপদ  গাড়ি খারাপ হয়ে গেছে। মেকানিক এলো পরিক্ষা নিরিক্ষার পর বোঝা গেল চার্জার খারাপ হয়েছে।আমাদের আজকে নাইভাসাতে এক ঘন্টা বোট রাইড ছাড়া বিশেষ কোন কাজ নেই।বরং এলিমেন্টেইটাতে আরো বেশ কিছুক্ষণ কাটাতে পেরে ভালোই লাগল।এখানে লোকজন বড় ভাল।ঘুরে বেরিয়ে এক কাপ কফি খেলাম।চারদিকে লাভ বার্ড আর স্টারলিং ঘুরে বেরাচ্ছে। এদের কে হোটেল থেকে অনেক খাওয়ানো হয় আর বেশ তাদের দুষ্টুমিকে লায় দেওয়া হয় বোঝা গেল।আমাদের কে কোন পাত্তাই দিচ্ছেনা কেউ। বিলিয়ার্ড বোর্ডে একটু ফোটোশেসন সেরে নিলাম। দেখতে দেখতে 11টা বেজে গেল।মাইকেল গাড়ি নিয়ে রেডি।জীবনের দুটো দিন এখানে কাটল।জানিনা বেচে থাকতে এখানে আর কখন আসা হবে কিনা। আবার নতুন কোন রাস্তা নতুন কোন জায়গা নতুন মানুষ।

এক ঘন্টায় লেক নাইভাসা পৌঁছে গেলাম।ভারি সুন্দর নীল জল টলমল করছে। লাইফ জ্যাকেট পরে বোটে চেপে পড়লাম আমরা।লেকের জলে জলহস্তী কিলবিল করছে।প্রায় 2000জলহস্তী আছে এখানে।সব জলে ডুবে বসে আছে। শুধু নাকটা বাইরে।ওরা ভোরবেলা ঘাস খেতে ডাঙ্গায় ওঠে।এদের স্কিন খুব নরম হওয়ায় সূর্যের তাপ সহ্য করতে পারেনা তাই রোদ উঠলে জলে ডুবে বিশ্রাম করে। লেক টা ভারি সুন্দর। মাঝে মাঝে কিছু গাছ দাঁড়িয়ে। পচুর ফিস ঈগল, পানকৌড়ি,পেলিক্যান,ফ্লেমিংগো-ও আছে এখানে। 2 টো নাগাদ লাঞ্চ সেরে আমরা বেরিয়ে পড়লাম।গন্তব্য মাসাইমারা।মাসাইমারার ঢোকার মেন গেট বিকেল 5টায় বন্ধ হয়ে যায়।আমাদের বেরতে দেরি হয়ে যাওয়ায় মাসাই ঢোকার প্রায় 70কিমি আগে থেকেই মেন রোড থেকে সরে আমাদের বাইপাস রাস্তা ধরতে হল।সেই রাস্তার অবস্থা বেশ খারাপ।কিন্তু জঙ্গলের ভেতর দিয়ে রাস্তা। একটা তিনজনের জিরাফ ফ্যামিলি কে দেখা গেল। তার এক হাত দুরেই গ্রাম।সেখানে আবার অনেক গোরু ছাগল চরছে।মানুষ আর পশুর সহবস্থান।রাস্তাতেই সূর্য ডুবে অন্ধকার নেমে এল।রাস্তায় গাড়ি লাফাচ্ছে।চারদিকে অন্ধকার।বেশ গা ছমছম করছে।প্রায় 7টা নাগাদ আমরা হোটেলে পৌঁছলাম।লা ম্যাসন রয়াল। এটা মাসাই জঙ্গল থেকে 7কিমি দূরে সেকিনিনি জঙ্গলের ভেতরে। বিশাল এলাকা জুড়ে 24টা টেন্ট।পাহাড়ের কোলে এক ধাপ নেমে আমাদের টেন্ট।রাজকীয় ব্যবস্থা।ঘরের বারান্দার সামনে মাসাইমারার জঙ্গল।এখানে কোন ফেন্সিং নেই।জীব জন্তু মাঝে সাজেই আসে।তাই টেন্টের বাইরে মাসাই রা সারা রাত পাহারা দেয়। এক পাও মাসাই দেহরক্ষী ছাড়া যাওয়া বারন। টেন্টের কিছুদূরেই হায়নার ডাক শোনা যাচ্ছে। কালকেই হোটেলের বা দিকের জঙ্গলে সিংহ শিকার করেছে। এখানে ইলেকট্রিক নেই। বিকেল 6.30pm থেকে 10.30pm জেনারেটর চলত। তার মধ্যেই সব চার্জ করে নিতে হত। আর গরম জল পাওয়া যেত বিকেল 5pm থেকে7pmআমরা তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়লাম। এখানে নেট ভালো কাজ করে না। বাইরে খুব হাওয়া দিচ্ছে তাতে টেন্টের ছাদে বেশ আওয়ায।তবে ঘরের ভেতর আরামদায়ক খুবি।কাল কপালে কি আছে। জঙ্গল খুব আনপ্রেডিক্টেবল। লাক খুব জরুরি।এইসব ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পরেছি।

