ছবি : ইন্টারনেট |
কবির জীবন
প্রদীপকুমার সামন্ত
কতই বা বয়স হবে ? দশ কি এগারো ।ক্লাস ফাইভ সিক্সে পড়ে । পড়ার প্রতি
অফুরন্ত টান । এই বয়সে তোতা পাখির মতো ছড়া কাটে । নানান বই পড়ে । ভূত - রূপকথা -অ্যাডভেঞ্চারের
গল্প । সরল দে , অন্নদাশঙ্কর রায় ,
সুকুমার রায় , ভবানীপ্রসাদ মজুমদারের ছড়া তার প্রিয় । ক্লাসের
পড়ার সাথে সাথে অন্যান্য বই পড়তে ভালোবাসে ।
ভাবে, এইসব মহাপুরুষের কতো দাম । কতো নাম ।কতই আলোর বন্যায়
তাদের জীবন ভাসতে থাকে । কতই আতিশায্যে ভরা তাদের জীবন । ছন্দের করিগর । তার উপর সাহিত্যিক
। কি বিশাল বাড়ি । না জানি কত নামী গাড়ি । কতই না সুখের জীবন । ভাবতে ভাবতে বুকটা পুলকে
ভরে ওঠে । কল্পনার জগতে ভাসতে থাকে ।
মনটা ভাবে, বড় হয়ে সে কবি - সাহিত্যিক হবে । মজার মজার গল্প
ও ছড়া লিখবে । ছন্দসুরে জীবনটা ভরিয়ে দেবে । দেশ-বিদেশে বেড়াবে । কী মজা । কি আনন্দ
!
দাদার সাথে জেলার বইমেলায় যায় । নতুন বইয়ের
গন্ধে মনটা ভরে যায় । বই কেনার ইচ্ছা থাকলেও সামর্থ্য কম । বর্তমানে আকাশছোঁয়া বইয়ে
দাম । বই দেখে দেখে , ছুঁয়ে ছুঁয়ে মনটা
ভরে যায় । দু- একটা বই কিনে বাড়ি ফিরে আসে ।
ঝুমা, কবি অতীন সরকারের ভক্ত । কত বড় কবি - সাহিত্যিক
। এদের জীবনধারা কত উন্নত ।শয়নে, স্বপনে , নিদ্রা- জাগরনে , ছন্দে গন্ধে ভরে আছে সাহিত্য জীবন । এনারা সুরম্য
রাজপ্রাসাদে বাস করে । মনোরম সুন্দর পরিবেশ । এদের কল্পনায় ঝুমার মনটা ঝলমল করে ওঠে
।
এই বয়েসে ছেলেমেয়েরা খেলাধুলায় মেতে থাকে
। কিন্তু ঝুমা সাহিত্যঅন্ত প্রাণ । পড়তে চায় রবীন্দ্রনাথ , বঙ্কিমচন্দ্র, শরৎচন্দ্র , নীরেন্দ্রনাথ , জীবনানন্দ দাশের বই । দীপ , শঙ্খ ঘোষের কবিতা তার মন ভরে যায় । মনটা টানে কাব্যস্রোতে
। কল্পনার প্রেরণায় । আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতা আবৃত্তি করে ।
ভালো লাগে । মন ভরে যায় ।
স্কুলে পুজোর ছুটি পড়ে গেছে । দুপুরে ভাতঘুম
না দিয়ে ঝুমা একমনে অতীন সরকারের কবিতার বই পড়ছে । কি আনন্দ চোখে মুখে !
পুজো শেষ । লক্ষ্মী পুজোও শেষ । মাঝে গ্যাপ
।পরে কালীপুজো । দাদা এসে বলল--- ঝুমা , তুই তো কবি অতীন সরকারের ভক্ত । চল, আজ তোক ওনার বাড়ি নিয়ে যাবো ।
কথাটা শুনে ঝুমার মনটা আনন্দে নেচে উঠল
। কোথায় দাদা ?
চল না , ওনার বাড়ি । ভালো লাগবে ।মনটা ভরে যাবে ।সেলিব্রীটি
ওরা ।
পরদিন তাড়াতাড়ি মধ্যাহ্ন ভোজ শেষ করে দু'জনে বাইকে করে বেরিয়ে পড়ে প্রিয় কবির বাড়ির উদ্দেশ্যে
। ঘন্টা পাঁচেক বাইকে যাবার পর তারা একটি গ্রামে
প্রবেশ করে । গ্রামটিকে অজ পাড়া গাঁ বলা যেতে পারে । সবুজ বনানীতে ঘেরা । মেঠোপথ ।
প্রকৃতি যেন তার সব সৌন্দর্য্য উজাড় করে ঢেলে দিয়েছেন । অপরূপ সব ছবি । তাল-তমালের
স্নিগ্ধ ছায়া । মন্দ লাগেনি ঝুমার ।
অবশেষে তারা এসে থামলো এক জরাজীর্ণ এক বাড়ির কাছে । পুরনো আমলের বাড়ি । পলেস্তারা খসে
পড়েছে । কয়েকটি জানলা পাল্লা বিহীন । রডগুলো কংকালসার । আগাছায় ভরে গেছে কিছুটা । বালি
ঝরে পড়লেও গেটৈ লেখা আছে " সরকার নিবাস
" । ধীরে ধীরে ভিতরে প্রবেশ করে ।
একটা ছেলে এসে বলল-- আমার দাদুকে খুঁজছেন ? আমার দাদু খুব অসুস্থ । হাঁটা চলা করতে পারে না
। বাইরে বের হতে বারণ ।
তোমার দাদুকে বলো-- আমরা বজবজ থেকে এসেছি
। আমরা আপনার পরম ভক্ত ।গুনমুগ্ধ পাঠক ।
অবশেষে আমাদের বাড়ির ভিতর নিয়ে গেল । দেখলাম
-- মান্ধাতা আমলের একটা খাটে শুয়ে আছেন অশীতিপর , বর্ষীয়ান কবি । বার্ধক্য দশা । কংকালসার দেহ । আমাদের
ক্ষীণকন্ঠে -- বললেন , তোমরা এসেছো ভায়া
! নিবাস কোথায় ? ভালো আছো তো ?
আমরা শান্তভাবে সব প্রশ্নের উত্তর দিলাম
। আমাদের জন্য ক্ষীণকণ্ঠে চা করে আনতে বললেন । আমরা না বললাম । দু'জনে দাদুর পায়ে প্রণাম করলাম । মনে অনেক স্বস্তি
পেলাম । শান্তি পেলাম । নামজাদা কবির হাত, এতো পরম সৌভাগ্য । পরম পাওয়া ।
আসতে আসতে বোন ঝুমা বলল -- দাদা ,
তুই তো বললি , লেখকরা বিশাল ধনী হয় । আতিশায্যে ভরা তাদের জীবন
। বিলাসবহুল বাড়ি ও গাড়ি । হুমায়ুন কবি কবিতা লিখে দ্বীপ কিনেছেন ।
সবই ঠিক । কবিরা আত্মভোলা হয় । সৃষ্টি সুখে
মগ্ন । জীবন - সংসার সম্পর্কে সম্পূর্ণ উদাসীন । তবে সব কবিরা নয় ।
ছন্দের করিগর কবি ও সাহিত্যিকদের প্রতি শ্রদ্ধা
আরো বেড়েই গেল ।
...(সমাপ্ত)...
No comments:
Post a Comment