চতুর্থ দিন

আজকে সকালে 6.30টায় বেরলাম। 7টায় মাসাইমারার মেন গেটে ঢুকলাম।এখানে  টোটাল 8টা গেট। জঙ্গলে ঢুকতে না ঢুকতেই চিতা।দুই চিতা একটা ওয়াইল্ড বীস্টকে শিকার করে খাচ্ছে। একদম ওপেন গ্রাস ল্যান্ডের ওপর।চারদিকে ল্যান্ড ক্রুজার ঘিরে দাড়িয়ে।তবে খুব বেশি নয়।আমাদের আজ আর কালকের ড্রাইভার কাম গাইড পীটার।ওর ভয় ডর নেই। আমাদের গাড়ি চিতাগুলোর 10 ফুটের ভেতর দাড় করিয়ে দিল।লাইভ ডিসকভারি চ্যানেল দেখছি। এ অভিজ্ঞতা এক জীবনে বেশি বার মানুষ পায়না। আমরা লাকি।চিতার সংখ্যা তুলনামূলক কম এখানে।চিতা খুব জোরে দৌড়াতে পারলেও বেশিক্ষন পারেনা তাই শিকার ধরার সাকশেস রেট ভালো না। ওয়াইল্ড বীস্ট টার আজ কপাল খারাপ।বেঘোরে প্রান টা গেলো।কিন্তু জঙ্গলে খাবারের প্র‍য়োজন ছাড়া কেউ কাউকে আক্রমণ করে না৷মানুষের থেকে তো ঢের ভালো এরা। বেশ কিছুক্ষণ ছবি তুলে আমরা এগোলাম। এরপর এগোতেই এক সিংহী।সেও এক ওয়াইল্ড বীস্ট শিকার করে খাচ্ছে।কিন্তু আমরা যখন পৌঁছেছি পেট তার ভর্তি। কিন্তু খাবার টা পাহারা দিয়ে আগলে রেখেছে।একটু পর আর এক সিংহি এলো।দুই বোন হবে হয়ত,দুই বৌ-এর তো এত ভাব হবে না।একটা সিংহের অনেক বৌ থাকে।কিন্তু প্রধান সিংহী হতে অনেক পরীক্ষা দিতে হয়।খাবারটা ছেড়ে একটু এগিয়ে ওরা বিশ্রাম করতেই একদল শকুন এসে হাজির।তাই দেখে দুই সিংহী আবার এসে তাদের তাড়ালো।পীটার এবার এগোল অন্য কিছু খোজার জন্য। বিভিন্ন রকম এন্টিলোপ - ইম্পালা,টোপি,থম্পসন গেজেল, ইলান্ড দেখলাম। হরিণ আর গোরুর মাঝামাঝি প্রজাতি হল এই এন্টিলোপ।আজকে অনেক লাইলাক ব্রেস্টেড রোলার দেখলাম যা এখানকার জাতীয় পাখি।আমাদের নীলকন্ঠের জাত ভাই।জেব্রা, জিরাফ, ওয়াইল্ড বীস্ট, ওয়ার্থগ, সেক্রেটারি বার্ড, দেখলাম। এরপর এক লেপার্ড দেখলাম গাছের তলায় বিশ্রাম করছে। এ হল লুলুকার মেয়ে,এর নাম জিলিমি। লেপার্ড খুব লাজুক তাই চট করে দেখা পাওয়া যায় না। দিনের বেলায় দেখা পেলেও সাধারণত কোন গাছের তলায় বিশ্রামরত অবস্থায় দেখা যায়। এরপর আমরা দেখলাম ক্রাউন্ড ক্রেন।এটা মোবাইল স্ক্রিনে মাঝে মাঝেই আসে। 4টে নাগাদ আমরা জঙ্গলের থেকে বেরোনো শুরু করলাম। হোটেল পৌছাতে 5টা বাজল।

পঞ্চম দিন

সকালে  4টেয় উঠলাম।আজকে পূর্ণিমা, চাদের আলোয় মাসাইমারার জঙ্গল আলোকিত।বন্যপ্রাণ ঘুমিয়ে আছে।অপরুপ সৌন্দর্য। অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি। কিভাবে কিছুক্ষণ কেটে গেল।তাড়াতাড়ি করে মোবাইল, ক্যামেরা গুলো একবার চেক করে নিয়ে রেডি হয়ে নিলাম।5.15তে বেরিয়ে পড়লাম। আজকেই আমাদের সফারির শেষ দিন মনটা খারাপ লাগছে। দিনটা শুরু হল এক সিংহ কে দিয়ে। সূর্যোদয়ের লালচে আভায় ঘাসের ওপর দিয়ে হেটে যাচ্ছে আফ্রিকার সিংহ। বিভূতিভুষনের শঙ্করের বর্ননায় কল্পনার সেই হিংস্র


আফ্রিকার সিংহ। এখানে সব পশুই সাফারি ভ্যান গুলোর সাথে অভ্যস্ত। আর এখানে আসা ট্যুরিস্ট-ও আমাদের মত জঙ্গলে পাঞ্জাবি গান চালিয়ে মদ খাওয়া টাইপ নয়। এখানে পশুরা জানে এই জন্তুগুলো তাদের ক্ষতি করবে না।তাই একদম পাশ দিয়েই তারা হেটে চলে যায়। এরপর এগিয়ে যেতেই একটা নালার পাশে একটা লেপার্ড। এর নাম লুলুকা। এ খুব ফেমাস কারণ এ খুব মানুষের সাথে ফ্রেন্ডলি।কাল এর মেয়ে জিলিমিকেই আমরা দেখেছিলাম।আরেকটু এগোতেই হায়না দেখলাম।হায়নার ঘ্রাণ শক্তি খুব শক্তিশালী। নিজেরা শিকার করতে পারেনা কিন্তু আমিষ খাবার ছাড়া চলে না বাবুদের।তাই চিতা সিংহের ফেলে দেওয়া খাবার ভরসা।বড্ড বাজে দেখতে।তাদের পেছনে যথারিতি লাইন দিয়েছে শকুন আর শিয়াল। দুটো চিতা বেশ কিছুক্ষণ ধরে শিকার করবে কি করবে না দোলাচলে আমাদের বেকুব করলো।ইম্পালা
,ওয়াইল্ড বীস্ট,থম্পসন গ্যাজেল, টোপি,ইলান,সেক্রেটারি বার্ড, জেব্রা,জিরাফ,অস্ট্রিচ, হাতি, বেবুন এসব আমরা এখন আর পাত্তাই দিচ্ছি না।

কিন্তু আজকে একটাই মন খারাপ যে মাইগ্রেশন দেখা হল না।কারণ আজকে অনেক জেব্রা আর ওয়াইল্ড বীস্ট তাঞ্জানিয়ার দিকে জড়ো হলেও নদীতে অনেক কুমির আছে বলে পার হল না। হাজার হাজার জলহস্তী মারা নদীতে। তিনটে জেব্রা পারে এসে জলে নামল একজন পার হয়ে গেল।পরের জন পার হতেই অপেক্ষারত কুমির টা আক্রমণ করল কিন্তু জেব্রাটা পেরিয়ে চলে এল।তিন নাম্বার জেব্রাটা সম্ভবত এদের বাচ্চা।সে আর কুমির দেখে জলে না নেমে পিছিয়ে গেল। এদিকে বাবা মা জেব্রা কেনিয়া তে  ওদিকে বাচ্চা তাঞ্জানিয়া তে।বাচ্চা টা বেশ জোরে ডাকছে। মনে হয় কাদছে।পেছন থেকে আরো কয়েকটা জেব্রা এগিয়ে এসে তাকে জটলা করে স্বান্তনা আর পরামর্শ দিতে এগিয়ে এল। আজকে আর রিভার ক্রস কেউ করবে না।ওয়াইল্ড বীস্ট গুলোর কোন তাগিদ-ই দেখা গেল না।তাই পিটার বলল তাহলে আমরা এগোই কারণ ফিরতে বেশ সময় লাগবে। সন্ধে 6টার মধ্যে গেট-এ পৌঁছাতে হয়।রাস্তায় যদি আরো কিছু পাওয়া যায় লাক ট্রাই করা।

ষষ্ঠ দিন

আজ ষষ্ঠ দিন।

সকালে 6টায় উঠলাম।রাতে ভালোই ঘুম হয়েছে।এখন হাওয়ায়  টেন্টের শব্দ,হায়নার ডাক এসব গা সওয়া হয়ে গেছে। বারান্দায় একটা সিংহ আসতেই পারে।বাইরে এন্থনি পাহাড়া দেয় সারা রাত।এখানে এটাই নিয়ম টেন্টের বাইরে ইলেকট্রিক ফেন্সিং নেই তাই মাসাই রা এখানে পাহাড়া দেয় সারা রাত।টেন্ট থেকে খাবার জায়গা বা অন্য টেন্ট বা সুইমিং পুল যেতে হলে সবসময় মাসাই রা সঙ্গে যায়।

ঘুম থেকে উঠে বারান্দায় বসে,সামনে নিস্তব্ধ মাসাইমারার জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে তার মোহময়ী রুপ দেখে হতবাক হয়ে গেলাম।আমাদের হলং অন্ত্যন্ত রোমান্টিক লাগে কিন্তু মাসাইমারার জঙ্গলের মাদকতাই আলাদা। সাধারণত এক জায়গায় দ্বিতীয় বার যাইনা,কিন্তু মাসাই তে  আবার আসতে হবে। ফ্রেশ হয়ে ব্রেকফাস্ট করে ঘরে এসে ব্যাগ গুছিয়ে নিলাম। একগাদা মন খারাপ সাথে নিয়ে মাসাইমারা পেছনে ফিরে আমরা এগিয়ে গেলাম নাইরোবির দিকে।পথে আমরা নামলাম মাসাই ভিলেজ।মন ছূয়ে যাওয়া অভিজ্ঞতা। মাসাই রা আজো সেই প্রাচীন আদবকায়দা মেনেই বেচে আছে।এই গ্রামে 120জন সদস্য।একজন মাসাই বিয়ে করতে চাইলে তাকে সিংহ মারতে হবে আর ফেমাস হতে গেলে বাফেলো মারতে হবে।তবে এখন আর তারা জন্তু মারে না।কারন জন্তুদের জন্যই তাদের দেশে অনেক ট্যুরিস্ট আসে তাই তাদের সম্মান দিতেই এই সিদ্ধান্ত।তারা সূর্য কে পূজা করে।আলাদা দেবতা কেউ নেই।সকালে উঠে পুরুষ রা গোরুর রক্ত খায়।বয়স্ক রা নিরামিষাশী খাবার খায়।এরস টাকা পয়সা লেন দেন করে না।যার যত বেশি গরু সে তত বড়লোক। একজন পুরুষ অনেক বার বিয়ে করতে পারে।এখানে এরেঞ্জ ম্যারেজ হয়,লাভ ম্যারেজ হয় না।প্রথম বৌ ঠিক করে দেয় বাবা মা।তারপরের বৌ ঠিক করে প্রথম বৌ। 10 টা গোরু যৌতুক দিলে একটা বৌ পাওয়া যাবে।আর প্রতিটা বৌ-এর জন্য আলাদা বাড়ি করতে হবে।আর বউ হতে হবে অন্য গ্রামের।আপনার পাপী বাঙালি মনে এটা শুনে যে চিন্তাগুলো আসছে ওগুলো মনেই রাখুন।গ্রামের প্রধান যেকোন রং-এর পোশাক পড়তে পারেন কিন্তু বাকিরা লাল রং-এর পোশাক পরে কারণ লাল রং দেখলে জন্তুরা ভয় পায়।মাসাই পুরুষরা মাইগ্রেট করে কিন্তু মহিলারা গ্রামের বাইরে যায় না।একটা জায়গায় গোল করে মাটির বাড়ি গুলো থাকে মাঝের গোল জায়গায় গোরু গুলো থাকে। বাছুরদের জন্য আলাদা ঘর থাকে।মাসাই রা কেনিয়া, তাঞ্জানিয়া আর সুদানে ছড়িয়ে রয়েছে।এদের মধ্যে যে যত উঁচু  লাফাতে পারে তার দাম তত বেশি। তাদের নাচ দেখাল তারা, তাদের নিজস্ব বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে।তাদের কাছে তাদের হাতে তৈরি কাঠের জিনিষ পাওয়া যায় আমরা সেসব কিনলাম।একটু দরদাম করতে হয়।আমরা যা নিয়েছিলাম তার জন্য ওরা চেয়েছিল 25000 সিলিংস কিন্তু শেখ অবদি 12000 সিলিংস-এই দিয়ে দিল।আরো কমেই হয়ত পাওয়া যেত কিন্তু শহরের দোকানের থেকে এমনিই অনেক কম দাম হয়েছে বলে আমরা আর দরদাম করলাম না।এছাড়া আমরা বাচ্চাদের লজেন্স, খাবার, কিছু জামা কাপড় নিয়ে গেছিলাম সেগুলো দিলাম আমরা। এখন বয়স বেরে গেছে আনন্দর অনুভূতি টাই কমে গেছে।বাচ্চা গুলোর মুখের আনন্দ দেখে মনটা বড় ভালো লাগল।এখন মাসাই বাচ্চারা স্কুলে যায়, যারা পড়াশোনায় ভালো তারা মাসাইমারা ইউনিভার্সিটিতে যায়।11.15 বাজল ঘড়িতে।

মাসাই ভিলেজের ভেতরে এত ভালো লাগছিলো কিন্ত সব কিছু সময় দিয়ে বাধা।তাই আমরা আবার গাড়িতে উঠলাম।মাসাই ভিলেজে এসেছি আমরা পিটার এর সাথে।নাইরোবি ফেরার কথা ছিল মাইকেলের সাথে, কিন্তু গাড়িটা গন্ডগোল করায় নতুন একটা গাড়িতে আমরা ফিরব।আজকে আমাদের চালক কেলভিন। এখানের সব মানুষ এত ভালো এখানে আবার আসবই।ইউরোপ আমেরিকার মানুষের থেকে আফ্রিকার মানুষের আন্তরিকতা অনেক মন ছুয়ে যায়।আমার তো এমনিও আফ্রিকার সাথে নারির টান আছে। 12.30টা নাগাদ আমরা একটা কফিশপে দাড়ালাম।লাঞ্চ আমাদের সাথেই আছে। একটু কফি নিয়ে নিলাম আমরা।এখানে কিছু কয়েন নিলাম।সব ব্যাপারেই এরা এত কো-অপারেটিভ, মুখ থেকে কথা বেরনোর অপেক্ষা। একটা বাচ্চা মেয়ের পিয়াঞ্জনার কানের দুল টা খুব পছন্দ হয়েছিল তাই ও ওকে ওটা দিয়ে এল।পাওয়াতে যা আনন্দ, দেওয়া তে আনন্দ অনেক বেশি। এই ভালোবাসার মুহুর্ত গুলো জমা করেই তো বাচা।কত দেশ কত মানুষ কত ভাষা কত স্বপ্ন কত চাওয়া -পাওয়া।এরা স্কুলে দুটো ভাষা শেখে সহেলি আর ইংলিশ।

লাঞ্চ সেরে গাড়ি এগোতে থাকল।একদম নাক বরাবর সোজা রাস্তা।আসারদিন দেরি হয়ে যাওয়ায় মাসাইমারার মেন গেট বিকেল 5টায় বন্ধ হয়ে গেছিল।তাই প্রায় 70কিমি আমাদের বাইপাস রাস্তা ধরে আসতে হয় যেটার অবস্থা ভালো নয়।আজকে সেসব ঝামেলা নেই।গোটা রাস্তা জুরেই পাহাড় জঙ্গল ফুল পাখি পশু। 4টেয় আমরা নাইরোবি পৌঁছে গেলাম।হোটেল লা ম্যসন রয়াল ( সাউথ সি)।খুবি সুন্দর হোটেল আর খুব ভালো এখানকার লোকের ব্যাবহার।হাতে বেশ কিছুটা সময় আছে আর নিজে একটু শহর টা ঘুরে দেখার একটা মজা আছে।এখানে উবের চলে।আজকে শনিবার,উইকেন্ড বলে বেশিরভাগ দোকান দুপুর দুটোয় বন্ধ হয়ে গেছে। সামনে একটা শপিং মল-এ গেলাম উবের করে, এখানে জামা কাপড়ের দাম একটু স্বস্তা কিন্তু সাইজ আমাদের ডবল।এখানে হাকুনা মাতাত ফ্লেভারের আইস ক্রিম খেলাম।একটু ঘুরে আবার উবের করে হোটেল ফিরে এলাম। ব্যাগ পত্র গুছিয়ে রাখলাম কিছুটা। 8টায় ডিনার করে নিলাম। ফ্রায়েড রাইস, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই,উগালি, ফিস,স্যালাড,ফল খেয়ে নিলাম।এখানে বিফ পর্ক থাকলেও রান্না গুলো ঠিক জুতের না আর বেশি পায়তারা কষে লাভ-ও নেই। ঘরে ফিরে আজকে হোটেলের ওয়াই ফাই দিয়ে জমে থাকা ম্যাসেজ গুলোর যততা সম্ভব উত্তর দিলাম।ছবিগুলো ভালো করে ল্যাপটপে কপি করে নিলাম। একটু লেখালিখি করে নিলাম।

কাল সকালে তাড়া নেই তাই একটু বন্ধুবান্ধব দের সাথে গল্প করে  11টা নাগাদ শুয়ে পড়লাম।কাল একরাশ স্মৃতি নিয়ে নিজের বালিশ বিছানার কাছে ফিরে যাবার পালা।

 ...(সমাপ্ত)...

No comments:

Post a Comment